আন্তর্জালিক সংবাদমাধ্যম বাংলামেইল গত ৭ আগস্ট আরেকটি সংবাদমাধ্যম টুডেনিউজ৭১.কম এর বরাত দিয়ে “বিমান দুর্ঘটনায় প্রধানমন্ত্রীর পুত্র জয়ের মৃত্যুর গুজব” শিরোনামে একটি খবর প্রকাশ করলে সেদিন রাতে র্যাব বাংলামেইলের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মো. সাহাদাতউল্যাহ খান, নির্বাহী সম্পাদক মাকসুদুল হায়দার চৌধুরী ও সহ-সম্পাদক প্রান্ত পলাশকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠায়। গত ৮ আগস্ট তথ্যপ্রযুক্তি আইনে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করে র্যাব এবং তাদের দড়িতে বেঁধে আদালতে হাজির করা হয়। বাংলামেইলের কার্যালয় বন্ধ করে দেয় র্যাব।
একটি গুজব-কেন্দ্রিক খবরকে ভিত্তি করে র্যাব ও রাষ্ট্রযন্ত্রের এই বাড়াবাড়ি ও সংবাদমাধ্যমের উপর কর্তৃত্বপরায়ণ মনোভাব জাহির শঙ্কার বিষয়।
একটি গুজব-কেন্দ্রিক খবরকে ভিত্তি করে র্যাব ও রাষ্ট্রযন্ত্রের এই বাড়াবাড়ি ও সংবাদমাধ্যমের উপর কর্তৃত্বপরায়ণ মনোভাব জাহির শঙ্কার বিষয়।
২
মূল গুজবটি প্রকাশ করে টুডেনিউজ৭১.কম, অথচ বাংলামেইলের সাংবাদিকদের গ্রেফতার করা হলো। একথা সত্যি যে অধিকাংশ সংবাদ ওয়েবসাইট পাঠক-আকৃষ্ট করার জন্য এবং সবার আগে সংবাদ পৌঁছে দেয়ার জন্য তড়িঘড়ি করে মুখরোচক খবর ছাপায়। বাংলামেইল খুব সম্ভবত সেই ফাঁদে পা দিয়েছিলো। কিন্তু লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে যে তাদের শিরোনামে উল্লেখ করা আছে ব্যাপারটি গুজব হতে পারে।
সরকার পক্ষ এই ব্যাপারে যা করতে পারতো তা হচ্ছে বাংলামেইল এবং টুডেনিউজ৭১.কম-কে অনুরোধ করতে পারতো গুজব-সংবাদটি সরিয়ে দেয়ার জন্য, যেহেতু এটি সত্যি নয়। মশা মারতে কামান দাগানোর মতো র্যাব পাঠানো হলো সংবাদমাধ্যমের কর্মকর্তাদের গ্রেফতার করার জন্য। কেনো পুলিশ নয়? এইসব আইনি কাজগুলো তো পুলিশের আওতাধীন। ভয় জাগে এই সাংবাদিক ও কর্মকর্তাগণ র্যাবের ক্রসফায়ারে পড়বেন না তো?
সজীব ওয়াজেদ জয় নিজেই তার ফেইসবুক পাতায় কিছু লিখে সংবাদটি যে গুজব তা প্রকাশ করতে পারতেন, থানা-পুলিশ করে হয়রানি এবং একটি সংবাদমাধ্যম বন্ধ করে দেয়ার দরকার পড়ে না। না কি এই গ্রেফতার ও সংবাদমাধ্যম বন্ধ অন্য কিছুর আলামত?
৩
একথা সত্যি যে আমাদের দেশে অনেক সংবাদমাধ্যমকে সাংবাদিকতার নৈতিক নিয়ম মেনে চলতে দেখা যায় না। সেই কারণে তারা ধর্ষকের চেয়ে ধর্ষিতার ছবি ছাপায়, রগরগে বর্ণনা ও ছবিতে হত্যা, ধর্ষণ ইত্যাদি সংবাদ পরিবেশন করে। একটি সংবাদের সাথে সংশ্লিষ্ট অনেকের গোপনীয়তাকে নষ্ট করে তাদের নাম, পরিবার পরিচয়, এমনকি ছবি ছাপায়। সরাসরি সম্প্রসারিত হয় জঙ্গি হামলার মতো ভয়াবহ ঘটনা। হুজুগে মেতে বাংলামেইলের এই সংবাদ পরিবেশন আমাদের ইঙ্গিত দেয় যে আমাদের সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকদের উচিত নিজেদের সংবাদ ও কার্যাবলীর দায়িত্ব নেয়া এবং এই ব্যাপারে পেশাদারিত্ব হওয়া।
কিন্তু ভুল হতেই পারে। প্রতিটি ব্যবস্থাই ভুল বা ক্রুটি থাকেই। বাংলামেইল যে ভুলটি করছে তা শোধরানো অনেক সহজ এবং এর জন্য সংবাদমাধ্যম বন্ধ ও সাংবাদিক গ্রেফতারের মতো এতো গুরুদণ্ড প্রাপ্যের নয়। বাংলামেইল ও টুডেনিউজ৭১.কম-কে তাদের বক্তব্য ও সংবাদ পরিহার করে বিবৃতি প্রদান ও সেই সংবাদটি সরিয়ে ফেলার সুযোগ দেয়া উচিত ছিলো। একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশে সংবাদমাধ্যম এভাবেই চলে।
৪
সঠিক ও স্বচ্ছ গণতন্ত্রের অন্যতম হাতিয়ার হচ্ছে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা ও প্রতিমতকে দমিয়ে না রেখে আলোচনার সুযোগ রাখা। সরকার সংবাদমাধ্যমে বন্ধ করে দিয়ে কিসের সংকেত দিচ্ছে? আজ এই তুচ্ছ ঘটনায় একটি সংবাদমাধ্যম বন্ধ করে দেয়া হলে ভবিষ্যতে কী ঘটবে? সরকারের বিরুদ্ধে বললে কিংবা ভুল ক্রুটি হলেই বন্ধ করে দেয়া হবে যেকোনো সংবাদমাধ্যম? তবে মুক্ত আলোচনা চর্চা ও গণতন্ত্র রইলো কোথায়?
সাংবাদিক গ্রেফতার ও সংবাদমাধ্যম বন্ধ করে দেয়া যায় যদি সেটি দেশদ্রোহী হয় কিংবা দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়। সজীব ওয়াজেদ জয় প্রধানমন্ত্রী পুত্র হিসেবে বিশেষ নজর পেতে পারেন, বাড়তি নিরাপত্তা ও খাতির পেতে পারেন, তার মানে এই নয় যে তার মৃত্যুর গুজব খবরের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে একটি সংবাদমাধ্যম। এইরকম ক্রুটিপূর্ণ মৃত্যুর গুজব সংবাদ অহরহ প্রকাশিত হয় দেশ বিদেশে। যেমন, আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ, কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল ক্যাস্ট্রোর মৃত্যুর খবরের গুজব প্রকাশিত হয়েছে, এমনকি ওসামা বিন লাদেন ও সাদ্দাম হোসেনের মৃত্যুর খবর-ও প্রকাশিত হয়েছে একাধিক বার। তাই বলে তো বন্ধ হয়ে যায় নি এইসব গুজব প্রকাশ করা সংবাদমাধ্যমগুলো, গ্রেফতার হন নি কোনো নিরীহ সাংবাদিক।
এই ঘটনায় মূলত সজীব ওয়াজেদ জয় বিতর্কিত হচ্ছেন।
৫
অবাক লাগে এই সাংবাদিক গ্রেফতার ও সংবাদমাধ্যমে বন্ধের বিরুদ্ধে জোরালো কোনো প্রতিবাদ করছে না উল্লেখযোগ্য কোনো সংবাদ প্রতিষ্ঠান। আজ নীরবে এই অন্যায় মেনে নিলে কাল সেই অন্যায় যে আপনাদের সাথে করা হবে না তার নিশ্চয়তা কী? আমরা তো যখন ব্লগার হত্যা হলো তখন নীরব ছিলাম তারা তথাকথিত “নাস্তিক” ছিলো বলে। এরপর তারা সংস্কৃতিকর্মী, মানবাধিকার কর্মী, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হত্যা করলো একে একে, যার ভয়াবহ পরিণতি দেখেছি আমরা গুলশান ও শোলাকিয়া হামলায়। অর্থাৎ, অন্যায় ও অন্যায়কারীর বিরুদ্ধে প্রথম থেকেই সোচ্চার হতে হয়, না হলে তা ক্রমশ দানবীয় হয়ে উঠে।
আজ বাংলামেইলের সাংবাদিকদের গ্রেফতার আমরা “গুজব প্রচারকারী” সাংবাদিকদের গ্রেফতার হিসেবে নীরবে মেনে নিতে পারি, কিন্তু এটি যদি ভবিষ্যতে আরো ভয়াবহ কিছুর দিকে নিয়ে যায় (যেমন, তথ্যপ্রযুক্তি আইনে বিরুদ্ধ প্রকাশকারীদের গ্রেফতার, কর্তৃত্ব পরায়ণভাবে যেকোনো সংবাদমাধ্যম সামান্য অজুহাতে বন্ধ করে দেয়া, মুক্তমতের চর্চাকে বাকরুদ্ধ করা) তবে তার দায়ভার আমাদেরই।
মার্টিন নাইমোলারের কবিতাটি প্রাসঙ্গিকভাবে মনে পড়ে:
যখন ওরা প্রথমে কমিউনিস্টদের জন্য এসেছিল, আমি কোনো কথা বলিনি,
কারণ আমি কমিউনিস্ট নই।
তারপর যখন ওরা ট্রেড ইউনিয়নের লোকগুলোকে ধরে নিয়ে গেল, আমি নীরব ছিলাম,
কারণ আমি শ্রমিক নই।
তারপর ওরা যখন ফিরে এলো ইহুদিদের গ্যাস চেম্বারে ভরে মারতে,আমি তখনও চুপ করে ছিলাম,
কারণ আমি ইহুদি নই।
আবারও আসল ওরা ক্যাথলিকদের ধরে নিয়ে যেতে,আমি টুঁ শব্দটিও উচ্চারণ করিনি,
কারণ আমি ক্যাথলিক নই।
শেষবার ওরা ফিরে এলো আমাকে ধরে নিয়ে যেতে,
আমার পক্ষে কেউ কোন কথা বলল না, কারণ, কথা বলার মত তখন আর কেউ বেঁচে ছিল না।
আমাদের পরিণতি যেনো এমন না হয় যে আমাদের জন্য কথা বলার মতো কেউ থাকবে না। আশা করি অবিলম্বে বাংলামেইলের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মো. সাহাদাতউল্যাহ খান, নির্বাহী সম্পাদক মাকসুদুল হায়দার চৌধুরী ও সহ-সম্পাদক প্রান্ত পলাশকে মুক্তি দেয়া হবে এবং বাংলামেইলকে তাদের কার্যাবলি শুরু করার সুযোগ করে দেয়া হবে।
No comments:
Post a Comment