এখানে রোদ জমে আলোর নদী হয়ে যাচ্ছে। আমরা গতরাতের কুয়াশার চাদর খুলে ঝাঁপি দিই, ঝাঁপি দিই বিবস্ত্র শরীরে। জলের ওম লেগে আসে আস্তিনে, চোখে, মুখে, নাকে। আমরা হাঁপি খাই। মাছের ঘ্রাণ নিয়ে অটুট হয়ে আছে কয়েকটি শালুক। আমরা তাদের কাছে গিয়ে দাঁড়াই। রোদের গল্প শুনি।
আমরা শুভালক্ষ্মীর জলে সিনানে।
দূরবর্তী মাঠে স্তনমতো হয়ে আছে একটি বট; তাহার শাখাহাড়ে, পাতার গোপনে কতগুলো শালিক খেলা করে বাতাসের সনে। আমরা দেখি। আমরা পাখি গুণি। আমরা বয়েসের হিসেব ভুলে যাই।
"পানিতে নামি?" প্রশ্ন শুনে আমরা মুখ ফিরে তাকাই। কয়েক গোছা ছেলেমেয়ে এসেছে স্নানে, তাদের হাতে-বুকে বিদ্যালয়ের পাঠসূচি।
"ইস্কুল শ্যাষ?" আমরা প্রশ্ন করি। আমাদের আদি জ্ঞানীপিতা সক্রেটিস প্রশ্ন করছেন।
"আইজকার লাই আঁর যন লাগতো ন।" তাহারা ঘাসের কোলে বই রেখে নেমে পড়ে, সাথে শৈশব। শালিকগুলো এসে নামতা পড়ে যায়, আমরা হাঁস হয়ে রই।
শীতলপাটি তৈয়ারীর ঝুম বেঁধেছে দাওয়ায়। বাতাসে বকুলফুলের ঘ্রাণসংসার। পাটিপাতা দিয়ে শীতলপাটিতে বিকেল লেখে রাখে শাহানা আপা, আমরা ছায়ার মাঝি হয়ে এসে দাঁড়াই তার চুলের নদীর কাছে। পিছনে লুকিয়ে রাখি মেঘের বিস্ময়।
'কনরে?'
'মুখ তুলবা না। কও তো কী আছে হাতের মইধ্যে।'
শাহানা আপা বাইন মাছের সখি হয়ে যান, বাতাসে সাঁতার কাটেন।
'কেমনে কমু, চক্ষের তুন হাত সরা।'
আমরা হাত সরি নিই। অন্য হাত দিয়ে পিছন থেকে বের করে আনি শালুকের মালা। এখনো টুপটাপ পানি ঝরছে। সাদাসাদা।
'তোমারে পরাই দি?' শাহানা আপা মেঘের মেয়ে, তার দয়ার শরীর। আমরা উৎসাহ পেয়ে মালা পরিয়ে দিই, আমরা এখন সাইকেল নিয়ে আইলের মাঝ দিয়ে চলে যাব বাংলাগঞ্জে; শুনেছি সেখানে সাপের খেলা জমে।
বাড়ির পিছনে বাগিচার ক্রমশবিস্তার। আম, কাঁঠাল, বেল, গাম, তেঁতুল ইত্যাদির পাতাদলের মাঝে রোদ হাড্ডুডু খেলে। ঝুম শব্দ করে খসে পড়ে পাতার আঁচল, ফলের গৌরব। আমরা কুঁড়িয়ে নিয়ে শাহানা আপার হাতে দিই। শাহানা আপা আঁচার করেন, আমসত্ত্ব করেন। আমরা সেইসব খেয়ে পড়া ভুলে যাই। মক্তবের নানী বেত দিয়ে শয়তান তাড়ান।
আমরা ধানক্ষেতে ইঁদুর তাড়ানো খেলতে গিয়ে বইপত্তুর হারিয়ে ফেলি, মাস্টারমশাই ইচ্ছেমতন বকে দেন; আমরা পাটক্ষেতে এসে মাস্টারমশাইর সমন্ধী করি! আমরা কাঁদতে কাঁদতে ঘরে ফিরি। শাহানা আপা মনভুলানো গল্প করেন সন্ধ্যের নামাজ পড়ে। আকাশে তখন চাঁদের বুড়ি তারার খই বাজে। আমরা ভরপুর খেয়ে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাদা। শাহানা আপা, আমাদের মা মিলে আমাদের দেহকে বিছানার শরীরে পুতুল বানিয়ে রাখেন।
লোকটার শুঁয়োপোকার মতো গোঁফ আছে। তাতে সূর্যের আলো লেগে ঝিকমিক করে উঠে। আমরা অভিশাপ দিই লোকটার গোঁফের বনে ইঁদুর-বিড়াল খেলা করুক, উঁকুন হোক। শাহানা আপা বিকাল বিক্রি করে দেন। আমরা নিম্নশ্রেণীর সওদাগর বলে ঠেকাই পড়ি। শাহানা আপা আর লোকটা বিকালে হাঁটেন, মাঝে মাঝে লোকটা আপার হাত ধরে। আমরা সাইকেলের চেইন হারিয়ে ফেলি, চেইন পড়ে গেলে বাতাসের ঝুমঝুমে আলেয়া হয়ে কাঁদি।
বাঁশঝাড়ের পাশে সিনানঘর, পয়ঃনিষ্কাশনঘর। ছোপ ছোপ অন্ধারে আমাদের ভয় লাগে; আশপাশে ঝিঁঝিঁ ডাকে, মাঝে মাঝে শিয়াল। আমরা ভয়ে হাসনাহেনা হয়ে যাই, আতংকের সাপ ভর করে। নক, নক; কড়া নেড়ে চলি একলা, দরজার ব্যায়াম হয়।
'কনরে?' শাহানা আপা মৃদ্যু স্বরে কহেন। আমরা তাহার চৌকির নড়াচড়ার শব্দ শুনি।
'প্রশ্রাবে ধইরছে। ভয় লাগে।'
শাহানা আপা ঘুমের কইতর চোখে নিয়ে বের হয়ে আসেন। জানালার ফাঁকে আসা চাঁন্দ্রের কোমল আলোয় সেই সব কইতর খেলা করে, শাহানা আপার চোখ দুটি সাদাসাদা।
'ওইখানে জামের গাছ আছে, কালাকালা জাম। খাইতে অনেক মিষ্ট।' আমরা কথা বুনি, ভয় কমে আসে। ভয়গুলো উড়ে গিয়ে মেঘ হয়ে রয় কালোকালো, চাঁদের মেয়েকে তারা চমকিত করবে বলে।
নারকেল পাতার ফাঁকে ফাঁকে আমরা দৃষ্টি দিয়ে চাঁদের মেয়েকে দেখে রাখি।
'জাম খাইলে কইল্জা লাল হয়, লাল কইল্জালা মানুষের বুকে অনেক সোহাগ।' শাহানা আপা ঘুমপাখি নীড় বাঁধা চোখে তাকিয় থাকেন।
'কিন্তু ভিত্তরে তো পুরা কালা, কলিম চাচাগো করণীর চমড়ার মতন।'
'কথা না কই তাড়াতাড়ি কর। বিহানে বিহানে উড়তে অইব।'
আমরা নৈঃশব্দের খরগোশ হয়ে যাই। আমরা আর কথা বলি না।
আপা টের পান আমাদের নিরবতা। বাতাসে চাপ সৃষ্টি করেন তিনি, 'এই বাঁশঝাড়ে মনহয় ফুল আইবো।'
আমরা বাঁশঝাড়কে ঈর্ষা করি। তাহাদের ফুল হয়, আমরা ফুল খেয়ে ফেলি।
'বাঁশে ফুল আইলে তো ইঁন্দুর-ও আইবো। তখন কাঁথা-কাপর আর পরা লাগদো ন।'
'বাঁশের ফুল অনেক হইলদা অয়।'
'তুঁই কি দেখছনি?'
'বাপের কাছে হুইনছি।'
আমরা নিঃশ্বাস বন্ধ করে রাখি, শাহানা আপার বাপ মানে আমাদের জেঠ্যা তারাদের নগর থেকে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকেন।
'তুঁই মন খারাপ কইরো না। তাইলে কিন্তুক জাম আঁইতান ন।'
শাহানা আপা তাকান। ঝিঁঝির কণ্ঠথলে চুরি করে যেন শাহানা আপা কেঁদে উঠেন। আমরা অবাক হয়ে অন্ধকারের বিস্তার দেখি। কাঁন্নায় মৃদ্যু বেঁকে উঠে তাহার পিঠের উঠোন। আমরা হাত রাখি।
শাহানা আপা আমাদের কাছে টেনে নেন।
'তুঁই কক্কোনো কাঁনবা না।' বলেই আমরা নিজেরাই কাঁদতে থাকি। তাহার শরীরের উষ্ণ, ওম আমাদের দেহে সঞ্চারিত হয়; আমরা কান্নার অশ্রুপদ্ম মেলে ধরি।
লোকটা কৃমির মতো গোঁফে রোদের রঙ নামিয়ে আসে মাঠে। আমরা পাদগোলক খেলা স্থগিত করে তাহার নতুন কোর্তার ঝুলন দেখি, কাদার আঙুল-স্পর্শ পাশ কাটিয়ে সে মাঠের ঘাসে এসে দাঁড়ায়।
'আমাকে খেলায় নিবে?'
আমরা খেলা ভুলে যাই, খেলার কৌশল। পৃথিবীর মানুষ খেলে নাকি? মনে হয় না, তাহারা শুধু পরষ্পরকে চিনিয়ে দেয় নিজেকে!
মাঠে রোদ জমে দিঘী হয়ে যায়। আমরা বল গুঁটিয়ে নিয়ে সাঁতারে যাই। লোকটা বিস্ময়ে চেয়ে থাকে, অতপর আকাশ দেখে- দু্ঃখসম্বন্ধী আকাশে পাখিদের উড্ডয়ন-ক্যানভাস।
খবর পেয়ে আমি ছুটে আসি, অথচ ভুলে যাই সাইকেলের কথা। আমরা ভুলে যাই বই-খাতার নিবিড়, জানি কাল মাস্টারমশাইয়ের হাত খোলামেলা হবে।
উঠোনে বৃক্ষছায়া ঝুলে আছে একলা একলা, আমরা গোপনে বৈঠকখানার দরজার অন্তরালে দাঁড়াই- আমরা ছায়া। শুনি গমনের উচ্চারণ- লোকটা চলে যাবে; সে সাথে নিয়ে যাবে স্বাদের আড়ম্বর। কাল বা পরশুর মাঝে সমাধা হয়ে গেলে নতুনকে নিয়ে যাবে শহরে। শুনে আমরা স্মরণ করি শালুকদের- তাদের আর ছিঁড়ে আনব না, মালা দিব না। শাহানা আপার নিচু মুখ দেখি, তাহার চোখ দেখে না সজল আমাদের।
আমরা জামের বনে চলে আসি। পাগলের মতো চঞ্চুচোখে জাম পাড়তে থাকি। মাঠের উর্বরে ছড়িয়ে দিই জামের প্লাবন- ধানেরা জামের মিষ্টি নিক, বাতাসের মুখে-ও খানিক। এই ধানক্ষেতে, সবজির ফলনে জামের বাগান জেগে উঠুক- কেউ যেন জামের স্বাদ না ভুলায়; জাম খাইলে কইল্জা লাল হয়, লাল কইল্জালা মানুষের বুকে অনেক সোহাগ!
দূরে রোদের ভাঁজে ঝিলিক দিয়ে উঠে সাদাসাদা। আমরা জামের বিটপী ছেড়ে কাছে গিয়ে দাঁড়াই। বাঁশের পাতার ছুরিতে কাটছে বাতাস আর রোদ। আমরা উপরে তাকাই। সেই সব পাতার গোপনে ফুল! বাঁশফুল- সাদাসাদা।
সেই থেকে আমরা ইঁদুর হয়ে তাহার ঘ্রাণঘ্রাণ খুঁজি।
২৫ই আগস্ট, ২০০৯
আমরা শুভালক্ষ্মীর জলে সিনানে।
দূরবর্তী মাঠে স্তনমতো হয়ে আছে একটি বট; তাহার শাখাহাড়ে, পাতার গোপনে কতগুলো শালিক খেলা করে বাতাসের সনে। আমরা দেখি। আমরা পাখি গুণি। আমরা বয়েসের হিসেব ভুলে যাই।
"পানিতে নামি?" প্রশ্ন শুনে আমরা মুখ ফিরে তাকাই। কয়েক গোছা ছেলেমেয়ে এসেছে স্নানে, তাদের হাতে-বুকে বিদ্যালয়ের পাঠসূচি।
"ইস্কুল শ্যাষ?" আমরা প্রশ্ন করি। আমাদের আদি জ্ঞানীপিতা সক্রেটিস প্রশ্ন করছেন।
"আইজকার লাই আঁর যন লাগতো ন।" তাহারা ঘাসের কোলে বই রেখে নেমে পড়ে, সাথে শৈশব। শালিকগুলো এসে নামতা পড়ে যায়, আমরা হাঁস হয়ে রই।
শীতলপাটি তৈয়ারীর ঝুম বেঁধেছে দাওয়ায়। বাতাসে বকুলফুলের ঘ্রাণসংসার। পাটিপাতা দিয়ে শীতলপাটিতে বিকেল লেখে রাখে শাহানা আপা, আমরা ছায়ার মাঝি হয়ে এসে দাঁড়াই তার চুলের নদীর কাছে। পিছনে লুকিয়ে রাখি মেঘের বিস্ময়।
'কনরে?'
'মুখ তুলবা না। কও তো কী আছে হাতের মইধ্যে।'
শাহানা আপা বাইন মাছের সখি হয়ে যান, বাতাসে সাঁতার কাটেন।
'কেমনে কমু, চক্ষের তুন হাত সরা।'
আমরা হাত সরি নিই। অন্য হাত দিয়ে পিছন থেকে বের করে আনি শালুকের মালা। এখনো টুপটাপ পানি ঝরছে। সাদাসাদা।
'তোমারে পরাই দি?' শাহানা আপা মেঘের মেয়ে, তার দয়ার শরীর। আমরা উৎসাহ পেয়ে মালা পরিয়ে দিই, আমরা এখন সাইকেল নিয়ে আইলের মাঝ দিয়ে চলে যাব বাংলাগঞ্জে; শুনেছি সেখানে সাপের খেলা জমে।
বাড়ির পিছনে বাগিচার ক্রমশবিস্তার। আম, কাঁঠাল, বেল, গাম, তেঁতুল ইত্যাদির পাতাদলের মাঝে রোদ হাড্ডুডু খেলে। ঝুম শব্দ করে খসে পড়ে পাতার আঁচল, ফলের গৌরব। আমরা কুঁড়িয়ে নিয়ে শাহানা আপার হাতে দিই। শাহানা আপা আঁচার করেন, আমসত্ত্ব করেন। আমরা সেইসব খেয়ে পড়া ভুলে যাই। মক্তবের নানী বেত দিয়ে শয়তান তাড়ান।
আমরা ধানক্ষেতে ইঁদুর তাড়ানো খেলতে গিয়ে বইপত্তুর হারিয়ে ফেলি, মাস্টারমশাই ইচ্ছেমতন বকে দেন; আমরা পাটক্ষেতে এসে মাস্টারমশাইর সমন্ধী করি! আমরা কাঁদতে কাঁদতে ঘরে ফিরি। শাহানা আপা মনভুলানো গল্প করেন সন্ধ্যের নামাজ পড়ে। আকাশে তখন চাঁদের বুড়ি তারার খই বাজে। আমরা ভরপুর খেয়ে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাদা। শাহানা আপা, আমাদের মা মিলে আমাদের দেহকে বিছানার শরীরে পুতুল বানিয়ে রাখেন।
লোকটার শুঁয়োপোকার মতো গোঁফ আছে। তাতে সূর্যের আলো লেগে ঝিকমিক করে উঠে। আমরা অভিশাপ দিই লোকটার গোঁফের বনে ইঁদুর-বিড়াল খেলা করুক, উঁকুন হোক। শাহানা আপা বিকাল বিক্রি করে দেন। আমরা নিম্নশ্রেণীর সওদাগর বলে ঠেকাই পড়ি। শাহানা আপা আর লোকটা বিকালে হাঁটেন, মাঝে মাঝে লোকটা আপার হাত ধরে। আমরা সাইকেলের চেইন হারিয়ে ফেলি, চেইন পড়ে গেলে বাতাসের ঝুমঝুমে আলেয়া হয়ে কাঁদি।
বাঁশঝাড়ের পাশে সিনানঘর, পয়ঃনিষ্কাশনঘর। ছোপ ছোপ অন্ধারে আমাদের ভয় লাগে; আশপাশে ঝিঁঝিঁ ডাকে, মাঝে মাঝে শিয়াল। আমরা ভয়ে হাসনাহেনা হয়ে যাই, আতংকের সাপ ভর করে। নক, নক; কড়া নেড়ে চলি একলা, দরজার ব্যায়াম হয়।
'কনরে?' শাহানা আপা মৃদ্যু স্বরে কহেন। আমরা তাহার চৌকির নড়াচড়ার শব্দ শুনি।
'প্রশ্রাবে ধইরছে। ভয় লাগে।'
শাহানা আপা ঘুমের কইতর চোখে নিয়ে বের হয়ে আসেন। জানালার ফাঁকে আসা চাঁন্দ্রের কোমল আলোয় সেই সব কইতর খেলা করে, শাহানা আপার চোখ দুটি সাদাসাদা।
'ওইখানে জামের গাছ আছে, কালাকালা জাম। খাইতে অনেক মিষ্ট।' আমরা কথা বুনি, ভয় কমে আসে। ভয়গুলো উড়ে গিয়ে মেঘ হয়ে রয় কালোকালো, চাঁদের মেয়েকে তারা চমকিত করবে বলে।
নারকেল পাতার ফাঁকে ফাঁকে আমরা দৃষ্টি দিয়ে চাঁদের মেয়েকে দেখে রাখি।
'জাম খাইলে কইল্জা লাল হয়, লাল কইল্জালা মানুষের বুকে অনেক সোহাগ।' শাহানা আপা ঘুমপাখি নীড় বাঁধা চোখে তাকিয় থাকেন।
'কিন্তু ভিত্তরে তো পুরা কালা, কলিম চাচাগো করণীর চমড়ার মতন।'
'কথা না কই তাড়াতাড়ি কর। বিহানে বিহানে উড়তে অইব।'
আমরা নৈঃশব্দের খরগোশ হয়ে যাই। আমরা আর কথা বলি না।
আপা টের পান আমাদের নিরবতা। বাতাসে চাপ সৃষ্টি করেন তিনি, 'এই বাঁশঝাড়ে মনহয় ফুল আইবো।'
আমরা বাঁশঝাড়কে ঈর্ষা করি। তাহাদের ফুল হয়, আমরা ফুল খেয়ে ফেলি।
'বাঁশে ফুল আইলে তো ইঁন্দুর-ও আইবো। তখন কাঁথা-কাপর আর পরা লাগদো ন।'
'বাঁশের ফুল অনেক হইলদা অয়।'
'তুঁই কি দেখছনি?'
'বাপের কাছে হুইনছি।'
আমরা নিঃশ্বাস বন্ধ করে রাখি, শাহানা আপার বাপ মানে আমাদের জেঠ্যা তারাদের নগর থেকে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকেন।
'তুঁই মন খারাপ কইরো না। তাইলে কিন্তুক জাম আঁইতান ন।'
শাহানা আপা তাকান। ঝিঁঝির কণ্ঠথলে চুরি করে যেন শাহানা আপা কেঁদে উঠেন। আমরা অবাক হয়ে অন্ধকারের বিস্তার দেখি। কাঁন্নায় মৃদ্যু বেঁকে উঠে তাহার পিঠের উঠোন। আমরা হাত রাখি।
শাহানা আপা আমাদের কাছে টেনে নেন।
'তুঁই কক্কোনো কাঁনবা না।' বলেই আমরা নিজেরাই কাঁদতে থাকি। তাহার শরীরের উষ্ণ, ওম আমাদের দেহে সঞ্চারিত হয়; আমরা কান্নার অশ্রুপদ্ম মেলে ধরি।
লোকটা কৃমির মতো গোঁফে রোদের রঙ নামিয়ে আসে মাঠে। আমরা পাদগোলক খেলা স্থগিত করে তাহার নতুন কোর্তার ঝুলন দেখি, কাদার আঙুল-স্পর্শ পাশ কাটিয়ে সে মাঠের ঘাসে এসে দাঁড়ায়।
'আমাকে খেলায় নিবে?'
আমরা খেলা ভুলে যাই, খেলার কৌশল। পৃথিবীর মানুষ খেলে নাকি? মনে হয় না, তাহারা শুধু পরষ্পরকে চিনিয়ে দেয় নিজেকে!
মাঠে রোদ জমে দিঘী হয়ে যায়। আমরা বল গুঁটিয়ে নিয়ে সাঁতারে যাই। লোকটা বিস্ময়ে চেয়ে থাকে, অতপর আকাশ দেখে- দু্ঃখসম্বন্ধী আকাশে পাখিদের উড্ডয়ন-ক্যানভাস।
খবর পেয়ে আমি ছুটে আসি, অথচ ভুলে যাই সাইকেলের কথা। আমরা ভুলে যাই বই-খাতার নিবিড়, জানি কাল মাস্টারমশাইয়ের হাত খোলামেলা হবে।
উঠোনে বৃক্ষছায়া ঝুলে আছে একলা একলা, আমরা গোপনে বৈঠকখানার দরজার অন্তরালে দাঁড়াই- আমরা ছায়া। শুনি গমনের উচ্চারণ- লোকটা চলে যাবে; সে সাথে নিয়ে যাবে স্বাদের আড়ম্বর। কাল বা পরশুর মাঝে সমাধা হয়ে গেলে নতুনকে নিয়ে যাবে শহরে। শুনে আমরা স্মরণ করি শালুকদের- তাদের আর ছিঁড়ে আনব না, মালা দিব না। শাহানা আপার নিচু মুখ দেখি, তাহার চোখ দেখে না সজল আমাদের।
আমরা জামের বনে চলে আসি। পাগলের মতো চঞ্চুচোখে জাম পাড়তে থাকি। মাঠের উর্বরে ছড়িয়ে দিই জামের প্লাবন- ধানেরা জামের মিষ্টি নিক, বাতাসের মুখে-ও খানিক। এই ধানক্ষেতে, সবজির ফলনে জামের বাগান জেগে উঠুক- কেউ যেন জামের স্বাদ না ভুলায়; জাম খাইলে কইল্জা লাল হয়, লাল কইল্জালা মানুষের বুকে অনেক সোহাগ!
দূরে রোদের ভাঁজে ঝিলিক দিয়ে উঠে সাদাসাদা। আমরা জামের বিটপী ছেড়ে কাছে গিয়ে দাঁড়াই। বাঁশের পাতার ছুরিতে কাটছে বাতাস আর রোদ। আমরা উপরে তাকাই। সেই সব পাতার গোপনে ফুল! বাঁশফুল- সাদাসাদা।
সেই থেকে আমরা ইঁদুর হয়ে তাহার ঘ্রাণঘ্রাণ খুঁজি।
২৫ই আগস্ট, ২০০৯
No comments:
Post a Comment