নেটফ্লিক্সের সিরিজ 13 Reasons Why নিয়ে কিছু কথা
বলা দরকার। সিরিজটির মূল কাহিনি হচ্ছে যে উচ্চ বিদ্যালয়ের এক ছাত্রী আত্মহত্যা করে
এবং ১৩টি টেপ রেখে যায় তার আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয়ার পেছনে একেক ব্যক্তির “অবদান” সম্পর্কে- একেকটি পর্ব একেকটি টেপ নিয়ে, যেখানে আত্মহত্যার
পেছনে একেকজনের “প্রভাব” চিত্রিত হয়েছে। শেষ পর্বে এসে
আত্মহত্যাকে ভয়ানকভাবে চিত্রায়িত করা হয়েছে, খানিকটা গ্লোরিফাই-ও করা হয়েছে।
সিরিজটি নিয়ে একেকজনের একেক অভিমত; কেউ বলছেন যে বেশ
ভালোভাবে একটি কিশোরীর মানসিক অবস্থা এবং কেনো সে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় ফুটিয়ে
তোলা হয়েছে। আত্মহত্যাপ্রবণতা নিয়ে কথা বলা দরকার, বিশেষ করে যাদের
বয়েস ১৫-২৪ তাদের মাঝে আত্মহত্যাপ্রবণতা অনেক; কারণ, এই বয়েসসীমাটি অনেক
ঝুঁকিপূর্ণ, মানুষের মস্তিষ্ক পুরোপুরি বিকশিত হতে প্রায় ২৫ বছর লাগে, ফলে এই
বয়েসসীমার অনেকের ইনহিভিশন কম থাকে, এছাড়া চিন্তাচেতনা, দূরদর্শীতা, বুদ্ধির ধার
ইত্যাদি একজন পূর্ণবয়ষ্কের মতো নয়। অন্যান্য বয়েসসীমার তুলনায় এই বয়েসসীমার
ব্যক্তিদের মাঝে আত্মহত্যার হার এমনিতেই বেশি। কিন্তু একটি কথা মনে রাখা দরকার যে
সিরিজটি আত্মহত্যার মতো সংবেদনশীল ব্যাপারটি নিয়ে আলোচনা, সচেতনতার পথ খুলে দিলে-ও
এটি কিন্তু এই ধারণা-ও তুলে ধরে যে আত্মহত্যা সমস্যার সাথে মোকাবেলার করার একটি
উপায় (হয়তোবা শেষ উপায়), অথচ আত্মহত্যা কখনোই সমস্যা মোকাবেলার উপায় নয়।
আপনি ভাবতে পারেন যে আরে সিরিজ দেখে তো আমি আত্মহত্যাপ্রবণ
হয়ে যাবো না, কিংবা কোনো কিশোরকিশোর হবে না। তবে মনে রাখা দরকার যে আত্মহত্যার
ব্যাপারটি “ছোঁয়াচে” রূপ নিতে পারে, অনেক
সময় দেখা যায় যে একেকটি অঞ্চলে একেক সময়ে “গুচ্ছ গুচ্ছ” আত্মহত্যার
প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়, একেকজনের দেখাদেখি আরেকজন করার সাহস পায়, যেটাকে কপিক্যাট
আত্মহত্যা (“copycat suicide”) বলতে পারেন। যেমন- নির্ভানা (Nirvana) ব্যান্ডের গায়ক কার্ট কোবেইন (Kurt Cobain) আত্মহত্যা
করেছিলো তখন আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের কিশোরকিশোরীদের (বিশেষ করে তার ভক্ত ও তার “এলাকার”) মাঝে আত্মহত্যার হার বেড়ে গিয়েছিলো; এটি তুলে ধরে যে
মানুষ আত্মহত্যা করা শিখে, এবং একেকজনের আত্মহত্যা অন্যজনকে উদ্বুদ্ধ করে। ঠিক
তেমনি নেটফ্লিক্সের সিরিজ কিশোরকিশোরিদের মাঝে আত্মহত্যাকে লঘু ব্যাপার হিসেবে
তুলে ধরতে পারে, যেহেতু একটি মেসেজ নেয়ার প্রবণতা একেকজনের কাছে একেক রকম, তাই
নিশ্চিত করে বলতে পারবেন না একেকজন কিশোরকিশোরীর মনে প্রভাব কেমন হবে; ঝুঁকিপূর্ণ
কাউকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে।
নাটক, বইপত্তুর, অর্থাৎ শিল্প বা শিল্পকর্মের প্রভাবে
আত্মহত্যার ঘটনা কিন্তু নতুন কিছু নয়। যেমন, ১৭৭৪ সালে জোহান উলফগ্যাং ভন গেইথের
উপন্যাসে, The Sorrows of Young Werther, নায়ক ওয়ার্থারের বন্ধু আলবার্টের
সাথে বিয়ে হয়ে যায় তার “প্রেমিকা” শার্লোটের,
হৃদ্ঘটিত ব্যথাবেদনা সহ্য না করতে পেরে আলবার্টের পিস্তল দিয়ে নিজেকে নিজে মেরে
ফেল। পরে সেইসময়ে ইউরোপে অনেক যুবক আত্মহত্যা করেছিলো, যারা ওয়ার্থারের মতো পোশাক
পরে এবং একই ধরণের পিস্তল ব্যবহার করেছিলো আত্মহত্যার জন্য। অনেকের শবদেহের পাশে
উপন্যাসটি আত্মহত্যার পাতাটি খোলা অবস্থায় পাওয়া-ও যায়! অর্থাৎ, ভালো শিল্প বাস্তব
ও কল্পনার জগৎটাকে ধোঁয়াশা করে তুলতে পারে; বিশেষ করে মানসিকভাবে (ও শারীরিকভাবে)
দুর্বলদের ক্ষেত্রে)। আত্মহত্যা নিয়ে গবেষণা করা অন্যতম গবেষক ডেইভিড ফিলিপস “ওয়ার্থার প্রভাব” (The Werther Effect”) শব্দগুচ্ছ উদ্ভাবন করেন এই ধরণের কপিক্যাট আত্মহত্যার জন্য। তার গবেষণার
অন্যতম একটি সুপারিশ হচ্ছে যে আত্মহত্যাস-সংক্রান্ত ঘটনাবলি যেনো সংবাদপত্রের
সামনের পৃষ্ঠায় না ছাপানো হয়।
আরেকটি ঘটনার কথা বললে সংবাদপত্র ও এইসব মাধ্যমের প্রভাব
ভালোভাবে তুলে ধরা যাবে। ১৯৮০ সালের দিকে ভিয়েনাতে পাতালরেলে আত্মহত্যার ঘটনা বেড়ে
যায়, সংবাদপত্রগুলো-ও নিয়মিত ফলা করে এই ব্যাপারে রিপোর্ট করতে থাকলো। পরে শহরের
প্রধান সংবাদপত্রগুলো সিদ্ধান্ত নেয় যে আত্মহত্যার ঘটনা আর ছাপাবে না। দেখা গেলো
যে আত্মহত্যার ঘটনা কমে আসে। অর্থাৎ, আমরা যেসব মিডিয়া ব্যবহার (ও গলদ্গরণ) করি আমাদের
মানসিক স্বাস্থ্যের উপর সেগুলোর প্রভাব অনেক।
সেলেব্রেটি বা তারকাদের আত্মহত্যার ঘটনা যে সাধারণ
জনসাধারণের মাঝে আত্মহত্যা প্রবণতা বাড়িয়ে দেয় সেটির আরেকটি নির্দশন হচ্ছে যে মেরিলিন
মনরোর মৃত্যুতে ৩০ বছর বয়েসী নারীদের মাঝে আত্মহত্যার ঝুঁকি বেড়ে গিয়েছিলো। আমাদের
দেশে-ও এই ধরণের উদাহরণ আছে, একটু ব্যতিক্রম যদিও। হুমায়ূন আহমেদের “বাকের ভাইয়ের” কথা মনে আছে? যদি-ও বাকের ভাই আত্মহত্যা করে নি, বরং তার ফাঁসি
দেয়া হচ্ছিলো এবং সেই ফাঁসির বিরুদ্ধে জনগণের মিছিল, নাটকের শ্যুটিং বন্ধ করা এইসব
ঘটনা নির্দেশ করে কীভাবে কাল্পনিক চরিত্রের সাথে বাস্তবের মানুষগুলো মেলবন্ধন
খুঁজে নিতে পারে; এবং সেই ক্ষেত্রে এইসব সাদৃশ্য মানুষকে নানাবিধ সিদ্ধান্তের দিকে
ধাবিত করতে পারে।
যাইহোক, টিভি এবং চলচ্চিত্রে আত্মহত্যার কল্পিত চিত্রকলার
প্রভাব কী সেটি নিয়ে গবেষণার অনেক জটিল। কিছু কিছু গবেষণা সাধারণ জনগণের উপর
আত্মহত্যা চিত্রায়নের প্রভাব ফেলে-ও কিছু কিছু গবেষণা তেমন কোনো প্রভাব পায় নি।
তবে এটি নিশ্চিত যে কপিক্যাট আত্মহত্যা সত্য, এবং আমাদের উচিত ওয়ার্থার প্রভাব
সম্পর্কে সচেতন থাকা।
ইতিমধ্যে
কানাডার কিছু ইস্কুল বোর্ড নেটফ্লিক্সের এই সিরিজ সম্পর্কে অভিভাবক ও
শিক্ষকশিক্ষিকাদের সতর্ক করে দিয়েছে, বিশেষ করে সিরিজটির গ্রাফিক উপাদান (যার
প্রভাব কম বয়েসীদের উপর বেশি) ও আত্মহত্যাকে বেশি মাত্রায় ফুটিয়ে তোলার কারণে। যেমন,
সিরিজটাতে আত্মহত্যা-সংক্রান্ত ব্যাপারকে গ্ল্যামোরাইজেশন করা হয়েছে, একই সাথে
পেশাদারি লোকদের কাছ থেকে (যেমন- মনোবিজ্ঞানী, মনোচিকিৎসক, কিংবা ডাক্তারদের)
প্রয়োজনে সাহায্য ও পরামর্শ চাওয়ার ব্যাপারটিকে নেতিবাচকভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, ফলে
অপ্রাপ্তবয়ষ্করা প্রয়োজনের সময়ে সাহায্য ও পরামর্শ চাওয়ার ক্ষেত্রে দ্বিধাবোধ করতে
পারে।
অন্টারিও’র একটি ইস্কুল বোর্ড অভিভাবকদের পরামর্শ দিয়েছেন যেনো তারা সন্তানদের (বয়েস ১৮
এর কম) সাথে এক সাথে সিরিজটি দেখেন, ফলে সন্তানদের কোনো প্রশ্ন কিংবা জিজ্ঞাসা
থাকলে যেনো সেগুলো উত্তর দেয়া যায়।
সবচেয়ে বড় কথা, আপনার সন্তান কিংবা কিশোর বয়েসী ভাইবোনদের
সাথে আত্মহত্যা নিয়ে কথা বলতে পারে, জিজ্ঞেস করতে পারেন অথবা পর্যবেক্ষণ করতে
পারেন তাদের মাঝে আত্মহত্যাপ্রবণতা আছে কিনা; অধিকাংশ আত্মহত্যার আগেই
আত্মহত্যাকারী প্রচুর আলামত দেখায় (যেমন- বন্ধুবান্ধবদের পরিকল্পনা-সংক্রান্ত
ব্যাপারে প্রশ্ন করা, জিনিসপত্র জোগাড় করা)। মনে রাখা দরকার যে মানসিক সমস্যার
ক্ষেত্রে খোলামেলা আলোচনার দরকার অনেক বেশি, অনেক সময় আলোচনার মাধ্যমে অনেক কিছুর
সমাধান পাওয়া যায়, অথবা, কথা বলার মানুষ পেলে অনেকের ভার লাগব হয়।
এর মানে এই না যে এই ধরণের সিরিজ দেখা বন্ধ করে দেয়া উচিত।
বরং এই ধরণের সিরিজ দেখার ফলে যেসব জিজ্ঞাসা জন্মে সেগুলো নিয়ে আলোচনা করা দরকার,
সচেতনতা সৃষ্টি করা দরকার। একটা ব্যাপার নেটফ্লিক্স সিরিজটা কৃতিত্বের দাবিদার।
বুলিং, ধর্ষণ, আত্মহত্যা ইত্যাদি ব্যাপারে আলোচনাকে সামনে নিয়ে আসতে সাহায্য
করেছে, অনেকে এই ব্যাপারে কথা বলছে, যা একদিকে সচেতনা সৃষ্টির প্রথম ধাপ।
No comments:
Post a Comment