এসো খড়ে সুঁই খুঁজি

Custom Search

Saturday, July 21, 2018

জনস্বাস্থ্য ও অর্থনীতির বিভিন্ন বিষয়ের উপর অতিরিক্ত তাপমাত্রার প্রভাব ও করণীয়

ফেইসবুকে অনেকের স্ট্যাটাস পড়ে যা টের পেলাম যে বাঙলাদেশে এখন প্রচুর গরম, তাপমাত্রা প্রায় ৪৭-৪৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত গড়িয়েছে (অনুভূত/feels like) কয়েক সপ্তাহ আগে মন্ট্রিয়ালে- এক সপ্তাহ ধরে তীব্র তাপপ্রবাহ হয়েছিলো, ফলে শুধু মন্ট্রিয়ালেই ৩৩ জন এবং সারা ক্যুবেক প্রদেশে প্রায় ৫৬ জন মারা গিয়েছিলো। অধিকাংশ ছিলো গৃহহীন, অসুস্থ কিংবা বয়ষ্ক মানুষেরা। তাই ধারণা করছি বাঙলাদেশ অবস্থা আরো ভয়াবহ যেহেতু সহজলভ্য শীতাতপ-নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেই, বাড়িঘর অতিরিক্ত গরমের কথা চিন্তা করে নকশা করা বানানো হয় নি, এবং যেহারে লোকজন বন, গাছপালা উজাড় করছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা যে সত্যি এটাতে এখনো অবিশ্বাস করেন?

মানবশরীরের জন্য ঠাণ্ডায় শরীর গরম রাখার চেয়ে গরমে শরীর ঠাণ্ডা রাখা কঠিন, প্রচুর শক্তি ব্যয় হয়। কার্যকরী দিক থেকে- ব্যাপারটি কঠিন, যেমন আপনি গরম জামাকাপড় জ্যাকেট পড়ে দিব্যি -২০ ডিগ্রী সেলসিয়াসে গিয়ে বাইরে কাজ করতে পারবেন, কিন্তু তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রী সেলসিয়াস হলে কী অবস্থা হবে বাইরে কাজ করতে গিয়ে সেটি চিন্তা করতে পারেন। 

যেহেতু যাবতীয় জৈবরাসায়নিক প্রক্রিয়াগুলো একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রার সীমার মাঝে সংঘটিত হয় সেহেতু অতিরিক্ত তাপমাত্রা শরীরের স্বাভাবিক জৈবরাসায়নিক প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে। যেমন- মানুষের মস্তিষ্কের গভীরের তাপমাত্রা শরীরের তাপমাত্রা চেয়ে প্রায়  ডিগ্রী কম থাকে, শরীর মস্তিষ্ক এটি বজায় রাখে কারণ মস্তিষ্কের জৈবরাসায়নিক বিক্রিয়াগুলোর জন্য এটি প্রয়োজনীয়। মস্তিষ্কের গভীরের তাপমাত্রা সাধারণত ৪২ ডিগ্রী সেলসিয়াসের বেশি হলে মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্থ হয়, তাই বাইরের তাপমাত্রা যতো থাকুক না কেনো মস্তিকের গভীরের তাপমাত্রা যেনো এই সীমায় না পৌঁছায় তার জন্য শরীর ব্যবস্থা নেয় (ছায়া শীতল জায়গা খোঁজা, ঘুমিয়ে পড়া- ঘুমের সময় শরীরের তাপমাত্রা প্রায় ডিগ্রী সেলসিয়াস কমে আসে জৈবরাসায়নিক প্রক্রিয়ায় বিরতির ফলে, প্রচুর ঘামানো, প্রচুর পান করা ইত্যাদি) 

মোটামুটি মস্তিষ্কের তাপমাত্রা এক ঘণ্টার জন্য ৪৩ ডিগ্রী সেলসিয়াসের বেশি হলে আপনি মারা যাবেন। মস্তিষ্কের তাপমাত্রা ৪৪ ডিগ্রী সেলসিয়াসের বেশি হলে মস্তিষ্কাংশ পচতে শুরু করে (coagulative necrosis)  

অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাময়িক অতিরিক্ত তাপমাত্রার (hyperthermia) পরে রোগী বা ব্যক্তিরা সুস্থ হয়ে ওঠেন, তবে জটিলতা শুরু হয় যদি আপনি অতিরিক্ত তাপমাত্রায় দীর্ঘসময় ধরে থাকেন, যতো বেশি সময় ধরে অতিরিক্ত তাপে থাকবেন ততো বেশি জটিলতার ঝুঁকি থাকে, এবং অনেক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নষ্ট হওয়া, এমনকি মৃত্যু হতে পারে। যেমন, সর্দিগর্মি (heatstroke) এর কারণে মৃত্যুর হার ৪০%- ৬৪% বেড়ে যায়, অর্থাৎ যেরোগে আপনি মারা যাওয়ার সম্ভবনা কম সেটির ক্ষেত্রে- সর্দিগর্মির কারণে ঝুঁকি ৪০%- ৬৪% বেড়ে যায়।

এছাড়া যারা অতিরিক্ত তাপমাত্রায় থাকেন তাদের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরণের স্নায়ুবিক ও মনোবৈজ্ঞানিক ক্রটি দেখা দেয়, যেমন, চিন্তার ব্যাঘাত, চাগাড়, উৎকণ্ঠা, খিটখিটে ভাব, আতঙ্ক, অস্থিরতা, খিঁচুনি হওয়া, এবং চেতনা হারিয়ে কোমায় চলে যাওয়া ইত্যাদি হতে পারে।

অতিরিক্ত তাপমাত্রা, এমনকি অল্প কিছুক্ষণের জন্য হলে-, চিন্তাগত টিলতা বা অবনতি ঘটাতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই ক্ষতি দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে (বেশি সময় ধরে বেশিক্ষণ অতিরিক্ত তাপমাত্রায় থাকলে) মনোযোগ, স্মৃতি তৈরি সংরক্ষণ, তথ্য প্রক্রিয়াকরণ ইত্যাদি নানা স্নায়ুবিক প্রক্রিয়া প্রভাবিত হতে পারে। যেমন, স্বল্পমেয়াদি স্মৃতি মনোযোগের চেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়। এক গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের মূল তাপমাত্রা (core temperature) ৩৮. ডিগ্রী সেলসিয়াস হওয়াতে স্মৃতিশক্তি হ্রাস পেতে দেখা যায়, যাদের তাপমাত্রা স্বাভাবিক ছিলো তাদের তুলনায়। অনেকক্ষেত্রে অতিরিক্ত তাপমাত্রার ফলে সৃষ্ট জটিলতার প্রভাব তাৎক্ষণিক না- দেখা দিতে পারে, বরং - ঘণ্টা পরে দেখা দিতে পারে।

গরমের ক্ষেত্রে যে ভুলটা মানুষ প্রায় করে সেটি হচ্ছে তাপমাত্রা কতো হবে সেটিতে বেশি মনোযোগ দেয়া। অথচ উচিত তাপসূচককে (heat index) প্রাধান্য দেয়া। তাপসূচক হচ্ছে তাপ হিউমিডিটি মিলিয়ে শরীরে যে তাপমাত্রা অনুভূত (feels like) হয় সেটি। যেমন গতকালে ঢাকার তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রী সেলসিয়াস দেখালে- অনুভূত তাপমাত্রা ছিলো প্রায় ৪৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস, বিশাল পার্থক্য।

অতিরিক্ত গরম কিংবা সর্দিগর্মিতে যা করা উচিত:
বাচ্চাকাচ্চা, বয়ষ্ক, চলাফেরায় অক্ষম কিংবা রোগে ভুগছেন এমনজনদের প্রতি নজর রাখেন। শুধু নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন না। উল্লেখিত ব্যক্তিদের সামর্থ্য বুদ্ধিমত্তা আপনার মতো না- হতে পারে, তাই নিজে দায়িত্ব নিন।
গৃহপালিত প্রাণী থাকলে তাদের প্রতি খেয়াল রাখুন। রাস্তায় কিংবা আশপাশের প্রাণীদের জন্য বারান্দা কিংবা খোলা জায়গায় কিছু খাদ্য পানি রেখে দেন; পারলে ছায়ায় আশ্রয় দিন।
পারলে রোদ পরিহার করুন। ছায়ায় থাকুন। বেশি বেশি পানি জলীয় খাবার খান। যে কাজ না করলেই নয় সেগুলো করুন, অতিরিক্ত কাজ করা মানে শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করা। 
বেশি প্রোটিনজাতীয় খাবার কিংবা অতিরিক্ত খাবার কম খান, এতে শরীরের মেটাবলিজম বাড়ে; তাই হালকা খাবার খান, যেমন শাকসবজি, ফলমূল ইত্যাদি।
কফি অ্যালকোহল পরিহার করুন, এগুলো শরীরের প্রক্রিয়াসমূহকে প্রভাবিত করে।
স্নান করুন নিয়মিত। মাথায় জলে ভেজা কাপড় দিতে পারেন।
হালকা জিনিস পরুন। বোরকা বা ধর্মীয় অতিরিক্ত কাপড় পরিহার করুন, আগে আপনার জীবন বড়, ধর্ম নয়।
জানালার পর্দা টেনে দিন, যেনো রোদ কম আসে। তাপ সৃষ্টি করে এমন যন্ত্র ইত্যাদি কম চালান।
হ্যাঁ, অবশ্যই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত স্থানে থাকুন সম্ভব হলে, যাদের সামর্থ্য নেই তাদের সাথে ভাগ করুন।
মনে রাখবেন যে, তাপ উপরের দিকে ওঠে, অর্থাৎ বাড়ির নিচতলায় তাপমাত্রা কম হবে উপরের তলার তুলনায় ইত্যাদি।

অতিরিক্ত তাপমাত্রায় অসুস্থতার লক্ষণ: গরমে- ঠাণ্ডা অনুভব করা কারণ ছাড়াই, অতিরিক্ত ঘামানো, অবসাদ বোধ করা, মাথা ঘোরা, কর্ডিনেশনে সমস্যা অনুভব করা, পেশিতে ব্যথা অনুভব করা, বমি করা বা বমি বমি ভাব, অতিরিক্ত জ্বর, খিটখিটে স্বভাব, বিভ্রান্তি, লাল চামড়া দেখা দেয়া, শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া, দ্রুত হৃদস্পদন, খিঁচুনি হওয়া। এসব লক্ষণ অনেকগুলো দেখা দিলে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন। শরীরের তাপমাত্রা কমিয়ে আনার চেষ্টা করুন (মাথায় পানি ঢালা, ঠাণ্ডা পানি পান করা) ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করুন।

অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে শিক্ষার্থীরা পর্যন্ত খারাপ রেজাল্ট করে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় (Harvard), কালিফোর্নিয়া লজ এঞ্জেলস বিশ্ববিদ্যালয় (the University of California Los Angeles (UCLA)) এবং জর্জিয়া প্রাদেশিক বিশ্ববিদ্যালয়ের  (Georgia State University) গবেষণা মতে যেসব বছরে অতিরিক্ত গরম পড়ে সেইসব বছরে ইস্কুলের ফলাফল শীতল বছরগুলোর তুলনায় খারাপ হয়। যদিও এটি কারণ-এবং-প্রতিক্রিয়া (cause-and-effect) জাতীয় গবেষণা নয় তারপর-ও এটি পড়াশোনা ও ইস্কুলের কর্মক্ষমতার (performance) উপর অতিরিক্ত তাপমাত্রার প্রভাব তুলে ধরে।  গবেষকরা ১৩ বছর ধরে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যের (একেক রাজ্যের সাথে অন্য রাজ্যের গড় তাপমাত্রায় পার্থক্য অনেক, ফলে তাপমাত্রার ফলাফল তুলনা করা যায়) প্রায় দশ মিলিয়ন মাধ্যমিকে পড়া শিক্ষার্থীদের কাজের মূল্যায়ন, ফলাফল, পরীক্ষা ইত্যাদি বিশ্লেষণ করে আবহাওয়ার নেতিবাচক প্রভাব খুঁজে পান। US National Bureau of Economic Research গবেষণাসংস্থা দ্বারা গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে।
তারা দেখেন যে যেসব বছরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি সেইসব বছরে শিক্ষার্থীরা খারাপ ফলাফল এবং শীতল বছরে ভালো ফলাফল করে। অবস্থা এমন যে প্রতি ০.৫৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা গড়বৃদ্ধির ফলে ফলাফল ও শেখার হার ১% হ্রাস পায়। তাপমাত্রা ২১ ডিগ্রী সেলসিয়াসের বেশি হওয়া শুরু করলে শেখার হার ও ফলাফল খারাপ হতে শুরু করে এবং তাপমাত্রা ৩২ ডিগ্রী সেলসিয়াস হলে শেখার হার হ্রাস পাওয়া ত্বরান্বিত হয়।

সবচেয়ে খারাপ অবস্থা হচ্ছে গরিব এবং সংখ্যালঘুদের অবস্থা, এদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত তাপমাত্রার প্রভাব সবচেয়ে বেশি। এমনিতেই গরিব এবং সংখ্যালঘুরা পেছিয়ে থাকে, এবং অতিরিক্ত তাপমাত্রার প্রভাব এর উপর যোগ হলে অবস্থা খারাপতর হয় বৈকি।
গবেষকরা ধারণা করছেন যে গরম আবহাওয়ায় শিক্ষার্থীদের মনোযোগ ব্যাহত হয়, ইস্কুলে পাঠদান ও অধ্যয়ন ব্যাহত হয়, শিক্ষার্থীরা বিভ্রান্ত ও উত্তেজিত থাকে, এবং বাড়ির কাজ ঠিক মতো সম্পন্ন করা হয় না, ফলে শেখার হার কমে। গবেষকদের মতে সরকার ও নীতিনির্ধারকদের উচিত এইরকম গবেষণার উপর নির্ভর করে ব্যবস্থা নেয়া (যেমন- ইস্কুলের পাঠদান এমন সময়ে করা উচিত যখন তাপমাত্রা কম থাকে, যেমন সকালবেলা অথবা বিকেলবেলা; ইস্কুলে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা, অভিভাবক ও শিক্ষকদের সচেতন করা ইত্যাদি)।

অন্য আরেকটি গবেষণা চমৎকারভাবে পড়াশোনা ও চিন্তাগত কর্মক্ষমতার উপর অতিরিক্ত তাপমাত্রার প্রভাব তুলে ধরেছে। Harvard T.H Chan School of Public Health দ্বারা পরিচালিত গবেষণা, যা PLOS Medicine জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে, সেই গবেষণাতে গবেষকরা দেখেন যে যেসব শিক্ষার্থী তাপপ্রবাহের সময়ে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ছাত্রাবাসে থাকে না তারা যেসব শিক্ষার্থী শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ছাত্রাবাসে থাকে তাদের তুলনায় বিভিন্ন চিন্তাগত (cognitive) পরীক্ষায় বাজে ফলাফল করে। অতিরিক্ত তাপমাত্রা যে মানুষের, এমনকি তরুণ শিক্ষার্থীদের, চিন্তাগত সামর্থ্যকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে সেটি এই গবেষণা তুলে ধরেছে।

গবেষণার জন্য গবেষকরা ৪৪ জন শিক্ষার্থীদের গ্রীষ্মকালে ১২ দিন ধরে ট্র্যাক করেন, এবং তাদের কামরার তাপমাত্রা, কার্বন মনোঅএক্সাইডের পরিমাণ, আদ্রর্তা, গোলমাল বা শব্দের পরিমাপ এবং তাদের শারীরিক কার্যকলাপ, ঘুম ইত্যাদি মাপেন ও নিরীক্ষণ করেন। ৪৪ জন শিক্ষার্থীর ২৪ জন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ছাত্রাবাসে এবং বাকি ২০ জন শীতাতপ নিয়ন্ত্রণবিহীন ছাত্রাবাসে থেকে ছিলো। এই ১২ দিনের মধ্যে প্রথম পাঁচ দিনের তাপমাত্রা গ্রীষ্মকালীন গড় তাপমাত্রা ছিলো, বাকি পাঁচদিন তাপপ্রবাহের (heatwave) দিন, এবং বাকি দুই দিন তাপপ্রবাহের পরে শীতলতার দিন ছিলো। প্রত্যেকদিন শিক্ষার্থীরা তাদের বুদ্ধিমান-ফোন ব্যবহার করে চিন্তাগত দুটো পরীক্ষায় অংশ নেয় যেগুলো তাদের চিন্তার দ্রুততা, নিয়ন্ত্রণ মূল্যায়ন, মনোযোগ ধরে রাখার ক্ষমতা, গাণিতিক প্রশ্ন সমাধান করা, কার্য-স্মৃতি (working memory) ইত্যাদি মূল্যায়ন করে।

গবেষকরা দেখেন যে যেসব শিক্ষার্থী শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ছাত্রাবাসে ছিলো না তারা তাপপ্রবাহ বৃদ্ধির সাথে সাথে প্রশ্নের উত্তর দিতে ১৩% বেশি সময় নিয়েছিলো, প্রশ্নের উত্তরে ১৩% বেশি ভুল করেছিলো, যেসব শিক্ষার্থী শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ছাত্রাবাসে ছিলো তাদের তুলনায়। অর্থাৎ, অতিরিক্ত তাপমাত্রায় কাজের গতি ও কাজের নির্ভুলতা কমে গিয়েছিলো। সবচেয়ে বিষ্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে যখন তাপপ্রবাহের পরে শীতল দিন শুরু হচ্ছিলো এবং বাইরের তাপমাত্রা কমা শুরু করছিলো অথচ ভেতরের তাপমাত্রা বেশি ছিলো তখনো শিক্ষার্থীদের মাঝে পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়, অর্থাৎ, তাপপ্রবাহ শেষ হয়ে গেলো-ও এর প্রভাব কিছু সময় ধরে থেকে যায়।
অতিরিক্ত তাপমাত্রা জনস্বাস্থ্যের জন্য গুরুতর ফল বয়ে আনতে পারে, এবং ভবিষ্যত দিনগুলোতে অবস্থার আরো অবনতি হতে পারে যেহেতু সারা বিশ্বে বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে তাপমাত্রা বাড়ছে। যেহেতু অধিকাংশ মানুষ তাদের দিনের বেশি অংশ অভ্যন্তরে কাটায়, এবং অতিরিক্ত তাপমাত্রা ছাত্রাবাসের মতো অভ্যন্তরে-ও প্রভাব রাখে, বিষয়টি তাই ভাবনার বিষয়। 

বাঙলাদেশের শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করুন। একটি শীতপ্রধান দেশের শিক্ষার্থীদের তুলনায় বাঙলাদেশের শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে থাকার পেছনে কি বাঙলাদেশের অতিরিক্ত গড় তাপমাত্রা কিছু অংশে দায়ী?

শুধু মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যই, অতিরিক্ত তাপমাত্রা বা তাপমাত্রা বৃদ্ধি অর্থনীতির জন্য-ও খারাপ। জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে পৃথিবীর নানা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রভাবিত হবে, কিছু দেশ ধনী এবং কিছু দেশ দরিদ্র হয় পড়বে। স্ট্যানফোর্ড এবং ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলের একদল বিজ্ঞানী তাপমাত্রা বৃদ্ধির ঐতিহাসিক উপাত্ত ব্যবহার করে গাণিতিক মডেলের মাধ্যমে নির্ণয় করেন কীভাবে তাপমাত্রার হ্রাসবৃদ্ধি একটি দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে প্রভাবিত করে।

বিজ্ঞানি Solomon Hsiang যিনি Goldman School of Public Policy at Berkeley এ কর্মরত এবং  Nature জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাটির অন্যতম লেখক, এর মতে,  জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে গড় বিশ্বব্যাপী আয় এই শতাব্দীর শেষে ২৩% কম হবে বলে পূর্বাভাস করা যায়। কিন্তু এই গড় আয় হ্রাস সব দেশ সমানভাবে বহন করবে না। যেমন, পৃথিবীর কিছু কিছু দেশ যেমন, রাশিয়া, ইউরোপের অনেক দেশ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে লাভবান হবে এবং অন্যদিকে দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা, এশিয়ার অনেক দেশ, যেগুলোর তাপমাত্রা এমনিতেই বেশি, সেগুলো আরো গরমের কারণে অর্থনৈতিক মন্দার সম্মুখীন হবে। বাজে ব্যাপার হচ্ছে যে এইক্ষেত্রে সেইসব দেশগুলোর ধনীরা আরো ধনী হবে এবং গরিবেরা আরো গরিবতর হবে।

গবেষকরা ১৯৬০ সাল থেকে ২০১০ পর্যন্ত প্রতিটি দেশের গড় বার্ষিক তাপমাত্রা এবং অর্থনৈতিক অবস্থার তুলনা করে পরিসংখ্যানিক মডেল ব্যবহার করে অন্যান্য ভেরিয়েবল যেমন নীতিনির্ধারণ ও আর্থিক চক্রের পরিবর্তনসমূহকে নিয়ন্ত্রণ করে  বার্ষিক গড় তাপমাত্রার সাথে অর্থনৈতিক অবস্থার সম্পর্ক নির্ণয় করেন এবং ভবিষ্যত অবস্থা কী হবে সেটি ভবিষ্যদ্বাণী করেন। তারা দেখেন যে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিচক্রের পরিবর্তন, ঘন ঘন দুর্যোগ হওয়া ইত্যাদি ছাড়াও শুধুমাত্র তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার প্রভাব অনেক, অর্থনীতির বিভিন্ন ব্যাপার, যেমন, শ্রম সরবরাহ, শ্রম উৎপাদনশীলতা, এবং ফসল উৎপাদন ইত্যাদি তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রী সেলসিয়াস ছাড়ালে কমতে থাকে। এমনকি ধনী এবং প্রযুক্তিগতদিক থেকে উন্নত দেশ, যেমন আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে-ও ব্যাপারটি সত্য। তাপমাত্রা গড়ে ৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াস ছাড়ালে প্রতিদিনের জন্য আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের গড়ে ২০ ডলার অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বেশি খরচ করতে হবে। অনেক দেশের জিপিডি নেতিবাচকভাবে পরিবর্তিত হবে (নিচের ছবি দেখুন)।


রসায়ন অথবা পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ের তুলনায়, মানুষের আচরণ এবং সামাজিক অবস্থার উপর তাপমাত্রা প্রভাব নিয়ে গবেষণা এমনিতেই কম। এই্সব গবেষণা তুল ধরে এবং আমাদের সতর্ক করে যে ভবিষ্যতে তাপমাত্রা আরো বাড়তে থাকলে সমাজ ও অর্থনৈতিক কী বিপর্যয় হতে পারে।

জনস্বাস্থ্য, সমাজ ও অর্থনীতির উপর তাপমাত্রা বৃদ্ধির এই নেতিবাচক প্রভাব রোধ করতে আপনিই পারেন। গাছ লাগান, পরিবেশ বাঁচান। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে মানুষের যেসব আচরণ দায়ী (যেমন, শক্তি ও সম্পদের অপচয়, বেশি সন্তান জন্মদান) যেগুলো পরিহার করুন। অন্যের উপর দায় না চাপিয়ে নিজেরটুকু করুন, আপনিই অন্যের অনুপ্রেরণা হবেন একদিন।


তথ্যসূত্র
Matsumi, N., MATSUMOTO, K., MISHIMA, N., MORIYAMA, E., FURUTA, T., NISHIMOTO, A., & TAGUCHI, K. (1994). Thermal Damage Threshold of Brain Tissue—Histological Study of Heated Normal Monkey Brains—. Neurologia medico-chirurgica, 34(4), 209-215.

Laurent, J. G. C., Williams, A., Oulhote, Y., Zanobetti, A., Allen, J. G., & Spengler, J. D. (2018). Reduced cognitive function during a heat wave among residents of non-air-conditioned buildings: An observational study of young adults in the summer of 2016. PLoS medicine15(7), e1002605.



No comments:

Post a Comment

কী নিয়ে মাতামাতি...

13 Reasons Why (1) ADHD (1) Alzheimer's disease (1) Antibiotic Resistance (1) Anxiety (1) Autism (1) Brexit (1) Brief Answers to the Big Questions (10) Britain (1) Bruce Peninsula (1) Cades Cove Scenic Drive (1) Canada (2) Clingsman Dome (1) District 9 (1) Dopamine (1) Dyer's Bay (1) Federico Garcia Lorca (1) Fierté Montréal (2) Gaspé & Percé Rock (1) Global Warming (2) Great Smoky Mountains (2) Heatwave (1) Hemianopia (1) infographics (1) Instagram (104) International Balloon Festival (1) Interstate 77 (1) Lift (1) Links (1) Maple syrup boiling down (1) Maple syrup harvesting (1) Marconi Union (1) Mike Krath (1) Montmorency Falls (2) Montreal International Jazz Festival (1) Montreal Pride Parade (2) Mother Teresa (1) Movies (1) Music (2) Netflix (1) Niagara Falls (3) Nickelback (1) Nirvana (1) North Carolina (1) nutella (1) Photography (2) Photos (104) Poets of the Fall (2) Psychology (1) Rain storm in Montreal (1) Rape (1) Reading List (1) Saint-Remi (1) Samuel de Champlain Bridge (1) Sandra Crook (1) Schizophrenia (1) Sci-Fi (1) Sci-Hub (1) Shortest Sci-Fi (1) Smoky Mountains (1) Stephen Hawking (15) Sunshine 2007 (1) Tennessee (1) The Beatles (1) The Danish Girl (1) The Grand Design (8) The Handsome Family (1) Tobermory (1) Toronto (2) Transexualism (1) True Detective (1) Tyrannosaurus rex (1) Wallingford Back Mine – Mulgrave et Derry (1) West Island (1) Womenchapter (1) অটিজম (3) অটোয়া (1) অণুগল্প (7) অনুবাদ (17) অভিগীতি (12) অভিলিপি (9) অর্থনীতি (2) অ্যালকোহল (1) আইন ও বিচারব্যবস্থা (1) আইসিস (2) আচরণগত স্নায়ুবিজ্ঞান (1) আত্মহত্যা (2) আলঝেইমারের রোগ (3) আলোকচিত্র (6) আলোকবাজি (9) ইচ্ছেকথা (3) ইন্সটাগ্রাম (104) উইমেন-চ্যাপ্টার (1) উদ্বেগ (1) উবার (1) একুশে বইমেলা (1) এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধ (1) এম-তত্ত্ব (5) কবিতা (95) কম্পিউটার বিজ্ঞান (1) করোনাভাইরাস (6) কলাম (5) কানাডা (4) কাব্যালোচনা (2) কাসেম বিন আবুবাকার (1) কিশোরতোষ (1) কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (1) কৃষ্ণগহ্বর (1) কোভিড-১৯ (8) ক্যান্সার (1) ক্রসফায়ার (1) ক্লোনিং (1) খাদ্যব্যবস্থা (1) গণতন্ত্র (1) গবেষণা (1) গবেষণাপত্র (1) গর্ভপাত (1) গল্প (8) গাঁজা (1) গান (17) গুজব (1) গ্যাব্রিয়েলা মিস্ট্রাল (1) চলচ্চিত্র (4) ছড়া (5) ছবি (104) ছোটগল্প (5) জঙ্গিবাদ (1) জনস্বাস্থ্য (2) জিকা ভাইরাস (1) জীববিজ্ঞান (1) জীবাণু (1) ট্রান্সসেক্সুয়াল (1) ট্রান্সসেক্সুয়ালিজম (1) ডাইনোসর (1) ডাউনলোড (1) ডোপামিন (1) তাপমাত্রা (1) তিল-গপ্পো (17) তুষার দত্ত (2) তেজস্ক্রিয়তা চিকিৎসা (1) দূরবীন (2) দৃষ্টিশক্তি (1) ধর্ম (3) ধর্ষণ (2) নায়াগ্রা ফলস জলপ্রপাত (1) নারী (3) নারী স্বাধীনতা (1) নুটেলা (1) নৈতিকতা (1) পরিবেশ (1) পাঁচমিশালী (1) পাঠসূচি (1) পাম তেল (1) পাহাড় (1) পুস্তক (1) পেডোফিলিয়া (1) প্রকৃতি (1) প্রবন্ধ (2) প্রবাস (2) প্রাইমেট (1) ফটোগ্রাফী (1) ফেসবুক (1) ফ্রান্স (1) বই (2) বড় প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত উত্তর (10) বয়ঃসন্ধি (1) বর্ণবাদ (1) বাঙলাদেশ (18) বাবা (1) বাংলাদেশ (1) বিজ্ঞপ্তি (1) বিজ্ঞান (13) বিটলস (1) বিষণ্নতা (3) বুরকিনি (1) বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি (7) বৈশ্বিক উষ্ণতা (1) ব্যক্তিত্ব (1) ব্যথা (1) ভাইটামিন ডি (1) ভাইরাস (1) ভালোবাসা (1) ভুয়া খবর (1) ভেন্টিলেটর (1) ভ্রমণ (3) মনস্তত্ত্ব (1) মনোবিজ্ঞান (19) মন্ট্রিয়াল (1) মন্ট্রিয়াল আন্তর্জাতিক জ্যাজ উৎসব (2) মস্তিষ্ক ক্যান্সার (1) মহিমান্বিত নকশা (3) মাদক (1) মাদকাসত্তি (2) মাদার তেরেসা (1) মানসিক স্বাস্থ্য (5) মুক্তগদ্য (3) মুক্তচিন্তা (3) মুক্তিযুদ্ধ (3) মৌলবাদ (1) যাপিত জীবন (2) যুগান্তর পত্রিকা (1) যৌনতা (1) রাজনীতি (1) রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প (3) রূপান্তরকাম (1) রৌদ্রস্নান (1) লিওনার্ড ম্লোডিনো (5) লিংক (2) লিঙ্গরূপান্তর (1) লিঙ্গরূপান্তরকারী (1) লিথিয়াম (1) লিফট (1) শিক্ষাব্যবস্থা (1) শিশুতোষ (3) সংগীত (3) সন্ত্রাসবাদ (1) সংবাদমাধ্যম (1) সময়ভ্রমণ (1) সমালোচনা (1) সর্দিগর্মি (1) সানশাইন (1) সামাজিক দূরত্ব (1) সাম্প্রতিক দেখা চলচ্চিত্র (1) সার্স-কোভ-২ ভাইরাস (4) সাহিত্য (4) স্কিৎসোফ্রেনিয়া (1) স্টিফেন হকিং (16) স্ট্রোক (1) স্নায়ুবিজ্ঞান (12) স্নায়ুবিষ (1) স্বাস্থ্যসেবা (1) হলুদ (1)
রোদের অসুখ © 2008 Por *Templates para Você*