কেনো আমাদের বড় প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা দরকার
মানুষ সবসময়ে বড় প্রশ্নের উত্তর চেয়েছে।
আমরা কোথা থেকে এসেছি? মহাবিশ্বের শুরু কীভাবে? এইসব কিছুর পেছনে অর্থ এবং নকশা
কী? আমরা ছাড়া অন্য কেউ আছে কিনা? অতীতের সৃষ্টিতত্ত্বের ধারণা এখন কম প্রাসঙ্গিক
এবং বিশ্বাসযোগ্য। সেগুলো এখন
প্রতিস্থাপিত হয়েছে বিভিন্ন জিনিস দিয়ে, নবযুগ (New Age) ধারণা থেকে শুরু করে স্টার ট্রেক (Star
Trek) দিয়ে, যেগুলোকে
শুধু কুসংস্কারই বলা চলে। কিন্তু প্রকৃত বিজ্ঞান বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির চেয়ে-ও অপরিচিত এবং আরো বেশি
সন্তোষজনক মনে
হতে পারে।
আমি একজন বিজ্ঞানী। পদার্থবিজ্ঞান, মহাজাগতিকতা,
মহাবিশ্ব এবং মানুষের ভবিষ্যত ইত্যাদি গভীর মোহে আকৃষ্ট একজন বিজ্ঞানী। আমার
বাবা-মা আমাকে এমনভাবে বড় করেছেন
যেনো আমার অটল দ্বিধাহীন কৌতূহল থাকে, এবং আমার বাবার মতন, বিজ্ঞান আমাদের যে অনেক
প্রশ্ন করে সেগুলো নিয়ে গবেষণা করা এবং উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করি। আমি আমার জীবন
ব্যয় করেছি মহাবিশ্ব জুড়ে ভ্রমণ করে, আমার মনের ভেতরে। তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের
মাধ্যমে আমি চেয়েছি কিছু বড় প্রশ্নের উত্তর দিতে। এক পর্যায়ে, আমি ভেবেছিলাম যে
আমি আমাদের পরিচিত পদার্থবিজ্ঞানের সমাপ্তি দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু এখন আমি মনে করি
আমার চলে যাওয়ার দীর্ঘদিন পরে-ও আবিষ্কারের বিস্ময় চলতে থাকবে। আমরা এইসব
উত্তরগুলোর কয়েকটির কাছাকাছি, তবে এখনো পুরোপুরি সেখানে নই।
সমস্যা হচ্ছে যে অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাস করে
যে প্রকৃত বিজ্ঞান বোঝা তাদের
জন্য অনেক কঠিন এবং জটিল। কিন্তু আমার সেইরকম মনে হয় না। মহাবিশ্বকে যেসব মৌলিক
নিয়ম বা সূত্র পরিচালনা করে সেগুলো নিয়ে গবেষণার জন্য প্রয়োজন সময়ের অঙ্গীকার, যা
অধিকাংশ মানুষের নেই; আমরা সকলেই তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে কাজ করতে শুরু করলে
বিশ্ব শীঘ্রই থেমে যাবে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ মৌলিক ধারণাগুলো বুঝতে পারে এবং উপলব্ধিপূর্বক
উপভোগ করে যদি ধারণাগুলোকে কোনো সমীকরণ ছাড়া স্পষ্টভাবে উপস্থাপন করা হয়, যা সম্ভব
বলে আমি বিশ্বাস করি এবং আমি সারাজীবন ধরে আনন্দের সাথে তা করার চেষ্টা করেছি।
বেঁচে থাকার জন্য এবং তাত্ত্বিক
পদার্থবিজ্ঞানে গবেষণার জন্য এটি একটি গৌরবান্বিত সময়কাল। গত পঞ্চাশ বছরে ধরে
আমাদের মহাবিশ্বের ছবি অনেক বদলে গেছে এবং আমি খুশি যদি আমি কিছুটা অবদান রেখে
থাকি। এই সময়ের মহা উদ্ঘাটনের একটি হচ্ছে এটি মানবতা সম্পর্কে যে দৃষ্টিভঙ্গি
আমাদের সামনে তুলে ধরেছে। যখন আমরা মহাকাশ থেকে পৃথিবীকে দেখি, আমরা আমাদের সমগ্র
হিসেবে দেখি। আমরা একতা দেখি, এবং বিভাজন নয়। এটি একটি অকাট্য বার্তা নিয়ে একটি
সাধারণ চিত্র: একটি গ্রহ, এক মানবজাতি।
আমি আমাদের বিশ্বব্যাপী সম্প্রদায়ের জন্য
গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জগুলোর ব্যাপারে অবিলম্বে পদক্ষেপ নেয়ার দাবি যারা করে তাদের
সাথে আমার কন্ঠ মেলাতে চাই। আমি আশা করি আসছে সময়ে, এমনকি যখন আমি এখানে আর থাকবো না, তখন ক্ষমতায়
থাকা মানুষগুলো সৃজনশীলতা, সাহস, এবং নেতৃত্ব প্রদর্শন করবে। তারা যেনো টেকসই
উন্নয়নের লক্ষ্যগুলোর চ্যালেঞ্জের বিপরীতে উদিত হয় এবং নিজের স্বার্থ নয়, বরং
জনসাধারণের স্বার্থে কাজ করে। আমি সময়ের বহুমূল্য সম্পর্কে অনেক সচেতন। এই
মুহূর্তকে পাকড়াও করো। এখনই কাজ শুরু করো।
*
আমি আমার জীবন নিয়ে আগে-ও লিখেছি কিন্তু
আমার প্রথম অভিজ্ঞতাসমূহের কিছু কিছু পুনরাবৃত্তির যোগ্য, বড় প্রশ্ন নিয়ে আমার
জীবনব্যাপী আকর্ষণের কথা চিন্তা করলে।
আমার জন্ম হয়েছিলো গ্যালিলিওর মৃত্যুর ঠিক
৩০০ বছর পরে, এবং আমি মনে করতে পছন্দ করি যে এই কাকতালীয় ব্যাপার আমার বৈজ্ঞানিক
জীবন কীভাবে পরিণত হয়েছে তার উপর প্রভাব ফেলেছে। যাইহোক, আমি অনুমান করি যে ওইদিন
প্রায় আরো ২০০০০০ শিশুর জন্ম হয়েছিলো; আমি জানি না তাদের কেউ পরে জ্যোতির্বিজ্ঞানে
আগ্রহী ছিলো কিনা।
আমি লন্ডনের হাইগেটের লম্বা সংকীর্ণ
ভিক্টোরিয়ান আমলের এক বাড়িতে বড় হয়েছি, যা আমার বাবা-মা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে
যখন সবাই ভেবেছিলো যে লন্ডন বোমা হামলায় মাটিতে মিশে যাবে তখন সস্তায় কিনে
নিয়েছিলো। আসলেই, একটি
ভি২ রকেট আমাদের বাড়ির কয়েক বাড়ি দূরেই পড়েছিলো। আমি আমার মা আর বোনকে নিয়ে বাইরে
ছিলাম তখন, এবং সৌভাগ্যক্রমে আমার বাবার কিছু হয় নি। কয়েক বছর পরে, আমি আমার বন্ধু
হাওয়ার্ডকে নিয়ে যে রাস্তায় খেলতাম সেটি
একটি বড়সড় বোমা বিস্ফোরণের
স্থান ছিলো। আমরা বিস্ফোরণের ফলাফল তদন্ত করেছিলাম সেই একই কৌতূহল নিয়ে যা আমাকে
আমার সারা জীবন ধরে
ধাবিত করেছে।
১৯৫০ সালে, আমার বাবার কাজের জায়গা লন্ডনের
উত্তর প্রান্তে, মিল হিলে নতুন নির্মিত চিকিৎসা গবেষণার জাতীয় প্রতিষ্ঠানে বদলি
হয়েছিলো, ফলে আমাদের পরিবার কাছাকাছি সেন্ট অ্যালবান্সের ক্যাথেড্রাল শহরে
স্থানান্তরিত হয়। আমাকে মেয়েদের
উচ্চ বিদ্যালয়ে পাঠানো হয়েছিলো, যেটি মেয়েদের ইস্কুল হওয়া সত্ত্বেও দশ বছর বয়স পর্যন্ত
ছেলেদের ভর্তি হতে দিতো। পরে আমি সেন্ট অ্যালবান্স ইস্কুলে গিয়েছিলাম- কিন্তু আমার সহপাঠীরা আমাকে আইনস্টাইন
ডাকনাম দিলো, সম্ভবত তারা ভালো কিছুর লক্ষণ দেখেছিলো। যখন আমার বয়েস বার, তখন আমার
এক বন্ধু অন্য আরেক বন্ধুর সাথে এক ব্যাগ মিষ্টির বাজি ধরেছিলো যে আমি আসলে জীবনে
কিছু করতে পারবো না।
সেন্ট অ্যালবান্সে আমার ছয় কিংবা সাতজন ভালো
বন্ধু ছিলো, এবং আমাদের বেতার-নিয়ন্ত্রিত
মডেল থেকে ধর্ম, সব বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা এবং বিতর্কের কথা আমার মনে আছে। আমরা যেসব
বড় প্রশ্নে নিয়ে আলোচনা করেছিলাম তার একটি ছিলো মহাবিশ্বের উৎস নিয়ে, মহাবিশ্বের
সৃষ্টি এবং যাত্রার জন্য কি ঈশ্বরের প্রয়োজন ছিলো কিনা। আমি শুনেছিলাম যে দূরবর্তী
ছায়াপথ থেকে উৎসারিত আলো বর্ণালীর লাল প্রান্তের দিকে অপবাহিত হয় এবং এর মানে ছিলো যে মহাবিশ্ব
বিস্তৃত হচ্ছিলো। কিন্তু আমি নিশ্চিত ছিলাম লাল দিকে অপবাহিত হওয়ার অন্য কারণ আছে।
হয়তো আলো ক্লান্ত হয়ে গেছে এবং আমাদের কাছে পৌঁছার পথে লাল হয়ে গেছে? মূলত এক
অপরিবর্তনীয় এবং চিরস্থায়ী মহাবিশ্ব অনেক বেশি প্রাকৃতিক লাগে। (মাত্র কয়েক বছর পরে,
আমার পিএইচডি গবেষণার দুই বছরের মাথায় মহাজাগতিক অণুতরঙ্গ পটভূমি আবিষ্কারের পরে
আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে আমার ধারণা ভুল ছিলো।)
আমি সবসময় জিনিসপত্র কীভাবে কাজ করে তাতে
খুব আগ্রহী ছিলাম, এবং আমি সেগুলো কীভাবে কাজ করে বোঝার জন্য সেগুলো আলাদা করে
খুলতাম, কিন্তু সেগুলো আবার জোড়া লাগানোর ক্ষেত্রে আমি খুব দক্ষ ছিলাম না। আমার ব্যবহারিক
ক্ষমতা আমার তাত্ত্বিক গুণাবলির সাথে কখনো মিলে নি। আমার বাবা আমাকে বিজ্ঞানে
উৎসাহিত করেছিলেন এবং খুব আশা করেছিলেন যে আমি হয় অক্সফোর্ড কিংবা কেমব্রিজে যাবো। তিনি নিজে
অক্সফোর্ডের ইউনিভার্সিটি কলেজে গিয়েছিলেন, তাই উনার মনে হয়েছিলো যে আমার সেখানে আবেদন করা উচিত।
সেইসময়ে, ইউনিভার্সিটি কলেজে গণিতের কোনো বৃত্তি (fellow) ছিলো না, তাই আমার প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে বৃত্তির জন্য আবেদন করা ছাড়া
বিশেষ উপায় ছিলো না। আমি সেটি পেয়ে নিজেকে নিজে অবাক করেছিলাম।
সেইসময় অক্সফোর্ডে যে কর্তৃত্বকর মনোভাব ছিলো তা হাচ্ছে কাজের প্রতি উদাসীন ভাব। এই ধারণা
প্রচলিত ছিলো যে আপনাকে
চেষ্টা-ছাড়াই মেধাবী হতে হবে, নতুবা আপনার সীমাবদ্ধতা মেনে নিতে হবে এবং একটি
চতুর্থ-শ্রেণির ডিগ্রী পেতে হবে। আমি এটাকে খুব অল্প কাজ করার আমন্ত্রণ হিসেবে
নিলাম। আমি এই ব্যাপারে গর্বিত নই। আমি সেইসময়ে আমার মনোভাব বর্ণনা করছি মাত্র,
আমার অন্যান্য সহকর্মী-ও এই মনোভাব পোষণ করতো। আমার অসুস্থতার এক ফলাফল ছিলো এই মনোভাব পরিবর্তন আসা। যখন আপনি আশু মৃত্যুর সম্ভাবনার
মুখোমুখি হোন, তখন আপনি বুঝতে পারবেন যে আপনার জীবন শেষ হয়ে যাওয়ার আগে আপনি অনেক
কিছু করতে চান।
আমার কাজে ফাঁকি দেওয়ার কারণে, আমি
পরিকল্পনা করেছিলাম যে চূড়ান্ত পরীক্ষার সময়ে যেসব প্রশ্নে প্রকৃত জ্ঞান বা উত্তর
লাগবে সেগুলো আমি এড়িয়ে যাবো এবং মনোনিবেশ করবো তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের
প্রশ্নগুলোতে। কিন্তু পরীক্ষার আগের রাতে আমি ঘুমাই নি এবং ফলে আমি পরীক্ষায় ভালো
করি নি। আমি প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর ডিগ্রীর মধ্যের সীমারেখায় ছিলাম এবং ফলে
আমাকে পরীক্ষকদের সামনে সাক্ষাৎকার দিতে হয়েছিলো আমার কোন ডিগ্রী পাওয়া উচিত সেটি
নির্ণয়ের জন্য। সাক্ষাৎকারে তারা আমাকে আমার ভবিষ্যত পরিকল্পনার কথা জিজ্ঞেস
করেছিলো। আমি বললাম যে আমি গবেষণা করতে চাই। তারা যদি আমাকে প্রথম-শ্রেণীর ডিগ্রী
দেন তবে আমি কেমব্রিজে যাবো। যদি আমি দ্বিতীয় শ্রেণীর ডিগ্রী পাই, তবে আমি
অক্সফোর্ডেই থাকবো। তারা আমাকে প্রথম-শ্রেণীর ডিগ্রী দিয়েছিলেন।
আমার চূড়ান্ত পরীক্ষার পরের দীর্ঘ অবকাশে, ভ্রমণের জন্য কলেজটি কয়েকটি ছোট অনুদান প্রদান
করেছিলো। আমি ভাবলাম যে আমার একটি অনুদান পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি হবে যদি আমি দূরে
কোথাও যাওয়ার প্রস্তাব করি, তাই আমি বলেছিলাম যে আমি ইরানে যেতে চাই। ১৯৬২ এর
গ্রীষ্মে, আমি ট্রেনে করে প্রথমে ইস্তাম্বুলে, সেখান থেকে পূর্ব তুর্কির
এর্জুরেমে, তারপর তাবিরিজ, তেহরান, ইসফাহান, শিরাজ এবং পারসেপোলিস, প্রাচীন ফারসি
রাজাদের রাজধানীতে গিয়েছিলাম। বাড়ি ফেরার পথে, আমি এবং আমার সহযাত্রী রিচার্ড চিন
বোয়াইন-জহরা (Bouin-Zahra) ভূমিকম্পের কবলে পড়েছিলাম, ৭.১ রিক্টারের
বিশাল ভূমিকম্প,
যাতে প্রায় ১২ হাজার লোক মারা গিয়েছিলো। আমি নিশ্চিত উপকেন্দ্রের ধারে কাছে ছিলাম,
কিন্তু আমি জানতাম না কারণ আমি অসুস্থ ছিলাম, এবং যে বাসে ছিলাম সেটি ইরানের
এবড়োখেবড়ো সড়কে এমনিতেই
ঝাঁকুনি খাচ্ছিলো।
পরের কয়েকদিন আমরা তাবরিজে কাটিয়েছিলাম, গুরুতর
আমাশয় এবং বাসের ঝাঁকুনিতে সামনের আসনের সাথে ধাক্কা খেয়ে ভাঙা পাঁজর থেকে যখন আমি
সুস্থ হয়ে উঠলাম, তখনো আমরা দুর্যোগ সম্পর্কে জানতাম না কারণ আমরা ফারসি জানতাম
না। আমরা ইস্তাম্বুলে পৌঁছার পরে জানতে পারলাম আসলে কী ঘটেছিলো। আমি আমার
বাবা-মাকে একটি পোস্টকার্ড পাঠালাম, তারা গত দশ ধরে উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করছিলেন এবং তারা শেষ শুনেছিলেন যে আমি ভূমিকম্পের দিন দুর্যোগ
অঞ্চলের দিকে তেহরান ছেড়ে গিয়েছিলাম। ভূমিকম্প সত্তে-ও, ইরানে আমার অনেক প্রিয়
স্মৃতি রয়েছে। জগত সম্পর্কে তীব্র কৌতূহল অনেককে ক্ষতির পথে ঠেলে দিতে পারে, কিন্তু
আমার জন্য সেইসময় ছিলো আমার জীবনের একমাত্র সময় যখন এটি সত্য ছিলো।
১৯৬২ সালের অক্টোবরে আমি যখন কেমব্রিজের
ফলিত গণিত এবং তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে পৌঁছলাম তখন আমার বয়েস বিশ। আমি সেই
সময়ে সবচেয়ে বিখ্যাত ব্রিটিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফ্রেড হোয়েলের সাথে কাজ করার জন্য
আবেদন করেছিলাম। আমি জ্যোতির্বিজ্ঞানী বলছি, কারণ তখন মহাবিশ্ববিজ্ঞান (cosmology) একটি
প্রথাসিদ্ধ ক্ষেত্র হিসেবে তেমন স্বীকৃত পায় নি। কিন্তু হোয়েলের ইতিমধ্যে
যথেষ্ট কয়েকজন
শিক্ষার্থী ছিলো, ফলে গভীরভাবে হতাশ করে আমাকে নিয়োগ করা হলো ডেনিস সায়মা (Dennis Sciama) –এর
অধীনে, যার কথা আমি আগে কখনো শুনি নি। কিন্তু এটি ভালো হয়েছে যে আমি হোয়েলের ছাত্র
ছিলাম না, কারণ তাহলে আমাকে
তার স্থির-অবস্থা তত্ত্ব (steady-state
theory) সমর্থন করার জন্য কাজ করতে হতো, যে কাজটি বেক্সিট
মধ্যস্ততার চেয়ে-ও কঠিন হতো। আমি সাধারণ আপেক্ষিকতার উপরে পুরাতন পাঠ্যপুস্তকগুলো
পড়ার মাধ্যমে আমার কাজ শুরু করেছিলাম, বড় প্রশ্নের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে।
আপনারা কয়েকজন হয়তো চলচ্চিত্রে দেখেছেন যে,
যেখানে এডি রেডমেইন আমার একটি বিশেষ সুদর্শন সংস্করণ ফুটিয়ে তুলেছে, অক্সফোর্ডে
আমার তৃতীয় বছরে আমি লক্ষ্য করলাম যে আমি জবরজঙ্গ হয়ে যাচ্ছি। আমি একবার কি দুইবার পড়ে গিয়েছিলাম এবং আমি
বুঝতে পারি নি কেনো, এবং আমি লক্ষ্য করলাম যে আমি সঠিকভাবে একটি বৈঠা-নৌকার বৈঠা চালাতে পারতাম না। এটা
স্পষ্ট হয়ে উঠলো যে কিছু একটা ঠিক নেই, এবং আমি কিছুটা অসন্তুষ্ট হলাম যখন ডাক্তার দেখে বললো যে বিয়ার খাওয়া ছেড়ে দিতে।
আমি কেমব্রিজে আসার পরের শীতকাল ছিলো খুব
ঠাণ্ডা। আমি তখন ক্রিসমাসের বিরতিতে ছিলাম যখন আমার মা আমাকে সেন্ট অ্যালবান্সের
হ্রদে স্কেটিং করার জন্য প্রলুদ্ধ করলো, যদিও আমি জানতাম যে আমি সেটার জন্য তৈরি ছিলাম না। আমি উল্টে পড়ে গেলাম এবং আমার আবার
উঠে দাঁড়াতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিলো। আমার মা বুঝতে পারলেন যে কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে এবং আমাকে ডাক্তারের কাছে
নিয়ে গেলেন।
আমি লন্ডনের সেন্ট বার্থোলোমিউ হাসপাতালে
কয়েক সপ্তাহ কাটালাম এবং অনেকগুলো পরীক্ষা করলাম। ১৯৬২ সালে, পরীক্ষাগুলো এখনকার
চেয়ে কিছুটা সেকেলে ছিলো। আমার বাহু থেকে পেশির একটি নমুনা নেয়া হলো, আমার শরীরে
ইলেকট্রোড লাগানো হলো এবং আমার মেরুদণ্ডে রেডিও-অভেদ্য তরল প্রবিষ্ট করানো হলো, যা
ডাক্তাররা বিছানা হেলানোর ফলে এক্স-রশ্মিতে উপরে ও নিচে ওঠানামা করতে দেখলো।
ডাক্তাররা আমাকে আসলে বলে নি কী সমস্যা, কিন্তু আমি অনুমান করলাম যে অবস্থা খুব
খারাপ, তাই আমি আর জানতে চাইলাম
না। আমি ডাক্তারদের কথোপকথন থেকে বুঝতে পারলাম যে ‘এটি’ যা হোক না কেনো, অবস্থার শুধু আরো
অবনতি হবে, এবং শুধুমাত্র আমাকে ভাইটামিন দেয়া ছাড়া তাদের আর কিছু করার নেই। এমনকি, যে ডাক্তার আমার পরীক্ষাগুলো
করেছিলেন তিনি আমার দায়িত্ব গ্রহণ করা থেকে সরে গেলেন এবং আমি আর উনাকে কখনো দেখি নি।
এক সময় আমি অবশ্যই জানতে পারলাম যে রোগটি
হচ্ছে অ্যামিওট্রোফিক পার্শ্বিক কলাকাঠিন্য (amyotrophic lateral sclerosis; ALS), এক ধরণের মোটর স্নায়ুকোষ রোগ, যাতে মস্তিস্ক এবং মেরুদণ্ডের
স্নায়ুকোষসমূহ ক্ষয় হতে থাকে। আমি আরো
জেনেছি যে এই রোগের রোগীরা ক্রমে চলাফেরা, নড়াচড়া, কথা বলা, খাওয়া, এবং একসময় শ্বাস
নেয়ার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে।
আমার অসুস্থতার দ্রুত অবনতি হতে লাগলো। বোধগম্যভাবে,
আমি বিষণ্ন হয়ে পড়লাম এবং আমার পিএইচডির গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখতে
পেলাম না, কারণ আমি জানি না যে আমি এটি শেষ করার জন্য ততোদিন বেঁচে থাকবো কিনা।
কিন্তু এরপর রোগের অগ্রগতি শ্লথ হলো এবং আমি আমার কাজের জন্য এক নতুন উদ্দীপনা
পেলাম। আমার প্রত্যাশা কমে শূন্যে নেমে যাওয়ার পরে, প্রতিটি নতুন দিনই একটি উপরিলাভ
হয়ে ওঠেছিলো, এবং আমি আমার যা কিছু আছে সব কিছু উপভোগ করতে শুরু করলাম। যতক্ষণ শ্বাস
ততক্ষণ আশ।
এবং অবশ্যই, জেন নামে একজন যুবতীও ছিলো, যার
সাথে আমার একটি আড্ডা-আসরে দেখা হয়েছিলো। সে খুব দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলো যে আমরা একসাথে
আমার অবস্থাকে ঘায়েল করতে পারবো। তার আস্থা আমাকে আশা দিয়েছে। বাগদান আমাকে
প্রফুল্ল করে তুললো, এবং আমি উপলব্ধি করলাম যে যদি আমরা বিয়ে করতে চাই তবে আমাকে
আমার পিএইচডি শেষ করে একটি চাকুরি পেতে হবে। এবং বরাবরের মতন, সেই বড় বড়
প্রশ্নগুলো আমাকে ধাবিত করছিলো। আমি কঠোর পরিশ্রম করতে শুরু করেছিলাম এবং আমি সেটি
উপভোগ করেছি।
আমার গবেষণার সময়ে নিজের খরচ যোগানোর জন্য
আমি গনভিল এবং কাইয়াস (কেমব্রিজে ‘কিছ’ হিসেবে উচ্চারিত) কলেজে (Gonvillle and Cauis College) একটি গবেষণা বৃত্তির জন্য আবেদন করলাম। অবাক করা ব্যাপার যে আমি
নির্বাচিত হলাম এবং সেই থেকে আমি কাইয়াসের একজন সভ্য (fellow)। বৃত্তিটি ছিলো
আমার জীবনের একটি বিশেষ
মোড়। এর মানে ছিলো যে আমি আমার ক্রমবর্ধমান অক্ষমতা সত্ত্বেও আমার গবেষণা চালিয়ে
যেতে পারবো। এর মানে এই-ও ছিলো যে আমি এবং জেন বিয়ে করতে পারবো, যা আমরা করেছিলাম
১৯৬৫ সালের জুলাইয়ে। আমাদের প্রথম সন্তান, রবার্ট, জন্মগ্রহণ করেছিলো আমাদের বিয়ে
হওয়ার দুই বছরের মাথায়। আমার দ্বিতীয় সন্তান, লুসি, জন্মগ্রহণ করেছিলো তিন বছর পরে।
আমার তৃতীয় সন্তান, টিমোথি, ১৯৭৯ সালে।
একজন বাবা হিসেবে, আমি সবসময় প্রশ্ন জিজ্ঞেস
করার গুরুত্ব তুলে ধরার
চেষ্টা করবো। আমার ছেলে টিম একবার একটি সাক্ষাৎকারে একটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার গল্প
করেছিলো, আমার মনে হয় সেই সময়ে সে সেই প্রশ্ন অর্থহীন হয়েছে মনে করে চিন্তিত ছিলো। সে জানতে
চেয়েছিলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনেকগুলো মহাবিশ্ব আছে কিনা। আমি তাকে বললাম যে কখনো
কোনো ধারণা কিংবা উপপ্রমেয় (hypothesis)
নিয়ে কথা বলতে যেনো ভয় না পায়, সেটি যতোই নির্বোধ বা হাবার (তার শব্দচয়ন, আমার নয়) মতো
শোনায় না কেনো।
*
মহাকাশবিজ্ঞানে ১৯৬০-এর দশকে বড় প্রশ্ন ছিলো
যে মহাবিশ্বের কি কোনো সূচনা ছিলো? অনেক বিজ্ঞানী প্রবৃত্তিগতভাবে এই ধারণার
বিরোধিতা করেছিলেন কারণ তারা মনে করেছিলেন যে সৃষ্টির একটি সূচনাবিন্দু এমন হবে যে
যেখানে বিজ্ঞান ভেঙে পড়বে। ফলে মহাবিশ্ব কীভাবে শুরু হয়েছিলো তা নির্ধারণের জন্য
আপনাকে ধর্ম এবং ঈশ্বরের হাতের কাছে ধরণা দিতে হবে। এটি স্পষ্টভাবেই একটি মৌলিক
প্রশ্ন ছিলো, এবং আমার পিএইচডি অভিসন্দর্ভ শেষ করার জন্য এটিই আমার দরকার ছিলো।
রজার পেনরোজ দেখিয়েছিলেন যে যখন একটি মৃতমান
নক্ষত্র একটি নির্দিষ্ট ব্যাসার্ধে সংকুচিত হয়, তখন অবশ্যই অবশ্যম্ভাবীভাবে এককত্ব
সৃষ্টি হবে, এই বিন্দুতে স্থান এবং কালের (সময়ের) সমাপ্তি হবে। অবশ্যই, আমি ভাবলাম
যে আমরা ইতিমধ্যেই জানতাম যে একটি বিশাল শীতল নক্ষত্র নিজস্ব মাধ্যাকর্ষণের অধীনে
পতিত হওয়া কিছুই ঠেকাতে পারবে না ততোক্ষণ পর্যন্ত না এটি অসীম ঘনত্বের এক এককত্বে
পৌঁছায়। আমি উপলব্ধি করলাম যে একই যুক্তি মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে-ও
প্রয়োগ করা যেতে পারে। এই ক্ষেত্রে, আমি প্রমাণ করতে পারবো যে এককত্ব হচ্ছে যেখানে স্থান-কালের সূচনা ছিলো।
একটি ইউরেকা মুহূর্ত এলো ১০৭০ সালে, আমার
কন্যা, লুসির জন্মের কয়েকদিন পরে এক সন্ধ্যায় যখন আমি বিছানায় যাচ্ছিলাম, যা আমার
অক্ষমতার কারণে একটি ধীর প্রক্রিয়া হয়ে গিয়েছিলো। আমি উপলব্ধি করলাম যে এককত্ব উপপাদ্যের
(singularity theorems ) জন্য আমার উদ্ভাবন করা নৈমিত্তিক গঠন তত্ত্ব (causal
structure theory) আমি কৃষ্ণগহ্বরের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে পারি। যদি
সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব সঠিক হয়ে থাকে এবং শক্তির ঘনত্ব ধনাত্মক হয়ে থাকে, তবে
কৃষ্ণগহ্বরের সীমানা, ঘটনাদিগন্তের (event horizon)
পৃষ্ঠভূমির বৈশিষ্ট্য হবে যে এটি সর্বদা বৃদ্ধি পাবে যদি এটিতে নতুন কোনো বস্তু
কিংবা বিকিরণ এসে পড়ে। কিন্তু, যদি দুটো কৃষ্ণগহ্বরের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে এবং তারা
একত্রিত হয়ে একটি কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হয়, তবে নতুন গঠিত কৃষ্ণগহ্বরের
ঘটনাদিগন্তের ক্ষেত্র মূল দুই কৃষ্ণগহ্বরের ঘটনাদিগন্তসমূহের ক্ষেত্রগুলোর সমষ্টির
চেয়ে বেশি হবে।
এটি ছিলো একটি সুবর্ণ যুগ, আমরা কৃষ্ণগহ্বর
তত্ত্বের প্রধান সমস্যাগুলোর অধিকাংশ সমাধান করে ফেলেছিলাম এমনকি কৃষ্ণগহ্বর
সম্পর্কে কোনো পর্যবেক্ষণমূলক প্রমাণের আগেই। আসলে, আমরা আপেক্ষিকতার চিরায়িত (classical) সাধারণ তত্ত্ব নিয়ে এতো বেশি
সফল ছিলাম যে ১৯৭৩ সালে জর্জ এলিস (George
Ellis) এর সাথে আমাদের বই The Large Scale Structure
of Space–Time প্রকাশের পরে আমি কিঞ্চিত লাগামছাড়া
ছিলাম। পেনরোজের সাথে আমার কাজ দেখিয়েছিলো যে এককত্বে সাধারণ আপেক্ষিকতা ভেঙে পড়ে,
ফলে সুস্পষ্ট পরবর্তী ধাপ হচ্ছে যে খুব বড় জিনিসের তত্ত্ব- সাধারণ আপেক্ষিকতাকে
খুব ছোট জিনিসের তত্ত্ব- কোয়ান্টাম তত্ত্বের সাথে সংযুক্ত করা। বিশেষভাবে, আমি
চিন্তা করছিলাম যে, এমন কোনো পরমাণসমূহ থাকতে পারে কি যেখানে পরমাণুকেন্দ্র (nucleus) হচ্ছে আদি
মহাবিশ্বে গঠিত একটি ক্ষুদ্র আদিম (মৌল) কৃষ্ণগহ্বর? আমার গবেষণা মার্ধ্যাকর্ষণ
এবং তাপগতিবিদ্যার (তাপের বিজ্ঞান) মধ্যে একটি গভীর এবং পূর্বে অপ্রত্যাশিত সম্পর্ক
তুলে ধরলো, এবং একটি আপার্তবৈপরীতা তুলে ধরলো যা নিয়ে গত ত্রিশ বছরে কোনো অগ্রগতি
ছাড়াই বিতর্ক হয়ে যাচ্ছে: কীভাবে একটি সঙ্কুচিত (shrinking) কৃষ্ণগহ্বরের অবশিষ্ট বিকিরণ
সেই কৃষ্ণগহ্বর কী দিয়ে
তৈরি হয়েছে সেই
সম্পর্কে সমস্ত তথ্য বহন করতে পারে? আমি আবিষ্কার করেছি যে তথ্য হারিয়ে যায় না,
কিন্তু এটি একটি কার্যকর উপায়ে ফিরে-ও
আসে না- অনেকটা একটি
বিশ্বকোষ জ্বালিয়ে ধোঁয়া ও ছাই ধরে রাখা বা সংগ্রহ করার মতন।
এই উত্তরের জন্য, আমি গবেষণা করলাম কীভাবে
একটি কৃষ্ণগহ্বর থেকে কোয়ান্টাম ক্ষেত্রসমূহ বা কণাসমূহ ছিটকে পড়বে। আমি প্রত্যাশা
করেছিলাম যে ঘটনা তরঙ্গের একটি অংশ শোষিত হয়ে যাবে এবং অবশিষ্ট অংশ বিক্ষিপ্ত
ছড়িয়ে পড়বে। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে যে আমি গবেষণা করে পেলাম যে স্বয়ং
কৃষ্ণগহ্বর থেকে নির্গমন
ঘটে। প্রথমে আমি ভাবলাম যে আমার হিসেবে কোনো ভুল আছে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে আমাকে
যা প্ররোচিত করলো তা হচ্ছে যে এই নির্গমন হচ্ছে কৃষ্ণগহ্বরের বিশৃঙ্খলা-মাত্রা
দিয়ে ঘটনাদিগন্তের ক্ষেত্র চিহ্নিত করার জন্য সুনির্দিষ্টভাবে যা প্রয়োজন ঠিক তাই।
এই বিশৃঙ্খলা-মাত্রা, একটি
ব্যবস্থার বিশৃঙ্খলার পরিমাপ, এই সাধারণ সমীকরণ দিয়ে হিসেব করা যায়:
যা বিশৃঙ্খলা-মাত্রাকে ঘটনাদিগন্তের ক্ষেত্র
এবং প্রকৃতির তিনটি মৌলিক ধ্রুবক, c,
আলো গতি, G, নিউটনের মার্ধ্যাকর্ষণ
ধ্রুবক, এবং ħ, প্লাঙ্কের ধ্রুবক দিয়ে প্রকাশ করে।
কৃষ্ণগহ্বর থেকে এই তাপ বিকিরণের নির্গমনকে এখন হকিং বিকিরণ বলা হয় এবং এটি
আবিষ্কার করে আমি গর্বিত।
১৯৭৪ সালে, আমি রয়েল সোসাইটির (Royal Society) একজন সভ্য
হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলাম। এই
নির্বাচন আমার বিভাগের সদস্যের জন্য আশ্চর্যজনক ব্যাপার ছিলো কারণ আমি তখনো
তরুণ এবং শুধুমাত্র একজন নিম্নপদস্থ গবেষণা সহকারী। কিন্তু তিন বছরের মধ্যেই আমাকে
প্রফেসর পদে পদোন্নত করা হলো। কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে আমার কাজ আমাকে আশা জোগালো যে আমরা
একটি সার্বিক তত্ত্ব (theory
of everything) আবিষ্কার করবো, এবং এই উত্তর খোঁজার অনুসন্ধান
আমাকে ধাবিত করলো।
একই বছরে, আমার বন্ধু কিপ থ্রোন আমাকে এবং
আমার নতুন পরিবারকে
এবং সাধারণ আপেক্ষিকতা নিয়ে কাজ করছে এমন কয়েকজনকে ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব
টেকনোলজিতে (ক্যালটেক) আমন্ত্রণ জানালো। এর গত চার বছরে, আমি একটি হস্তচালিত চাকাচেয়ার
(wheelchair) এবং একটি নীল বৈদ্যুতিক তিন চাকার গাড়ি ব্যবহার করতাম, যা খুবই আস্তে
চলতো এবং যেটিতে আমি মাঝে মাঝে বেআইনীভাবে যাত্রী বহন করেছিলাম। যখন আমরা
ক্যালিফোর্নিয়াতে গেলাম, আমরা বিদ্যায়তনের কাছাকাছি ক্যালটেক-মালিকানাধীন
ঔপনিবেশিক-শৈলীর একটি বাড়িতে থাকলাম এবং আমি এই প্রথম একটি বৈদ্যুতিক চাকাচেয়ারের
পূর্ণ ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছিলাম। এটি আমাকে ব্যাপক স্বাধীনতা দিলো, কারণ আমেরিকার
যুক্তরাষ্টের ভবনগুলো এবং ফুটপাতগুলো ব্রিটেনের চেয়ে অক্ষমদের চলাচলের জন্য বেশি
সুগম।
যখন আমরা ১৯৭৫ সালে ক্যালটেক থেকে ফিরে
আসলাম, প্রথম প্রথম আমার খুব খারাপ লাগতো। ব্রিটেনে সবকিছু সংকীর্ণ এবং নিয়ন্ত্রিত
মনে হতো আমেরিকার পারো-করো মনোভাবের তুলনায়। সেই সময়ে, ডাচ এলম রোগে মৃত গাছপালায়
আশপাশ বিক্ষিপ্ত ছিলো এবং দেশ ধর্মঘট লেগে ছিলো। যাইহোক, আমার মনমেজাজ ভালো হওয়া
শুরু করলো যখন আমি আমার কাজের সফলতা দেখলাম এবং ১৯৭৯ সালে আমাকে গণিতের লুকাসিয়ান
প্রফেসরিতে (Lucasian
Professorship) পদোন্নতি করা হলো, যে পদটি স্যার আইজ্যাক নিউটন
এবং পল ডিরাক (Paul Dirac) গ্রহণ করেছিলেন।
১৯৭০-এর দশকে, আমি প্রধানত কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে
কাজ করছিলাম, কিন্তু মহাবিশ্ববিজ্ঞান নিয়ে আমার আগ্রহ নতুন করে শুরু হলো যখন
প্রস্তাব করা হলো যে আদি মহাবিশ্ব একটি সময়ের জন্য দ্রুত স্ফীতিজনিত সম্প্রসারণের
মধ্য দিয়ে গেছে যার ফলে এর আকার ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পেয়েছিলো, যেমন
যুক্তরাজ্যে ব্রেক্সিট ভোটের পরে জিনিসপত্তের দাম বেড়ে গিয়েছিলো। আমি জিম হার্টলের
(Jim Hartle)
সাথে কাজ করে সময় কাটালাম, মহাবিশ্বের জন্ম নিয়ে একটি তত্ত্ব প্রণয়ন করলাম যা আমরা
“অসীমানা” (no
boundary) তত্ত্ব নামে অভিহিত করলাম।
১৯৮০-এর দশকের প্রথম দিকে, আমার স্বাস্থ্য আরো
খারাপ হতে লাগলো, এবং আমি দীর্ঘদিন ধরে খাবার আটকে বিষম খেতে লাগলাম যেহেতু আমার
গলনালী দুর্বল হয়ে পড়ছিলো এবং আমার ফুসফুসে খাওয়ার সময়ে খাবার ঢুকে যাচ্ছিলো । ১৯৮৫ সালে
সুইজারল্যান্ডের সার্নে (CERN;
European Organisation for Nuclear Research) এক ভ্রমণে আমার
নিউমোনিয়া হলো। এটি ছিলো জীবন-পরিবর্তনকারী মুহূর্ত। আমাকে দ্রুত লুসার্ন
ক্যান্টনাল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো এবং একটি ভেন্টিলেটরে দেয়া হলো। ডাক্তাররা
জেইনকে বললো যে অবস্থা এমন পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যে কিছুই করার নেই এবং তারা
ভেন্টিলেটর বন্ধ করে দিয়ে আমার জীবন অবসান করতে পারে। কিন্তু জেইন প্রত্যাখ্যান করেছিলো
এবং আমাকে আকাশ-অ্যাম্বুলেন্সের মাধ্যমে কেমব্রিজের অ্যাডেনব্রুক হাসপাতালে
স্থানান্তর করালো।
কল্পনা করতে পারেন যে এটি খুব কঠিন সময়
ছিলো, কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে অ্যাডেনব্রুকের ডাক্তাররা কঠোর চেষ্টা করলো আমাকে
সুইজারল্যান্ড সফরের আগের অবস্থায় ফিরে আনার জন্য। যাইহোক, যেহেতু আমার গলনালী
তখনো খাবার এবং লালা আমার ফুসফুসে যেতে দিচ্ছিলো, ডাক্তাররা শ্বাসনালীতে একটি অস্ত্রোপচার
করলো। আপনারা অনেকে জানতে পারেন
যে শ্বাসনালীতে অস্ত্রোপচার আপনার কথা বলার ক্ষমতা কেড়ে নেয়। আপনার স্বর অনেক
গুরুত্বপূর্ণ। যদি এটি স্লান হয়, আমার মতো, লোকজন ভাবতে পারে যে আপনি একজন অপরিণতমনস্ক ব্যক্তি এবং আপনার
সাথে সেই অনুযায়ী আচরণ করতে পারে। শ্বাসনালীর অস্ত্রোপচারের আগে আমার কথাবার্তা
এতোই অস্ফুট ছিলো যে যারা আমাকে ভালোভাবে জানতো তারাই আমার কথা বুঝতে পারতো। আমার
সন্তানেরা যারা আমার কথা বুঝতে পারতো তাদের কয়েকজন ছিলো। অস্ত্রোপচারের পরের কিছু
সময়ের জন্য, যে একমাত্র উপায়ে আমি যোগাযোগ করতে পেরেছি তা হচ্ছে শব্দ বানান করে,
অক্ষরের পর অক্ষর, যখন কেউ একটি বানানের কার্ডে (spelling card) সঠিক অক্ষর নির্দেশ করতো তখন
আমার ভ্রু উচিয়ে নির্দেশ করে।
সৌভাগ্যক্রমে ওয়াল্ট ওল্টজ (Walt Woltosz) নামে
ক্যালিফোর্নিয়ার এক কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ আমার অসুবিধার কথা শুনেছিলেন। তিনি
ইক্যুলাইজার (Equalizer) নামে তার লেখা একটি কম্পিউটার
প্রোগ্রাম আমাকে পাঠিয়েছিলেন। এটি আমার হাতে একটি সুইচ টিপে আমার চাকাচেয়ারে কম্পিউটার
পর্দায় কতকগুলো শব্দতালিকা থেকে পূর্ণ শব্দ বাছাই করতে দিতো। সেই সময় থেকে বছর
ধরে, ব্যবস্থার উন্নতি সাধন হয়েছে। এখন আমি ইন্টেলের (Intel) বানানো অ্যাক্যাট (Acat) নামে একটি প্রোগ্রাম
ব্যবহার করি, যা আমি গাল নাড়িয়ে আমার চশমায় বসানো ছোট সেন্সর দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করি।
এটির একটি মুঠোফোন আছে, যা দিয়ে আমি আন্তর্জালের (internet) সাথে যুক্ত হতে পারি। আমি দাবি করতে পারি যে আমি পৃথিবীর সবচেয়ে
সংযুক্ত ব্যক্তি। আমি আমার আদি বাক সংশ্লেষণকারীটি (speech
synthesiser) রেখে দিয়েছি, কারণ আংশিকভাবে, আমি ভালো শব্দসমষ্টিসহ অন্য
আরেকটি শুনি নি এবং আংশিকভাবে এই কণ্ঠস্বরটির আমেরিকান উচ্চারণ সত্ত্বে-ও আমি এই
কন্ঠস্বরের সাথে একাত্মবোধ করি।
মহাবিশ্ব সম্পর্কে একটি জনপ্রিয় সাধারণ বই
লেখার চিন্তা আমার মাথায় আসে ১৯৮২ সালে, আমার “অসীমানা” তত্ত্বের কাজের সময়ে। আমি
ভেবেছিলাম যে আমার বাচ্চাদের ইস্কুলের খরচ এবং আমার যত্নের ক্রমবর্ধমান খরচ
যোগানোর জন্য আমি কিছু পরিমিত টাকা আয় করতে পারবো, তবে মূল কারণ ছিলো আমাদের
মহাবিশ্বকে বোঝার সম্পর্কে আমরা কতো দূর এসেছি বলে আমি অনুভব করেছি তা আমি
ব্যাখ্যা করতে চেয়েছি: কীভাবে আমরা মহাবিশ্ব এবং তাদের মাঝে সমস্ত কিছুকে বর্ণনা করার একটি
সার্বিক তত্ত্বের ধারেকাছে এসে থাকতে পারি। প্রশ্ন করা এবং উত্তর খোঁজা শুধুমাত্র
গুরুত্বপূর্ণ নয়, আমরা যা কিছু শিখছি তা বিশ্বকে জানানোর জন্য একজন বিজ্ঞানী
হিসেবে আমি বাধ্য বোধ করেছি।
যথোপযুক্তভাবে, কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস (A Brief History of Time)
বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯৮৮ সালের এপ্রিল ফুলের দিনে (April Fool’s Day)। প্রকৃতপক্ষে, বইটি মূলত প্রথমে “মহাবিস্ফোরণ
থেকে কৃষ্ণগহ্বর: সময়ের একটি ছোট ইতিহাস” (From the Big Bang to Black Holes: A Short
History of Time)
নামে নামকরণ করা হয়েছিলো। শিরোনাম ছোট করা হলো এবং “সংক্ষিপ্ত”
হিসেবে পরিবর্তিত করা হয়েছে,
এবং বাকিটা ইতিহাস।
আমি কখনোই ‘কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’ এতো
ভালো চলবে বলে প্রত্যাশা করি নি। নিঃসন্দেহে, আমার অক্ষমতা সত্ত্বে-ও একজন
সর্বাধিক-বিক্রিত লেখক এবং একজন তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী হয়ে ওঠার গল্পের প্রতি
সবার মানবিক-আগ্রহ সাহায্য করেছে। সবাই হয়তো বইটি পুরো শেষ করে নি কিংবা তারা যা
পড়েছে তা পুরোটা বুঝতে পারে নি, কিন্তু তারা আমাদের অস্তিত্বের একটি বড় প্রশ্নের
সাথে জড়িয়ে পড়েছে এবং এই ধারণা পেয়েছে যে আমরা যুক্তিসঙ্গত নিয়ম সূত্র দ্বারা পরিচালিত
একটি মহাবিশ্বে বাস করি, যেগুলো আমরা বিজ্ঞানের মাধ্যমে আবিষ্কার করতে এবং বুঝতে
পারি।
আমার সহকর্মীদের কাছে আমি মাত্র আরেকজন
পদার্থবিজ্ঞানী, কিন্তু জনসাধারণের কাছে আমি সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে সুপরিচিত
বিজ্ঞানী হয়ে উঠেছি। এটি আংশিকভাবে কারণ, আইনস্টাইন ব্যতীত, বিজ্ঞানীরা সাধারণত এতো
জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন না, এবং আংশিকভাবে আমি এক অক্ষম প্রতিভাধরের বাঁধাধরা চিত্রের
সাথে মানাই। আমি নিজেকে পরচুলা আর কালো চশমা দিয়ে ছদ্মবেশী সাজাতে পারবো না-
চাকাচেয়ার আমাকে সহজে চিহ্নিত করতে সাহায্য করে ফেলে। সুপরিচিত হওয়া এবং সহজেই চিনতে
পারার ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দিক আছে, কিন্তু ইতিবাচক দিকগুলো নেতিবাচক দিকগুলোর
চেয়ে বেশি। লোকজন আমাকে দেখে সত্যি সত্যি খুশি হয় মনে হয়। ২০১২ সালে লন্ডনে যখন
আমি প্যারালিমপিক খেলার (Paralympic
games) উদ্ধোধন করি তখন আমি আমার সবচেয়ে বিশাল দর্শক পেয়েছি।
*
আমি এই গ্রহে এক অসাধারণ জীবন কাটিয়েছি, একই
সাথে আমার মন এবং পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রাবলি ব্যবহার করে মহাবিশ্ব জুড়ে ভ্রমণ
করেছি। আমি আমাদের ছায়াপথের সবচেয়ে দূরবর্তী জায়গায় গিয়েছি, একটি কৃষ্ণগহ্বরে
ভ্রমণ করেছি, এবং সময়ের সূচনাতে ফিরে গিয়েছি। পৃথিবীতে, আমি তুঙ্গ এবং অনুচ্চ
অবস্থা, অশান্তি এবং শান্তি, সাফল্য এবং কষ্ট ভোগ করেছি। আমি ধনী এবং গরিব থেকেছি,
আমি সক্ষম-শরীরের এবং অক্ষম হয়েছি। আমি প্রশংসা পেয়েছি এবং সমালোচিত হয়েছি, কিন্তু
কখনো উপেক্ষিত হই
নি। আমি অতিশয় সুবিধে পেয়েছি, আমার কাজের মাধ্যমে, আমাদের মহাবিশ্বকে বোঝার
ক্ষেত্রে অবদান রাখতে। কিন্তু আমি যে মানুষদের ভালোবাসি এবং যারা আমাকে ভালোবাসে
তাদের ছাড়া এটি একটি শূন্য মহাবিশ্ব হবে। তাদের ছাড়া, এইসব কিছুর বিস্ময় হারিয়ে যাবে।
এবং এই সবের শেষে, এটি সত্য যে আমরা মানুষেরা, আমরা
নিজেরাই যে কেবলমাত্র প্রকৃতির মৌলিক কণাগুলোর সমষ্টি, আমাদের মহাবিশ্ব এবং একে
পরিচালনাকারী নিয়ম সূত্রাবলি বোঝার কাছাকাছি আসতে সক্ষম হয়েছি, সেটি একটি মহান
বিজয়। আমি এই বড়
প্রশ্নগুলো সম্পর্কে আমার উত্তেজনা এবং সেগুলোর অনুসন্ধানে আমার উদ্যম ভাগ করে
নিতে চাই।
একদিন, আমি আশা করি আমরা এই সব প্রশ্নগুলোর
উত্তর জানতে পারবো। কিন্তু অন্যান্য অনেক সমস্যা আছে, এই গ্রহের অন্যান্য বড়
প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে হবে, এবং এর জন্য প্রয়োজন এক নতুন প্রজন্মের, যারা আগ্রহী এবং জড়িত, এবং
যাদের বিজ্ঞান সম্পর্কে ধারণা আছে। কীভাবে আমরা ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যাকে খাওয়াবো?
পরিষ্কার পানি সরবরাহ করবো, নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপন্ন করবো, রোগ প্রতিরোধ এবং
নিরাময় করবো, এবং বৈশ্বিক জয়বায়ু পরিবর্তনের গতি কমিয়ে আনবো? আমি আশা করি বিজ্ঞান
এবং প্রযুক্তি এই প্রশ্নগুলোর উত্তর যোগাবে, কিন্তু এই সমাধানগুলো বাস্তবায়নের
জন্য প্রয়োজন মানুষের, জ্ঞানী এবং বুঝদার মানুষ। এসো সংগ্রাম করি যেনো প্রত্যেক নারী
এবং প্রত্যেক পুরুষ সুস্থ, সুরক্ষিত জীবন, সুযোগ এবং ভালোবাসায় পূর্ণ জীবন যাপনের
সুযোগ পায়। আমরা সবাই সময়
ভ্রমণকারী, ভবিষ্যতের দিকে একসাথে যাত্রা করছি। কিন্তু এসো এমন ভবিষ্যত বানাতে এক
সাথে কাজ করি যেখানে আমরা যেতে চাই।
সাহসী হোন, কৌতূহলী হোন, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হোন,
প্রতিকূলতাকে পরাস্ত করুন। এটি করা সম্ভব।
যখন ছোট ছিলেন তখন আপনার স্বপ্ন কী ছিলো,
এবং সেটি কি সত্যি হয়েছে?
আমি একজন মহান
বিজ্ঞানী হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু যখন ইস্কুলে ছিলাম তখন আমি খুব ভালো ছাত্র ছিলাম
না, এবং আমার শ্রেণীর অর্ধেকের-ও কমই ছিলাম। আমার কাজ ছিলো অগোছালো, এবং আমার
হাতের লেখা খুব ভালো ছিলো না। কিন্তু ইস্কুলে আমার ভালো বন্ধু ছিলো। এবং আমরা সবকিছু নিয়ে কথা
বলতাম, এবং বিশেষভাবে, মহাবিশ্বের উৎস নিয়ে। এভাবেই আমার স্বপ্নের শুরু, এবং আমি
খুব ভাগ্যবান যে এটি সত্যি হয়েছে।
I have learn a few just right stuff here.
ReplyDeleteDefinitely worth bookmarking for revisiting. I wonder how much attempt you put to make
any such magnificent informative site.
Awesome blog! Do you have any helpful hints for aspiring writers?
ReplyDeleteI'm planning to start my own website soon but I'm a little lost on everything.
Would you recommend starting with a free platform like Wordpress or go for a paid option? There
are so many choices out there that I'm completely confused ..
Any recommendations? Kudos!