০
এইসব রাতে রমিজ মিয়া পাশ ফিরে শোয়।
রমিজ মিয়া, সরকারপুকুর পাড়ার রমিজ মিয়া- বাবার নাম মরহুম মফিজ সর্দার, পাশ ফিরে শুতে গেলে বছর সাতেক বিবাহবার্ষিকী পার করা বৃদ্ধা খাটটি শব্দ করে তন্দ্রা ভেঙে ফেলে মাঝরাতিতে। বেড়ার ফাঁক দিয়ে রবিশস্য ছোঁয়া বাতাসের পাশাপাশি কয়েক গাছি জোছনা এসে মাটির ভিটায় চারুপাঠে বসে যায়।
অ
'হুদাই, ফাল মারিস না। যা করতে বললাম তাই করগে।'
'ছ্যার, আঁর কোন সমস্যা হইলে পরে কে দেখপো? হইলা পোলা হইছে। কয়েকদিন অপসর নিই?'
'এই অর্কমা জাতির কিছু হলো না আলসেমির কারণে। যা, দূরে গিয়া মর।'
'খোঁটা দেন ক্যা? কত দিবেন?'
'ঠিকঠাক মতো কর। খুশি হইলে অনেক পাবি। তুই তো জানিস এসব বিষয়ে...'
'সে আর বলতে।'
রমিজ মিয়া আবারো এপাশ-ওপাশ করেন। চোখের পাতা বন্ধ, চক্ষুমণিটা কেঁপে কেঁপে উঠে পাতার নিচে; শ্যামলতলী বাস-ইস্টিশনের চাপকলটার মতো করে।
২
'এই কাজটা করিস না। তোর মতোই তো লোকটা।'
'আমার মতো মানে? সে বিরাট মানুষ। দু'হাতে কামায়, মাটি কাটে না। মাটি কাটায়।'
'সৎ লোক, তোগো ব্যাপারীর মতো না।'
'ধুর, সদ-অসদের মায়েরে বাপ। এমুন দুর্যোগের কালে ভেলা ভাসায়ে লাভ নাই, ব্যাপারী অন্তত সাম্পানে ঠাঁই দিব।'
'সে ক্ষমতায় আসলে দুর্যোগ কমানির চেষ্টা দিব। করিস না কইলাম, তোর মায়ের কসম।'
'মা এখন মাটিঝুঁড়ির কয়লা। কব্বরে আছে। তার তো খিদা লাগে না, আমার লাগে। আমি হইলাম গাও্উয়া তেলাপোকা।'
'নয়া বিয়া করছে লোকটা। তোর বউরে ভালা লাগে না?'
'হাটে বেঁইচ্চা দিমু। এখন দূর হ হালার পো। ঘুমাইতে দে।'
আ
রমিজ মিয়া লাথি চালান। সে লাথি গিয়ে পড়ে বউয়ের গায়ের উপর। ধড়পড় করে উঠে বসে সে। ঘুমের খরগোশগুলো গিয়ে চৌকির তলায় লুকোয়। পাশ থেকে কিছু সরে যাওয়া টের পেয়ে রমিজ মিয়া-ও উঠে বসেন।
'হানি'
'কি?'
'বউ, হানি খামু। পিপাস লাগে।'
নবজাতকটা স্তনের বোঁটায় ঠোঁট লাগিয়ে ঘুমিয়ে, একটা কচি হাত দিয়ে মাকে জড়িয়ে আছে।
'এখন উটলে তো পোলা জাইগ্গা যাইব। সারারাত না ঘুমায়ে কাটান লাগব'পরে। আপনে এক কাম করে, নিজে গিয়া খান। কলসী ভরা আছে।'
রমিজ মিয়া লুঙ্গি সামলায়ে উঠে পড়ে।
'ঘুম ভাঙল ক্যান?'
'বউ, তোমারে বেঁইচ্চা দিছি।'
'কী সব কন। মাথা ঠিকাছে?'
'স্বপ্নে উজান নাচেরে বউ, ঘুমাইতে পারি না।'
'পানি খান, খাইয়া ঘুম দেন। আমি মাথায় হাত বুলাই দি, আসেন।'
৩
পুকুরে খালি কলসী ডুবালে প্রথম যেমন ডগডগ করে পানি ঢুকে সেরকম করে রমিজ মিয়া পানি খায়। কিছু গড়িয়ে পড়ে চিবুক বেয়ে কাঁধের কাছের কাটাদাগটার পাশ দিয়ে, যেন আরেকখান নদী। গতবার ভোটের সময় সজীব হারামিটা কোঁপ দিয়েছিল।
সে এসে ভ্রান্তির চাদর ঢেকে শুয়ে পড়ে। ঝর্ণাবউটা কলকল করে বিলি কেটে দেয়। শিশুটা নির্ভরতার গন্ধে আরেকটু ঘুমিয়ে মৃন্ময়।
রমিজ মিয়া এধার-ওধার করেন। চোখের পাতা নেতানো, চক্ষুমণিটা কেঁপে কেঁপে উঠে পাতার নিচে।
ই
'শুধু একটা ঘ্যাচাং। আর কিছু না।'
'পারুম তো? গতবারের লাহান ক্যাঁচাল হবে না তো?'
'কালা শাল পইরা যাবি। সবকিছু কালা। পারলে কালি-ও মাখতারিস। সবজি খেতের পাশ দিয়ে....'
'আপনে কথা রাখপেন তো? আমারে যেন টিকটিকিরা না ধরে'
'ধুর শালা, বেশি কথা বলিস। আমি আছি না। চিন্তা নিস না। কাজ শেষ করলে টেম্পুটা তোর, যা।'
'একবারে না কইরা লুলা করি দিই, কী কন?'
'যা করবার বললাম তাই কর। লুলা করলে-ও সে বক্তৃতা করব। এরে ডুমুরফুল বানানির কাম।'
রমিজ মিয়া টাকার ধারের মতো রামদাটা দেখে। কলাগাছের কস্ লেগে কেমন কালো হয়ে আছে।
৪
এইসব রাতে রমিজ মিয়া পাশ ফিরে শোয়। মূলত মানুষ আদি থেকে পাশ ফিরে শোয়- পৃথিবীটাকে আরেকটু পাশ ফিরে শোয়ানোর চেষ্টায়।
এইসব রাতে রমিজ মিয়া পাশ ফিরে শোয়।
রমিজ মিয়া, সরকারপুকুর পাড়ার রমিজ মিয়া- বাবার নাম মরহুম মফিজ সর্দার, পাশ ফিরে শুতে গেলে বছর সাতেক বিবাহবার্ষিকী পার করা বৃদ্ধা খাটটি শব্দ করে তন্দ্রা ভেঙে ফেলে মাঝরাতিতে। বেড়ার ফাঁক দিয়ে রবিশস্য ছোঁয়া বাতাসের পাশাপাশি কয়েক গাছি জোছনা এসে মাটির ভিটায় চারুপাঠে বসে যায়।
অ
'হুদাই, ফাল মারিস না। যা করতে বললাম তাই করগে।'
'ছ্যার, আঁর কোন সমস্যা হইলে পরে কে দেখপো? হইলা পোলা হইছে। কয়েকদিন অপসর নিই?'
'এই অর্কমা জাতির কিছু হলো না আলসেমির কারণে। যা, দূরে গিয়া মর।'
'খোঁটা দেন ক্যা? কত দিবেন?'
'ঠিকঠাক মতো কর। খুশি হইলে অনেক পাবি। তুই তো জানিস এসব বিষয়ে...'
'সে আর বলতে।'
রমিজ মিয়া আবারো এপাশ-ওপাশ করেন। চোখের পাতা বন্ধ, চক্ষুমণিটা কেঁপে কেঁপে উঠে পাতার নিচে; শ্যামলতলী বাস-ইস্টিশনের চাপকলটার মতো করে।
২
'এই কাজটা করিস না। তোর মতোই তো লোকটা।'
'আমার মতো মানে? সে বিরাট মানুষ। দু'হাতে কামায়, মাটি কাটে না। মাটি কাটায়।'
'সৎ লোক, তোগো ব্যাপারীর মতো না।'
'ধুর, সদ-অসদের মায়েরে বাপ। এমুন দুর্যোগের কালে ভেলা ভাসায়ে লাভ নাই, ব্যাপারী অন্তত সাম্পানে ঠাঁই দিব।'
'সে ক্ষমতায় আসলে দুর্যোগ কমানির চেষ্টা দিব। করিস না কইলাম, তোর মায়ের কসম।'
'মা এখন মাটিঝুঁড়ির কয়লা। কব্বরে আছে। তার তো খিদা লাগে না, আমার লাগে। আমি হইলাম গাও্উয়া তেলাপোকা।'
'নয়া বিয়া করছে লোকটা। তোর বউরে ভালা লাগে না?'
'হাটে বেঁইচ্চা দিমু। এখন দূর হ হালার পো। ঘুমাইতে দে।'
আ
রমিজ মিয়া লাথি চালান। সে লাথি গিয়ে পড়ে বউয়ের গায়ের উপর। ধড়পড় করে উঠে বসে সে। ঘুমের খরগোশগুলো গিয়ে চৌকির তলায় লুকোয়। পাশ থেকে কিছু সরে যাওয়া টের পেয়ে রমিজ মিয়া-ও উঠে বসেন।
'হানি'
'কি?'
'বউ, হানি খামু। পিপাস লাগে।'
নবজাতকটা স্তনের বোঁটায় ঠোঁট লাগিয়ে ঘুমিয়ে, একটা কচি হাত দিয়ে মাকে জড়িয়ে আছে।
'এখন উটলে তো পোলা জাইগ্গা যাইব। সারারাত না ঘুমায়ে কাটান লাগব'পরে। আপনে এক কাম করে, নিজে গিয়া খান। কলসী ভরা আছে।'
রমিজ মিয়া লুঙ্গি সামলায়ে উঠে পড়ে।
'ঘুম ভাঙল ক্যান?'
'বউ, তোমারে বেঁইচ্চা দিছি।'
'কী সব কন। মাথা ঠিকাছে?'
'স্বপ্নে উজান নাচেরে বউ, ঘুমাইতে পারি না।'
'পানি খান, খাইয়া ঘুম দেন। আমি মাথায় হাত বুলাই দি, আসেন।'
৩
পুকুরে খালি কলসী ডুবালে প্রথম যেমন ডগডগ করে পানি ঢুকে সেরকম করে রমিজ মিয়া পানি খায়। কিছু গড়িয়ে পড়ে চিবুক বেয়ে কাঁধের কাছের কাটাদাগটার পাশ দিয়ে, যেন আরেকখান নদী। গতবার ভোটের সময় সজীব হারামিটা কোঁপ দিয়েছিল।
সে এসে ভ্রান্তির চাদর ঢেকে শুয়ে পড়ে। ঝর্ণাবউটা কলকল করে বিলি কেটে দেয়। শিশুটা নির্ভরতার গন্ধে আরেকটু ঘুমিয়ে মৃন্ময়।
রমিজ মিয়া এধার-ওধার করেন। চোখের পাতা নেতানো, চক্ষুমণিটা কেঁপে কেঁপে উঠে পাতার নিচে।
ই
'শুধু একটা ঘ্যাচাং। আর কিছু না।'
'পারুম তো? গতবারের লাহান ক্যাঁচাল হবে না তো?'
'কালা শাল পইরা যাবি। সবকিছু কালা। পারলে কালি-ও মাখতারিস। সবজি খেতের পাশ দিয়ে....'
'আপনে কথা রাখপেন তো? আমারে যেন টিকটিকিরা না ধরে'
'ধুর শালা, বেশি কথা বলিস। আমি আছি না। চিন্তা নিস না। কাজ শেষ করলে টেম্পুটা তোর, যা।'
'একবারে না কইরা লুলা করি দিই, কী কন?'
'যা করবার বললাম তাই কর। লুলা করলে-ও সে বক্তৃতা করব। এরে ডুমুরফুল বানানির কাম।'
রমিজ মিয়া টাকার ধারের মতো রামদাটা দেখে। কলাগাছের কস্ লেগে কেমন কালো হয়ে আছে।
৪
এইসব রাতে রমিজ মিয়া পাশ ফিরে শোয়। মূলত মানুষ আদি থেকে পাশ ফিরে শোয়- পৃথিবীটাকে আরেকটু পাশ ফিরে শোয়ানোর চেষ্টায়।
No comments:
Post a Comment