রামপাল প্রকল্পের বিরুদ্ধে জনগণ ও পরিবেশবাদীদের আয়োজিত শান্তিপূর্ণ নিরীহ সাইকেল মিছিলে হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ ও পুলিশ। অথচ পুরো মিছিলটি ছিলো শান্তিপূর্ণ, পুলিশের হামলা চালানো রামপাল প্রকল্প বিষয়ে সরকারের কর্তৃত্বপরায়ণ মনোভাবকে তুলে ধরে। ছাত্রলীগ একটি রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠন, তারা কেনো এবং কীভাবে পুলিশ সাথে হামলা চালানোর অধিকার পায়? সরকার কি রামপাল প্রকল্পের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ-ও করতে দিবে না?
রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প আমাদের জন্য অর্থনৈতিকভাবে অলাভজনক, এবং ভৌগলিক ও পরিবেশগত দিক থেকে সুন্দরবন ও সংলগ্ন জনপদের জন্য ক্ষতিকর। সম্প্রতি জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেস্কো রামপাল প্রকল্পের ফলে সুন্দরবনের (যা বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী স্থানের একটি এবং ডলফিন ও বাঙলার বাঘসহ অনেক বিপন্ন প্রাণীর বাসস্থান) ক্ষতি হতে পারে ফলে উদ্বেগ প্রকাশ করে এই প্রকল্প সুন্দরবনের পাশে না করার জন্য বাঙলাদেশ সরকারকে সুপারিশ করেছে।
ইউনেস্কোর বিবৃতি কিন্তু মংলা বন্দর, পদ্মা সেতু কিংবা মংলা বন্দর কেন্দ্রিক শিল্পায়নের বিরুদ্ধে নয়, বরং এগুলোকে কেন্দ্র করে শিল্পায়নের নামে সরকারের যত্রতত্র পরিবেশ বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে সতর্ক বিবৃতি। ইউনেস্কো সুন্দরবন এলাকায় রামপাল প্রকল্প স্থাপনের বিরুদ্ধে সরকারকে চিঠি দিয়েছে, ইউনেস্কোর বক্তব্যকে বিকৃত করে অনেকে ইউনেস্কো ও রামপাল প্রকল্পের প্রতিবাদীদের বিপক্ষে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে চাচ্ছেন।
সরকার বিভিন্ন মাধ্যমে রামপাল প্রকল্পের পক্ষে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে এবং অনেকে এই প্রকল্পের পক্ষে-ও লিখছেন। তবে এইসব বিজ্ঞাপন ও লেখনীতে অনেক কুযুক্তি ও ভুল তথ্য আছে, যা মূলত প্রকল্পের বিপর্যয়-বিষয় ব্যাপারগুলোকে হালকা করে দেখানোর চেষ্টা এবং ভুল তথ্য দিয়ে জনগণকে প্রভাবিত করার চেষ্টা।
২
রামপাল প্রকল্প পরিবেশগত দিক থেকে ভয়ংকর যেহেতু এটি কয়লাভিত্তিক; সবচেয়ে সহজলভ্য ও সস্তা জ্বালানি-উৎস হিসেবে কয়লা অনেক দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়, কিন্তু অধিকাংশ দেশ ক্রমে পুরাতন কেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দিচ্ছে (পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্যের উপর এর প্রভাবের কথা বিবেচনা করে) অথবা দূষণ কমানোর জন্য বিভিন্ন প্রযুক্তির সাহায্য নিচ্ছে, এবং নতুন কেন্দ্র স্থাপনে বিধিনিষেধ জারি অথবা কঠোর সমীক্ষা করছে অথবা অনুমতি দিচ্ছে না; সেই তুলনায় আমাদের দেশে হচ্ছে উল্টো। অনেকে বলছেন যে ভারত, চীন ইত্যাদি দেশে কয়লাভিত্তিক প্রকল্প আছে, আমরা করলে সমস্যা কী? অন্যান্য দেশে এইসব প্রকল্প হয়েছে ২০-৩০ বছর আগে, যখন কয়লাভিত্তিক পরিবেশ বিপর্যয় সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান ছিলো আর-ও সীমিত। বর্তমানে এইসব দেশে ক্রমান্বয়ে পুরাতন কেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে বা মেরামত করা হচ্ছে না, এবং নিত্য নতুন প্রকল্প চালুতে কঠোর আইন মানতে হয়। ভারত এবং চীন ভুল সিদ্ধান্ত নিলেই যে আমাদের একই সিদ্ধান্ত নিতে হবে এটি মূলত কুযুক্তি।
এছাড়া, সারাবিশ্ব ক্রমে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছে; আধুনিক প্রযুক্তির কারণে নবায়নযোগ্য শক্তি অনেক সহজলভ্য ও সস্তা; নবায়নযোগ্য শক্তির জন্য দরকার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও দূরদর্শিতা, যা আমাদের দেশের অনেক প্রকল্পে পাওয়া যায় না।
অন্যান্য দেশের মতো ভারত সরকার-ও কয়লাভিত্তিক প্রকল্পের অনুমোদন দিচ্ছে না, দিলে-ও তা বন্ধ করে দিচ্ছে। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে পানির অভাব (কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রচুর পানির প্রয়োজন পড়ে), এবং পরিবেশের কথা। যেমন, ভারত সরকার ১০ জুন, ২০১৬ তারিখে চারটি প্রদেশে পূর্বপরিকল্পিত ও অনুমোদিত (Chhattisgarh, Karnataka, Maharashtra এবং Odisha) কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থগিত করে পরিবেশ-বান্ধব নয় বলে (ও জনমত কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বিপক্ষে), এবং জ্বালানি কাজে কয়লার ব্যবহার কমিয়ে আনার জন্য। এছাড়া চীন ক্রমে পারমাণবিক জ্বালানির দিকে ঝুঁকছে এবং কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ-কেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দিচ্ছে। এছাড়া, বুশ ও ওবামা সরকার আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র জাত দূষণ কমানোর জন্য গত দেড় দশকে প্রায় ১.৪ বিলিয়ন ডলার খরচ করলে-ও কোনো উল্লেখযোগ্য লাভ হয়নি; ফলে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র পরিবেশ সমীক্ষা কমিটির সুপারিশ অনুসারে পুরাতন কেন্দ্রগুলোর যন্ত্রাংশ হালনাগাদ করছে, নতুন কেন্দ্র স্থাপনে উৎসাহী নয় ও নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসের দিকে ঝুঁকছে।তাই সরকারি বুদ্ধিজীবীরা যখন বলেন যে ভারত ও চীন ইত্যাদি দেশ কয়লাভিত্তিক প্রকল্প করছে তখন তারা মূলত ভুল তথ্য দিয়ে সহানুভূতি কুড়ানোর চেষ্টা করছেন। সার্বিকভাবে বিবেচনা করলে (দ্বিগুণ দামে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও ক্রয়; জনমতের বিরুদ্ধে; সুন্দরবনের মতো সংবেদনশীল ম্যানগ্রোভ বনের ক্ষতির সম্ভাবনা; মানবস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ইত্যাদি) প্রতীয়মান হয় যে শুধুমাত্র নিজেদের আখের গোছানো ও রাজনৈতিক কারণে সরকার রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য এতো বেশি তৎপর। পৃথিবীর যাবতীয় কয়লা মওজুদের৭% আছে ভারতে। ভারত যদি নিজেদের পরিবেশ ও মানবসম্পদের জন্য কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র না বানায় তবে এই কয়লা রপ্তানি করতে পারে অবলীলায়। যদিও বাঙলাদেশ সরকার বলছে যে ভারত থেকে কয়লা আমদানি করবে না কিন্তু প্রকল্প চালু হলে এই কথার কতটা মানা হবে তা নিয়ে সংশয় আছে। ভারতে প্রাপ্ত কয়লার মান অনেক কম, যা অধিক পরিমাণে ছাই ও কার্বন-ডাই-অক্সাইডসহ ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ নির্গত করে বেশি (পরিশোধিত কয়লার তুলনায়)।
রামপাল প্রকল্পের পক্ষের লোকেরা সুপারিশ করে থাকেন যে রামপাল প্রকল্পে সুপারক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহৃত হবে যা পরিবেশ দূষণ কমাবে। এটি কিন্তু সত্য নয়, রামপালে যে প্রযুক্তি ব্যবহৃত হবে তা পুরাতন, কয়লাভিত্তিক প্রকল্পে ফিল্টারিঙের জন্য আধুনিক প্রযুক্তি হচ্ছে আলট্রা-সুপারক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি।সুপারক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহার করলে রামপাল প্রকল্প থেকে প্রচুর কার্বন-ডাই-অক্সাইড উৎপন্ন হবে এবং নির্গত পানি নদী ও সমুদ্রে প্রাণী বা মাছের মৃত্যুর কারণ হবে যেহেতু এই পানি দূষিত হবে। কয়লা-কেন্দ্রিক দূষণ কমানোর প্রযুক্তি থাকলে-ও (কিন্তু কিছু দূষণ সব সময়েই হবে) সেইসব প্রযুক্তি এতো বেশি ব্যয়বহুল ও এর জন্য যে অবকাঠামোর প্রয়োজন তা বাঙলাদেশের জন্য বহন করা অবাস্তব অথবা সম্ভব নয়। যেমন, উৎপন্ন কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে ধরে তা ভূগর্ভস্থ (অথবা সমুদ্রের মাটির নিচে) স্থানে সংরক্ষণ করতে প্রয়োজন হয় একটি কেন্দ্রের উৎপাদিত ৩০% শক্তি, এই শক্তি যেহেতু বাড়তি হিসেবে আসতে হবে তাই আরো বেশি বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে হবে, আরো বেশি বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে গিয়ে আরো বেশি কার্বন-ডাই-অক্সাইড উৎপন্ন হবে; অর্থাৎ পুরো ব্যাপারটি একটি অশুভ চক্রের মতো। এছাড়া, বিভিন্ন ধাতু যেমন মার্কারি, অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থের পরিশোধনের কাঁচামাল (যেমন সালফার-ডাই-অক্সাইড ও নাইট্রোজেন অক্সাইডের) অনেক ব্যয়বহুল, এবং বাঙলাদেশকে এগুলো নিয়মিতভাবে বাড়তিভাবে আমদানি করতে হবে।
৩
প্রকল্পের অবস্থান সুন্দরবনের নিকটে, সুন্দরবন থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরে। সুন্দরবনের সীমা থেকে পার্শ্ববর্তী ১০ কিলোমিটার এলাকা কিন্তু সুন্দরবনের পরিবেশগতভাবে স্পর্শকাতর এলাকা, অর্থাৎ পরিবেশ ও বনাঞ্চল বিষয় গবেষণা মতে এই ১০ কিলোমিটারের মধ্যে শিল্পায়ন করা উচিত নয়। সেই বিচারে রামপাল প্রকল্প মূলত সুন্দরবনের স্পর্শকাতর এলাকা থেকে মাত্র চার কিলোমিটার দূরে! আমাদের দেশের জলবায়ু (যেমন- দীর্ঘ বর্ষা) ও আবহাওয়ার (যেমন- বাতাসের গতিপথ ও বেগ) কথা মনে রেখে বলতে হয় যে রামপাল প্রকল্প সুন্দরবনের ১৪ কিমি দূরে হলে-ও এই কেন্দ্র-উৎপন্ন দূষণ অনায়াসে সুন্দরবনকে ক্ষতি করবে। যেমন, উৎপন্ন ক্ষতিকর গ্যাস ও ক্ষতিকর পদার্থে দূষিত বায়ু রামপালের আকাশে স্থির থাকবে না (রামপালে ব্যবহৃত চিমনিসমূহ অনেক উঁচু), চক্রের কারণে এটি সুন্দরবন ও সংলগ্ন স্থানে গিয়ে অ্যাসিড-রেইন ঝরাবে, এছাড়া দূষিত পদার্থ, ভারী ধাতু নির্গমনের মাধ্যমে নদী ও পানিপথে সুন্দরবনে গিয়ে মিশবে (পৃথিবীতে এমন কোনো সহজলভ্য ও সস্তা প্রযুক্তি নেই যা কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র-জাত দূষণকে পুরোপুরি ফিল্টার করতে পারে); ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে সুন্দরবনের ইকো-সিস্টেমে জল বিশেষ উপাদান, ফলে অন্যান্য ইকো-সিস্টেমের তুলনায় এখানে সহজে দূষণ ছড়িয়ে পড়বে অনেক জায়গায়।
পরিবেশ বিপর্যয়ের ব্যাপারটি একদিনে ঘটে না, বছরের পর বছর ধরে তিল তিল করে ধূমপানে ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার মতো নীরবে ঘটে; যেমন- ১৯৬০ দশকের দিকে লন্ডনে (ইংল্যান্ড) কারখানা স্থাপন ও শিল্পবিপ্লবের কারণে লন্ডনে পরিবেশ দূষিত হয় প্রচুর, পরবর্তীতে এই দূষণ কমানো হলে-ও সাম্প্রতিক কালের অনেক রোগ-বিষয়ক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে যে বর্তমানে (প্রায় ৫০-৬০ বছর পরে) অনেকে যেসব নিউরোডিজেনারিটিভ (স্নায়ুকোষের মৃত্যু বা বিকল্যতার কারণে সৃষ্ট বিভিন্ন রোগ, যেমন, পারকিনসনের রোগ, আলঝেইমারের রোগ ইত্যাদি) রোগে ভুগছেন তাদের অনেকে এই পরিবেশ দূষণের সংস্পর্শে এসেছেন অথবা এই দূষণে বড় হয়েছেন; অর্থাৎ, এই সব পরিবেশ বিপর্যয় প্রভাব ফেলে দীর্ঘমেয়াদে। আজ রামপাল প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে এর প্রভাব পেতে পারেন আগামী ২০-৩০ বছরে।
প্রশ্ন করতে পারেন কেনো আমরা সুন্দরবন এবং এর বিলুপ্ত প্রাণীসহ অন্যান্য প্রাণীকে রক্ষা করতে সচেষ্ট হবো? কারণ সুন্দরবন একটি ঐতিহ্যবাহী স্থান ছাড়া-ও এটি আমাদের দেশের বনাঞ্চল ও প্রাণীবৈচিত্র্যের অন্যতম স্থান। আমাদের দেশে মোট আয়তনের তুলনায় মাত্র ৭% বনাঞ্চল আছে (একটি দেশের মোট আয়তনের২৫% বনাঞ্চল থাকা উচিত), সুন্দরবন ও সংলগ্ন বনাঞ্চল যার বিরাট অংশ, এই সুন্দরবনের ক্ষতি হলে বৈশ্বিকউষ্ণতা ও আবহাওয়া বৈরিতার এই সময়ে বাঙলাদেশ আরো বেশি বন্যা, ঝড় ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত হতে থাকবে। সুন্দরবনের প্রাণীরা ইকো-সিস্টেমেরই অংশ, প্রাণীদের মেরে আপনি বনাঞ্চল পাবেন না, এবং বনাঞ্চল সাফ করে প্রাণীবৈচিত্র্য পাবেন না; কারণ ইকো-সিস্টেমের প্রতিটি উপাদান একে অন্যের উপর নির্ভরশীল।
অন্যান্য দেশের মতো ভারত সরকার-ও কয়লাভিত্তিক প্রকল্পের অনুমোদন দিচ্ছে না, দিলে-ও তা বন্ধ করে দিচ্ছে। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে পানির অভাব (কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রচুর পানির প্রয়োজন পড়ে), এবং পরিবেশের কথা। যেমন, ভারত সরকার ১০ জুন, ২০১৬ তারিখে চারটি প্রদেশে পূর্বপরিকল্পিত ও অনুমোদিত (Chhattisgarh, Karnataka, Maharashtra এবং Odisha) কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থগিত করে পরিবেশ-বান্ধব নয় বলে (ও জনমত কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বিপক্ষে), এবং জ্বালানি কাজে কয়লার ব্যবহার কমিয়ে আনার জন্য। এছাড়া চীন ক্রমে পারমাণবিক জ্বালানির দিকে ঝুঁকছে এবং কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ-কেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দিচ্ছে। এছাড়া, বুশ ও ওবামা সরকার আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র জাত দূষণ কমানোর জন্য গত দেড় দশকে প্রায় ১.৪ বিলিয়ন ডলার খরচ করলে-ও কোনো উল্লেখযোগ্য লাভ হয়নি; ফলে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র পরিবেশ সমীক্ষা কমিটির সুপারিশ অনুসারে পুরাতন কেন্দ্রগুলোর যন্ত্রাংশ হালনাগাদ করছে, নতুন কেন্দ্র স্থাপনে উৎসাহী নয় ও নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসের দিকে ঝুঁকছে।তাই সরকারি বুদ্ধিজীবীরা যখন বলেন যে ভারত ও চীন ইত্যাদি দেশ কয়লাভিত্তিক প্রকল্প করছে তখন তারা মূলত ভুল তথ্য দিয়ে সহানুভূতি কুড়ানোর চেষ্টা করছেন। সার্বিকভাবে বিবেচনা করলে (দ্বিগুণ দামে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও ক্রয়; জনমতের বিরুদ্ধে; সুন্দরবনের মতো সংবেদনশীল ম্যানগ্রোভ বনের ক্ষতির সম্ভাবনা; মানবস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ইত্যাদি) প্রতীয়মান হয় যে শুধুমাত্র নিজেদের আখের গোছানো ও রাজনৈতিক কারণে সরকার রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য এতো বেশি তৎপর। পৃথিবীর যাবতীয় কয়লা মওজুদের৭% আছে ভারতে। ভারত যদি নিজেদের পরিবেশ ও মানবসম্পদের জন্য কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র না বানায় তবে এই কয়লা রপ্তানি করতে পারে অবলীলায়। যদিও বাঙলাদেশ সরকার বলছে যে ভারত থেকে কয়লা আমদানি করবে না কিন্তু প্রকল্প চালু হলে এই কথার কতটা মানা হবে তা নিয়ে সংশয় আছে। ভারতে প্রাপ্ত কয়লার মান অনেক কম, যা অধিক পরিমাণে ছাই ও কার্বন-ডাই-অক্সাইডসহ ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ নির্গত করে বেশি (পরিশোধিত কয়লার তুলনায়)।
রামপাল প্রকল্পের পক্ষের লোকেরা সুপারিশ করে থাকেন যে রামপাল প্রকল্পে সুপারক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহৃত হবে যা পরিবেশ দূষণ কমাবে। এটি কিন্তু সত্য নয়, রামপালে যে প্রযুক্তি ব্যবহৃত হবে তা পুরাতন, কয়লাভিত্তিক প্রকল্পে ফিল্টারিঙের জন্য আধুনিক প্রযুক্তি হচ্ছে আলট্রা-সুপারক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি।সুপারক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহার করলে রামপাল প্রকল্প থেকে প্রচুর কার্বন-ডাই-অক্সাইড উৎপন্ন হবে এবং নির্গত পানি নদী ও সমুদ্রে প্রাণী বা মাছের মৃত্যুর কারণ হবে যেহেতু এই পানি দূষিত হবে। কয়লা-কেন্দ্রিক দূষণ কমানোর প্রযুক্তি থাকলে-ও (কিন্তু কিছু দূষণ সব সময়েই হবে) সেইসব প্রযুক্তি এতো বেশি ব্যয়বহুল ও এর জন্য যে অবকাঠামোর প্রয়োজন তা বাঙলাদেশের জন্য বহন করা অবাস্তব অথবা সম্ভব নয়। যেমন, উৎপন্ন কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে ধরে তা ভূগর্ভস্থ (অথবা সমুদ্রের মাটির নিচে) স্থানে সংরক্ষণ করতে প্রয়োজন হয় একটি কেন্দ্রের উৎপাদিত ৩০% শক্তি, এই শক্তি যেহেতু বাড়তি হিসেবে আসতে হবে তাই আরো বেশি বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে হবে, আরো বেশি বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে গিয়ে আরো বেশি কার্বন-ডাই-অক্সাইড উৎপন্ন হবে; অর্থাৎ পুরো ব্যাপারটি একটি অশুভ চক্রের মতো। এছাড়া, বিভিন্ন ধাতু যেমন মার্কারি, অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থের পরিশোধনের কাঁচামাল (যেমন সালফার-ডাই-অক্সাইড ও নাইট্রোজেন অক্সাইডের) অনেক ব্যয়বহুল, এবং বাঙলাদেশকে এগুলো নিয়মিতভাবে বাড়তিভাবে আমদানি করতে হবে।
৩
প্রকল্পের অবস্থান সুন্দরবনের নিকটে, সুন্দরবন থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরে। সুন্দরবনের সীমা থেকে পার্শ্ববর্তী ১০ কিলোমিটার এলাকা কিন্তু সুন্দরবনের পরিবেশগতভাবে স্পর্শকাতর এলাকা, অর্থাৎ পরিবেশ ও বনাঞ্চল বিষয় গবেষণা মতে এই ১০ কিলোমিটারের মধ্যে শিল্পায়ন করা উচিত নয়। সেই বিচারে রামপাল প্রকল্প মূলত সুন্দরবনের স্পর্শকাতর এলাকা থেকে মাত্র চার কিলোমিটার দূরে! আমাদের দেশের জলবায়ু (যেমন- দীর্ঘ বর্ষা) ও আবহাওয়ার (যেমন- বাতাসের গতিপথ ও বেগ) কথা মনে রেখে বলতে হয় যে রামপাল প্রকল্প সুন্দরবনের ১৪ কিমি দূরে হলে-ও এই কেন্দ্র-উৎপন্ন দূষণ অনায়াসে সুন্দরবনকে ক্ষতি করবে। যেমন, উৎপন্ন ক্ষতিকর গ্যাস ও ক্ষতিকর পদার্থে দূষিত বায়ু রামপালের আকাশে স্থির থাকবে না (রামপালে ব্যবহৃত চিমনিসমূহ অনেক উঁচু), চক্রের কারণে এটি সুন্দরবন ও সংলগ্ন স্থানে গিয়ে অ্যাসিড-রেইন ঝরাবে, এছাড়া দূষিত পদার্থ, ভারী ধাতু নির্গমনের মাধ্যমে নদী ও পানিপথে সুন্দরবনে গিয়ে মিশবে (পৃথিবীতে এমন কোনো সহজলভ্য ও সস্তা প্রযুক্তি নেই যা কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র-জাত দূষণকে পুরোপুরি ফিল্টার করতে পারে); ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে সুন্দরবনের ইকো-সিস্টেমে জল বিশেষ উপাদান, ফলে অন্যান্য ইকো-সিস্টেমের তুলনায় এখানে সহজে দূষণ ছড়িয়ে পড়বে অনেক জায়গায়।
পরিবেশ বিপর্যয়ের ব্যাপারটি একদিনে ঘটে না, বছরের পর বছর ধরে তিল তিল করে ধূমপানে ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার মতো নীরবে ঘটে; যেমন- ১৯৬০ দশকের দিকে লন্ডনে (ইংল্যান্ড) কারখানা স্থাপন ও শিল্পবিপ্লবের কারণে লন্ডনে পরিবেশ দূষিত হয় প্রচুর, পরবর্তীতে এই দূষণ কমানো হলে-ও সাম্প্রতিক কালের অনেক রোগ-বিষয়ক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে যে বর্তমানে (প্রায় ৫০-৬০ বছর পরে) অনেকে যেসব নিউরোডিজেনারিটিভ (স্নায়ুকোষের মৃত্যু বা বিকল্যতার কারণে সৃষ্ট বিভিন্ন রোগ, যেমন, পারকিনসনের রোগ, আলঝেইমারের রোগ ইত্যাদি) রোগে ভুগছেন তাদের অনেকে এই পরিবেশ দূষণের সংস্পর্শে এসেছেন অথবা এই দূষণে বড় হয়েছেন; অর্থাৎ, এই সব পরিবেশ বিপর্যয় প্রভাব ফেলে দীর্ঘমেয়াদে। আজ রামপাল প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে এর প্রভাব পেতে পারেন আগামী ২০-৩০ বছরে।
প্রশ্ন করতে পারেন কেনো আমরা সুন্দরবন এবং এর বিলুপ্ত প্রাণীসহ অন্যান্য প্রাণীকে রক্ষা করতে সচেষ্ট হবো? কারণ সুন্দরবন একটি ঐতিহ্যবাহী স্থান ছাড়া-ও এটি আমাদের দেশের বনাঞ্চল ও প্রাণীবৈচিত্র্যের অন্যতম স্থান। আমাদের দেশে মোট আয়তনের তুলনায় মাত্র ৭% বনাঞ্চল আছে (একটি দেশের মোট আয়তনের২৫% বনাঞ্চল থাকা উচিত), সুন্দরবন ও সংলগ্ন বনাঞ্চল যার বিরাট অংশ, এই সুন্দরবনের ক্ষতি হলে বৈশ্বিকউষ্ণতা ও আবহাওয়া বৈরিতার এই সময়ে বাঙলাদেশ আরো বেশি বন্যা, ঝড় ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত হতে থাকবে। সুন্দরবনের প্রাণীরা ইকো-সিস্টেমেরই অংশ, প্রাণীদের মেরে আপনি বনাঞ্চল পাবেন না, এবং বনাঞ্চল সাফ করে প্রাণীবৈচিত্র্য পাবেন না; কারণ ইকো-সিস্টেমের প্রতিটি উপাদান একে অন্যের উপর নির্ভরশীল।
কেনো প্রাণীবৈচিত্র্যের দরকার? কারণ, প্রাণীবৈচিত্র্য আমাদের পরিবেশের খাদ্যচক্র ও অন্যান্য চক্রে ব্যাপক প্রভাব রাখে, একটি চক্র ব্যাহত হলে অন্যান্য চক্র ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যেমন, মৌমাছি মধু উৎপাদন ছাড়াও ফুল ফল বৃক্ষাদির নিষেকে ভূমিকা রাখে। তেমনি বনাঞ্চল সাফ করে মানুষ টিকে থাকতে পারবে না, যেহেতু মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বনাঞ্চলের উপর নির্ভরশীল।পৃথিবীতে বর্তমানে পরিবেশ বিপর্যয়ের অনেকাংশ (যেমন, মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাওয়া, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাওয়া, প্রাণীবৈচিত্র্য হ্রাস পাওয়া ইত্যাদি) মানুষের সৃষ্টি, প্রাকৃতিকভাবে নয়, বরং কৃত্রিমভাবে। কিন্তু এই বিপর্যয়ের কথা বুঝতে পেরে পৃথিবীর অনেক দেশ পরিবেশ সংক্রান্ত আইনকে কঠোর করছে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে, তার বিপরীতে বাঙলাদেশ হাঁটছে উল্টোপথে।
রামপাল প্রকল্পের পক্ষে বলতে গিয়ে অনেকে বলে থাকেন যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা না জেনে পরিবেশের ক্ষতি করবেন না কি? এখানে বলে রাখা ভালো যে রামপাল প্রকল্পের বিরোধিতা করার মধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর দেশপ্রেমকে যাচাই করা হচ্ছে না, প্রধানমন্ত্রী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মেয়ে, তার দেশপ্রেম নিয়ে সংশয় নেই; যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দেশের নানাবিধ উন্নয়নের মাধ্যমে তিনি সেই নজির রাখছেন। প্রকল্পের সাথে জড়িত আমলা ও মন্ত্রীগণ পরিবেশগত নানাবিধ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ নন, অথচ যারা বিশেষজ্ঞ (দেশি ও বিদেশি) তারাই বলেছেন যে এই প্রকল্প ভয়াবহ। রামপাল প্রকল্পের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা দেয়া হয়ে-ও থাকতে পারে। সরকারের একটি ভুল সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করা মানেই সরকার প্রধানের দেশপ্রেম নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা নয়। এভাবে বলে মূলত প্রকল্পের পক্ষের লোকেরা ব্যাপারটিকে রাজনৈতিক আকার দিচ্ছেন এবং নিজেদের বক্তব্যকে হালকা করছেন।
৪
আমাদের বিপুল জনসংখ্যার চাহিদার জন্য প্রচুর বিদ্যুৎ দরকার। যেহেতু আমাদের স্থান সীমিত আমাদের পদক্ষেপ নিতে হবে কীভাবে আমরা নির্দিষ্ট বিনিয়োগ করে বিপুল লাভ বা চাহিদা মেটাতে পারি। কয়লাভিত্তিক প্রকল্প সীমিত স্থানে বিপুল লাভ বা চাহিদা মেটাবে না দীর্ঘমেয়াদে। প্রথমত, অর্থনৈতিকভাবে এই প্রকল্প লাভজনক নয়। এই প্রকল্পের জন্য সরকারকে বাড়তি দামে বিদ্যুৎ কিনতে হবে ভারতীয় বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান থেকে (অথচ মাত্র ১৫% বিনিয়োগ করে তারা ৫০% মালিকানা পাবে), অথবা সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, একেকটি কয়লা বিদ্যুতকেন্দ্রের মেয়াদ মাত্র ১৫-২০ বছর এবং এর রক্ষণাবেক্ষণের খরচ অন্যান্য বিদ্যুতকেন্দ্রের দুই থেকে তিনগুণ বেশি; অর্থাৎ দীর্ঘমেয়াদে-ও এই প্রকল্প লাভজনক নয়। অথচ যদি রামপাল প্রকল্পের জন্য বিনিয়োগকৃত অর্থ সরকার অন্য কোনো নবায়নযোগ শক্তিনির্ভর প্রকল্পে বিনিয়োগ করে তবে দীর্ঘমেয়াদে আমরা প্রচুর লাভবান হবো এবং আমাদের পরিবেশের-ও ক্ষতি হবে না, সুন্দরবন বিনাশের আশংকা-ও নেই।
রামপাল (ও বাঁশখালি) যেহেতু কয়লাকেন্দ্রিক এবং প্রয়োজনীয় কয়লা যেহেতু আমদানি করতে হবে তাই এগুলো নদী বা জলপথ সংলগ্ন স্থানে স্থাপিত হচ্ছে (আমরা জানি যে জলপথ নির্ভর আমদানি সহজ ও সস্তা)। সরকার যদি এই দোহাই দিয়ে রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করতে চায় তবে অনায়াসে কিছু কাঠামোগত পরিবর্তন করে তেল-নির্ভর অথবা বায়োমাস নির্ভর বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করতে পারে। পরিশোধিত তেল-নির্ভর কেন্দ্র কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র থেকে কম পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড ত্যাগ করে, মার্কারির ঝামেলা নেই, এবং অন্যান্য ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থের নির্গমন-ও অনেক কম; অর্থাৎ, তেল-নির্ভর কেন্দ্র মন্দের ভালো। অন্যদিকে, বায়োমাস নবায়নযোগ্য শক্তি-উৎস, ও সংশ্লিষ্ট দূষণ তেল ও কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রের তুলনায় কম। যেমন, একটি কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রে (রামপালের মতো বড়সড়) বছরে প্রায় ৫০ টন মার্কারিনির্গমিত হয়, বায়োমাসে যার পরিমাণ শূন্য। অন্যদিকে রামপালের কয়লাভিত্তিক প্রকল্পের জন্য প্রস্তাবিত অবকাঠামো ব্যবহার করেই বায়োমাস ও তেল-নির্ভর বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপন সম্ভব, যেহেতু এইসব কেন্দ্রে মূলত জ্বালানি পুড়িয়ে বাষ্প সৃষ্টি করে টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়; কিছু বাড়তি বিনিয়োগ অথবা কাঠামো পরিবর্তন করেই জ্বালানি হতে পারে বায়োমাস অথবা তেল। হতে পারে বায়ুকল-ভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র।
বাঙলাদেশের রয়েছে দীর্ঘ সামুদ্রিক সীমানা, যেখানে টারবাইন ব্যবহার করে সামুদ্রিক তরঙ্গ ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ডস ইত্যাদি দেশগুলো তাদের বিদ্যুৎ চাহিদার অনেকাংশ এভাবেই মেটায়। এই প্রকল্প অনায়াসে মংলা বন্দর কেন্দ্রিক হতে পারে। ফলে শিল্পায়নে-ও বাঁধা নেই, এবং পরিবেশ বিপর্যয়ের আশংকা কম।
সরকারের একাধিক আমলা ও মন্ত্রী বলেছেন যেকোনো উপায়ে রামপাল প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে। বাঙলাদেশ সরকার জনগণের বিরোধিতা, বিশেষজ্ঞদের মতামতকে উপেক্ষা করে এই প্রকল্প বাস্তবায়নে এতো মরিয়া কেনো? প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট বিদেশি রাষ্ট্র, সংস্থা, প্রতিষ্ঠানসমূহকে সন্তুষ্ট রাখতে, না কি গভীর কোনো দুর্নীতি হয়ে গেছে যে এর দায়ভার বহন করতে গিয়ে আমলাদের এখন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা ছাড়া উপায় নেই বা দেখছে না?
রামপাল প্রকল্প যেভাবে প্রস্তাবিত হয়েছে তাতে সুন্দরবনের ক্ষতি অনিবার্য। তাই প্রকল্পের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিবাদ অব্যাহত রাখতে হবে। সরকারকে সর্বোচ্চ আদালত ও আন্তর্জাতিক পরিবেশ-বিষয়ক আদালতে জবাবদিহির জন্য পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। আর দেশীয় বিভিন্ন পরিবেশ সংগঠন, সচেতন নাগরিকদের সভা ও অন্যান্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
রামপাল প্রকল্পের পক্ষে বলতে গিয়ে অনেকে বলে থাকেন যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা না জেনে পরিবেশের ক্ষতি করবেন না কি? এখানে বলে রাখা ভালো যে রামপাল প্রকল্পের বিরোধিতা করার মধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর দেশপ্রেমকে যাচাই করা হচ্ছে না, প্রধানমন্ত্রী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মেয়ে, তার দেশপ্রেম নিয়ে সংশয় নেই; যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দেশের নানাবিধ উন্নয়নের মাধ্যমে তিনি সেই নজির রাখছেন। প্রকল্পের সাথে জড়িত আমলা ও মন্ত্রীগণ পরিবেশগত নানাবিধ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ নন, অথচ যারা বিশেষজ্ঞ (দেশি ও বিদেশি) তারাই বলেছেন যে এই প্রকল্প ভয়াবহ। রামপাল প্রকল্পের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা দেয়া হয়ে-ও থাকতে পারে। সরকারের একটি ভুল সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করা মানেই সরকার প্রধানের দেশপ্রেম নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা নয়। এভাবে বলে মূলত প্রকল্পের পক্ষের লোকেরা ব্যাপারটিকে রাজনৈতিক আকার দিচ্ছেন এবং নিজেদের বক্তব্যকে হালকা করছেন।
৪
আমাদের বিপুল জনসংখ্যার চাহিদার জন্য প্রচুর বিদ্যুৎ দরকার। যেহেতু আমাদের স্থান সীমিত আমাদের পদক্ষেপ নিতে হবে কীভাবে আমরা নির্দিষ্ট বিনিয়োগ করে বিপুল লাভ বা চাহিদা মেটাতে পারি। কয়লাভিত্তিক প্রকল্প সীমিত স্থানে বিপুল লাভ বা চাহিদা মেটাবে না দীর্ঘমেয়াদে। প্রথমত, অর্থনৈতিকভাবে এই প্রকল্প লাভজনক নয়। এই প্রকল্পের জন্য সরকারকে বাড়তি দামে বিদ্যুৎ কিনতে হবে ভারতীয় বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান থেকে (অথচ মাত্র ১৫% বিনিয়োগ করে তারা ৫০% মালিকানা পাবে), অথবা সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, একেকটি কয়লা বিদ্যুতকেন্দ্রের মেয়াদ মাত্র ১৫-২০ বছর এবং এর রক্ষণাবেক্ষণের খরচ অন্যান্য বিদ্যুতকেন্দ্রের দুই থেকে তিনগুণ বেশি; অর্থাৎ দীর্ঘমেয়াদে-ও এই প্রকল্প লাভজনক নয়। অথচ যদি রামপাল প্রকল্পের জন্য বিনিয়োগকৃত অর্থ সরকার অন্য কোনো নবায়নযোগ শক্তিনির্ভর প্রকল্পে বিনিয়োগ করে তবে দীর্ঘমেয়াদে আমরা প্রচুর লাভবান হবো এবং আমাদের পরিবেশের-ও ক্ষতি হবে না, সুন্দরবন বিনাশের আশংকা-ও নেই।
রামপাল (ও বাঁশখালি) যেহেতু কয়লাকেন্দ্রিক এবং প্রয়োজনীয় কয়লা যেহেতু আমদানি করতে হবে তাই এগুলো নদী বা জলপথ সংলগ্ন স্থানে স্থাপিত হচ্ছে (আমরা জানি যে জলপথ নির্ভর আমদানি সহজ ও সস্তা)। সরকার যদি এই দোহাই দিয়ে রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করতে চায় তবে অনায়াসে কিছু কাঠামোগত পরিবর্তন করে তেল-নির্ভর অথবা বায়োমাস নির্ভর বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করতে পারে। পরিশোধিত তেল-নির্ভর কেন্দ্র কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র থেকে কম পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড ত্যাগ করে, মার্কারির ঝামেলা নেই, এবং অন্যান্য ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থের নির্গমন-ও অনেক কম; অর্থাৎ, তেল-নির্ভর কেন্দ্র মন্দের ভালো। অন্যদিকে, বায়োমাস নবায়নযোগ্য শক্তি-উৎস, ও সংশ্লিষ্ট দূষণ তেল ও কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রের তুলনায় কম। যেমন, একটি কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রে (রামপালের মতো বড়সড়) বছরে প্রায় ৫০ টন মার্কারিনির্গমিত হয়, বায়োমাসে যার পরিমাণ শূন্য। অন্যদিকে রামপালের কয়লাভিত্তিক প্রকল্পের জন্য প্রস্তাবিত অবকাঠামো ব্যবহার করেই বায়োমাস ও তেল-নির্ভর বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপন সম্ভব, যেহেতু এইসব কেন্দ্রে মূলত জ্বালানি পুড়িয়ে বাষ্প সৃষ্টি করে টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়; কিছু বাড়তি বিনিয়োগ অথবা কাঠামো পরিবর্তন করেই জ্বালানি হতে পারে বায়োমাস অথবা তেল। হতে পারে বায়ুকল-ভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্র।
বাঙলাদেশের রয়েছে দীর্ঘ সামুদ্রিক সীমানা, যেখানে টারবাইন ব্যবহার করে সামুদ্রিক তরঙ্গ ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ডস ইত্যাদি দেশগুলো তাদের বিদ্যুৎ চাহিদার অনেকাংশ এভাবেই মেটায়। এই প্রকল্প অনায়াসে মংলা বন্দর কেন্দ্রিক হতে পারে। ফলে শিল্পায়নে-ও বাঁধা নেই, এবং পরিবেশ বিপর্যয়ের আশংকা কম।
সরকারের একাধিক আমলা ও মন্ত্রী বলেছেন যেকোনো উপায়ে রামপাল প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে। বাঙলাদেশ সরকার জনগণের বিরোধিতা, বিশেষজ্ঞদের মতামতকে উপেক্ষা করে এই প্রকল্প বাস্তবায়নে এতো মরিয়া কেনো? প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট বিদেশি রাষ্ট্র, সংস্থা, প্রতিষ্ঠানসমূহকে সন্তুষ্ট রাখতে, না কি গভীর কোনো দুর্নীতি হয়ে গেছে যে এর দায়ভার বহন করতে গিয়ে আমলাদের এখন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা ছাড়া উপায় নেই বা দেখছে না?
রামপাল প্রকল্প যেভাবে প্রস্তাবিত হয়েছে তাতে সুন্দরবনের ক্ষতি অনিবার্য। তাই প্রকল্পের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিবাদ অব্যাহত রাখতে হবে। সরকারকে সর্বোচ্চ আদালত ও আন্তর্জাতিক পরিবেশ-বিষয়ক আদালতে জবাবদিহির জন্য পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। আর দেশীয় বিভিন্ন পরিবেশ সংগঠন, সচেতন নাগরিকদের সভা ও অন্যান্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
No comments:
Post a Comment