রসুল উৎসুক দৃষ্টিতে চারপাশে তাকাল। প্রায় সবাই কাজে ব্যস্ত, থাকারই কথা; কারণ, অনতিদূরে দাঁড়িয়ে ব্যবস্থাপক কলিমউদ্দিন শ্যোনদৃষ্টিতে মাপছে শ্রমিকদের। তার হাতে মুঠোফোন, মালিককে তোষামোদে ব্যস্ত।
শহরতলীর কাছাকাছিই এই ধান-মাড়ানো-কল। আশপাশে গাছপালার বালাই কম, বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে অনুর্বর জমি। দূরে শহরে যাওয়ার মহাসড়ক চোখে পড়ে, জানান দেয় হাতছানি পল্লীর।
রসুল কাজে মনোযোগ দিতে চেষ্টা করল। ভালো টাকা না পেলে আজও উপোস দিতে হবে। আজ তিনদিন ধরে ভাতের মাড় আর ধনেপাতার ভক্তা ছাড়া পড়েনি কিছু পেঠে। আজকাল আর হাহাকার লাগে না, কিন্তু ছোট বাচ্চাটার দিকে তাকালে জলে ভরে আসে চক্ষু দুখানি। তিন-তিনটা বাচ্চা তার। আমার দোষ, রসুল খিস্তি করে, আর বাচ্চা লোমু না। কিন্তু এ পরিকল্পনা কার্যকর হয়না, মাষ মাসে তীব্র শীতের কোন আনন্দঘন মূর্হুতে, কিংবা সহজলভ্য বিনোদনের কাছে হারমানা কারোর।
আজ তিনদিন উপোস ওরা। "আজ চুরি করে হলেও চাল নিব", রসুল নিজ মনে আওড়ায়, "পোলাপানের মুখ দেখবার পারিনা আমি। আমি এক অধম পিতা"।
সত্যেনদা শহরে ভালো কাজের জন্য যেতে বলেছিল। রসুল যায়নি, পিতৃভূম ছেড়ে কে যেতে চায়। আমি এখানে থেকেই জীবন পার করব, এযেন রসুলের মতন ঘোয়ার লোকদের পণ।
আকাশে মেঘ জমছে। উত্তর দিগন্তে কালো মেঘের আঁচল পড়েছে। পাখিদের ঘরে ফেরার ব্যস্ত আনাগোনা।
"কি রসুল ভাই, কাজে মন নাই কেন?" শুধায় সহ-শ্রমিক কামলাল।
"শক্তি নারে"। ঘরঘর করে ওঠে রসুল।
"খাও নাই?" ভ্রু-কুঁচকায় কামলাল, "তোমাদের নিয়ে পারা গেল না। যতসব"। দূরে সরে যায় কামলাল, রসুল কিছু বলার আগেই।
পাঁচটার দিকে কাজ শেষ হবে ওর। কিছু নিতে পারলেই তবে আজ রান্না হবে। কিন্তু নিবে কিভাবে? একটা থলে কিংবা কাপুড়ে কিছু তো চাই।
রসুল প্রকৃতির ডাকের সাড়া দেয়ার কথা বলে কল পাড়ে চলে এল। এখানটায় হয়ত কোন থলে পাওয়া যেতেও পারে। হ্যাঁ, ঐতো, একটা। রসুল কুঁড়িয়ে নেয় থলেটা, বুক পকেটে লুকিয়ে রাখে সযতনে।
ছুটির সময় সবাই যখন নিজ নিজ কার্যে ব্যস্ত, রসুল থলেটা বের করে, দ্রুত অনাড়ী হাতে ধান ভরে সে। আরো কিছু, তবে কালও হয়ে যাবে। আর কিছু কি নিবে? তাহলে তিনদিনের জন্য চিন্তা নাই, আর তিনদিন পরে তো সাপ্তাহিক মাইনে পাবে ও, তখন চাল-ডাল কিনে নেয়া যাবে।
"কিরে তুই এখানে কি করিছ?" শীতল অথচ নরম কন্ঠে বলে ওঠে কলিমউদ্দিন। কখন যে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে রসুল টেরও পাইনি।
"জ্বী, জ্বী..... কিছুই করিনা"। নিজেকে অভিশাপ দিল রসুল, মনে মনে।
"সবাই চলে গেল সেই কখন, তুই এখনো যাস নি?" রসুলের হাতে ধরা থলেটা হঠাৎ চাক্ষুস করে কলিমউদ্দিন। " হাতে ঐটা কিরে তোর?" কলিমউদ্দিন উৎকন্ঠিত স্বরে জানতে চায়।
"নাতো, কিছু না।"
হঠাৎ কি মনে হল, হাতের থলেটাসহ দৌড় দেয় রসুল, মরণদৌড়।
"নিয়ে গেলরে, নিয়ে গেলরে। তোরা কোথায় সব? সব ধান নিয়ে গেলরে রসুল্লাই।" কঁকিয়ে, চিৎকার করে ওঠে কলিমউদ্দিন।
পিছন পিছন সে তাড়া করে রসুলকে।
দৌড়ে অনেকখানি এগিয়ে রসুল, ওকে যে এই চাল পৌঁছে দিতে হবে আমেনার হাতে। ছেলেটা না খেয়ে আছে, ভাবতে ভাবতে আরো বল পায় রসুল, অনেকখানি এগিয়ে যায় আরো।
মাঠের 'পরে রাখা তক্তার সাথে বাড়ি খেয়ে পড়ে গেল রসুল। থলেভর্তি ধানগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে মাঠে। চিরে গেছে হাত, তবুও সাবধানী হাতে ঐগুলো কুঁড়িয়ে নিতে যায় রসুল, কিন্তু ততক্ষণে পৌঁছেগেছে কলিমউদ্দিন। কষে লাথি মারে রসুলকে।
"শালা, ধান চুরি করিস। তোকে আমি ভালো ভেবে কাজ দিলুম, আর তুই কিনা আমারে ফাঁকি দিয়ে ধান চুরি করিস"।
বাচ্চাটার মুখখানি ভেসে ওঠে মানসপঠে। হাত ধাক্কা দিয়ে কলিমউদ্দিনকে সরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ায় রসুল। কিন্তু অন্য শ্রমিকরা ততক্ষণে ঘিরে ফেলেছে ওদের। পালানোর পথ নেই ওর।
"ওরে আমারে যাইবার দে। আমার বাপজান না খাইয়ে আছে"। ঢুঁকরে কেঁদে উঠে রসুল। তার আহাজারি ঈশ্বরের কানে হয়ত পৌঁছায়, কিন্তু শ্রমিকদের কানে পৌঁছায় না; কারণ, এখন রসুলকে আটকালে মাইনের সাথে বাড়তি কিছু টাকা পাওয়া যাবে।
ধাক্কা দিয়ে রসুলকে মাটিতে ফেলা হল, তারপর আলোপাতাড়ি লাথি আর কিল-ঘুঁসি।
বৃষ্টি নামতে শুরু করেছে। ধানের থলেটা কেড়ে নিয়ে কলিমউদ্দিন থানায় ফোন করল।
নিথর পড়ে আছে রসুল। বৃষ্টির জলে ধুয়ে যাচ্ছে তার রক্ত, ঝাপসা হয়ে আসছে দৃষ্টি। ঠিক পুরোপুরি ঝাপসা হয়ে আসার আগে চোখের সামনে ভেসে উঠল একথালা ডালমাখা ভাতের ছবি, যার নিরবিচ্ছিন যোগান দিতে পারেনি তার পাঁচ বছরের ধান-মাড়ানো-কলের কাজও।
শহরতলীর কাছাকাছিই এই ধান-মাড়ানো-কল। আশপাশে গাছপালার বালাই কম, বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে অনুর্বর জমি। দূরে শহরে যাওয়ার মহাসড়ক চোখে পড়ে, জানান দেয় হাতছানি পল্লীর।
রসুল কাজে মনোযোগ দিতে চেষ্টা করল। ভালো টাকা না পেলে আজও উপোস দিতে হবে। আজ তিনদিন ধরে ভাতের মাড় আর ধনেপাতার ভক্তা ছাড়া পড়েনি কিছু পেঠে। আজকাল আর হাহাকার লাগে না, কিন্তু ছোট বাচ্চাটার দিকে তাকালে জলে ভরে আসে চক্ষু দুখানি। তিন-তিনটা বাচ্চা তার। আমার দোষ, রসুল খিস্তি করে, আর বাচ্চা লোমু না। কিন্তু এ পরিকল্পনা কার্যকর হয়না, মাষ মাসে তীব্র শীতের কোন আনন্দঘন মূর্হুতে, কিংবা সহজলভ্য বিনোদনের কাছে হারমানা কারোর।
আজ তিনদিন উপোস ওরা। "আজ চুরি করে হলেও চাল নিব", রসুল নিজ মনে আওড়ায়, "পোলাপানের মুখ দেখবার পারিনা আমি। আমি এক অধম পিতা"।
সত্যেনদা শহরে ভালো কাজের জন্য যেতে বলেছিল। রসুল যায়নি, পিতৃভূম ছেড়ে কে যেতে চায়। আমি এখানে থেকেই জীবন পার করব, এযেন রসুলের মতন ঘোয়ার লোকদের পণ।
আকাশে মেঘ জমছে। উত্তর দিগন্তে কালো মেঘের আঁচল পড়েছে। পাখিদের ঘরে ফেরার ব্যস্ত আনাগোনা।
"কি রসুল ভাই, কাজে মন নাই কেন?" শুধায় সহ-শ্রমিক কামলাল।
"শক্তি নারে"। ঘরঘর করে ওঠে রসুল।
"খাও নাই?" ভ্রু-কুঁচকায় কামলাল, "তোমাদের নিয়ে পারা গেল না। যতসব"। দূরে সরে যায় কামলাল, রসুল কিছু বলার আগেই।
পাঁচটার দিকে কাজ শেষ হবে ওর। কিছু নিতে পারলেই তবে আজ রান্না হবে। কিন্তু নিবে কিভাবে? একটা থলে কিংবা কাপুড়ে কিছু তো চাই।
রসুল প্রকৃতির ডাকের সাড়া দেয়ার কথা বলে কল পাড়ে চলে এল। এখানটায় হয়ত কোন থলে পাওয়া যেতেও পারে। হ্যাঁ, ঐতো, একটা। রসুল কুঁড়িয়ে নেয় থলেটা, বুক পকেটে লুকিয়ে রাখে সযতনে।
ছুটির সময় সবাই যখন নিজ নিজ কার্যে ব্যস্ত, রসুল থলেটা বের করে, দ্রুত অনাড়ী হাতে ধান ভরে সে। আরো কিছু, তবে কালও হয়ে যাবে। আর কিছু কি নিবে? তাহলে তিনদিনের জন্য চিন্তা নাই, আর তিনদিন পরে তো সাপ্তাহিক মাইনে পাবে ও, তখন চাল-ডাল কিনে নেয়া যাবে।
"কিরে তুই এখানে কি করিছ?" শীতল অথচ নরম কন্ঠে বলে ওঠে কলিমউদ্দিন। কখন যে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে রসুল টেরও পাইনি।
"জ্বী, জ্বী..... কিছুই করিনা"। নিজেকে অভিশাপ দিল রসুল, মনে মনে।
"সবাই চলে গেল সেই কখন, তুই এখনো যাস নি?" রসুলের হাতে ধরা থলেটা হঠাৎ চাক্ষুস করে কলিমউদ্দিন। " হাতে ঐটা কিরে তোর?" কলিমউদ্দিন উৎকন্ঠিত স্বরে জানতে চায়।
"নাতো, কিছু না।"
হঠাৎ কি মনে হল, হাতের থলেটাসহ দৌড় দেয় রসুল, মরণদৌড়।
"নিয়ে গেলরে, নিয়ে গেলরে। তোরা কোথায় সব? সব ধান নিয়ে গেলরে রসুল্লাই।" কঁকিয়ে, চিৎকার করে ওঠে কলিমউদ্দিন।
পিছন পিছন সে তাড়া করে রসুলকে।
দৌড়ে অনেকখানি এগিয়ে রসুল, ওকে যে এই চাল পৌঁছে দিতে হবে আমেনার হাতে। ছেলেটা না খেয়ে আছে, ভাবতে ভাবতে আরো বল পায় রসুল, অনেকখানি এগিয়ে যায় আরো।
মাঠের 'পরে রাখা তক্তার সাথে বাড়ি খেয়ে পড়ে গেল রসুল। থলেভর্তি ধানগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে মাঠে। চিরে গেছে হাত, তবুও সাবধানী হাতে ঐগুলো কুঁড়িয়ে নিতে যায় রসুল, কিন্তু ততক্ষণে পৌঁছেগেছে কলিমউদ্দিন। কষে লাথি মারে রসুলকে।
"শালা, ধান চুরি করিস। তোকে আমি ভালো ভেবে কাজ দিলুম, আর তুই কিনা আমারে ফাঁকি দিয়ে ধান চুরি করিস"।
বাচ্চাটার মুখখানি ভেসে ওঠে মানসপঠে। হাত ধাক্কা দিয়ে কলিমউদ্দিনকে সরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ায় রসুল। কিন্তু অন্য শ্রমিকরা ততক্ষণে ঘিরে ফেলেছে ওদের। পালানোর পথ নেই ওর।
"ওরে আমারে যাইবার দে। আমার বাপজান না খাইয়ে আছে"। ঢুঁকরে কেঁদে উঠে রসুল। তার আহাজারি ঈশ্বরের কানে হয়ত পৌঁছায়, কিন্তু শ্রমিকদের কানে পৌঁছায় না; কারণ, এখন রসুলকে আটকালে মাইনের সাথে বাড়তি কিছু টাকা পাওয়া যাবে।
ধাক্কা দিয়ে রসুলকে মাটিতে ফেলা হল, তারপর আলোপাতাড়ি লাথি আর কিল-ঘুঁসি।
বৃষ্টি নামতে শুরু করেছে। ধানের থলেটা কেড়ে নিয়ে কলিমউদ্দিন থানায় ফোন করল।
নিথর পড়ে আছে রসুল। বৃষ্টির জলে ধুয়ে যাচ্ছে তার রক্ত, ঝাপসা হয়ে আসছে দৃষ্টি। ঠিক পুরোপুরি ঝাপসা হয়ে আসার আগে চোখের সামনে ভেসে উঠল একথালা ডালমাখা ভাতের ছবি, যার নিরবিচ্ছিন যোগান দিতে পারেনি তার পাঁচ বছরের ধান-মাড়ানো-কলের কাজও।
No comments:
Post a Comment