এসো খড়ে সুঁই খুঁজি

Custom Search

Thursday, May 26, 2011

রৌদ্রস্নানের মানবিক দৃশ্যপট


আমাদের সূর্য এখন প্রায় মাঝবয়েসী নারীর মতন, মনিকা বেলুচ্চির মতন সূর্য আমাদের এই প্রপঞ্চ শীতে আন্তরিক রোদ নিয়ে আসে, আমরা সেই রোদের পানে
তাপমাত্রা দশ মিলিয়ন হিলিয়াম উন্নীত হলে হাইড্রোজেন ফিউশন শুরু হবে, হিলিয়াম থেকে তৈরি হবে কার্বন বা ভারী মৌল। সেইসব যাকগে, আমরা তার আগেই "শূন্য করে চলে যাবো [যাব] জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার" (আট বছর আগের একদিন, জীবনানন্দ দাশ)। আমরা না থাকি তো কী হয়েছে, কাজলা দিদি যেমন চলে গেলে আমাদের জীবন থেমে থাকে না, আমরা চলে গেলে-ও আমাদের উত্তরাধিকার প্রজন্ম থেকে যাবে। মানুষের বিবর্তন হয়ে ততদিন হয়তো অতিমানব হবে, কিম্বা বুদ্ধিভিত্তিক কোনো কিমাকার প্রাণীর উদ্ভব হবে, কিংবা হয়তো তার আগেই মানুষ পরস্পরের ধনে পোদ্দারি করতে গিয়ে পৃথিবীকে উড়িয়ে দেবে। কী হবে যদি দেখেন যে আমাদের জ্বালানী-যোগানদার সূর্য ফুরিয়ে যেতে শুরু করে? আপনি কী করবেন? আচ্ছা, পাঁচ বিলিয়ন পরের কথা কল্পনা করতে আপনার কষ্ট হলে আসুন নিকটে তাকাই। প্রতি মাসে অনেক ধুমকেতু, নাক্ষত্রিক বস্তুসমূহ সূর্যের দিকে ধেয়ে আসে, বিশাল হলে সূর্যের কিছুটা ক্ষতি করে, না হলে জ্বলে খাক হয়ে যায়। মনে করুন এইরকম কোনো বিশাল কিছু সূর্যের দিকে ধেয়ে আসলো, কিংবা কোনো কারণে সূর্য ফুরিয়ে যেতে শুরু করেছে, ফুরিয়ে যাওয়া কবিদের একঘেয়ে কবিতার মতন তখনো সে এলেবেলেভাবে কিছুটা রোদ দিচ্ছে বটে, কিন্তু আপনি টের পাচ্ছেন পৃথিবীতে শুরু হচ্ছে সৌরশীত। পঞ্চাশ বছর পরে সূর্য পুরোপুরি নিভে যাবে, আপনি তখন কী করবেন?


শিল্প ও বিজ্ঞান তথা প্রযুক্তির চমৎকার মেলবন্ধনের সুযোগ আছে চলচ্চিত্রে। কবিতায় হয়, কবিতা সৃষ্টি করে দৃশ্যকল্প এবং তা বিজ্ঞান ফুটিয়ে তুলতে পারে বটে; সংগীত-ও তেমনি- তবে এসবের উর্ধ্বে হলো চলচ্চিত্র। কবিতার মৃত্যু টের পাওয়া যায়, বড়জোর দুই তিন শতকে কবিতার মৃত্যু হবে- নিদেনপক্ষে এমনতর বিবর্তন হবে যে আজকে আমরা যেটাকে কবিতা বলছি সেটা থাকবে না। ছায়াছবি, সামগ্রিকভাবে চলচ্চিত্র এই স্থান দখল করে ফেলতে পারে। হেইচটিএমএল (HTML 5) এর উৎকর্ষতা এবং ওয়েব ৩.০ এর আগমনে নিশ্চয় আন্তর্জালে-ও চলচ্চিত্রের আনাগোনা আরো বাড়বে। অর্থাৎ, মানুষ ক্রমশ দৃষ্টিনির্ভর উপাদানের দিকে ধাবিত হচ্ছে, যেইসবে তার নিজস্ব অংশগ্রহণ রয়েছে। 


ধর্মের কী হবে? উত্তর ভবিষ্যতেও কি ধর্ম আধিপত্য করবে? অক্টোপাসের শুঁড়ের মতো আঁকড়ে ধরে রাখবে ব্যক্তি, সমাজ এবং নৈতিকতাকে? সমাজে বিদ্যমান নৈতিকতাকে ঘষামাজা করে পুঁজি করে গড়ে ওঠে প্রতিটি ধর্ম, এবং সমাজে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়াটাই যতো গণ্ডগোলের মূল। প্রাতিষ্ঠানিক রূপহীন ধর্ম সদ্য জন্মানো মানবশিশুর মতন অসহায়, আর ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ হেমলকের মতো ভয়াবহ, তেজস্ক্রিয়তার মতো দীর্ঘস্থায়ী।
সূর্য নিভে যেতে শুরু করলে আপনা কী করবেন সেটা এতক্ষণে ভেবে অনেকাংশে বের করে ফেলেছেন:
  • অন্য কোনো সৌরব্যবস্থায় স্থানান্তরিত হওয়া। কিন্তু ভেবে দেখুন কম করে খুব নিকট ভবিষ্যৎ ২০৫০ সালে পৃথিবী মানবসংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ১২ বিলিয়ন। এই বিপুল মানুষজনকে স্থানান্তরিত করা মহাসমুদ্র থেকে একটি নির্দিষ্ট শৈবাল খুঁজে বের করা মতো দুঃসাধ্য। ততদিনে সেইরকম প্রযুক্তি হাতে পাবো তো?
  • কৃত্রিম জ্বালানির যোগান। বিদ্যুৎ না পেলে বৈশাখের রাতে আপনি যেমন মোমবাতি দিয়ে বাতাস ও আলো পান না এবং মৌলিক সুবিধাবলি না দিতে পারা ও অব্যবস্থাপনার জন্য সরকারের মায়েরে বাপ দিতে চান, তেমনি সূর্য নিভে গেলে পৃথিবীতে কৃত্রিম জ্বালানি সৃষ্টি করা একই কুমিরছানা পাঁচবার দেখানো মতো শোনায়।
  • যা ইচ্ছে তাই হোক, ধরবো তোমার কাশফুল-বিকেল। ক্লাসের শেষ বেঞ্চে বসলে-ও এক টুকরো রোদ দেখবো, এক টুকরো উচ্ছন্নে যাওয়া মেঘ। একদিন না একদিন মরতে তো হবেই, সূর্য নিভে যাচ্ছে, না হয় একটু তাড়াতাড়িই মরি। না, মানুষ এতো সহজে হার মানে না।
  • আরেকটা উপায় আছে। সূর্যকে কোনোভাবে জিইয়ে রাখা, সূর্যের ভেতরে ঘটতে থাকা বিক্রিয়াকে কোনোভাবে আবার চালু করে দেয়া।

এই পৃথিবীতে মানুষ অন্যান্য প্রাণী থেকে স্বতন্ত্র এবং বিবর্তনের মাধ্যমে এই অবস্থানে পৌঁছানোর কারণ তিনটি, জেমস ট্রেফিল এর মতে:
  • যন্ত্রপাতি বানানোর দক্ষতা। যন্ত্রপাতি কিন্তু বানর-ও বানায়, পাথরখণ্ড ঠিকঠাক কেটে ছুরিকা, টুলস বানিয়ে বাদাম ভেঙে খায়, কিন্তু বানরের যন্ত্রপাতি বানানোর দক্ষতা মানুষের দক্ষতার সমান নয়। আমরা অনায়সে প্রেমে পড়ার মতো বানিয়ে ফেলতে পারি অতি ক্ষমতাসম্পন্ন কম্পিউটার থেকে শুরু করে আদি মহাবিশ্বের পরিবেশ জানার জন্য গবেষণাগার বৃহৎ হ্যাড্রন সংঘর্ষক (Large Hadron Collider)। অর্থাৎ, আমরা প্রয়োজনীয় হাতিয়ার তৈরিতে অনেক প্রতিভাবান এবং প্রচুর দক্ষ।
  • ভাষা। নীল তিমিরা মহাসমুদ্রের গভীরে শব্দতরঙ্গ ব্যবহার করে পরস্পরের সাথে যোগাযোগ করে। আবার এক প্রজাতির মৌমাছি প্রায় বৃত্তিক পথে নেচে নেচে বিপরীত লিঙ্গকে আকৃষ্ট করে যৌনতা ও প্রজনন এবং মৌ আহরণের জন্য। এইরকম হাজারো উদাহরণ রয়েছে- আপনি ইচ্ছে করলে এইসবকে ভাষা না-ও বলতে পারেন। তবে জেনে রাখুন প্রজাতি ভেদে কুকুর প্রায় ১০০০ এর বেশি শব্দ জানে, আপনি ইচ্ছে করলে বিভিন্ন প্রাণীকে ভাষা শেখাতে পারবেন। হাতি, গরিলা, শিম্পাঞ্জি ইত্যাদির বেলায় বেশ সাফল্য দেখা গেছে, পাখিরা-ও শিখতে পারে অনায়সে। কিন্তু এইসবের চেয়ে মানুষের ভাষার ব্যবহার অনেক ভিন্ন, স্বতন্ত্র এবং উৎকৃষ্ট। বলুন তো যোগাযোগের মাধ্যম ছাড়া ভাষার আরেকটি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয়তা কী? হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন, প্রজন্মান্তরে জ্ঞানের প্রবাহ। লেখালেখির মাধ্যমে আমরা যে জ্ঞান পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিই তা বংশগতিতে প্রাপ্ত তথ্যের চেয়ে অনেক বিশাল, ফলে পরবর্তী প্রজন্মকে শূন্য থেকে সূচনা করতে হয় না।
  • উপরে উল্লেখিত ব্যাপারগুলোর পেছনে বড় অবদান আমাদের মস্তিষ্কের। আমাদের মস্তিষ্ক আমাদের বুদ্ধিমত্তা, জ্ঞান, অস্তিত্ব সবকিছু জন্য গোলাভরা-ধানের মতন। এবং এই ধূসর পদার্থের পরিমাণ বাড়ছে, আর বাড়ছে মানুষের কর্মদক্ষতা, তথ্যবিশ্লেষণ ক্ষমতা ইত্যাদি।
এখন আপনিই বলুন মানুষ্য প্রজাতি কি সূর্যের এই নিভে যাওয়ায় কিছুই করবে না? উপরোল্লিখিত ধর্ম, সূর্যের নিভে যাওয়া, মানুষের নৈতিকতা এবং নৈতিকতার ভেঙে পড়া, ভবিষ্য পৃথিবী ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে আমরা চোখ রাখতে পারি ২০০৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছায়াছবি সানশাইনে (Sunshine), রচনায় অ্যালেক্স গারল্যান্ড এবং পরিচালনায় ছিলেন ড্যানি বয়েল।


১০৭ মিনিটের ছায়াছবিটি শুরু হয় ইক্যারাস ২ এর পদার্থবিজ্ঞানি রবার্ট ক্যাপার (সিলিয়ান মার্ফি) স্বগোক্তি থেকে, জানা যায় ১৬ মাস আগে তারা সূর্যের দিকে যাত্রা শুরু করে সূর্যকে পুনরায় জাগিয়ে তোলার জন্য, সাতজন মহাকাশচারীকে নিয়ে। তবে তারও আগে ইক্যারাস ১ কে পাঠানো হয়েছিলো, কিন্তু কোনো কারণে সে গন্তব্যে পৌঁছায় নি, কেউ হদিস জানেন না যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলো বলে। যেহেতু ইক্যারাস ২ পৃথিবী সব জ্বালানি ও রসদ নিয়ে গঠিত পেলোড বহন করছে, এই অভিযান ব্যর্থ হলে সূর্য ও পৃথিবীর পতন অনিবার্য।
ইক্যারাস নামটা চেনাচেনা লাগছে? হ্যাঁ, গ্রীক পুরাণের সেই ইক্যারাস যে দুরন্ত মনে সূর্যের দিকে উড়ে গিয়েছিলো, কিন্তু ডানার মোল গলে তার মৃত্যু হয়। ফলে অভিযানের বিজ্ঞানিদের মনে প্রথম থেকে শঙ্কা খেলেছিলো যে তারা না-ও সফল হতে পারে। অল্প সময় পরেই তারা মৃত্যুসীমায় পৌঁছে, এই দূরত্বের পরে আর পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ করা যাবে না। তাই ক্যাপা তার বাবা-মাকে শেষ বার্তা পাঠায়:
So, if you wake up one morning, and it's a particularly beautiful day you'll know we made it
যদি একদিন সকালে তোমরা জেগে দেখো একটি বিশেষ সুন্দর দিন, তবে জেনো আমরা পেরেছি।
এরপর ছোটবেলার মার্বেলখেলায় সকাল-দুপুর গড়ানোর মতো সময় গড়ায়, যখন ইক্যারাস বুধগ্রহকে পাশ কাটাচ্ছিল তখন অভিযাত্রীরা ইক্যারাস ১ এর বেতার সঙ্কেত ধারণ করে, পৃথিবী থেকে অনেক দূরবর্তী হওয়ার কারণে এটি আলো এবং শব্দতরঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছিলো। যদি ইক্যারাসের পেলোডটি অটুট থাকে, তবে তারা দুটো বোমা পাবে অর্থাৎ দুটো সুযোগ, সূর্যকে জাগিয়ে তোলার জন্য। কিন্তু গতিপথ পরিবর্তন করে ইক্যারাসের দিকে যাওয়ার ব্যাপারে বাঁধ সাধে কেউ কেউ, কিন্তু মনোবিজ্ঞানি সার্ল (ক্লিফ কুর্টিস) যুক্তি দেন:
We are not a Democracy. We are collection of astronauts and scientists. So we are gonna make the most informed decision available to us.
আমরা গণতান্ত্রিক সমাজ নই। আমরা জ্যোতির্বিজ্ঞানি এবং পদার্থবিজ্ঞানিদের একটি দল। সুতারাং আমরা আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য সবচেয়ে তথ্যাভিজ্ঞ সিদ্ধান্তটিই নিবো।
ঝুঁকি পরিমাপ করে অধিনায়ক ক্যাপা সিদ্ধান্ত নেন যে ইক্যারাসের দিকে যাবেন, কিন্তু মহাকাশযানের চালক ট্রে গতিপথ পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় একটি চালকের মান গণনায় নিতে ভুলে যায়, ফলে মহাকাশযানকে রক্ষা করতে থাকা শিল্ড পুড়ে যায়। সেটিকে ঠিক করতে গিয়ে প্রাণ হারায় অধিনায়ক এবং আরো ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয় তারা। অক্সিজেন সংরক্ষণাগারে আগুন ধরে যাওয়ায় আসা-যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের অভাব দেখা দেয়, পুরো ঘটনার জন্য ট্রে নিজেকে দায়ী করে, মনোবিজ্ঞানী সার্ল তাকে বোঝালেও সে আত্মহত্যাকে বরণ করে নেয়।
বাধ্য হয়ে ইক্যারাস ১ সাথে রঁদেভু করার জন্য যাত্রা শুরু করে অভিযাত্রীরা। ইক্যারাস ১ এর সবকিছু ভালো, বাড়ির পাশের শান্ত পুকুরের মতো একটি বাস্তুসংস্থান আছে, আছে পানির সরবরাহ, উষ্ণতা সবকিছু; কেবল মূল কম্পিউটারটিকে অন্তর্ঘাতভাবে ক্ষতিসাধন করা হয়েছে। ইক্যারাস ২ এর অভিযাত্রীরা একটি চলচ্চিত্র পায়, পিনবেকার, ইক্যারাস ১ এর দলনায়কের। সে অভিমত দেয় যে যেহেতু ঈশ্বর "চাচ্ছে" সূর্য নিভে যাক, মানবজাতির উচিত ঈশ্বরের অবাধ্য না হয়ে মৃত্যুকে মেনে নেয়া। সহজেই বোঝা যায় পিনবেকার ধর্মান্ধ, এবং ইক্যারাস ১ এর অভিযাত্রীদের মৃত্যুর জন্য সে দায়ী ছিলো। হঠাৎ এয়ারলক বিযুগল হয়ে গেলো, ফলে অভিযাত্রীদের নিজহাতে সব পরিচালনা করতে হয়। দুর্ঘটনায় মারা পড়ে হার্ভি। কিন্তু এতে কিছু সুফল আসে, চারজনের জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের বন্দোবস্ত হয়।
ক্রমে ঘটনাবিশ্লেষণ করে জানা গেলো যে কেউ না কেউ ইক্যারাস ১ এর ভেতরে জীবিত আছে, সাত বছর ধরে! এবং এয়ারলক বিযুগল হওয়ার কারণ সে, পরোক্ষভাবে অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতির জন্য-ও দায়ী। পিনবেকার! হ্যাঁ, সে বেঁচে আছে, এবং ক্রমে সে ইক্যারাস ২ এর অভিযাত্রীদের মেরে ফেলতে শুরু করে। কাউকে অক্সিজেন বাগানে, কাউকে নিজহাতে, কাউকে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে পরোক্ষভাবে। কিন্তু মানবতার জয় হয়, পিনবেকারকে প্রতিহত করে পেলোডকে বিস্ফোরিত করা যায় এবং সূর্যস্নান সম্ভব হয়।


অন্যান্য ঘরানার চলচ্চিত্রের মতো বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি নির্ভর ছায়াছবিতে নির্দিষ্ট কোনো প্রপাগান্ডার উপস্থিত কমই থাকে। তবে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি নির্ভর ছায়াছবির অধিকাংশের মাঝে কিছু হেজিমনি থাকে। হয় বিজ্ঞানের মূল ব্যাখ্যা ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়, নতুবা সবকিছু তালগোল পাকিয়ে জগাখিচুড়ি বানানো হয়। ব্যাপারটি অবশ্য কল্পগল্পের ক্ষেত্রে-ও সঠিক। এছাড়া আজকাল কম্পিউটার, ক্যামেরা, এবং আনুষঙ্গিক সফটওয়্যার ব্যবহার করে ধরাকে সরা হিসেবে উপস্থাপন করা যায়। সেই তুলনায় সানশাইন অনেক পরিচ্ছন্ন। ক্যামেরার কাজ ভালো, ভিজুয়াল ইফেক্ট পরিমিত, ক্ষেত্রবিশেষে মনে হয় কমই। পরিচালক নিজেই একাধিক সাক্ষাৎকার, বক্তব্যে স্বীকার করেছেন যে ছায়াছবিটির অঙ্গসজ্জা, পাত্রপাত্রীদের পোশাকআশাক স্ট্যানলি কুবরিকের অনবদ্য সৃষ্টি “২০০১: আ স্পেস অডিসি” (১৯৬৮), আন্দ্রে তারকোভ্‌স্কির “সোলিয়ারিস” এবং রিডলি স্কটের “এলিয়েন” ছায়াছবিগুলো দ্বারা কিছুটা প্রভাবিত বা অনুপ্রাণিত।
ছায়াছবিটির চমৎকার দিক, যেকারণে আকৃষ্ট হয়ে এই লেখাটি লিখছি, তা হলো মানুষের সম্পর্কের টানাপোড়েন, নৈতিকতা এবং নৈতিকতার অবক্ষয় দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারা। সুজন হলে তেঁতুল পাতায় নয়জন, না হলে দুর্জন- এই আটজন অভিযাত্রীদের ষোল মাস পরে-ও মনের মধ্যের বিষের থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। মানুষ হয়ে অন্য মানুষকে নিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষা, কূটকৌশলের আশ্রয় নেয়া ইত্যাদি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে হার্ভি চরিত্রের মাধ্যমে, সে আদিম গুহামানবের মতো নিজের জীবন রক্ষা করতে বিপদের মুখে ঠেলে দিতে চায় অন্যান্য অভিযাত্রীদের, এমনকি সমগ্র মানবজাতিকে। অন্যদিকে দলনায়ক ক্যানিডা, পদার্থবিজ্ঞানি মেইস, মনোবিজ্ঞানি সার্ল প্রমুখ মানবজাতির বৃহত্তর গুণটি তুলে ধরেছে- মানবতা। নিজের জীবন বিপন্ন জেনেও অন্যকে সাহায্য করা, সামগ্রিক পরিস্থিতির প্রয়োজনে ক্ষুদ্রতাকে বিসর্জন দেয়া খুব ভালো বার্তা প্রদান করে। অভিনেতা-নেত্রীদের অভিব্যক্তি, যাপন, সংলাপ, এবং মিথস্ক্রিয়া ফুটে ওঠে চরম মূহুর্তে মানুষের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা কী রকম হতে পারে। মানুষ এখনো প্রকৃতির কাছে শিশু, কিন্তু সামগ্রিকভাবে, যেনো সেটাই ফুটে ওঠেছে, সে যৌক্তিক আবদার করতে পারা কেউ হয়ে উঠতে পারে। 


ছায়াছবিটিতে কোনো যৌনদৃশ্য নেই, তবে এক ধরণের আভাস মেলে- ক্যাপা এবং ক্যাসির মধ্যকার হৃদয়ঘটিত কোনো ব্যাপারস্যাপারের, তবে খুব ক্ষীণ বীক্ষণ, অনেকাংশে উপেক্ষা করার মতোই। ব্যক্তিগত প্রেমের চেয়ে মানুষের সামগ্রিক প্রেম মানবতাকে দৃশ্যায়িত করা হয়েছে।
কিছু বৈজ্ঞানিক ক্রুটি আছে, একটির কথা শুরুতেও বলেছি, সূর্য এতো তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যাওয়ার কথা নয়, সেটা মেনে নিলেও কীভাবে মহাকাশযানটির ভেতরে পৃথিবীর অভিকর্ষের মতো অবস্থা সৃষ্টি করা হয়েছে তা বলা নেই, কোনো আভাস-ও নেই। তবে কৃত্রিম অভিকর্ষ তৈরি করা যায় বটে। মহাকাশভ্রমণের ক্ষেত্রে সুদীর্ঘ সময়ে মানুষ বা জীবের হাড়ের ঘনত্ব হ্রাস পেতে শুরু করে। ফলে দেয়া দেয় স্থানিক অভিযোজন উপসর্গ (Space adaptation syndrome), আপনার যদি কোনো পরিচিতজন হুইল চেয়ার নির্ভর হয়ে থাকে তবে তার ক্ষেত্র খুব সামান্যভাবে উপসর্গ দেখা দিতে পারে। এই অসুবিধা দূর করার জন্য কৃত্রিম অভিকর্ষ বা মহাকর্ষ ভালো উপায় হতে পারে। বিজ্ঞানিরা ইঁদুর ও মোরগ দিয়ে-ও বিভিন্ন পরীক্ষা করেছেন। কীভাবে কৃত্রিম অভিকর্ষ তৈরি করা যায়? অভুক্ত কারো সামনে আলুর ভর্তা, ডাল আর ইলিশের মাছের তরকারি দিয়ে এক বাসন ভাত রাখলে সে যেমন নাদানের মতো গিলবে তেমনি আমরা-ও একটু ঘনোভাবে ব্যাপারটি নিয়ে ভাবি:
  • ঘূর্ণন: একটি ঘূর্ণমান মহাকাশযান তার অধঃশরীরের দিকে মহাকর্ষ প্রয়োগ করে। এটাকে কেন্দ্রাভিমুখী বল-ও বলা হয়ে থাকে।
  • সরলরৈখিক ত্বরণ: তাত্ত্বিকভাবে একটি মহাকাশযান সরলরৈখিক ত্বরণে চললে সেটি ভেতরের বস্তুসমূহকে বিপরীতভাবে ত্বরণের অন্যদিকে বল প্রয়োগ করবে। কিন্তু সরলরৈখিক ত্বরণে চলতে হলে নিয়মিত শক্তির যোগানের প্রয়োজন এবং তা সরবরাহ কঠিনই বৈকি।
  • বিশাল ভর: বিশাল ভরের বস্তু যেমন ধরুন একটি ধুমকেতু বা ছোটখাট গ্রহ মহাকর্ষ সৃষ্টি করবে, কিন্তু এটাকে বহন করতে হবে তো! জ্বালানির সেই গণ্ডগোলটা সতীনের মতো বাগড়া দিবে।
  • চুমকত্ব: হ্যাঁ, দ্বিচুমকত্ব দিয়ে মহাকর্ষের মতো একই ধরণের প্রভাব সৃষ্টি করা যায়। তবে এরজন্য প্রয়োজন হবে কয়েক হাজার কেজি ভরের চুম্বকের এবং ৬ মেগাওয়াটের নিয়মিত বিদ্যুৎপ্রবাহ। এখন পর্যন্ত একটি ইঁদুরের উপর প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে এমন চুম্বক তৈরি করা গিয়েছে।
অর্থাৎ এখনো পর্যন্ত কার্যকরী ব্যবস্থা নেই কৃত্রিম মহাকর্ষ সৃষ্টি করার জন্য। কিন্তু ছায়াছবিটিতে দেখানো হয়েছে মহাকাশযানে সবাই দিব্যি শ্বশুর বাড়ি জামাই-আভিজাত্যে ঘোরাফেরা করছে।
অন্য একটি বৈজ্ঞানিক ক্রুটি হলো সূর্যকে পুনরায় জাগিয়ে তোলার জন্য যে বোমাটি ব্যবহার করা হবে সেটি পৃথিবীর সমস্ত জ্বালানি এবং এমনকি পুরো পৃথিবী দিয়ে বানানো হলেও কাজ না হওয়ারই কথা। আপনি নিশ্চয় জানেন যে সূর্য পৃথিবী থেকে প্রায় তের লক্ষগুণ বড়ো। তাছাড়া, সূর্য পরিণত হবে লাল দানবে, ছায়াছবিতে যেভাবে দেখানো হয়েছে সেভাবে মৃত নক্ষত্র হয়ে যাবে না।


কিছু ক্রুটি মেনে নিলেও এটি চিন্তাকর্ষক, সামগ্রিক একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা পৌঁছে দেয়, তবে সে বার্তা বিজ্ঞাপনের মতো ভুজংভাং নয়, সিদ্দিকা কবিরের রেসিপি অনুসারে বানানো খাবারের মতো সুস্বাদু নিশ্চিত! ধর্ম ও বিজ্ঞান যে সাংঘর্ষিক সেটা স্পষ্ট বোঝা যায়। ধর্ম ভালো কী :খারাপ সেই আলোচনা বাদ দিলেও আমরা ইতিহাসে দেখি যে বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে এটি ন্যাড়া-কুকুরের-ঘেউ-ঘেউ এর মতো কোলাহল সৃষ্টি করেছে। এমনকি দেখতে পাই, ইক্যারাস ১ এর দলনায়ক পিনবেকারকে ধর্মানুরাগী এবং ঈশ্বরের অনুচর হিসেবে উপস্থাপনা করার মাধ্যমে দেখানো হয়েছে ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের দ্বন্দ্ব, পিনবেকার নিজের অপবিশ্বাসের জন্য সমগ্র পৃথিবী তথা মানবজাতিকে বিলিয়ে দিতে রাজি। সে দাবি করে সে হচ্ছে ঈশ্বরের সাথে সময়ের শেষ ব্যক্তি, ঈশ্বরের প্ররোচনায় সে অভিযানগুলো থামিয়ে দিতে চেয়েছিলো বিভিন্ন যন্ত্রাদি অকেজো করে, যাত্রীদের হত্যা করে।


এই ছায়াছবিটি ২০ মিলিয়নের বাজেট নিয়ে বেশ ভালোই সাড়া পেয়েছে, ঘটনার অনিবার্যতা, পাত্রপাত্রীদের মনস্তাত্বিক জটিলতা এবং মানবতার জয়কে উজ্জ্বলভাবে তুলে ধরা হয়েছে। সবদিক মিলিয়ে ছায়াছবিটি স্বয়ম্ভু না হয়ে উঠলেও এটি দর্শনের দাবি রাখে, এবং উপভোগ্য।

No comments:

Post a Comment

কী নিয়ে মাতামাতি...

13 Reasons Why (1) ADHD (1) Alzheimer's disease (1) Antibiotic Resistance (1) Anxiety (1) Autism (1) Brexit (1) Brief Answers to the Big Questions (10) Britain (1) Bruce Peninsula (1) Cades Cove Scenic Drive (1) Canada (2) Clingsman Dome (1) District 9 (1) Dopamine (1) Dyer's Bay (1) Federico Garcia Lorca (1) Fierté Montréal (2) Gaspé & Percé Rock (1) Global Warming (2) Great Smoky Mountains (2) Heatwave (1) Hemianopia (1) infographics (1) Instagram (104) International Balloon Festival (1) Interstate 77 (1) Lift (1) Links (1) Maple syrup boiling down (1) Maple syrup harvesting (1) Marconi Union (1) Mike Krath (1) Montmorency Falls (2) Montreal International Jazz Festival (1) Montreal Pride Parade (2) Mother Teresa (1) Movies (1) Music (2) Netflix (1) Niagara Falls (3) Nickelback (1) Nirvana (1) North Carolina (1) nutella (1) Photography (2) Photos (104) Poets of the Fall (2) Psychology (1) Rain storm in Montreal (1) Rape (1) Reading List (1) Saint-Remi (1) Samuel de Champlain Bridge (1) Sandra Crook (1) Schizophrenia (1) Sci-Fi (1) Sci-Hub (1) Shortest Sci-Fi (1) Smoky Mountains (1) Stephen Hawking (15) Sunshine 2007 (1) Tennessee (1) The Beatles (1) The Danish Girl (1) The Grand Design (8) The Handsome Family (1) Tobermory (1) Toronto (2) Transexualism (1) True Detective (1) Tyrannosaurus rex (1) Wallingford Back Mine – Mulgrave et Derry (1) West Island (1) Womenchapter (1) অটিজম (3) অটোয়া (1) অণুগল্প (7) অনুবাদ (17) অভিগীতি (12) অভিলিপি (9) অর্থনীতি (2) অ্যালকোহল (1) আইন ও বিচারব্যবস্থা (1) আইসিস (2) আচরণগত স্নায়ুবিজ্ঞান (1) আত্মহত্যা (2) আলঝেইমারের রোগ (3) আলোকচিত্র (6) আলোকবাজি (9) ইচ্ছেকথা (3) ইন্সটাগ্রাম (104) উইমেন-চ্যাপ্টার (1) উদ্বেগ (1) উবার (1) একুশে বইমেলা (1) এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধ (1) এম-তত্ত্ব (5) কবিতা (95) কম্পিউটার বিজ্ঞান (1) করোনাভাইরাস (6) কলাম (5) কানাডা (4) কাব্যালোচনা (2) কাসেম বিন আবুবাকার (1) কিশোরতোষ (1) কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (1) কৃষ্ণগহ্বর (1) কোভিড-১৯ (8) ক্যান্সার (1) ক্রসফায়ার (1) ক্লোনিং (1) খাদ্যব্যবস্থা (1) গণতন্ত্র (1) গবেষণা (1) গবেষণাপত্র (1) গর্ভপাত (1) গল্প (8) গাঁজা (1) গান (17) গুজব (1) গ্যাব্রিয়েলা মিস্ট্রাল (1) চলচ্চিত্র (4) ছড়া (5) ছবি (104) ছোটগল্প (5) জঙ্গিবাদ (1) জনস্বাস্থ্য (2) জিকা ভাইরাস (1) জীববিজ্ঞান (1) জীবাণু (1) ট্রান্সসেক্সুয়াল (1) ট্রান্সসেক্সুয়ালিজম (1) ডাইনোসর (1) ডাউনলোড (1) ডোপামিন (1) তাপমাত্রা (1) তিল-গপ্পো (17) তুষার দত্ত (2) তেজস্ক্রিয়তা চিকিৎসা (1) দূরবীন (2) দৃষ্টিশক্তি (1) ধর্ম (3) ধর্ষণ (2) নায়াগ্রা ফলস জলপ্রপাত (1) নারী (3) নারী স্বাধীনতা (1) নুটেলা (1) নৈতিকতা (1) পরিবেশ (1) পাঁচমিশালী (1) পাঠসূচি (1) পাম তেল (1) পাহাড় (1) পুস্তক (1) পেডোফিলিয়া (1) প্রকৃতি (1) প্রবন্ধ (2) প্রবাস (2) প্রাইমেট (1) ফটোগ্রাফী (1) ফেসবুক (1) ফ্রান্স (1) বই (2) বড় প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত উত্তর (10) বয়ঃসন্ধি (1) বর্ণবাদ (1) বাঙলাদেশ (18) বাবা (1) বাংলাদেশ (1) বিজ্ঞপ্তি (1) বিজ্ঞান (13) বিটলস (1) বিষণ্নতা (3) বুরকিনি (1) বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি (7) বৈশ্বিক উষ্ণতা (1) ব্যক্তিত্ব (1) ব্যথা (1) ভাইটামিন ডি (1) ভাইরাস (1) ভালোবাসা (1) ভুয়া খবর (1) ভেন্টিলেটর (1) ভ্রমণ (3) মনস্তত্ত্ব (1) মনোবিজ্ঞান (19) মন্ট্রিয়াল (1) মন্ট্রিয়াল আন্তর্জাতিক জ্যাজ উৎসব (2) মস্তিষ্ক ক্যান্সার (1) মহিমান্বিত নকশা (3) মাদক (1) মাদকাসত্তি (2) মাদার তেরেসা (1) মানসিক স্বাস্থ্য (5) মুক্তগদ্য (3) মুক্তচিন্তা (3) মুক্তিযুদ্ধ (3) মৌলবাদ (1) যাপিত জীবন (2) যুগান্তর পত্রিকা (1) যৌনতা (1) রাজনীতি (1) রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প (3) রূপান্তরকাম (1) রৌদ্রস্নান (1) লিওনার্ড ম্লোডিনো (5) লিংক (2) লিঙ্গরূপান্তর (1) লিঙ্গরূপান্তরকারী (1) লিথিয়াম (1) লিফট (1) শিক্ষাব্যবস্থা (1) শিশুতোষ (3) সংগীত (3) সন্ত্রাসবাদ (1) সংবাদমাধ্যম (1) সময়ভ্রমণ (1) সমালোচনা (1) সর্দিগর্মি (1) সানশাইন (1) সামাজিক দূরত্ব (1) সাম্প্রতিক দেখা চলচ্চিত্র (1) সার্স-কোভ-২ ভাইরাস (4) সাহিত্য (4) স্কিৎসোফ্রেনিয়া (1) স্টিফেন হকিং (16) স্ট্রোক (1) স্নায়ুবিজ্ঞান (12) স্নায়ুবিষ (1) স্বাস্থ্যসেবা (1) হলুদ (1)
রোদের অসুখ © 2008 Por *Templates para Você*