ভূমিকা
প্রফেসর কিপ এস. থ্রোন
স্টিফেন হকিঙের সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিলো
১৯৬৫-এর জুলাইয়ে ইংল্যান্ডের লন্ডনে, সাধারণ আপেক্ষিকতা (General Relativity) এবং
মহাকর্ষের উপরে একটি সম্মেলনে। স্টিফেন তখন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে তার পিএইচডি
করছিলো; আমি সবে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেরটি শেষ করেছিলাম। সম্মেলনের
হলসমূহের চারপাশে গুজব ছড়িয়ে পড়েছিলো যে স্টিফেন অকাট্য যুক্তি প্রস্তুত করেছিলেন
যে আমাদের মহাবিশ্ব একটি নির্দিষ্ট সময়ে জন্মগ্রহণ করেছে। এটি অসীম রকমের পুরানো
হতে পারে না।
প্রায় অন্যান্য ১০০ লোকের সাথে, আমি
স্টিফেনের বক্তব্য শোনার জন্য মোটামুটি চল্লিশজনের জায়গা হবে এমন কামরায় গাথাগাথি করে ঢুকলাম। তিনি একটি ছড়ির
সাহায্য নিয়ে হাঁটছিলেন এবং তার গলা কিছুটা অস্পষ্ট, এছাড়া বছর দুয়েক আগে ধরা পড়া
মোটর স্নায়ুকোষের রোগের মাত্র কয়েকটি লক্ষণ দেখিয়েছিলেন। তার মনন মেধা স্পষ্টভাবে অপ্রভাবিত
ছিলো। তার সুষ্পষ্ট যুক্তি আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার সমীকরণ ও আমাদের
মহাবিশ্ব যে সম্প্রসারিত হচ্ছে সেই ব্যাপারে জ্যোতির্বিজ্ঞানিদের পর্যবেক্ষণ, এবং বাস্তব মনে হওয়ার সম্ভাবনাই
বেশি এমন কিছু সাধারণ অনুমানের উপর নির্ভর করেছিলো, আর রজার পেন্রোসের (Roger Penrose) পরিকল্পিত
কিছু নতুন গাণিতিক কৌশল ব্যবহার করেছিলো। এইসব উপায় ও
কৌশলকে একত্রে ব্যবহার
করা ছিলো চতুর, শক্তিশালী ও অকাট্য ব্যাপার, এবং স্টিফেনের উপসংহার ছিলো: আমাদের মহাবিশ্ব প্রায়
১০ বিলিয়ন বছর আগে অবশ্যই কিছুটা একক অবস্থা (singular state) থেকে শুরু হয়েছিলো। (পরবর্তী দশকে, স্টিফেন এবং রজার, যৌথভাবে, আরো
অকাট্যভাবে সময়ের এই একক সূচনা প্রমাণ করতে লেগেছিলো, এবং আরো অকাট্যভাবে প্রমাণ
করেছিলো যে প্রতিটি কৃষ্ণগহ্বরের কেন্দ্র বা মর্মস্থল একটি এককত্ব (singularity) দ্বারা অধ্যুষিত, যেখানে সময় শেষ হয়।)
আমি স্টিফেনের ১৯৬৫ সালের বক্তৃতা থেকে
অতিশয় প্রভাবিত হয়ে বের হয়েছিলাম। শুধুমাত্র তার যুক্তি এবং উপসংহারের কারণেই নয়, কিন্তু
আরো গুরুত্বপূর্ণভাবে তার অন্তর্দৃষ্টি এবং সৃজনশীলতার কারণে। তাই আমি তাকে খুঁজে
বের করলাম এবং এক ঘণ্টা তার সাথে একান্তে কথা বললাম। সেটি ছিলো জীবনব্যাপী এক
বন্ধুত্বের সূচনা, যে বন্ধুত্বতা শুধুমাত্র বিজ্ঞানে পারস্পরিক আগ্রহের উপর ভিত্তি
করে নয়, বরং এক অসাধারণ পারস্পরিক সহানুভুতি, পরস্পরকে মানুষের মতো করে বোঝার এক
ভূতুড়ে ক্ষমতার উপর
ভিত্তি করে। শীঘ্রই আমরা
বিজ্ঞানের চেয়ে আমাদের জীবন,
ভালোবাসা, এবং মৃত্যু নিয়ে বেশি কথা বলতে লাগলাম, যদিও আমাদের বিজ্ঞান তখন-ও ছিলো
আমাদের একত্রিত ধরে রাখার আঠা।
১৯৭৩ -এর সেপ্টেম্বরে আমি স্টিফেন এবং
তার স্ত্রী জেনকে রাশিয়ার মস্কোতে নিয়ে গেলাম। ঠাণ্ডা যুদ্ধের (cold war) ক্রোধ
সত্ত্বে-ও, আমি এক মাস বা তার-ও বেশি সময় মস্কোতে কাটাচ্ছিলাম, ইয়াকভ বরিসোভিচ যেলদোভিচ
(Yakov Borisovich Zel’dovich) এর নেতৃত্বে পরিচালিত একটি গবেষক দলের সাথে গবেষণার জন্য একত্রে কাজ
করছিলাম। যেলদোভিচ ছিলেন
একজন চমৎকার জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী (astrophysicist), এবং সোভিয়েত হাইড্রোজেন বোমার একজন জনক। পারমাণবিক বিষয়ে তার
অন্ধিসন্ধির কারণে পশ্চিম ইউরোপ অথবা আমেরিকাতে তার ভ্রমণ নিষিদ্ধ ছিলো। তিনি
স্টিফেনের সাথে আলোচনার জন্য উন্মুখ হয়েছিলেন; যেহেতু তিনি স্টিফেনের কাছে যেতে
পারতেন না তাই আমরা তার কাছে গিয়েছিলাম।
স্টিফেন মস্কোতে যেলদোভিচ এবং অন্যান্য আরো
কয়েক শত বিজ্ঞানীকে তার অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে অভিভূত করেছিলো, এবং বিনিময়ে স্টিফেন
যেলদোভিচ থেকে দুয়েকটি জিনিস শিখেছিলো। সবচেয়ে স্মরণীয় হচ্ছে স্টিফেন এবং আমি
রোশিয়া (Rossiya) হোটেলে স্টিফেনের কামরায় এক সাথে একটি বিকেল কাটিয়েছিলাম যেলদোভিচ এবং
তার পিএইচডি শিক্ষার্থী অ্যালেক্সিই স্টারোবিনস্কির (Alexei Starobinsky) সাথে। যেলদোভিচ তাদের একটি অনন্য আবিষ্কার স্বজ্ঞামূলকভাবে ব্যাখ্যা
করেছিলেন, এবং স্টারোবিনস্কি গাণিতিকভাবে সেটি ব্যাখ্যা করেছিলেন।
একটি কৃষ্ণগহ্বরের ঘূর্ণনে শক্তির প্রয়োজন।
আমরা ইতিমধ্যে এটা জানতাম। একটি কৃষ্ণগহ্বর, তারা ব্যাখ্যা করেছিলেন, কণা তৈরি
করতে এটির ঘূর্ণনের শক্তি ব্যবহার করতে পারে, এবং এই কণাগুলো ঘূর্ণনের শক্তি সাথে
নিয়ে দূরে উড়ে যাবে। এই অংশ ছিলো নতুন এবং বিস্ময়কর- তবে খুব বেশি বিস্ময়কর নয়।
যখন একটি বস্তুর গতিশক্তি থাকে, প্রকৃতি সাধারণত একটি উপায় খুঁজে বের করে এই
শক্তিকে বের করে আনতে (extract)। আমরা ইতিমধ্যেই জানতাম একটি কৃষ্ণগহ্বরের ঘূর্ণনের শক্তি বের করে আনার অন্যান্য
উপায় সম্পর্কে, তবে
তাদের ব্যাখ্যা ছিলো একটি নতুন অপ্রত্যাশিত উপায়।
এই ধরণের কথোপকথনের দুর্দান্ত মূল্য হচ্ছে
যে এই কথোপকথন চিন্তার নতুন দিক উন্মোচিত করতে পারে। এই ব্যাখ্যা স্টিফেনের মনে
গেঁথে গেলো। পরবর্তী কয়েক মাস ধরে সে যেলদোভিচ/স্টারোবিনস্কির আবিষ্কার ভেবে
চিন্তে দেখতে লাগলো, একবার এই দিক থেকে, অন্যবার অন্য দিক থেকে, এভাবে একদিন এটি
স্টিফেনের মনে এক সত্যিকারের আমূল অন্তর্দৃষ্টি আলোড়িত করেছিলো: একটি কৃষ্ণগহ্বর থেমে
যাওয়ার পরে-ও সেটি কণা নির্গত করতে পারবে। এটি বিকিরণ করতে পারবে- এবং এমনভাবে
বিকিরণ হবে যেনো মনে হয় যে কৃষ্ণগহ্বরটি গরম, সূর্যের মতো, যদিও খুব গরম নয়, শুধু
হালকা গরম। একটি কৃষ্ণগহ্বর যতো ভারী, এর তাপমাত্রা ততো কম। সূর্যের মতন ভারী একটি কৃষ্ণগহ্বরের তাপমাত্রা হচ্ছে ০.০০০০০০০৬ কেলভিন, পরম শূন্যের (absolute zero)
এক ডিগ্রী বেশি তাপমাত্রার ০.০৬ মিলিয়নতম (millionths)
তাপমাত্রা। এই তাপমাত্রা গণনা করার সূত্রটি লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে
স্টিফেনের সমাধীর শীর্ষদেশের পাথরে খোদাই করা আছে, যেখানে তার ছাই নিউটন এবং
চার্লস ডারউইনের মাঝখানে সমাধিত
রয়েছে।
একটি কৃষ্ণগহ্বরের এই “হকিং
তাপমাত্রা” (Hawking
temperature ) এবং এই “হকিং বিকিরণ” (Hawking radiation) (এই
নামেই নামকরণ করা হয়েছে) ছিলো সত্যিকার অর্থেই ভিত্তিগত- সম্ভবত বিংশ শতাব্দীর
দ্বিতীয়ার্ধে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম মৌলিক আবিষ্কার। এগুলো সাধারণ
আপেক্ষিকতা (কৃষ্ণগহ্বর), তাপগতিবিজ্ঞান (তাপের পদার্থবিজ্ঞান) এবং কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের
(কোনো কিছু না থাকা থেকে কণা সৃষ্টি হওয়া) মধ্যকার গভীর সম্পর্ক আমাদের সামনে তুলে
ধরেছিলো। যেমন, এর ফলে স্টিফেন প্রমাণ করতে পেরেছিলো যে কৃষ্ণগহ্বরের বিশৃঙ্খলা-মাত্রা
(এনট্রপি; entropy) রয়েছে, যার মানে হচ্ছে যে কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে বা এর আশপাশে কোথাও
প্রচুর বিশৃঙ্খলা বা বিক্ষিপ্ততা (randomness) আছে। সে যুক্তির সাহায্যে উপনীত হয়েছিলো যে বিশৃঙ্খলা-মাত্রার পরিমাণ
(একটি কৃষ্ণগহ্বরের বিশৃঙ্খলতার পরিমাণের লগারিদম) কৃষগহ্বরের পৃষ্ঠভূমির
সমানুপাতিক। বিশৃঙ্খলা-মাত্রার এই সমীকরণ কেমব্রিজের গনভিল এবং কাইয়াস কলেজে (যেখানে স্টিফেন কাজ
করতো) স্টিফেনের স্মৃতিস্তম্ভের উপরে খোদাই করা আছে।
গত পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে, স্টিফেন এবং শত শত
অন্যান্য পদার্থবিজ্ঞানী কৃষ্ণগহ্বরের বিশৃঙ্খলতার সুনির্দিষ্ট প্রকৃতি বোঝার জন্য
সংগ্রাম করছেন। এই প্রশ্নটি সাধারণ আপেক্ষিকতার সাথে কোয়ান্টাম তত্ত্বের
যোগসূত্রের ব্যাপারে নতুন অন্তর্দৃষ্টি বা ধারণা তৈরি করে যাচ্ছে-অর্থাৎ, কোয়ান্টাম
মাধ্যাকর্ষণের অস্পষ্ট-বোধগম্য সূত্র সম্পর্কে।
১৯৭৪ সালের শরৎকালে স্টিফেন তার পিএইচডি
শিক্ষার্থীদের এবং তার পরিবার (তার স্ত্রী জেন এবং তাদের দুই সন্তান রবার্ট এবং
লুসি) নিয়ে এসেছিলো এক বছরের জন্য ক্যার্লিফোর্নিয়ার প্যাসাডেনাতে, যাতে সে এবং
তার শিক্ষার্থীরা আমার বিশ্ববিদ্যালয়, ক্যালটেকের বুদ্ধিজীবী জীবনে অংশগ্রহণ করতে
পারে, এবং আমার গবেষণা দলের সাথে সাময়িকভাবে একত্র হতে পারে। এটি ছিলো একটি
মহিমান্বিত বছর, যা চূড়ান্ত সময়ে “কৃষ্ণগহ্বরের গবেষণার সুবর্ণ সময়” নামে পরিচিতি
লাভ করে।
সেই বছরে, স্টিফেন এবং তার শিক্ষার্থীরা এবং
আমার কিছু শিক্ষার্থীরা কৃষ্ণগহ্বরকে গভীরভাবে বুঝতে গিয়ে হোঁচট খাচ্ছিলো, এবং
আমি-ও কিছুটা খাচ্ছিলাম। কিন্তু স্টিফেনের উপস্থিতি, এবং কৃষ্ণগহ্বর গবেষণার জন্য
আমাদের যৌথ দলে তার নেতৃত্ব আমাকে একটি নতুন ব্যাপারে চিন্তা করার স্বাধীনতা
দিয়েছিলো, যা আমি কয়েক বছর ধরে ভাবছিলাম:
মহাকর্ষীয় তরঙ্গ (gravitational waves)।
শুধুমাত্র দুই ধরণের তরঙ্গ আছে যা মহাবিশ্ব
জুড়ে পরিভ্রমণ করতে পারে এবং আমাদের জন্য তথ্য বয়ে আনতে পারে দূরবর্তী জিনিস
সম্পর্কে: তড়িৎচুম্বকীয়
তরঙ্গ (যাতে অন্তর্ভুক্ত আছে আলো, এক্স-রশ্মি, গামা রশ্মি, অণুতরঙ্গ, বেতার তরঙ্গ…), এবং
মহাকর্ষীয় তরঙ্গ।
তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ দোলায়মান বৈদ্যুতিক এবং
চৌম্বকীয় বলের সম্মন্বয়ে গঠিত, যা আলোর গতিতে ভ্রমণ করে। যখন তরঙ্গগুলো আধানযুক্ত কণাতে প্রবিষ্ট হয়,
যেমন একটি রেডিও অথবা টিভি অ্যান্টেনাতে ইলেকট্রনের মতন, তখন সেগুলো কণাগুলোকে সামনে পিছনে আন্দোলিত
করে, তরঙ্গগুলো যে তথ্য বহন করে তা
“কণার
কাছে জমা দেয়”।
এই তথ্য এরপর বর্ধিত করা যায় এবং মানুষের বোধগম্যের জন্য একটি লাউডস্পীকার অথবা
টিভির পর্দায় পরিবেশন করা যায়।
আইনস্টাইনের মতে, মহাকর্ষীয় তরঙ্গ দোলায়মান
স্থানিক কুঞ্চণ (oscillatory
space warp) নিয়ে গঠিত: স্থানের একটি
দোলায়মান প্রসারণ এবং সংকোচন। ১৯৭২ সালে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির
রেইনার (রাই) ওয়েইস (Rainer (Rai) Weiss) মহাকর্ষীয়-তরঙ্গ
সনাক্তকরক (detector) আবিষ্কার করেছিলেন, যার মধ্যে
এল-আকৃতির (L-shaped) একটি শূন্যস্থানিক (vacuum) নলের ভেতরে কোণে এবং প্রান্তে ঝুলন্ত আয়নাগুলো স্থানের প্রসারণ দ্বারা
এল-আকৃতির কাঠামোর এক পায়া বরাবর পৃথক থাকে এবং স্থানের সংকোচন দ্বারা অন্য পায়া
বরাবর একত্রে থাকে। রাই প্রস্তাব করেছিলেন যে লেজার রশ্মি ব্যবহার করে এই
প্রসারণ ও সংকোচনের দোলায়মান বা আন্দোলনের প্যার্টান পরিমাপ করা যাবে। লেজার রশ্মি
একটি মহাকর্ষীয় তরঙ্গের তথ্য আহরণ করতে পারবে এবং এই সংকেতকে বর্ধিত করে
কম্পিউটারের মাধ্যমে মানুষের জন্য বোধগম্যযোগ্যভাবে
উপস্থাপন করা যাবে।
তড়িৎচুম্বকীয় টেলিস্কোপের (তড়িৎচুম্বকীয়
জ্যোতির্বিজ্ঞান; electromagnetic astronomy) মাধ্যমে মহাবিশ্বের গবেষণা গ্যালিলিও শুরু করেছিলেন, যখন তিনি একটি
ছোট্ট কাঁচীয় টেলিস্কোপ বানিয়েছিলেন এবং বৃহস্পতির দিকে তাক করে আবিষ্কার করেছিলেন
যে বৃহস্পতির চারটি বড় বড় চাঁদ আছে। তখন থেকে ৪০০ বছর ধরে, তড়িৎচুম্বকীয় জ্যোতির্বিজ্ঞান মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের বোঝার ক্ষেত্রে
সম্পূর্ণরূপে বিপ্লব সাধন করেছে।
১৯৭২ সালে আমার শিক্ষার্থীরা এবং আমি চিন্তা
করা শুরু করলাম মহাকর্ষীয় তরঙ্গের মাধ্যমে আমরা মহাবিশ্ব সম্পর্কে কী জানতে পারবো: আমরা মহাকর্ষীয়-তরঙ্গ
জ্যোতির্বিজ্ঞানের জন্য একটি দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে শুরু করলাম। কারণ মহাকর্ষীয়
তরঙ্গ এক ধরণের স্থানিক কুঞ্চণ, যা সেইসব বস্তু থেকে উদ্গত যেগুলো নিজেরাই
সম্পূর্ণরূপে অথবা আংশিকভাবে কুঞ্চিত স্থান-কাল দ্বারা গঠিত, তারমানে, বিশেষ করে,
কৃষ্ণগহ্বর। আমরা উপসংহার টানলাম যে, মহাকর্ষীয় তরঙ্গ হচ্ছে কৃষ্ণগহ্বর সম্পর্কে
স্টিফেনের অন্তর্দৃষ্টি বা ধারণা
অনুসন্ধান এবং পরীক্ষা করার জন্য আদর্শ হাতিয়ার।
আরো সাধারণভাবে, আমাদের মনে হলো যে, মহাকর্ষীয়
তরঙ্গ তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ থেকে আমূলভাবে আলাদা, যা মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের বোঝার
ক্ষেত্রে এক নিজস্ব নতুন বিপ্লব তৈরি করতে পারে এই ব্যাপারে নিশ্চিত বলা যায়, যা গ্যালিলিও
থেকে শুরু করে তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের বিপ্লবের সাথে তুলনাযোগ্য- যদি এই অধরা
তরঙ্গকে সনাক্ত এবং নিরীক্ষণ করা যেতে পারে। কিন্তু এটি ছিলো একটি বড় যদি: আমরা অনুমান করলাম যে পৃথিবীকে
ঘিরে যে মহাকর্ষীয় তরঙ্গগুলো আছে সেগুলো এতো দুর্বল যে রাই ওয়েইসের এল-আকৃতির
বস্তুটির প্রান্তে আয়নাগুলো তরঙ্গের প্রভাবে পরস্পরের কাছ থেকে সামনে পেছনে সরবে
একটি প্রোটিনের ব্যাসার্ধের ১/১০০ ভাগের চেয়ে বেশি নয় (তার মানে, একটি পরমাণুর
আকারের ১/১০০০০০০০ ভাগের এক ভাগ), এমনকি যদি আয়নাগুলো পরস্পরের কয়েক কিলোমিটার
দূরে থাকে। এমন ক্ষুদ্র গতির পরিমাপ ছিলো একটি বিশাল বিপত্তি।
তাই সেই গৌরবময় বছরে, যখন স্টিফেনের এবং
আমার গবেষণা দল ক্যালটেকে একত্রিত হয়েছিলো, আমি আমার সময়ের বড় অংশ ব্যয় করলাম
মহাকর্ষীয়-তরঙ্গের সাফল্যের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখায়। স্টিফেন এই ব্যাপারে সহায়ক
ছিলো, বেশ কয়েক বছরে আগে, সে এবং তার ছাত্র গ্যারি গিবসন তাদের নিজস্ব একটি
মহাকর্ষীয়-তরঙ্গ সনাক্তকরক নকশা করেছিলো (যা তারা কখনো আর বানায় নি)।
স্টিফেনের কেমব্রিজে ফিরে যাওয়ার কিছুকাল
পরেই, আমার অন্বেষণ সফল হলো, ওয়াশিংটন ডিসিতে রাইয়ের হোটেলে রাই ওয়েইসের এবং আমার
সারারাত্তি ধরে তীব্র আলোচনার শেষে। আমি সাফল্যের সম্ভাবনার ব্যাপারে যথেষ্ট
দৃঢ়প্রত্যয়ী হয়েছিলাম
যে ভাবলাম যে আমার উচিত আমার নিজের কর্মজীবন এবং আমার ভবিষ্যত শিক্ষার্থীদের
গবেষণা মনোনিবেশ করা রাই এবং অন্যান্য গবেষকদের আমাদের মহাকর্ষীয়-তরঙ্গ স্বপ্ন
বাস্তবায়নে সহায়তা করে। আর বাকিটা হচ্ছে, তারা যেমন বলে, ইতিহাস।
২০১৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর, লিগো
মহাকর্ষীয়-তরঙ্গ সনাক্তকারকগুলো (LIGO
gravitational-wave detectors) (রাই, আমার, এবং রোনাল্ড
ড্রেভারের যৌথ-অর্থায়নে, এবং ব্যারি ব্যারিশের সংগঠনে, একত্রকরণে, এবং নেতৃত্বে
নির্মিত ১০০০-জনের প্রকল্প) তাদের প্রথম
মহাকর্ষীয় তরঙ্গ নিবন্ধিত করে। এই তরঙ্গ প্যার্টানের সাথে কম্পিউটার সিমুলেশন থেকে
প্রাপ্ত পূর্বাভাস মিলিয়ে, আমাদের দল উপসংহারে পৌঁছেছে যে সেই মহাকর্ষীয় তরঙ্গগুলো
পৃথিবী থেকে ১.৩ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের দুটি ভারী
কৃষ্ণগহ্বরের সংঘর্ষ থেকে উৎপাদিত। আমাদের দল মহাকর্ষীয় তরঙ্গগুলোর জন্য সেই অর্জন করেছিলো, যা গ্যালিলিও
তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের জন্য অর্জন করেছিলেন।
আমি নিশ্চিত যে, আগামী কয়েক দশক ধরে,
মহাকর্ষীয়-তরঙ্গের জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের পরবর্তী প্রজন্ম এই তরঙ্গগুলো ব্যবহার করবে
শুধুমাত্র স্টিফেনের কৃষ্ণগহ্বরের পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র পরীক্ষা করার জন্যই নয়,
বরং আমাদের মহাবিশ্বের একক জন্ম থেকে উদ্ভূত মহাকর্ষীয় তরঙ্গসমূহ সনাক্ত এবং
পর্যবেক্ষণের জন্য-ও,
এবং এইভাবে আমাদের মহাবিশ্ব কীভাবে এসেছে সে সম্পর্কে স্টিফেন এবং অন্যদের
ধারণাগুলো পরীক্ষা করবে।
১৯৭৪-৫ এর গৌরবান্বিত বছরে, যখন আমি মহাকর্ষীয়
তরঙ্গের ব্যাপারে
দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম, এবং স্টিফেন কৃষ্ণগহ্বর গবেষণায় আমাদের একত্রিত দলকে নেতৃত্ব
দিচ্ছিলো, তখন স্টিফেন নিজেই তার হকিং বিকিরণের আবিষ্কারের চেয়ে আরো এক ভিত্তিগত
অন্তর্দৃষ্টি লাভ করেছিলো। সে একটি অকাট্য, প্রায় নিশ্ছিদ্র প্রমাণ দিলো যে যখন
কৃষ্ণগহ্বর গঠিত হয় এবং যখন এটি ক্রমে সম্পূর্ণভাবে উবে (বাষ্পীভূত) যায় বিকিরণ
নির্গত করে, তখন কৃষ্ণগহ্বরে যে তথ্য গিয়েছিলো তা আর ফিরে আসতে পারে না। তথ্য
অবশ্যম্ভাবীভাবে হারিয়ে যায়।
এটি ভিত্তিগত কারণ কোয়ান্টাম
পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রসমূহ সুস্পষ্টভাবে দাবি করে যে তথ্য কখনো পুরোপুরি হারিয়ে
যেতে পারে না। সুতারাং,
যদি স্টিফেন সঠিক হয়ে থাকে, তবে কৃষ্ণগহ্বর কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞানের অন্যতম মৌলিক
নীতি লঙ্ঘন করে।
এটা কীভাবে সম্ভব? কৃষ্ণগহ্বরের উবে যাওয়া
(বাষ্পীভবন) কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞান এবং সাধারণ আপেক্ষিকতা- কোয়ান্টাম মাধ্যাকর্ষণের
অস্পষ্ট-বোধগম্য যৌথ নীতি সূত্র দ্বারা পরিচালিত হয়, এবং তাই, স্টিফেন যুক্তি দিলো
যে, কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞান এবং আপেক্ষিকতার অগ্নিসদৃশ মেলবন্ধনের ফলে তথ্য ধ্বংস হয়ে
যায়।
অধিকাংশ তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানিরা এই
উপসংহারকে জঘন্য মনে করে। তারা এই ব্যাপারে অত্যন্ত সন্দেহপ্রবণ। ফলে, চুয়াল্লিশ
বছর ধরে তারা এই তথাকথিত তথ্য-বিনাশ
আপার্তবৈপরীতা (information-loss
paradox) নিয়ে বিপদে আছেন। এই সংগ্রাম এর
পেছনের প্রচেষ্টা এবং যন্ত্রণার দাবি রাখে, কারণ এই আপার্তবৈপরীতা কোয়ান্টাম মাধ্যাকর্ষণ নিয়মনীতি
বোঝার ক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী চাবিকাঠি। স্বয়ং স্টিফেন ২০০৩ সালে কীভাবে
কৃষ্ণগহ্বর থেকে তথ্য মুক্তি পেতে পারে তার একটি উপায় বের করে, তবে তাত্ত্বিকরা
খুব একটা প্রশমিত হয় নি। স্টিফেন প্রমাণ করে নি তথ্য পালিয়ে যাচ্ছে বা মুক্তি
পাচ্ছে, ফলে উপায় খোঁজার সংগ্রাম চলতে থাকে।
স্টিফেনের জন্য আমার স্তুতিবক্তব্যে,
ওয়েস্টমিনস্টারে তার ছাইয়ের সমাধি-ক্রিয়ার সময়ে, আমি এই সংগ্রামকে এইভাবে স্মরণ
করেছিলাম: “নিউটন
আমাদের উত্তরে দিয়েছিলেন। হকিং আমাদের প্রশ্ন দিয়েছেন। এবং হকিংয়ের প্রশ্নসমূহ
নিজেরাই কয়েক দশক পরে-ও
সাফল্য বয়ে আনছে। যখন আমরা অবশেষে কোয়ান্টাম মাধ্যাকর্ষণের নিয়মনীতি আয়ত্ত করতে
পারবো, এবং মহাবিশ্বের সূচনা সম্পূর্ণরূপে বুঝতে পারবো, সেটি মূলত হকিংয়ের কাঁধে
ভর করে সম্ভব হবে।”
আমাদের গৌরবান্বিত ১৯৭৪-৫ বছর যেমন ছিলো
আমার মহাকর্ষীয়-তরঙ্গ সন্ধানের সূচনা, তেমনি সেটি ছিলো কোয়ান্টাম মাধ্যকর্ষণের
নিয়মনীতি বিস্তারিতভাবে বোঝার জন্য, এবং সেই নিয়মনীতিগুলো কৃষ্ণগহ্বরের তথ্য এবং
বিশৃঙ্খলা-মাত্রার আসল প্রকৃতি সম্পর্কে কী বলে, এবং আমাদের মহাবিশ্বের একক সূচনার
আসল প্রকৃতি, কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে এককত্বের আসল প্রকৃতি- সময়ের জন্ম এবং মৃত্যুর
আসল প্রকৃতি বোঝার ক্ষেত্রে স্টিফেনের সন্ধানের সূচনা।
এগুলো বড় প্রশ্ন। অনেক বড়।
আমি বড় প্রশ্ন করা থেকে দূরে সরে গেছি।
সেগুলো মোকাবেলা করার জন্য আমার যথেষ্ট দক্ষতা, বিজ্ঞতা বা আত্মবিশ্বাস নেই।
অন্যদিকে, স্টিফেন সর্বদা বড় প্রশ্নে আকৃষ্ট ছিলো, এমনি সেগুলো তার বিজ্ঞানে
গভীরভাবে জড়িত ছিলো অথবা না-ছিলো না কেনো। তার প্রয়োজনীয় দক্ষতা, বিজ্ঞতা, এবং আত্মবিশ্বাস ছিলো।
এই বইটি বড় বড় প্রশ্নের জন্য তার উত্তরগুলোর
একটি সংকলন, যে উত্তরের উপর সে তার মৃত্যুর সময়ে-ও কাজ করছিলো।
প্রশ্নগুলোর ছয়টির ক্ষেত্রে স্টিফেনের উত্তর
তার বিজ্ঞানে গভীরভাবে শিকড় গাড়া। (ঈশ্বর কি আছেন? সবকিছুর শুরু কীভাবে? আমরা কি
ভবিষ্যত পূর্বাভাস করতে পারি? কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে কী? সময় পরিভ্রমণ সম্ভব? আমরা
কীভাবে ভবিষ্যতকে গড়তে পারি?)। এই বইয়ে
আপনি এই ভূমিকাতে আমি যে বিষয়গুলো সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করেছি সেগুলো এবং অন্যান্য
অনেক কিছুর উপরে তাকে গভীর আলোচনায় পাবেন।
অন্য চারটি বড় প্রশ্নের ব্যাপারে তার উত্তর
পুরোপুরিভাবে তার বিজ্ঞানে শিকড় গাড়া নয়। (আমরা কি পৃথিবীতে টিকে থাকবো? মহাবিশ্বে
কি অন্য কোনো বুদ্ধিমান প্রাণ আছে? আমাদের উচিত মহাকাশে উপনিবেশ স্থাপন করা?
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি আমাদের ছাড়িয়ে যাবে?)। তবুও, তার উত্তরগুলো গভীর বিজ্ঞতা
এবং সৃজনশীলতা তুলে ধরে, যেমনটি আমরা আশা করি।
আমি আশা করছি আপনি তার উত্তরগুলোকে আমার মতো
উদ্দীপক এবং অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ হিসেবে পাবেন। উপভোগ করুন!
কিপ এস. থ্রন
জুলাই ২০১৮
No comments:
Post a Comment