'এইটা কী গাছ?'
প্রশ্ন শুনে আমি মাথা উঁচু করে বাঁ দিকে তাকালাম, গভীর সহজ সবুজ পাতা, লালচে-ধূসর বাকল, আর হলদে-সবুজ অগণন ফুলের মাঝে কচি কচি সবুজাভ হলদে পাকা ফলের বৃক্ষ, লম্বায় প্রায় ১৩ ফুট। থোকা থোকা আপেলের মতো ফল, বিষে সমৃদ্ধ, ধর্মনেতা আর রাজনীতিবিদদের মনের মতো।
আমি লুবনার দিকে তাকাই জ্ঞানী জ্ঞানী ভাব নিয়ে।
'ম্যাঞ্চিনীল। উত্তর দক্ষিণ আমেরিকার গাছ। স্প্যানিশে আদর করে ডাকে manzanilla de la muerte বা little apple of death। মৃত্যুর খুদে আপেল। দূরে সরে দাঁড়াও। চরম বিষাক্ত। বৃষ্টির সময় এর নিচে দাঁড়ালে আর এর রস গায়ে লাগলে গায়ে ফোস্কা ফুটে যাবে।'
'কী যে বলো।
সত্যি বলছো?'
'হ্যাঁ গো।' আমি হাসি, কেনো জানি।
আমরা হাঁটতে থাকি। বাগানের এইদিকে আমি নিজেও তেমন আসি না, এখানে বিষাক্ত গাছগুলো লাগানো, বিষাক্ত মানুষেরা।
লুবনা
এসেছে অনেকদিন পরে। ঠিক কতো পরে সেটা মনে করতে পারি না, মাতৃগর্ভের স্মৃতির মতো। লুবনা
বিয়ে করেছে, অন্য কাউকে, আমাদের সম্পর্কে ছিলো রোদে
শুকাতে দেয়া কাপড়ের মতো বাতাসে উড়াউড়ির, আমাদের
নিজস্বতা ছিলো, কিন্তু আমরা
কারণে অকারণে নিজেদের হতে পারি নি। তবুও আমাদের বন্ধুত্বতা রয়ে গেছে, কিন্তু দেখা কম হয়। সে এখন
ইউরোপে থাকে, আর আমি
ব্রিটিশ কলম্বিয়ার প্রবল ভ্যাঙ্কুভারে। ইদানীং নিজেকে একা একা লাগে, এতো শত বৃক্ষের মাঝেও।
'কে ছিলো এটা?'
'আমার দ্বিতীয়
চাকুরির বস। ভীষণ বদমাশ। চারটা বছর আমার জীবনকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে। আমার মনে
হতো আমি যেনো তার দাস। তাই এই বিষ গাছ বানালাম। হাহা।'
আমি অপ্রকৃতিস্থের মতো হাসি, কোনো পাখি উড়ে যায় না, জোরালো বাতাসে উড়িয়ে দেয়া কাগুজে উড়োজাহাজের মতো সেই হাসি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে, ফিরে আসে প্রতিধ্বনি হয়ে, যেনো সূর্যের চারদিকে অসহায় প্রেমিকের মতো ঘুরে বেড়ানো পৃথিবী শনি বৃহস্পতির মতন।
হাঁটতে হাঁটতে আমরা বাগানের মাঝামাঝি চলে আসি। এখানে এখনো কোনো মানববৃক্ষ লাগাই নাই। খালি। বন্ধ্যা নারীর সন্তানের জন্য আকুলতার মতো সবুজাভ-হলদে ঘাস। সেখানে ফড়িং, পোকামাকড় ইত্যাদির বনভোজন, চড়ুইভাতি, অথবা বেঁচে থাকার সংগ্রাম।
ইকোম্যান কোম্পানি যাত্রা শুরু করেছিলো ২০১৭ সালে। তারা মানুষ মারা গেলে সেই মানুষের মৃতদেহ পোড়ানোর ছাই বা জীবাশ্মকে একটি বায়োডিগ্রেইডেইবল বোতলে করে তাতে আপনার পছন্দ মতো গাছের বীজ বুনে দেয়ার বোতল বাজারে ছাড়ে। যেনো মৃত্যুর পর আপনি নিজে বৃক্ষ হিসেবে বড় হোন, জীবনের রূপান্তর হয়, চক্র থামে না। ব্যাপারটি আমার অভিনব লাগে। দেশে যাওয়ার সময় আমি কিছু বোতল কিনে নিয়েছিলাম। দেশে গিয়েছিলাম ২০১৮ সালের প্রথমদিকে, তিন মাসের জন্য, দাদা-দাদী মারা গেলো সেই সময়ে, দূর সম্পর্কের এক খালাও, তাদের ছাই নিয়ে এখানে এখন চেরি মেইপল ইত্যাদির গাছ। ক্রমে হাসপাতাল মর্গে কাজ করার সুবাধে আমার বাগানে বিভিন্ন গাছের সংগ্রহ বেড়ে গেলো। তারপর আমি নিজেও শুরু করলাম...মানববৃক্ষের জন্য মানুষ সংগ্রহ।
বাগানের মাঝখানে একটি বিশেষ গাছ লাগাবো বলে অনেকদিন ধরে পরিচর্যা করে সব ঠিক করছি। এখন শুধু পাখিকে খাঁচায় পুরার মতো সেই মানুষটিকে বোতলে জমানো।
ডানদিকে কোদাল, সার মাটির বস্তা। কম্পোস্ট।
লুবনাকে ইদানীং অনেক মনে পড়ে। তাই ফোন করে আনা, অনেক কষ্টে। লুবনাকে যেতে দিতে ইচ্ছে করে না...
আমি অনেকদিন ধরে ভেবে পরিকল্পনা করেছি। সব ঠিকঠাক আছে। তাকে মেরে ফেলা সহজ হবে। এদিকটায় লোকজন এমনিতেই কম, চারদিকে অনেক গাছের জন্য ফুফাতো বোনকে লুকিয়ে স্নান করতে দেখার মতো গোপনীয়তা। তারপর ফায়ারপ্লেসের আগুনে...সেই ছাই সংগ্রহ করে বোতলে...লুবনাকে কোন বৃক্ষে মানায়? আমার কোন প্রিয় বৃক্ষ? ফুলের গাছ?
আমার দাদার এক গভীর অদ্ভুত ব্যাপার ছিলো। তার নিম গাছের বাগান ছিলো। নিমের ভেষজ গুণ আছে, গ্রামের দিকের বাড়িতে দুয়েকটা থাকে, কিন্তু বাগান থাকে না। তার ছিলো। সেই বাগানে তিনি সকাল ও সন্ধ্যাবেলা নিয়ম করে ঘুরতেন, মাঝে মাঝে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতেন গাছগুলোর মাঝে। আমি দেখতাম। ভয় হতো। তাকে জিজ্ঞেস করলে নিমবাগানের ব্যাপারে তিনি হাসতেন। কিছু বলতেন না। দাদার এই ঘন অসুখ কি আমার মাঝে? নাহলে বাগান নিয়ে এতো আহলাদ আমার কখনোই ছিলো না।
লুবনা বেড়ে উড়বে বাগানের মাঝখানে। আমি আমার উইল ও আইনজীবিকে বলে রেখেছি অঙ্গদানের পর আমার নিজের শরীরকে-ও যেনো এইভাবে বৃক্ষে পরিণত করা হয় আর ঠিক কোন জায়গায় রোপন করা হবে সেটিও চিহ্নিত করে দিয়েছি। লুবনা থাকবে আমার পাশে। লুবনা কি কখনো আমাকে বুঝে নি? তাতে কি, যখন আমাদের বৃক্ষদেহ পরষ্পরকে ছুঁয়ে যাবে, আমাদের পাতায় বাতাস শব্দ করে যাবে আমরা পরষ্পরের দিকে তাকিয়ে পার করে দেবো পৃথিবীর ঘোমটা সরানো কতো ঋতু।
আমি লুবনাকে কয়েক কদম এগিয়ে যেতে দিলাম। ডানপাশ থেকে কোদাল তুলে নিলাম। লুবনার শেষ চিৎকার এই বৃক্ষসমাজে কাগুজে উড়োজাহাজের মতো ঘুরপাক খেতে লাগলো...
No comments:
Post a Comment