এসো খড়ে সুঁই খুঁজি

Custom Search

Saturday, October 24, 2009

আমরা একটা নদীর নাম দিয়েছিলিম

ক্রমশ সংস্কৃতিবিচ্ছিন্নতা অস্বীকার করে আমরা বিক্রি করে চলি বাংলাদেশের ঠোঙা, পাঠ করি ধর্মের পুঁথি। মানুষের গেঞ্জির ঘামশহর দেখে ভুলে যাই বানরের নগর পত্তন।

================================



মাড়াই করা ধান নৌকায় নিয়ে এপার-ওপার করে সবুজ মাঝি - কাঁধে মেলে রাখা লাল গামছায় রোদের শাঁস। কয়েকটা হলদে মাছ রোদের লোভে ডিগবাজি খায় জলের 'পরে; ঝুপ করে আবার জলে নামার আগে দেখে নেয় মাঝির মুখের পুরাণ।

দাগনভূঁইয়া থেকে বাংলাবাজার পর্যন্ত যত মানুষ থাকে তাঁদের অশ্রু জমে কালিডাঙায় উপচে যেতে পারে, সে বিষয়ে চক্ষুপাত নেই আমাদের।



হাঁটুবয়েসের বন্ধু রফিকের বয়ান মনে পড়ে সহসা, "শালার, ডান্ডিগুলা দেবীর নামে নাম রাখি নদীটারে দূষিত করি হালাইছে!" শুনে আমরা চুপ করে থাকি, দূরে বাজচিলের পালক উড়ে। তার উক্তির এক চিলতে ভিত্তি আছে। পূর্বে নদীর ভ্রুণস্থানে শশ্মান আর কালিমন্দির ছিল; যদি-ও এখন আশপাশ ছেঁয়ে গেছে মুসলমানি লিঙ্গে- বাতাসে কেবল ছেঁড়া পালকের কবর!

আমরা শক্তি ও উৎসাহ পাই ইমামের ওয়াজে; তিনি হিন্দুনদীর পাশে নবনির্মিত মসজিদের অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন- তিনি হয় মসজিদ সরানো নতুবা নদীর নামের নতুন আকিকা করার উপদেশ দিয়েছেন। নতুন নামকরণই সহজ- আমাদের শরীরে বল আসে; আমরা নামের তালাশ করতে লাগি।


সাবেতাদের লিচু গাছে এবারে বেবাক ফলন। বসতবাড়িতে লিচুগাছ থাকলে বংশনাশ হয় এমন প্রবাদের মুখে ছাইভাত দিয়ে মহলমিয়া সংসার পেতেছেন সুখেই। সাবেতাদের বাগিচায় গাছপালা আছে নানা কিছিমের, ছায়াশস্য হরেক। আমরা অমাবস্যার রাতে নারিকেল, সুপারি চুরি করে আনি- গঞ্জে বিক্রি করে সিনেমার টাকা উঠাই- ফলের বিকিকিনিতে লাভ বেশি; তাই সাবেতা এবং তার সখীরা আমাদের কাছে পয়গম্বরের মতো জানান দেয়।
সাবেতার গালে আশ্বিনা মেঘ-রোদ মাখামাখি হয়ে হলদে সাদা- ছাপছাপ; বিকেল এলে মেঘনাগরের টানে সে হাঁটতে বের হয় নয়না, সেতারা প্রমুখকে নিয়ে। তাদের দেখে আমরা পথের মাপঝাঁপ বাড়িয়ে দিই। পশ্চিমের পুকুরপাড় ঘুরে এলে এক মুঠো বিকেল, দক্ষিণে সূর্যমুখী কিংবা সরিষার ক্ষেত মাড়ালে এক চিমটি সন্ধ্যা- আমরা এভাবে পথ ও সময়ের হিসেব রাখি। নয়না বিংশ বয়েসী- সখীদের মাঝে সে প্রাচীন; তার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য শান্তিবাদী মনোভাব। যখন-তখন লুঙ্গির কোঁচ মেরে উরুতে বাতাস লাগানো রফিকের নজর নয়নার চক্ষুদ্বয়ে নয়- সে বরং নয়নার শাড়ির প্রস্থ মাপতে আগ্রহী। আমি যেমন সাবেতার তিলের অভিমান খুঁড়তে খুঁড়তে আধ-জাগরণে রাত কাটাই; কেবল বালিশের বয়েস বাড়তে থাকে।


রফিকের বিশেষ পরিচয় আছে- সে মমিন সাহেবের ছেলে। মমিন সাহেব ভাতঘুম না দিয়ে বাজারের পর্দ লিখেন, আড়তের হিসেব করেন, বাঁ হাতের আঙুলে টাকার ঝাঁঝ নিয়ে বসে থাকেন; সে তুলনায় রফিক আলাভোলা ছেলে, কেবল মুখের লাগাম নাই। সে গান বাঁধে, নিজে গায়। সে বাঙলা সিনেমার গান অনুকরণে গান বাঁধে। আমরা স্মরণে রেখেছি:
'চল না ঘুরে আসি সাবেতাদের বাগিচায়
যেখানে মেঘ এসে সময় কাটিয়েছে
আবার এল যে নয়নার ফুল, শুধু
সেতারার কপালে চাঁদ টিপ হয়েছে।'
এসব শুনে আমরা বিনোদিত হই, কেবল সেতারার খোঁপার জবা আরো লাল হয়।
রফিকের গানগুলো যেভাবে শুরু হোক না কেন অবধারিতভাবে শেষ হবে নয়নার গুণকীর্তন করে! যেমন-
উত্তরের নদীতে নামালে মাটির নাও
জলে ভাসি নগ্ন বেশে
স্থানে এলে গামছাখানি সোহাগে দাও
আমার কাঁধের পাশে
বিনিময়ে বকুল দিব আজলা ভরে
নয়না, আমার মন উচাটন করে


আমার ঘরে একটা মাত্র জানালা- উত্তরের দেয়ালে, সেখানে শায়লা ফুফুর পায়রাগুলো সন্ধ্যের আগেআগে হাজির হয়, খুঁদ খায়। গৃহপালিত পশুপাখির দেখাশুনা, কলের জল আনা এসব ছোটছোট কাজ দেখভাল করে সুখী। সুখী আঁচলে চাল রেখে ছড়িয়ে দেয় সারা উঠোন, এই কাজটা সে উৎসাহের সাথে করে- সে জাতে হিন্দু! পায়রাগুলো এসে সমাবেশ করে; আমি পায়রা হয়ে জন্ম দিব পরের জন্মে। আমি পায়রা দেখি- না সুখীকে দেখি তা ঠাহর করতে পারি না!
না, সাবেতাই সই। ইচ্ছে করে সাবেতাদের বাগানের শেষ তেঁতুল গাছটার তেঁতুল মেখে খেতে একগাল, সেই তেঁতুলের শরীরে বৈকালিন রোদের ক্লান্তি লেগে থাকে।

সাবেতাদের উঠোনে একটু-ও মিথ্যে নেই। সে তুলনায় সাবেতার মায়ের গলা বাজখাঁই; আমরা তাই শার্টের খুঁট ধরে ধানক্ষেতের আইলে দাঁড়িয়ে থাকি- তেঁতুল পাকতে থাকে একলা। নিশিথবেলা তেঁতুল গাছ অনেকাংশেই বিপদজনক বিধায় আম-সুপারী নিয়েই আমাদের সন্তুষ্ট থাকতে হয়।

সাবেতা সারাদেহ নিয়ে লেপ্টে থাকুক আমার অঙ্গে, বুকের মাঠে; এতেই বেহেশত-কিছিমের সুখ। ছোটবেলায় একবার বুকের উপর দিয়ে সাইকেল চলে গিয়েছিল, আমি মরি নি; আজিব ব্যাপার হলো আমার ব্যথাই লাগে নি! সেদিন সাইকেলের চাপে আমার বুকের মাঠ সাবেতার জন্য বিশাল হয়ে গিয়েছিল, আমি জানি।


শশ্মান লাগোয়া মেঠোপথ ধরে মাইল দুয়েক কেবল নারিকেল গাছের সারি। এসব ফেরিয়ে একটি পুরানো দোতলা দালান আছে। সবুজ মাঝি আর নসু সন্ন্যাসী সেখানে থাকে। নসুকে সন্ন্যাস বলা যায় কিনা তা বিতর্কের বিষয়; সন্ন্যাসীদের সংসার উদাস থাকে; বুকের খাঁচার লোহা-সম্প্রদায় নিরীক্ষায় তারা সময় খরচ করে। কিন্তু এই সমস্তের বিপরীতে নসুর বউ আছে, তবে সন্তান নেই- হয় না। তার বউের গায়ের রঙ তার পরম শক্র হতে পারত বিধায় নসু পাখির পালক হয়েছে। সংসার পড়ে থাকে, সে চল্লিশোর্ধ শরীর নিয়ে বাতাসে উড়ে। তার বউের গায়ের রঙ আঁখের ভিতরের মতো হলুদাভ-সাদা। এই প্রকারের বহু ললনা আমাদের অঞ্চলের বাতাস টানে, আমরা জানি; তবে বিশেষ আগ্রহের ব্যাপার হলো যে নসুর বউের গায়ে একটা প্রাকৃতিক ছাপ বিদ্যমান। অনেকক্ষণ জমাট জলে স্নান করলে ত্বক যেমন আবেগীরঙা হয়ে যায়- তেমন! সবুজ মাঝি বউহারা, বয়েসী শরীরে নদী বাহে; খায়-দায় নসুদের সাথেই। গভীর রাতে এসে ঘুম পাড়ে, বিহানে আবার নদীর সহোদর।

নসু আমাদের পথের জোঁক হয়ে আছে। সে কখনো মসজিদের সিঁড়িতে ঘুমায়, কখনো মন্দিরের মেঝেতে গড়াগড়ি দেয়; এসবে আমাদের বিবাদ নাই- কিন্তু নচ্চারটা নদীর নাম বিষয়ক ইমাম সাহেবের ওয়াজকালে মসজিদের সিঁড়িতে প্রস্রাব করে দিয়েছে! হারামজাদা আবার দাঁড়ি রাখে, খালি গায়ে পৈতা পরে শহর বিষ করে।



সাবেতার লোমঘাসের রঙ লালচে কালো, চিরহরিৎ ওমের যোগান; আমার কোন কোন বিহানে শীত লাগলে তাদের পুকুরপাড়ে চলে যাই। সেখানে সাবেতা দাঁত মাজে। আমার সাথে সাবেতার চোখাচোখি হলে জবালাল।
'সু, ঘুম কেরকুম অইছে?'
'ভালা, সক্কালবেলার দিকে একটু ঠান্ডা পরে।'
'আমার বাড়িতে তুলা গাছ আছে, কম্বল আছে।'
সাবেতা চোখ তুলে তাকায়, গাঢ় ।
'তুঁই এসব ভেজালেতে যাইও না।'
'কিসের ভেজাল?' আমি সর্তক হই।
'নদীর নাম হিন্দু, মুসলমান অয় নিকি? নদী অইল নদী; বর্ষার সম্পত্তি; আমনেরা এত হাল দেন ক্যান নাম নিয়া?'
'হুন, সু। গোপন কথা কই। তুঁই তো জানোই মণ্ডল মিয়া ইলিকশনে খাঁড়াইবো সামনের মাসে। এবার আমার বাপের দৌড়ানি কম। তারউরপে মণ্ডল মিয়ারে সাপোর্ট করের জলিল মাস্টার। বাপজান চায় একটু মাঠ গরম করার জন্য। নামটাম এসব কিছু না। সব ধুঁয়া।'
'তুঁই তো আগে এরকুম আছিলা না। শহরে চাকরী পাও নাই তো কি অইছে। গাঁয়ে কিছু কামকাজ কর। বাপ চেয়ারম্যান অইছে বইল্লা মানষের বাড়া ভাতে ছাই দিবা এমন তো না।'
আমার গলা দিয়ে কথা উঠে আসে না, তরঙ্গ-জ্যাম শরীরে। জবা ফুল রঙ বদলায়, লাল থেকে কালো- অতপর রঙশূন্য।


জামশেদ একটা কাণ্ড করে বসল।

রাতের ডিগা যখন বয়েসী হয় তখন আমরা মাঝে মাঝে উত্তরের সরিষাক্ষেতে যাই। রস আর আতপচালের সিন্নি বানানো হয়- সাথে আটার রুটি। এসব আমরাই পাকাই। রস চুরি করা হয় যেমন খুশি। গাছগাছালি গোস্বা করে। আমাদের ঠোঁটে মিছরিছুরিহাসি।

শীতের ওষ্ঠ যখন চুষতে থাকে কালিডাঙার পাড়, আমরা তখন রাজ্য কাঁপাই। ঘরের মুরগি, হাঁস জবাই করা করা হয়, কবজি ডুবিয়ে খাই। আর কচি ডাবের পানি। পুরা মহুয়া!
জামশেদ একটা ছাগল পাকড়াও করেছে। বিশাল কারবার। কিন্তু আমাদের কারো ছাগলের মাংশ রান্না করার অভিজ্ঞতা নেই। আমরা সাবেতা, নয়না, সেতারা এদের-ও ডাকলাম। লোক বেশি হলে কাজ দ্রুত হবে, ধরা পড়লে-ও কেলেংকারি কম হবে।
"সাবাশ, জাইম্মা।" রফিক দাঁত কেলিয়ে হাসে। "কামের কাম কইরছত।"
"হে, হে। তালুকদারের হোগা বরাবর একটা চাপ দিলাম।" জামশেদ অকপট হয়।
"তাল্লাইর ছাগল নি? সম্বন্ধী সেদিন বাপের কাছে নালিশ দিছে- আঁই বোলে হেঁতার মাইয়্যার দিকে ফাল মারি।"
আমি কণ্ঠ ঝাড়ি, "ছাগলের মাংশে কি কাবাব বানান যায়?"
"না, মনে হয় না। মাইয়্যাগোরে জিগ্নন লাগবো।" রফিক বলে।
মেয়েরা এসে যায় আঁচলে কোমলগান্ধার নিয়ে।
"জামশেদ, লারকি জোগাড় করন লাগব। রফিক্যারে কইছি হেতে কলার বরগ আইনব, তুই যাই কিছু হুকনা ডালপালা লই আয়।" আমি বললাম।
আমি ছাগলের মাংশ কাটতে শুরু করে দিলাম। আহা! মাল একখান।
সাবেতা নারিকেল গাছের ছায়া দাঁড়িয়ে আছে। আলোর শরীরে ছায়ার ওলান। জামশেদ পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। আমি স্পষ্ট ওদের কণ্ঠ শুনতে পাই।
"সাবু, কেমন আছ?"
"ভালা আছি, জামশেদ ভাই। আমনের মার শরীল ভালা আছে নি?"
"হ, মাঝে মধ্যে কাশ হয়। বয়স অইগেলে আর ক'দিন!" জামশেদ বিরতি নেয়। "সাবু, আইজকা তোরে সুন্দর লাগের।"
সাবেতা কথা বলে না। সাবেতা কি জোরে শ্বাস ফেলছে? গালে লাল জমেছে? আমি ঠিক ঠাহর পাই না।
আমি হাঁক ডাকি, "জামু, তোরে না কইছি লারকি আনবেল্লাই!"
আমি উঠে গিয়ে ওদের পাশে দাঁড়াই।
"এরকুম ছিল্লাছিল্লি কররি কাঁ? যাইয়ের যে দেখরি না?" জামশেদ সূর্যে গরম বালি।
"চুপ, শালা। কথা বলবি তো পেট নামাই দিমু।" আমি ঈগলের ছায়া তখন।
জামশেদ আমার হাতে ধরা মাংশ কাটার ছুরি দিয়ে তাকায়। তাদের চোখে ভয়ের অবাক অস্তিত্ব।
সে চলে যায়। আমি সাবেতার দিকে তাকাই। সে কহে, "অবাক অই ন'।"

আমি-ও অবাক হই না।



সুখী'র একটা ফুলের বাগান আছে। সেই বনানীর সংকর প্রজাপতিদের সাথে আমার বিবাদ! সেই বাগানে সারাদিন ছায়াশরৎ খেলা করে, একটা মৌমাছি গান করে; আর রাতের বেলা একটি বেড়াল ডানা খুলে হাঁটে।
নসু কী উপায়ে সুখীকে নিকা করল সেকথা ভাবার চেয়ে আমি বরং খোলা পাথারে নৌকা নিয়ে চলা সবুজ মাঝির কথা ভাবি, তাতে ঢের সুখ হবে। অঞ্চলের তাদের বাস দু হালি এক বছর, তার পূর্ব ইতিহাস আমাদের বাপ-দাদারা দাঁড়ির ভিতরে লুকিয়ে রেখেছেন, ফলশ্রুতিতে আমরা নাগাল পাই না।
রাতের বেলা জোনাকদলের সাথী হয়ে আমি চলে এলাম শশ্মানের কাছে। অন্ধকারের ভীমরুল উড়ছে চারিদিকে, আলোর আগমন তাই সংকীর্ণ। উল্টোদিক দিয়ে চলে এলাম নসুর বাড়ির পিছনে, এখানে সুখীর বাগান- একটি বিড়ালের রাজত্ব; আমি কি কুকুর হয়ে যাব? নারিকেল পাতার মতো লকলকে জিহবা বের করে বাতাস চাটব?

ছোট ছোট আইলের দুপাশে গাছগাছালির অবস্থান। আধ-দালান, আধা খড় আর মাটিতে বাঁধানো ঘরের সীমানায় বাতির সংশ্রব নেই। বাড়িতে কি কেউ নেই? সুখী কি রাতে বাড়িতে থাকে না? ঘরস্বর-ও কি আজ অরাত্তিরে ঘুমিয়ে পড়েছে? আমি ভাবতে থাকি, পৃথিবীর ক্ষয় হয়।


দরজার বক্ষে শব্দ করে ডাকলে খিড়কী রেগে যায়! কপাট খুলে দেয় সুখী। অবিন্যস্ত আঁচল মাটির টান অনুভব করে ঝরে পড়ছে ক্রমশ। সুখীর হাতে একটি ছুরি ধরা। কসম কেটে বলছি, আমি চুরি করে কোনদিন ঠাকুরঘরে কলা খাই নি।

"আমনে কি করেন এই নিশিরাতে ইয়ানে? মায়ে পাঠাইছে?"
"না। নসু ঘরে? হেতার লগে আলাপ আছে।"
"সে রাইতক্যা ঘরে থাহে না।"
"কই থাকে?"
"আঁই কেন্নে কমু! শশ্মানে ভুত খায়, চাঁন্দের রূপ দেখে।"
"আমনে সরি খাড়ান, আঁই ঘরে দেখুম। সে ইদানীং বাজারে ঝামেলা পাকাইতেছে। মসজিদের চত্বরের পস্রাব করি দিছে সেদিন।"
আমি ঘরে ঢুকে পড়ি।
বিবস্ত্র খাটে একটা বালিশ ও একটি কাঁচুলি! প্রথম দৃষ্টিতে এই চোখে পড়ে। চেরাগ জ্বলছে বাঁশের চেয়ারের উপর, মেঝেতে নকশীকাঁথা পাতা- সেলাই চলছে বোঝা যায়। বামদিকে অন্য ঘরে যাওয়ার দরজা, সে ঘরে অদ্ভুত রহস্য।
সুখীর কথা বলতে ভালো লাগে, আমার শুনতে। নসু যৌবনে জওয়ানদার ছিল, ইস্টিশন মাস্টার; কিন্তু বিয়ের বছর চারেক পরে গ্রামে বেড়াতে গিয়ে পাগলামী দেখা দেয়- আর সারে নি। সেই থেকে সুখীর সংসার-উপবাস। ইদানীং তা প্রকট আকার ধারণ করছেই।
সুখী সেলাই-এ মনযোগ দেয়, আমি দেহপাতায়।


অনেক পরে যখন চেরাগের আলো কমে আসে তেল ফুরিয়ে গেলে- সুখীর কাঁথাসেলাইয়ে লেখা হয়ে যায় সময়ের গল্পসমূহ তখন আমি-ও দেহপাতায় গল্প লেখার আহবান জানাই। তার শরীরে ঘাম জমে।

আমি তাই নসুকে ক্ষমা করে দিই- কিছু দিয়ে যেতে হয়।


একটা ছায়া সরে যায়। আমি টের পাই- জামশেদ! দূর শালা, আমি বিড়ালই থেকে গেলাম, কুকুর হতে পারলাম না!



গর্ভবতী নদী উজানে মেলে দেয় জলশিশু- আমরা তারে বন্যা বলি।
ভেসে যায় বাঙলাবাজার- আমরা হাঁপিয়ে উঠি। আমাদের চালের টিন উড়ে গিয়ে ঘাসের বন্ধু; খড়ের দোচালা এলোমেলো পালক হয়ে উড়ে। দূরের বটগাছটা কৌতূহলে নুয়ে যায়।
চারিদিকে মানুষের লাশ। আমরা রঙ ভুলে যাই। নদীর নাম স্থগিত থাকে।
নসুকে খুঁজে পাওয়া যায় না। জলিল মাস্টার ত্রাণের খরগোশ। বাবা সাপ হয়ে চলেন।
সবুজ মাঝি নৌকা হারিয়ে ফেলেছেন। আমি কাঠ কেটে দিই আমাদের বন থেকে। বাবা টের পায় না।

সুখী পোয়াতি এখন। সবাই চোখ কচলায়। নসু তো এখন বাতাস।

আমি জানি। আমি।


'আমি?'
'সন্দেহ আছে?' পুরাতন মন্দিরের দেয়ালে একটা টিকটিকি, তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। তাহার পাশে বিকালের আলো।
'নসু না?'
'নসু শামুক। তার সামর্থ্য নাই।'
'কী করবা? আমি তো শ্যাষ।'
'কিছু করুম না। আমি ফুল পামু।'
'বাপে আমারে দেশছাড়া কইরবো। আমারে মাফ দাও। শহরে যাইবা? একদিনে খালাশ কইরে ফিরা আসা যাইব।'
এখানে দুর্গা নেই। পূজো নেই। সুখী এখন দুর্গা।
'পুরুষ চিনতে ভুল হয় না। আপনে পুরুষ না। নসু ভাবতো আমি বাঁজা। আমি ফুলের বাগান করি, পানি দিই। অথচ আমার ফুল নাই। আপনে সেই ফুল নষ্ট করতে কন?'
'ঘটনা বুঝার চেষ্টা করেন। এইটা রাষ্ট্র হইলে নির্ঘাত হারা। শহরে থাকবা, আমি মাসে মাসে টেকা পাঠামু নি।'
'আঁই নিজেই চলি যামু।'

টিকটিকিটা সব দেখে শুনে বাজারে রাষ্ট্র করে দেয়। আমি শইল মাছ হয়ে যাই। জামশেদ শেয়ানে শেয়ানে।




সন্ধ্যে হয়ে গেছে। বাতি জ্বেলে দেয়া যায়। আমার ইচ্ছে করছে না।
সুখী উধাও। আমি জানি বাপজান করিৎকর্মা লোক। পুলিশঝাঁক এসেছে। তিনি সামাল দিবেন।
সাবেতা লিচুগাছ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের উঠোনে। আমার সব নাশ!
বিছানায় শুয়ে শুয়ে নিজের কামরা দেখি- অন্ধকারের চোখ-মুখ-চিবুক; আর আশ্চর্য এক নদী। আঁধারের নদী।
দরজায় খিড়কী নাড়ছে কেউ। আমি জবাব দিই না। শব্দ বাড়তে থাকে।
"কে?"
"আমি রফিক। দোর খুল।"
আমি দোর খুলি না। খিড়কী নাড়ার শব্দ বাড়তে থাকে। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে আমার অন্ধকারের নদী খোঁড়া! কতগুলো নদী। আমি নাম দিতে থাকি- এটা কালিডাঙা, এটা শুভালক্ষ্মী, ওইটা মাতামহুরী...।
অন্ধকারের নদী খুঁড়ে...।

৬/২০০৯ [আনুমানিক] 

No comments:

Post a Comment

কী নিয়ে মাতামাতি...

13 Reasons Why (1) ADHD (1) Alzheimer's disease (1) Antibiotic Resistance (1) Anxiety (1) Autism (1) Brexit (1) Brief Answers to the Big Questions (10) Britain (1) Bruce Peninsula (1) Cades Cove Scenic Drive (1) Canada (2) Clingsman Dome (1) District 9 (1) Dopamine (1) Dyer's Bay (1) Federico Garcia Lorca (1) Fierté Montréal (2) Gaspé & Percé Rock (1) Global Warming (2) Great Smoky Mountains (2) Heatwave (1) Hemianopia (1) infographics (1) Instagram (104) International Balloon Festival (1) Interstate 77 (1) Lift (1) Links (1) Maple syrup boiling down (1) Maple syrup harvesting (1) Marconi Union (1) Mike Krath (1) Montmorency Falls (2) Montreal International Jazz Festival (1) Montreal Pride Parade (2) Mother Teresa (1) Movies (1) Music (2) Netflix (1) Niagara Falls (3) Nickelback (1) Nirvana (1) North Carolina (1) nutella (1) Photography (2) Photos (104) Poets of the Fall (2) Psychology (1) Rain storm in Montreal (1) Rape (1) Reading List (1) Saint-Remi (1) Samuel de Champlain Bridge (1) Sandra Crook (1) Schizophrenia (1) Sci-Fi (1) Sci-Hub (1) Shortest Sci-Fi (1) Smoky Mountains (1) Stephen Hawking (15) Sunshine 2007 (1) Tennessee (1) The Beatles (1) The Danish Girl (1) The Grand Design (8) The Handsome Family (1) Tobermory (1) Toronto (2) Transexualism (1) True Detective (1) Tyrannosaurus rex (1) Wallingford Back Mine – Mulgrave et Derry (1) West Island (1) Womenchapter (1) অটিজম (3) অটোয়া (1) অণুগল্প (7) অনুবাদ (17) অভিগীতি (12) অভিলিপি (9) অর্থনীতি (2) অ্যালকোহল (1) আইন ও বিচারব্যবস্থা (1) আইসিস (2) আচরণগত স্নায়ুবিজ্ঞান (1) আত্মহত্যা (2) আলঝেইমারের রোগ (3) আলোকচিত্র (6) আলোকবাজি (9) ইচ্ছেকথা (3) ইন্সটাগ্রাম (104) উইমেন-চ্যাপ্টার (1) উদ্বেগ (1) উবার (1) একুশে বইমেলা (1) এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধ (1) এম-তত্ত্ব (5) কবিতা (95) কম্পিউটার বিজ্ঞান (1) করোনাভাইরাস (6) কলাম (5) কানাডা (4) কাব্যালোচনা (2) কাসেম বিন আবুবাকার (1) কিশোরতোষ (1) কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (1) কৃষ্ণগহ্বর (1) কোভিড-১৯ (8) ক্যান্সার (1) ক্রসফায়ার (1) ক্লোনিং (1) খাদ্যব্যবস্থা (1) গণতন্ত্র (1) গবেষণা (1) গবেষণাপত্র (1) গর্ভপাত (1) গল্প (8) গাঁজা (1) গান (17) গুজব (1) গ্যাব্রিয়েলা মিস্ট্রাল (1) চলচ্চিত্র (4) ছড়া (5) ছবি (104) ছোটগল্প (5) জঙ্গিবাদ (1) জনস্বাস্থ্য (2) জিকা ভাইরাস (1) জীববিজ্ঞান (1) জীবাণু (1) ট্রান্সসেক্সুয়াল (1) ট্রান্সসেক্সুয়ালিজম (1) ডাইনোসর (1) ডাউনলোড (1) ডোপামিন (1) তাপমাত্রা (1) তিল-গপ্পো (17) তুষার দত্ত (2) তেজস্ক্রিয়তা চিকিৎসা (1) দূরবীন (2) দৃষ্টিশক্তি (1) ধর্ম (3) ধর্ষণ (2) নায়াগ্রা ফলস জলপ্রপাত (1) নারী (3) নারী স্বাধীনতা (1) নুটেলা (1) নৈতিকতা (1) পরিবেশ (1) পাঁচমিশালী (1) পাঠসূচি (1) পাম তেল (1) পাহাড় (1) পুস্তক (1) পেডোফিলিয়া (1) প্রকৃতি (1) প্রবন্ধ (2) প্রবাস (2) প্রাইমেট (1) ফটোগ্রাফী (1) ফেসবুক (1) ফ্রান্স (1) বই (2) বড় প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত উত্তর (10) বয়ঃসন্ধি (1) বর্ণবাদ (1) বাঙলাদেশ (18) বাবা (1) বাংলাদেশ (1) বিজ্ঞপ্তি (1) বিজ্ঞান (13) বিটলস (1) বিষণ্নতা (3) বুরকিনি (1) বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি (7) বৈশ্বিক উষ্ণতা (1) ব্যক্তিত্ব (1) ব্যথা (1) ভাইটামিন ডি (1) ভাইরাস (1) ভালোবাসা (1) ভুয়া খবর (1) ভেন্টিলেটর (1) ভ্রমণ (3) মনস্তত্ত্ব (1) মনোবিজ্ঞান (19) মন্ট্রিয়াল (1) মন্ট্রিয়াল আন্তর্জাতিক জ্যাজ উৎসব (2) মস্তিষ্ক ক্যান্সার (1) মহিমান্বিত নকশা (3) মাদক (1) মাদকাসত্তি (2) মাদার তেরেসা (1) মানসিক স্বাস্থ্য (5) মুক্তগদ্য (3) মুক্তচিন্তা (3) মুক্তিযুদ্ধ (3) মৌলবাদ (1) যাপিত জীবন (2) যুগান্তর পত্রিকা (1) যৌনতা (1) রাজনীতি (1) রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প (3) রূপান্তরকাম (1) রৌদ্রস্নান (1) লিওনার্ড ম্লোডিনো (5) লিংক (2) লিঙ্গরূপান্তর (1) লিঙ্গরূপান্তরকারী (1) লিথিয়াম (1) লিফট (1) শিক্ষাব্যবস্থা (1) শিশুতোষ (3) সংগীত (3) সন্ত্রাসবাদ (1) সংবাদমাধ্যম (1) সময়ভ্রমণ (1) সমালোচনা (1) সর্দিগর্মি (1) সানশাইন (1) সামাজিক দূরত্ব (1) সাম্প্রতিক দেখা চলচ্চিত্র (1) সার্স-কোভ-২ ভাইরাস (4) সাহিত্য (4) স্কিৎসোফ্রেনিয়া (1) স্টিফেন হকিং (16) স্ট্রোক (1) স্নায়ুবিজ্ঞান (12) স্নায়ুবিষ (1) স্বাস্থ্যসেবা (1) হলুদ (1)
রোদের অসুখ © 2008 Por *Templates para Você*