ইদানীং বিড়ালটা বড্ড জ্বালাতন করছে। রান্নায় মুখ দিচ্ছে, মাঝরাত্তিরে অন্যরকম খিদে পেয়ে ঘুম ভাঙলে বাথরুমে যাওয়ার সময় পথে ভয় দেখাচ্ছে। গতকাল তো মায়ের জায়নামাজে প্রস্রাব করে দিয়েছিল হতচ্ছাড়াটা। সর্বোপরি যাতনার একশেষ।
আমাদের দোতলা বাড়ির সীমানায় তেমন কোন বড় আলয় নেই। দূরে শিল্পীদের বাড়ি; তারপরে জনপদ কিছুটা বিরান। বিকালের নিরজনে আকাশ প্রেম করে। আমি ছাদ থেকে দেখি, আমি টের পাই; ছাদ থেকে বাড়ির পিছনের আহলাদী দিঘীর জলে নিজের ভাবনার প্রতিবিম্ব দেখি।
বিড়ালটার আগমন ইতিহাস বৈকি। তাকে সর্বপ্রথম দেখতে পাওয়া যায় আমাদের ছাদের চিলেকোঠার কাছটায়। দাদার পারাপারকালীনদশা প্রায়, প্রতি ভোরে তিনি বিকলাঙ্গ পা নিয়ে ইজি-চেয়ারে শুয়ে সবলাঙ্গ রোদ্দুর গায়ে মাখেন। সকালের রোদ স্নানটুকুই তার বিরাট পাওয়া, নতুবা দিনের বাকি সাত প্রহর তার কাটে স্মৃতিজাগানিয়া কোরাস গেয়ে; নিঃশব্দ কোরাসে তিনি নিজের কামরাটিকে আঁকড়ে রাখেন। দাদাই প্রথম দেখেছিলেন বিড়ালটাকে। আগের রাতে বৃষ্টি হয়েছিল বলে সকালের রোদ ছিল তুলা-নরম ভেজা ভেজা, রৌদ্রে ছিলনা গভীর উত্তাপ। সুতারাং ছাদে শুয়ে থাকা প্রায় নিরর্থক। দাদা তার বেল বাজিয়ে আমাকে ডাকলেন; বলা চলে কোন একজনকে ডাকলেন। যেহেতু আমি থাকি চিলেকোঠার ঘর লাগোয়া, আমিই প্রথম উপস্থিত হয়েছিলাম।
"সকাল ভাল্লাগে না। রোদ নাই।"
"হুঁ। ঘরে যাবে?" আমি উৎসুক জানতে চাইলাম।
"নিয়ে চল। রান্না হল কিছু?"
এখানে বলা আবশ্যক যে দাদা সকালে শুধু চিরতার রস পান করেন। তাঁর দুপুরের খানা পরিবেশন করা হয় বেলা এগার কিংবা বারটা নাগাদ। বিকালে তিনি চা পান করেন এবং তার উছিলায় আমরা ছোটরাও। রাত্রে নৈশভোজের পর তিনি কোরআন পাঠ করেন মিহি সুরে। এই ক্ষণটা আমার প্রিয়। যদিও ধর্মকর্মে আমি চিরকালীন উদাসীন, তবুও দাদার তেলাওয়াত আমার নিত্য শ্রাব্য সংগীত।
যাইহোক আমি দাদার বগলে হাত দিয়ে তাঁকে তুলে দাঁড় করালাম। দাদার প্রশ্নের জবাব দিইনি আমি, অপ্রয়োজনীয় কোন কিছুর জবাব হয় না আমার কাছে। তিনি জানেন খাওয়া তৈরী হলে তাঁকে ডাকা হবে, এটা অবধারিত ব্যাপার।
আমি হঠাৎ টের পেলাম দাদার শরীরটা আড়ষ্ট হয়ে গেছে। তাঁর চোখের দৃষ্টি অনুসরণ করে আমিও তাকালাম, আর তখনি বিড়ালটাকে চোখে পড়ে। গুঁটিশুঁটি শুয়ে আছে, শীত লাগছে বোধহয়। সারা শ্রী সাদা, কপালের কাছটায় শুধু আশ্চর্য কিছু কালো লোম।
"ওটাকে কাছে নিয়ে আয় তো।"
"বাদ দাও। ঘরে চল। পরে ঠান্ডা লাগলে মা বকবে ফের।"
"নিয়ে আয়। আমাকে শুয়ে দে আবার।"
আমার সময় কম। বাড়ির কাজ শেষ করতে হবে। কালক্ষেপণ করা নিজেকে শাস্তি প্রদান স্বরূপ এখন। আমি কথা না বাড়িয়ে বিড়ালটাকে আনতে গেলাম। অবাক কান্ড! আমাকে কাছে টের পেয়েও এটা সরে গেল না, দৌড়ে পালিয়ে গেল না অনিমেষ। আমি নিরীহ হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরলাম বিড়ালটাকে।
দাদা বিড়ালটাকে বুকের কাছে টেনে নিল। গরম উত্তাপে ওম দিল।
সেই থেকে বিড়ালটা আমাদের গৃহপালিত পশু বিশেষ। কয়েকদিনের মধ্যে বিড়ালটা অনেকের বিনেপয়সার সঙ্গী হয়ে গেল। লিলি আপা তো ফি বিকালে হাঁটতে বের হয় দিঘীর পাড়ে বিড়ালটাকে নিয়ে। অবাক বিষয় হল- লিলি আপার মেয়ে নিধীকে দেখলাম বিড়ালটার সাথে একা একা কথা বলছে। বেচারীকে উৎসাহ দেয়ার জন্য আমিও যোগ দিলাম। আমি আধশোয়া বসলাম আমার দু'পা মেলে দিয়ে। বিড়ালটাকে বসালাম আমার একত্রিত দুই পায়ের 'পরে। এটা অতি আরামদায়ক আসন। দু'পাকে এখন হালকা চালে দোলাতে হবে। চোখ বুজে আসে সরলছন্দিত সুখে। নিধী আমার দিকে বড়বড় চোখ করে তাকাচ্ছে।
"কিরে, ওভাবে দেখছিস কেন?"
"তুমি আমার আদর ওকে দিচ্ছ কেন? আমি কান্না করব, আম্মু বলে দিব।" এখানে বলা দরকার যে, সেসব রাত্রে নিধীর স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ঘুম আসে না, সেইসব রাতে ওকে ঘুম পাড়ানো জন্য এই পদ্ধতি অবলম্বন করি; নিধী ধারণা রাখে যে মামার কাছ থেকে পাওয়া এই আদরটুকু অবণ্টনযোগ্য এবং একান্ত নিজের- গায়ের লাওয়ারিশ লোমের মতন।
একদিনের কথা বলি। আমি বিকালের অবসরটুকু উপভোগ করছিলাম দূরের ধান ক্ষেতে বাতাসের ব্যস্ত অভিসার দেখতে দেখতে। কাছে যাচ্ছিলাম না, জগতের কিছু কিছু সৌন্দর্য দূর থেকেই ভোগ করা সুন্দরতম পন্থা। আমি বাহিরে পা বাড়ালাম আমার জামা-কাপড় আনার জন্য; জলিলদা কাপড় রোদে দিয়েছে। ঘরে আনার কাজটুকু এই অধমকেই করতে হবে।
বাগানের কাছটায় যাওয়ার সময় আমার পা নিশ্চল হয়ে গেল হঠাৎ- সাপটা ঠিক আমার কাছ থেকে দুই হাত দূরে; হলদে শরীরে কাল দাগকাটা। নেত্রপত্রহীন দুই চোখে প্রাগতৈহাসিক জাদু। আমার কি দৌড় দেয়া উচিত? কোন রকমে বাড়ির কাছে যেতে পারলেই হল। দৌড়ের সময় চিৎকার করে জলিলদা'কে ডাকব, তিনি নিচে নেমে আসবেন প্রয়োজনীয় অস্ত্র নিয়ে। আমি সরল বিশ্বাসে সর্তকতার সাথে একপা পিছালাম, আর তখনি সাপটা যে মারাত্নক গা-ছাড়া দিল তাতে আমার আত্না ঈশ্বরের আরাধনায় নিমগ্ন হয়ে গেল। সাপে কেটে মরব? শালা, এরচেয়ে বরং মাইশার জন্য বিদ্রোহ করে মরা ভাল; আশপাশের দু-তিন পাড়ায় কয়েক পুরুষ ধরে অমর হয়ে থাকব।
আমাকে উদ্ধারের জন্য এগিয়ে এল বিড়ালটা। সে অনেক আগেই এগিয়ে গিয়েছিল, মনে হয় আমার উপস্থিতি না থাকাতে ফিরে এসেছে। আশ্চর্য! বিড়ালটা নিরব পায়ে এসে সাপের লেজ কামড়ে দূরে ফেলে দিতে চাইল। নিজের ওজনের চেয়ে দ্বিগুণ ভারী ওজন বহন করা কত যে কঠিন তা আমি টের পেলাম বিড়ালটার এই সাহস দেখে। সাপটা হঠাৎ আক্রমণে দিশেহারা হয়ে রইল কয়েক সেকেন্ড। আর এইটুকু সময় ছিল আমার জন্য স্বর্গ পাওয়া। আমি ভোঁ-দৌড় দিলাম বাড়ির পানে। জলিলদা নেমে আসছে সিঁড়ি দিয়ে, হাতে বড় লোহার দণ্ড।
"খালাম্মা জানালা দিয়ে দেখছে,আমারে কইছে। আপনে তফাত গিয়া দাঁড়ায় থাকেন। দেখেন আমার খেলা....."
জলিলদা বীরবিক্রমে সাপ নিধনে প্রবৃত্ত হলেন। বিড়ালটা সাপটার কাছ থেকে সরে এসেছে। একে অন্যের দিকে সর্তক চোখে তাকিয়ে আক্রমণের পথ খুঁজছে। জলিলদা চিৎকার করে গিয়ে এক বাড়ি মার সাপটার ঠিক মাথা বরাবর। উনি এক মিনিটের মাথায় ধরাশয়ী করে ফেললেন সাপটাকে।
সেই রাতে বিড়ালটাকে আমি নিজ পয়সায় দুই লিটার দুধ আর তিনটা পাউরুটি খাওয়ালাম। বিড়ালটা আমারও সঙ্গী হয়ে গেল। আমি বাগান কিংবা ঝোপঝাড়, ক্ষেতে বেড়াতে গেলে সে আমার দ্বিতীয় ছায়া হয়।
তবে আজকাল খাতির বিড়ম্বনার মতন ওটার উপস্থিতি আজকাল কাঁটার মতন। গলার কাঁটা দূরীকরণে বিড়ালের পা ধরা হয়, বিড়াল দূরীকরণে কি কর্তব্য? আমি নিত্যদিন ভাবছি।
--------------------------------------
ঘুমটা ভাঙল মায়ের চিৎকারে। মা ধমকের সুরে কথা বললেই চিৎকারের মত শোনায়। নিশ্চয় বাবাকে অপ্রিয় বাজার সামগ্রী আনার জন্য কথাপিটা করছে! ধুর...ঘুমটা বেশ জমেছিল। মাইশাকে প্রায় রাজিয়ে করে ফেলেছিলাম সিনেমা দেখার ব্যাপারে। মা হতে দিল না আমার একরত্তি অভিসার।
আমি তোয়ালে নিয়ে দরজার চৌকাঠে দাঁড়ালাম। বাবার টিকিটি নেই আশপাশে। কাজের লোক জলিলদা অনতিদূরে দাঁড়িয়ে, যেন পালিয়ে যেতে পারলে বাঁচে। আমার দক্ষ চোখ ঘটনার কেন্দ্রস্থলে হানা দিল অতিদ্রুত। বিড়ালটা মেঝেতে বসা, আশপাশে দুধেল সমুদ্দুর। ঘটনা বুঝতে দেরী হল না।
"দেখ, কাণ্ড দেখ। তোর বাবার জন্য দুধ গরম দিয়েছিলাম, এসে দেখি এই অবস্থা।"
"আমার ঘুম ভেঙে গেল।"
"আজই এটাকে দূরে কোথাও ফেলে দিয়ে আস।" মা সমন জারী করল।
আমি কিছু না বলে বাথরুমে প্রবেশ করলাম। বাথরুম কিন্তু চিন্তা করার জন্য উৎকৃষ্ট জায়গা, আমার মনে হয়। নীরব, নিজের শ্বাস-প্রশ্বাস সাক্ষী রেখে চিন্তা করা যায়। সাক্ষী রেখে চিন্তা করার ব্যাপারটা খোলাসা করে বলি। আমাদের সকল চিন্তাই কোন না কোন বস্তু, ব্যক্তিকে সাক্ষী রেখে। এটা সবল সত্য। এটা বিষয় জানেন? মানুষ যত বৃদ্ধ হয় তার ভিতর মায়া বসতি গড়ে। শৈশব আর বাধৈক্য হল মায়ার আশ্রম সময়। কৈশোর হল নিষ্ঠুর কাল। কিশোররা সবচেয়ে নিষ্ঠুর প্রকৃতির হয়; আর যৌবন, সে পাখা মেলার সময়। আমি কিন্তু বিশিষ্ট চিন্তাবিদ না। তবে ভাবি, আপনিও যেমন ভাবেন; আমি হয়ত এক চামচ বেশি ভাবি।
আমি বিড়ালটাকে নিয়ে চিন্তা করলাম। বাথরুমের ত্যাগ কার্যাবলীর প্রেক্ষাপটে আমার মাথায় ব্যাপারটা খেলে গেল। আমি পরিষ্কার হয়ে বের হলাম।
"মা, খাবার দাও। ঘরে কি পাকা মরিচ আছে? একটু ভর্তা করে দিবে?"
আমি আহলাদী সুরে বললাম। আমি জানি মা না করবে না। মায়েরা না করতে ঘৃণা করে।
"দেখি। তার আগে এটাকে দূর কর। তোর বাবা আসলে হৈচৈ কাণ্ড বাঁধাবে।"
"বাবা কোথায়?"
"সকালে তো বের হল। হাঁটতে। বাজারে যেতে পারে। বুদ্ধি করে দুধ নিয়ে এলে হয়, ঘরে একটুও বাকি নেই।"
আমি বিড়ালটাকে নিয়ে ঘর থেকে বের হলাম। সিঁড়িতে দেখা হল জলিলদা'র সাথে। তার হাতে কোদাল, কাঁচি; নিশ্চয় বাগান থেকে ফিরছে।
"কই যান ভাইজান?"
"মা বলল এটাকে দূরে ফেলে আসতে।" আমি বিড়ালটার দিকে ঈঙ্গিত করলাম।
"মাটি মাইখ্যা দিয়েন। তাইলে আর আইবো না।"
আমি সরু চোখে তাকালাম। কৌতুহলের সাথে বললাম, "কেন? মাটি কেন?
"কাদা মাটি মাইখ্যা দিলে বিড়াল ঘরে ফিরে না। আমার দাদায় বলছিল। আমাদের বাড়িতে একবার ইয়া বড়......" আমি জলিলদাকে গল্প ফাঁদতে দিলাম না। তার হাতের কাঁচিটা নিয়ে নিলাম। মাটি কাটায় সুবিধা হবে।
আমি চলে এসেছি দিঘীর পাড়ে। দিঘীর পানি টলটলা, তবে সোঁদা গন্ধ। কেহ ব্যবহার করে না বিধায়। যে গোসল করবে তার শরীর তেলাপোকার মত গন্ধ হয়ে যাবে।
দিঘী, পুকুর কিংবা জলাশয়ের চারধারে সাধারণত নারিকেল, সুপারী ইত্যাদি গাছ রোপন করা হয়, যেন সূর্যালোক আবদ্ধ না হয়। কিন্তু দাদার বিচিত্র খেয়ালের কারণে আমাদের দিঘীর চারধা' শোভা পাচ্ছে চার চারটি বটবৃক্ষ। কথিত আছে, দাদীজানের মন রক্ষা করতে গিয়ে দাদাজান বটগাছ লাগিয়েছিলেন। দাদীজান খেয়ালী মহিলা ছিলেন।
আমি উত্তর দিকের বটগাছটার নিচে চলে এলাম। গাছের গুঁড়িতে বসলাম আরাম করে। হাতের বিড়ালটাকে মাটিতে রাখলাম। বাগানের মাটি কোপানোর কাঁচিটা দিয়ে কিছু মাটি তুলে আনলাম। কাদা দরকার আমার। জলিলদা তাই বলেছে। আমি দিঘীর কাছ থেকে কিছু জল ধার করে নিয়ে আনলাম। দিঘী জানে আমি আজন্মের ঋণগ্রস্ত মানুষ।
পানি, মাটি মিশিয়ে ব্যস্ত হাতে কাদা বানিয়ে ফেললাম। আলতো করে বিড়ালের সারা গায়ে মাখলাম। বিড়ালটা কাঁপছে। হাত থেকে ছুটে যেতে চাচ্ছে। এটা কি টের পেয়ে গেছে? আমি বাম হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে রেখে ডান হাত দিয়ে কাঁচিটা নিলাম। ঘাড়ের কাছটা থেকে শুরু করলাম, প্রথমে হালকা টান দিলাম। কয়েকটা লোম উঠে এল। এবার গভীর করে কাঁচিটা টেনে আনলাম সোজা ঘাড় থেকে লেজ পর্যন্ত। কয়েক সেকেন্ডের জন্য কিছুই হল না, সাদা চর্বির মত দেখাল। ব্যাটা তো দেখি অনেক চর্বি বানিয়েছে। তারপর ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হল। বিরতিহীনভাবে। বিড়ালটা আমার হাতের মধ্যে লাফাচ্ছে। আমি হিমশিম খাচ্ছি প্রায়।
আমি কাঁচিটা হালকা অথচ গভীরভাবে চালিয়ে দিলাম গলা বরাবর। গৎ, গৎ করে শব্দ হল কিছুক্ষণ। অনর্গল রক্ত বের হচ্ছে। আমার হাত রক্তে মাখামাখি। এক সময় বিড়ালটা নিস্তেজ হয়ে এল। আমি খানিকক্ষণ নিরব বসে রইলাম। বিপ্রতীপ ভালবাসা বড় যন্ত্রণার।
তারপর আমার মস্তিষ্ক সচল হল। এটাকে চাপা দিতে হবে। আচ্ছা, দিঘীতে ফেলে দিলে কি হয়? ঝামেলা চুকে গেল। আমার কোন গর্ত করার ঝামেলায় যেতে হবে না। কিন্তু এটা তো ভেসে উঠবে আবার। সবাই টের পেয়ে যাবে। বিকালের দিকে অনেকে দিঘীর পাড়ে বেড়াতে আসে। আচ্ছা, কাঁচিটা বিড়ালটার শরীরে গেঁথে ফেলে দিলে কেমন হয়? জলিলদা নিশ্চয় কাঁচির জন্য আমার জাত-মান গাইবে না। জানতে চাইলে কিছু একটা বলে দিলেই হল। বলব, হারিয়ে গেছে। কাঁচি আর বিড়ালের সম্মিলিত আপেক্ষিক গুরুত্ব নিশ্চয় পানি অপেক্ষা বেশি। কাঁচি ভারী, হওয়ার সম্ভবনাই বেশি।
আমি তাই করলাম। এক কোপে মৃত বিড়ালটার শরীরে গেঁথে ফেললাম কাঁচিটা। দিঘীর শান্ত জলে ছুঁড়ে দিলাম কাঁচিসমেত বিড়ালের শরীর। ধুপ! একটা শব্দ হল, অতঃপর সব তলিয়ে গেল।
আমি হাত ধুয়ে নিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম। মা নিশ্চয় আমার জন্য ভর্তা করে বসে আছে। অনেকদিন পর তারিয়ে তারিয়ে খাওয়া যাবে। কতদিন খাই না!
আমাদের দোতলা বাড়ির সীমানায় তেমন কোন বড় আলয় নেই। দূরে শিল্পীদের বাড়ি; তারপরে জনপদ কিছুটা বিরান। বিকালের নিরজনে আকাশ প্রেম করে। আমি ছাদ থেকে দেখি, আমি টের পাই; ছাদ থেকে বাড়ির পিছনের আহলাদী দিঘীর জলে নিজের ভাবনার প্রতিবিম্ব দেখি।
বিড়ালটার আগমন ইতিহাস বৈকি। তাকে সর্বপ্রথম দেখতে পাওয়া যায় আমাদের ছাদের চিলেকোঠার কাছটায়। দাদার পারাপারকালীনদশা প্রায়, প্রতি ভোরে তিনি বিকলাঙ্গ পা নিয়ে ইজি-চেয়ারে শুয়ে সবলাঙ্গ রোদ্দুর গায়ে মাখেন। সকালের রোদ স্নানটুকুই তার বিরাট পাওয়া, নতুবা দিনের বাকি সাত প্রহর তার কাটে স্মৃতিজাগানিয়া কোরাস গেয়ে; নিঃশব্দ কোরাসে তিনি নিজের কামরাটিকে আঁকড়ে রাখেন। দাদাই প্রথম দেখেছিলেন বিড়ালটাকে। আগের রাতে বৃষ্টি হয়েছিল বলে সকালের রোদ ছিল তুলা-নরম ভেজা ভেজা, রৌদ্রে ছিলনা গভীর উত্তাপ। সুতারাং ছাদে শুয়ে থাকা প্রায় নিরর্থক। দাদা তার বেল বাজিয়ে আমাকে ডাকলেন; বলা চলে কোন একজনকে ডাকলেন। যেহেতু আমি থাকি চিলেকোঠার ঘর লাগোয়া, আমিই প্রথম উপস্থিত হয়েছিলাম।
"সকাল ভাল্লাগে না। রোদ নাই।"
"হুঁ। ঘরে যাবে?" আমি উৎসুক জানতে চাইলাম।
"নিয়ে চল। রান্না হল কিছু?"
এখানে বলা আবশ্যক যে দাদা সকালে শুধু চিরতার রস পান করেন। তাঁর দুপুরের খানা পরিবেশন করা হয় বেলা এগার কিংবা বারটা নাগাদ। বিকালে তিনি চা পান করেন এবং তার উছিলায় আমরা ছোটরাও। রাত্রে নৈশভোজের পর তিনি কোরআন পাঠ করেন মিহি সুরে। এই ক্ষণটা আমার প্রিয়। যদিও ধর্মকর্মে আমি চিরকালীন উদাসীন, তবুও দাদার তেলাওয়াত আমার নিত্য শ্রাব্য সংগীত।
যাইহোক আমি দাদার বগলে হাত দিয়ে তাঁকে তুলে দাঁড় করালাম। দাদার প্রশ্নের জবাব দিইনি আমি, অপ্রয়োজনীয় কোন কিছুর জবাব হয় না আমার কাছে। তিনি জানেন খাওয়া তৈরী হলে তাঁকে ডাকা হবে, এটা অবধারিত ব্যাপার।
আমি হঠাৎ টের পেলাম দাদার শরীরটা আড়ষ্ট হয়ে গেছে। তাঁর চোখের দৃষ্টি অনুসরণ করে আমিও তাকালাম, আর তখনি বিড়ালটাকে চোখে পড়ে। গুঁটিশুঁটি শুয়ে আছে, শীত লাগছে বোধহয়। সারা শ্রী সাদা, কপালের কাছটায় শুধু আশ্চর্য কিছু কালো লোম।
"ওটাকে কাছে নিয়ে আয় তো।"
"বাদ দাও। ঘরে চল। পরে ঠান্ডা লাগলে মা বকবে ফের।"
"নিয়ে আয়। আমাকে শুয়ে দে আবার।"
আমার সময় কম। বাড়ির কাজ শেষ করতে হবে। কালক্ষেপণ করা নিজেকে শাস্তি প্রদান স্বরূপ এখন। আমি কথা না বাড়িয়ে বিড়ালটাকে আনতে গেলাম। অবাক কান্ড! আমাকে কাছে টের পেয়েও এটা সরে গেল না, দৌড়ে পালিয়ে গেল না অনিমেষ। আমি নিরীহ হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরলাম বিড়ালটাকে।
দাদা বিড়ালটাকে বুকের কাছে টেনে নিল। গরম উত্তাপে ওম দিল।
সেই থেকে বিড়ালটা আমাদের গৃহপালিত পশু বিশেষ। কয়েকদিনের মধ্যে বিড়ালটা অনেকের বিনেপয়সার সঙ্গী হয়ে গেল। লিলি আপা তো ফি বিকালে হাঁটতে বের হয় দিঘীর পাড়ে বিড়ালটাকে নিয়ে। অবাক বিষয় হল- লিলি আপার মেয়ে নিধীকে দেখলাম বিড়ালটার সাথে একা একা কথা বলছে। বেচারীকে উৎসাহ দেয়ার জন্য আমিও যোগ দিলাম। আমি আধশোয়া বসলাম আমার দু'পা মেলে দিয়ে। বিড়ালটাকে বসালাম আমার একত্রিত দুই পায়ের 'পরে। এটা অতি আরামদায়ক আসন। দু'পাকে এখন হালকা চালে দোলাতে হবে। চোখ বুজে আসে সরলছন্দিত সুখে। নিধী আমার দিকে বড়বড় চোখ করে তাকাচ্ছে।
"কিরে, ওভাবে দেখছিস কেন?"
"তুমি আমার আদর ওকে দিচ্ছ কেন? আমি কান্না করব, আম্মু বলে দিব।" এখানে বলা দরকার যে, সেসব রাত্রে নিধীর স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ঘুম আসে না, সেইসব রাতে ওকে ঘুম পাড়ানো জন্য এই পদ্ধতি অবলম্বন করি; নিধী ধারণা রাখে যে মামার কাছ থেকে পাওয়া এই আদরটুকু অবণ্টনযোগ্য এবং একান্ত নিজের- গায়ের লাওয়ারিশ লোমের মতন।
একদিনের কথা বলি। আমি বিকালের অবসরটুকু উপভোগ করছিলাম দূরের ধান ক্ষেতে বাতাসের ব্যস্ত অভিসার দেখতে দেখতে। কাছে যাচ্ছিলাম না, জগতের কিছু কিছু সৌন্দর্য দূর থেকেই ভোগ করা সুন্দরতম পন্থা। আমি বাহিরে পা বাড়ালাম আমার জামা-কাপড় আনার জন্য; জলিলদা কাপড় রোদে দিয়েছে। ঘরে আনার কাজটুকু এই অধমকেই করতে হবে।
বাগানের কাছটায় যাওয়ার সময় আমার পা নিশ্চল হয়ে গেল হঠাৎ- সাপটা ঠিক আমার কাছ থেকে দুই হাত দূরে; হলদে শরীরে কাল দাগকাটা। নেত্রপত্রহীন দুই চোখে প্রাগতৈহাসিক জাদু। আমার কি দৌড় দেয়া উচিত? কোন রকমে বাড়ির কাছে যেতে পারলেই হল। দৌড়ের সময় চিৎকার করে জলিলদা'কে ডাকব, তিনি নিচে নেমে আসবেন প্রয়োজনীয় অস্ত্র নিয়ে। আমি সরল বিশ্বাসে সর্তকতার সাথে একপা পিছালাম, আর তখনি সাপটা যে মারাত্নক গা-ছাড়া দিল তাতে আমার আত্না ঈশ্বরের আরাধনায় নিমগ্ন হয়ে গেল। সাপে কেটে মরব? শালা, এরচেয়ে বরং মাইশার জন্য বিদ্রোহ করে মরা ভাল; আশপাশের দু-তিন পাড়ায় কয়েক পুরুষ ধরে অমর হয়ে থাকব।
আমাকে উদ্ধারের জন্য এগিয়ে এল বিড়ালটা। সে অনেক আগেই এগিয়ে গিয়েছিল, মনে হয় আমার উপস্থিতি না থাকাতে ফিরে এসেছে। আশ্চর্য! বিড়ালটা নিরব পায়ে এসে সাপের লেজ কামড়ে দূরে ফেলে দিতে চাইল। নিজের ওজনের চেয়ে দ্বিগুণ ভারী ওজন বহন করা কত যে কঠিন তা আমি টের পেলাম বিড়ালটার এই সাহস দেখে। সাপটা হঠাৎ আক্রমণে দিশেহারা হয়ে রইল কয়েক সেকেন্ড। আর এইটুকু সময় ছিল আমার জন্য স্বর্গ পাওয়া। আমি ভোঁ-দৌড় দিলাম বাড়ির পানে। জলিলদা নেমে আসছে সিঁড়ি দিয়ে, হাতে বড় লোহার দণ্ড।
"খালাম্মা জানালা দিয়ে দেখছে,আমারে কইছে। আপনে তফাত গিয়া দাঁড়ায় থাকেন। দেখেন আমার খেলা....."
জলিলদা বীরবিক্রমে সাপ নিধনে প্রবৃত্ত হলেন। বিড়ালটা সাপটার কাছ থেকে সরে এসেছে। একে অন্যের দিকে সর্তক চোখে তাকিয়ে আক্রমণের পথ খুঁজছে। জলিলদা চিৎকার করে গিয়ে এক বাড়ি মার সাপটার ঠিক মাথা বরাবর। উনি এক মিনিটের মাথায় ধরাশয়ী করে ফেললেন সাপটাকে।
সেই রাতে বিড়ালটাকে আমি নিজ পয়সায় দুই লিটার দুধ আর তিনটা পাউরুটি খাওয়ালাম। বিড়ালটা আমারও সঙ্গী হয়ে গেল। আমি বাগান কিংবা ঝোপঝাড়, ক্ষেতে বেড়াতে গেলে সে আমার দ্বিতীয় ছায়া হয়।
তবে আজকাল খাতির বিড়ম্বনার মতন ওটার উপস্থিতি আজকাল কাঁটার মতন। গলার কাঁটা দূরীকরণে বিড়ালের পা ধরা হয়, বিড়াল দূরীকরণে কি কর্তব্য? আমি নিত্যদিন ভাবছি।
--------------------------------------
ঘুমটা ভাঙল মায়ের চিৎকারে। মা ধমকের সুরে কথা বললেই চিৎকারের মত শোনায়। নিশ্চয় বাবাকে অপ্রিয় বাজার সামগ্রী আনার জন্য কথাপিটা করছে! ধুর...ঘুমটা বেশ জমেছিল। মাইশাকে প্রায় রাজিয়ে করে ফেলেছিলাম সিনেমা দেখার ব্যাপারে। মা হতে দিল না আমার একরত্তি অভিসার।
আমি তোয়ালে নিয়ে দরজার চৌকাঠে দাঁড়ালাম। বাবার টিকিটি নেই আশপাশে। কাজের লোক জলিলদা অনতিদূরে দাঁড়িয়ে, যেন পালিয়ে যেতে পারলে বাঁচে। আমার দক্ষ চোখ ঘটনার কেন্দ্রস্থলে হানা দিল অতিদ্রুত। বিড়ালটা মেঝেতে বসা, আশপাশে দুধেল সমুদ্দুর। ঘটনা বুঝতে দেরী হল না।
"দেখ, কাণ্ড দেখ। তোর বাবার জন্য দুধ গরম দিয়েছিলাম, এসে দেখি এই অবস্থা।"
"আমার ঘুম ভেঙে গেল।"
"আজই এটাকে দূরে কোথাও ফেলে দিয়ে আস।" মা সমন জারী করল।
আমি কিছু না বলে বাথরুমে প্রবেশ করলাম। বাথরুম কিন্তু চিন্তা করার জন্য উৎকৃষ্ট জায়গা, আমার মনে হয়। নীরব, নিজের শ্বাস-প্রশ্বাস সাক্ষী রেখে চিন্তা করা যায়। সাক্ষী রেখে চিন্তা করার ব্যাপারটা খোলাসা করে বলি। আমাদের সকল চিন্তাই কোন না কোন বস্তু, ব্যক্তিকে সাক্ষী রেখে। এটা সবল সত্য। এটা বিষয় জানেন? মানুষ যত বৃদ্ধ হয় তার ভিতর মায়া বসতি গড়ে। শৈশব আর বাধৈক্য হল মায়ার আশ্রম সময়। কৈশোর হল নিষ্ঠুর কাল। কিশোররা সবচেয়ে নিষ্ঠুর প্রকৃতির হয়; আর যৌবন, সে পাখা মেলার সময়। আমি কিন্তু বিশিষ্ট চিন্তাবিদ না। তবে ভাবি, আপনিও যেমন ভাবেন; আমি হয়ত এক চামচ বেশি ভাবি।
আমি বিড়ালটাকে নিয়ে চিন্তা করলাম। বাথরুমের ত্যাগ কার্যাবলীর প্রেক্ষাপটে আমার মাথায় ব্যাপারটা খেলে গেল। আমি পরিষ্কার হয়ে বের হলাম।
"মা, খাবার দাও। ঘরে কি পাকা মরিচ আছে? একটু ভর্তা করে দিবে?"
আমি আহলাদী সুরে বললাম। আমি জানি মা না করবে না। মায়েরা না করতে ঘৃণা করে।
"দেখি। তার আগে এটাকে দূর কর। তোর বাবা আসলে হৈচৈ কাণ্ড বাঁধাবে।"
"বাবা কোথায়?"
"সকালে তো বের হল। হাঁটতে। বাজারে যেতে পারে। বুদ্ধি করে দুধ নিয়ে এলে হয়, ঘরে একটুও বাকি নেই।"
আমি বিড়ালটাকে নিয়ে ঘর থেকে বের হলাম। সিঁড়িতে দেখা হল জলিলদা'র সাথে। তার হাতে কোদাল, কাঁচি; নিশ্চয় বাগান থেকে ফিরছে।
"কই যান ভাইজান?"
"মা বলল এটাকে দূরে ফেলে আসতে।" আমি বিড়ালটার দিকে ঈঙ্গিত করলাম।
"মাটি মাইখ্যা দিয়েন। তাইলে আর আইবো না।"
আমি সরু চোখে তাকালাম। কৌতুহলের সাথে বললাম, "কেন? মাটি কেন?
"কাদা মাটি মাইখ্যা দিলে বিড়াল ঘরে ফিরে না। আমার দাদায় বলছিল। আমাদের বাড়িতে একবার ইয়া বড়......" আমি জলিলদাকে গল্প ফাঁদতে দিলাম না। তার হাতের কাঁচিটা নিয়ে নিলাম। মাটি কাটায় সুবিধা হবে।
আমি চলে এসেছি দিঘীর পাড়ে। দিঘীর পানি টলটলা, তবে সোঁদা গন্ধ। কেহ ব্যবহার করে না বিধায়। যে গোসল করবে তার শরীর তেলাপোকার মত গন্ধ হয়ে যাবে।
দিঘী, পুকুর কিংবা জলাশয়ের চারধারে সাধারণত নারিকেল, সুপারী ইত্যাদি গাছ রোপন করা হয়, যেন সূর্যালোক আবদ্ধ না হয়। কিন্তু দাদার বিচিত্র খেয়ালের কারণে আমাদের দিঘীর চারধা' শোভা পাচ্ছে চার চারটি বটবৃক্ষ। কথিত আছে, দাদীজানের মন রক্ষা করতে গিয়ে দাদাজান বটগাছ লাগিয়েছিলেন। দাদীজান খেয়ালী মহিলা ছিলেন।
আমি উত্তর দিকের বটগাছটার নিচে চলে এলাম। গাছের গুঁড়িতে বসলাম আরাম করে। হাতের বিড়ালটাকে মাটিতে রাখলাম। বাগানের মাটি কোপানোর কাঁচিটা দিয়ে কিছু মাটি তুলে আনলাম। কাদা দরকার আমার। জলিলদা তাই বলেছে। আমি দিঘীর কাছ থেকে কিছু জল ধার করে নিয়ে আনলাম। দিঘী জানে আমি আজন্মের ঋণগ্রস্ত মানুষ।
পানি, মাটি মিশিয়ে ব্যস্ত হাতে কাদা বানিয়ে ফেললাম। আলতো করে বিড়ালের সারা গায়ে মাখলাম। বিড়ালটা কাঁপছে। হাত থেকে ছুটে যেতে চাচ্ছে। এটা কি টের পেয়ে গেছে? আমি বাম হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে রেখে ডান হাত দিয়ে কাঁচিটা নিলাম। ঘাড়ের কাছটা থেকে শুরু করলাম, প্রথমে হালকা টান দিলাম। কয়েকটা লোম উঠে এল। এবার গভীর করে কাঁচিটা টেনে আনলাম সোজা ঘাড় থেকে লেজ পর্যন্ত। কয়েক সেকেন্ডের জন্য কিছুই হল না, সাদা চর্বির মত দেখাল। ব্যাটা তো দেখি অনেক চর্বি বানিয়েছে। তারপর ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হল। বিরতিহীনভাবে। বিড়ালটা আমার হাতের মধ্যে লাফাচ্ছে। আমি হিমশিম খাচ্ছি প্রায়।
আমি কাঁচিটা হালকা অথচ গভীরভাবে চালিয়ে দিলাম গলা বরাবর। গৎ, গৎ করে শব্দ হল কিছুক্ষণ। অনর্গল রক্ত বের হচ্ছে। আমার হাত রক্তে মাখামাখি। এক সময় বিড়ালটা নিস্তেজ হয়ে এল। আমি খানিকক্ষণ নিরব বসে রইলাম। বিপ্রতীপ ভালবাসা বড় যন্ত্রণার।
তারপর আমার মস্তিষ্ক সচল হল। এটাকে চাপা দিতে হবে। আচ্ছা, দিঘীতে ফেলে দিলে কি হয়? ঝামেলা চুকে গেল। আমার কোন গর্ত করার ঝামেলায় যেতে হবে না। কিন্তু এটা তো ভেসে উঠবে আবার। সবাই টের পেয়ে যাবে। বিকালের দিকে অনেকে দিঘীর পাড়ে বেড়াতে আসে। আচ্ছা, কাঁচিটা বিড়ালটার শরীরে গেঁথে ফেলে দিলে কেমন হয়? জলিলদা নিশ্চয় কাঁচির জন্য আমার জাত-মান গাইবে না। জানতে চাইলে কিছু একটা বলে দিলেই হল। বলব, হারিয়ে গেছে। কাঁচি আর বিড়ালের সম্মিলিত আপেক্ষিক গুরুত্ব নিশ্চয় পানি অপেক্ষা বেশি। কাঁচি ভারী, হওয়ার সম্ভবনাই বেশি।
আমি তাই করলাম। এক কোপে মৃত বিড়ালটার শরীরে গেঁথে ফেললাম কাঁচিটা। দিঘীর শান্ত জলে ছুঁড়ে দিলাম কাঁচিসমেত বিড়ালের শরীর। ধুপ! একটা শব্দ হল, অতঃপর সব তলিয়ে গেল।
আমি হাত ধুয়ে নিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম। মা নিশ্চয় আমার জন্য ভর্তা করে বসে আছে। অনেকদিন পর তারিয়ে তারিয়ে খাওয়া যাবে। কতদিন খাই না!
No comments:
Post a Comment