মধ্য আফ্রিকার বশঙ্গো জাতির মতে, আদিতে কেবল ছিলো অন্ধকার, জল, এবং মহান দেবতা সুম্বা। একদিন পেটের ব্যথায় কাতর হয়ে সুম্বা সূর্যকে বমি করে উগলে দিয়েছিলেন। সেই সময় সূর্য কিছু পানি শুকিয়ে ফেলে, ফলে স্থলভাগের সৃষ্টি হয়। কিন্তু সুম্বা তখনো ব্যথায় কাতর ছিলেন, এবং আরো বমি করলেন। ফলে চাঁদ, নক্ষত্র, এবং পরে অন্যান্য প্রাণী: চিতাবাঘ, কুমির কচ্ছপ এবং সবশেষে মানুষের আবির্ভাব হয়েছিলো। মধ্য আমেরিকা এবং মেক্সিকোর মায়ানদের মাঝে-ও একই গল্প প্রচলিত আছে- আদিতে ছিলো সমুদ্দুর, আকাশ এবং স্রষ্টা। মায়ান কিংবদন্তী মতে, স্রষ্টা অখুশি ছিলেন কারণ তার গুণকীর্তন করার মতো কেউ ছিলো না, তাই তিনি পৃথিবী, পাহাড়-পর্বত, গাছগাছালি এবং অধিকাংশ জীবজন্তুর সৃষ্টি করলেন। কিন্তু জীবজন্তুরা কথা বলতে পারতো না বিধায় তিনি মানুষকে সৃষ্টি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। প্রথমে তিনি কাদা ও মাটি দিয়ে মানুষ বানিয়েছিলেন, কিন্তু তারা কেবল প্রলাপ বকতো। তিনি তাদের লুপ্ত করে ফেললেন, এবং আবার বানানোর চেষ্টা করলেন, এইবার কাঠ থেকে মানুষ সৃষ্টি করলেন। কিন্তু সেই মানুষগুলো হলো একঘেয়ে। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে সেগুলোকে ধ্বংস করে ফেলবেন, কিন্তু তারা বনের দিকে পালিয়ে গেলো, পথিমধ্যে ক্ষয়ক্ষতির ফলে তাদের রূপের কিছুটা পরিবর্তন ঘটার কারণে আমরা আজকাল যেটিকে বানর বলে জানি সেটির সৃষ্টি হলো। ওই চরম ব্যর্থতার পরে, স্রষ্টা একটি কার্যকরী সূত্রের নাগাল ফেলেন, এবং প্রথম মানুষ সৃষ্টি করলেন সাদা ও হলুদ ভুট্টা থেকে। আজকাল আমরা ভুট্টা থেকে ইথানল তৈরি করি, কিন্তু এখন পর্যন্ত স্রষ্টার মানুষ সৃষ্টির কৃতিত্বের মতন কিছু মেলাতে পারি নি।
আমরা এই বইটিতে যেসব প্রশ্নের উল্লেখ করেছি- সৃষ্টি সম্পর্কিত এইসব পুরাণকথা সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে চেষ্টা করে: কেনো এই মহাবিশ্ব, এবং মহাবিশ্ব ঠিকই এইরকমই হলো? আমাদের এই প্রশ্নাবলির উত্তর দেয়ার ক্ষমতা সেই প্রাচীন গ্রীকদের থেকে ধীরে ধীরে বেড়েছে, বিশেষ করে গত শতাব্দিতে। পূর্ববর্তী অধ্যায়গুলোর আলোচনাকে সম্বল করে আমরা এই প্রশ্নগুলোর একটি সম্ভাব্য উত্তর দিতে প্রস্তুত।
সেই প্রথম থেকে একটি প্রচলিত ধারণা হলো যে হয় মহাবিশ্ব খুব সাম্প্রতিক সৃষ্টি অথবা মানুষের অস্তিত্ব মহাজাগতিক ইতিহাসের একটি ক্ষুদ্রাংশ। কারণ মানুষ্য প্রজাতি জ্ঞান এবং প্রযুক্তিতে এতো দ্রুত উৎকর্ষ সাধন করছে যে যদি মানুষের সৃষ্টি কয়েক মিলিয়ন বছর আগে হতো তবে মানুষ মহাবিশ্বে আধিপত্য বিস্তারে আরো অনেক এগিয়ে থাকতো। পুরাতন বাইবেল অনুযায়ী, ঈশ্বর আদম ও হাওয়াকে সৃষ্টিকর্মের প্রথম ছয় দিনে সৃষ্টি করেছিলেন। এমনকি ১৬২৫ থেকে ১৬৫৬ পর্যন্ত সমগ্র আয়ারল্যান্ডের আর্চবিশপ উশার আরো সম্যকভাবে বলেছিলেন জগতের সূচনা হয়েছিলো ২৭ শে অক্টোবর, খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০৪ সালে। আমরা একটু ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখবো: মানুষ সাম্প্রতিক সৃষ্টি হলেও মহাবিশ্বের সূচনা হয়েছিলো অনেক অনেক আগে, প্রায় ১৩.৭ বিলিয়ন বছর আগে।
মহাবিশ্বের সূচনা সম্পর্কিত প্রকৃত বৈজ্ঞানিক প্রমাণের দেখা মেলে সর্বপ্রথম ১৯২০ সালের দিকে। তৃতীয় অধ্যায়ে আমরা যেমন বলেছি, সেই সময়ে অধিকাংশ বিজ্ঞানিই বিশ্বাস করতেন যে মহাবিশ্ব স্থির এবং সব সময়েই এর অস্তিত্ব ছিলো। ভিন্ন ধারণার প্রমাণটি ছিলো পরোক্ষ, ক্যালিফোর্নিয়ার প্যাসাডিনার উইলসন পর্বতের উপর থেকে ১০০ ইঞ্চি টেলিস্কোপ দিয়ে এডউইন হাবল যে পর্যবেক্ষণগুলো করেছিলেন সেগুলোর উপর ভিত্তি করে। ছায়াপথগুলোর নির্গত আলোকরশ্মির বর্ণালি বিশ্লেষণ করে হাবল নির্ণয় করেছিলেন যে প্রায় সব ছায়াপথই আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, এবং সেগুলো যতো দূরে, তাদের দূরে যাওয়ার গতি ততো বেশি। ১৯২৯ সালে তিনি আমাদের কাছ থেকে ছায়াপথগুলোর দূরত্ব ও সেই দূরত্ব অনুযায়ী সেগুলোর পশ্চাদপসরণের হার সম্পর্কিত একটি সূত্র প্রকাশ করেছিলেন এবং উপসংহার টেনেছিলেন যে মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে। সেটি যদি সত্য হয়ে থাকে, তবে মহাবিশ্ব অতীতে আরো ছোট ছিলো। প্রকৃতপক্ষে, আমরা যদি জ্ঞাত জ্ঞান পরিমাপ হতে সেই সুদূর অতীতের হিসেব করি তবে দেখা যায় যে মহাবিশ্বের সকল ভর ও শক্তি অকল্পনীয় আয়তন ও তাপমাত্রার একটি অতিক্ষুদ্র অঞ্চলে কেন্দ্রীভূত হয়ে ছিলো এবং আমরা যদি যথেষ্ট পিছনে যাই, এমন একটি সময়ের দেখা মেলে যখন সমস্ত কিছুর শুরু হয়েছিলো- যেটিকে আমরা এখন মহাবিস্ফোরণ বলি।
মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে এই ধারণাটি কিছুটা সূক্ষ্ম ধারণা। উদাহরণস্বরূপ, আমরা বোঝাচ্ছি না যে মহাবিশ্ব এমনভাবে প্রসারিত হচ্ছে যেমনটি কেউ একজন একটি বাড়ির প্রসারণ করে- যেখানে এককালে ছিলো একটি রাজকীয় ওক গাছ সেই সংলগ্ন একটি দেয়াল ভেঙে একটি নতুন গোসলখানা বানানো। বরঞ্চ, মহাবিশ্ব নিজ থেকে প্রসারিত হচ্ছে, যে কোনো দুটো বিন্দুর মধ্যবর্তী দূরত্ব বেড়েই চলছে। ধারণাটি ১৯৩০ সালের দিকে বিতর্কিত ধারণা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলো, কিন্তু এখন পর্যন্ত ধারণাটিকে কল্পনা করার জন্য সর্বোত্তম পন্থা হলো ১৯৩১ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানি আর্থার এডিংটন কর্তৃক সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা একটি রূপক। এডিংটন একটি বেলুনের পৃষ্ঠভাগকে মহাবিশ্ব এবং পৃষ্ঠভাগের উপর কতকগুলো বিন্দুকে একেকটি ছায়াপথ হিসেবে কল্পনা করেছিলেন। এই চিত্র কেনো দূরবর্তী ছায়াপথগুলো নিকটবর্তীগুলো থেকে আরো দ্রুত দূরে সরে যায় সেটি সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করে। উদাহরণস্বরূপ, যদি বেলুনটির ব্যাসার্ধ প্রতি ঘণ্টায় দ্বিগুণ হয়, তবে বেলুনের উপরে দুটো ছায়াপথের মধ্যকার দূরত্ব প্রতি ঘণ্টায় দ্বিগুণ হবে। যদি কোনো এক সময়ে দুটো ছায়াপথের মধ্যবর্তী দূরত্ব এক ইঞ্চি হয়, এক ঘণ্টা পরে তারা ২ ইঞ্চি দূরে থাকবে, এবং মনে হবে যে তারা পরস্পরের সাপেক্ষে প্রতি ঘণ্টায় ১ ইঞ্চি করে দূরে সরে যাচ্ছে। কিন্তু তারা যদি প্রথমেই নিজেদের কাছ থেকে ২ ইঞ্চি দূরত্বে থাকতো তবে এক ঘণ্টা পরে তারা ৪ ইঞ্চি দূরত্বে থাকবে এবং মনে হবে যে তারা পরস্পরের সাপেক্ষে প্রতি ঘণ্টায় ২ ইঞ্চি হারে দূরে সরে যাচ্ছে। হাবল এটিই পেয়েছিলেন: একটি ছায়াপথ যতো দূরে, সেটি ততো দ্রুত হারে আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
এটি উপলব্ধি করা জরুরি যে মহাবিশ্বের এই প্রসারণ বল দ্বারা ঐক্যবদ্ধ থাকা জড়বস্তুগুলো যেমন- ছায়াপথ, গ্রহ-নক্ষত্র, আপেল, অণু কিংবা অন্যান্য বস্তু ইত্যাদির আকার-আকৃতির উপর প্রভাব ফেলে না। যেমন, আমরা যদি বেলুনের উপরে একগুচ্ছ ছায়াপথকে চিহ্নিত করি, চিহ্নটি বেলুন সম্প্রসারণের সাথে সাথে প্রসারিত বা বড় হবে না। বরং, যেহেতু ছায়াপথগুলো মহাকর্ষীয় বল দিয়ে আবদ্ধ থাকে, চিহ্নটি এবং চিহ্নটির মধ্যকার ছায়াপথগুলো বেলুন সম্প্রসারণের সাথে সাথে তাদের আকার ও আপেক্ষিক আকৃতি একই রাখে। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ আমরা প্রসারণ পরিমাপ করতে পারি কেবল যদি আমাদের পরিমাপ যন্ত্রগুলোর নির্দিষ্ট আকার-আকৃতি থাকে। সবকিছু যদি স্বাধীনভাবে প্রসারিত হতো, তবে আমরা, আমাদের গজফিতা, পরীক্ষাগার, এবং সবকিছু আনুপাতিকহারে প্রসারিত হতাম এবং আমরা সম্প্রসারণে সৃষ্ট পার্থক্য টের পেতাম না।
মহাবিশ্বের প্রসারিত হওয়া আইনস্টাইনের জন্য একটি চরম খবরই ছিলো। কিন্তু ছায়াপথগুলো যে পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে সেটির সম্ভাব্যতা হাবলের তাত্ত্বিক গবেষণার আগেই আইনস্টাইনের নিজস্ব কিছু সমীকরণে উপস্থাপন করা হয়েছিলো। ১৯২২ সালে, রাশিয়ার পদার্থবিজ্ঞানি এবং গণিতবিদ আলেক্সান্দার ফ্রাইডম্যান খতিয়ে দেখতে চাইলেন যে গাণিতিক হিসেবনিকেশকে বিরাট রকমের সরল করে দেবে এমন দুটো অনুমানের উপর নির্ভর করে একটি মডেল মহাবিশ্বের ভাগ্যে ঠিক কী ঘটবে: যদি মহাবিশ্বটি দেখতে সব দিকেই অভিন্ন রকমের হয় এবং সকল পর্যবেক্ষণ বিন্দু থেকে দেখতে একই রকম লাগে। আমরা জানি যে ফ্রাইডম্যানের প্রথম অনুমানটি পুরোপুরি সত্য নয়, মহাবিশ্ব সৌভাগ্যজনকভাবে সর্বত্র একরূপ নয়! আমরা উপরে এক দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকালে হয়তো সূর্য দেখতে পাই, অন্য দিকে তাকালে চাঁদ কিংবা দেশান্তরী হচ্ছে এমন রক্তচোষা বাদুড়ের একটি দলকে দেখবো। কিন্তু ছায়াপথগুলোর মধ্যবর্তী দূরত্বের চেয়ে আরো বড় পাল্লায় মহাবিশ্বকে সব দিকে প্রায় একই রকম দেখায়। অনেকটা খুব উপর থেকে একটি বন দেখার মতন। আপনি যদি বনের খুব কাছাকাছি যান তবে আপনি প্রতিটি পাতা, গাছ, নিদেনপক্ষে গাছগুলোর মধ্যবর্তী দূরত্ব মাপতে পারবেন। কিন্তু আপনি যদি খুব উঁচু থেকে দেখেন- এতোটাই উঁচু যে আপনার বৃদ্ধাঙ্গুলি বনটির এক বর্গমাইল এলাকা আড়ালে ঢেকে ফেলে, তবে আপনার কাছে বনটিকে সমভাবে বিস্তৃত সবুজের একটি পটভূমি মনে হবে। তখন আমরা বলবো যে ওই পাল্লায় বনটি সর্বত্র অভিন্ন।
তার অনুমানগুলোর উপর নির্ভর করে ফ্রাইডম্যান আইনস্টাইনের সমীকরণগুলোর একটি সমাধান আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছিলেন যেটিতে মহাবিশ্ব ঠিক এমনভাবে প্রসারিত হয় যা পরবর্তীতে হাবল সত্য বলে চাক্ষুষ করেছিলেন। সুনির্দিষ্টভাবে, ফ্রাইডম্যানের মডেল মহাবিশ্বের সূচনা ঘটে শূন্য আকার থেকে এবং ক্রমেই বাড়তে থাকে যতক্ষণ না মহাকর্ষীয় আকর্ষণের ফলে প্রসারণ শ্লথ হয়ে পড়ে, এবং এক সময় সঙ্কুচিত হয়ে নিজের উপর ভেঙে পড়ে বা পতিত হয়। (শেষ পর্যন্ত দেখা গেলো যে আইনস্টাইনের সমীকরণগুলোর ভিন্ন দুটো সমাধান সম্ভব যেগুলো ফ্রাইডম্যানের অনুমানগুলোকে-ও সন্তুষ্ট করে; সমাধান দুটোর একটি মতে মহাবিশ্বের প্রসারণ হার কিছুটা কমলেও এটি চিরদিন প্রসারিত হবে, এবং অন্যটি মতে মহাবিশ্বের প্রসারণ হার শূন্যের কাছাকাছি হয়ে যাবে, কিন্তু কখনোই শূন্য হবে না।) ফ্রাইডম্যান এই মেধাকর্ম পেশ করার কয়েক বছর পরেই মারা যান, ফলে তার ধারণাগুলো অনেকাংশে অজানা থেকে যায়, হাবলের আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত। কিন্তু ১৯২৭ সালে পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং রোমান ক্যাথলিক পুরোহিত জর্জ ল্যমেইত্র অনুরূপ ধারণা প্রস্তাব করেন: আপনি যদি মহাবিশ্বের ইতিহাসের আদি উৎস অনুসন্ধান করেন, এটি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হতে থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনি একটি সৃষ্টিসূচনায় পৌঁছান- যেটিকে আমরা এখন মহাবিস্ফোরণ বলি।
সবাই কিন্তু মহাবিস্ফোরণের ধারণাটি পছন্দ করেন নি। প্রকৃতপক্ষে, “মহাবিস্ফোরণ” শব্দটি উদ্ভাবন করেছিলেন ১৯৪৯ সালে ক্যামব্রিজ জ্যোতিপদার্থবিজ্ঞানি ফ্রেড হয়েল, যিনি কিনা বিশ্বাস করতেন যে মহাবিশ্ব চিরদিন প্রসারিত হতে থাকবে এবং অবজ্ঞাসূচক অর্থে তিনি মহাবিস্ফোরণ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। ১৯৬৫ সালের আগে এই ধারণাকে সমর্থন যোগানো সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা যায় নি, তখন আবিস্কৃত হয়েছিলো যে মহাবিশ্বের সর্বত্র ক্ষীণ মাইক্রোতরঙ্গ পটভূমি বিদ্যামান। এই মহাজাগতিক অণুতরঙ্গ পটভূমি বিকিরণ (cosmic microwave background radiation) বা সংক্ষেপে মঅপবি আপনার অণুতরঙ্গ চুলার (microwave oven) মতো একই, তবে অনেক কম শক্তিশালী। আপনি নিজেও মঅপবি পর্যবেক্ষণ করতে পারেন- আপনার টিভিকে একটি অব্যবহৃত চ্যানেলে চালান, পর্দায় যে সাদা সাদা বিন্দু দেখবেন সেটি এই বিকিরণের কারণে সৃষ্ট। বেল গবেষণাগারের দুইজন বিজ্ঞানি তাদের অণুতরঙ্গ অ্যান্টেনা থেকে এই সাদা সাদা বিন্দু ছোপ দূর করতে গিয়ে ঘটনাক্রমে মঅপবি আবিস্কার করেন। প্রথমে তারা ভেবেছিলেন যে তাদের অ্যান্টেনায় বাসা বাঁধা পায়রার কিচিরমিচির থেকে এটি আসছে, কিন্তু শেষমেষ দেখা গেলো যে সমস্যার উৎস আরো আগ্রহোদ্দীপক কিছু- অতি উত্তপ্ত এবং ঘন আদি মহাবিশ্ব থেকে নির্গত বিকিরণের অবশিষ্ট- যেটি কিনা মহাবিস্ফোরণের কিছু পরে অস্তিত্বমান ছিলো। মহাবিশ্ব প্রসারণের সাথে সাথে এটি ঠাণ্ডা হতে থাকে এবং বিকিরণটি আমাদের পর্যবেক্ষণ করা আজকের এই ক্ষীণ অবস্থায় এসেছে। বর্তমানে এই অণুতরঙ্গ আপনার খাবারকে বড়জোর -২৭০ ডিগ্রী সেলসিয়াস পর্যন্ত গরম করতে পারবে- যা কিনা পরমশূন্য তাপরমাত্রা থেকে ৩ ডিগ্রী বেশি এবং এই তাপমাত্রা খই ফুটানোর জন্য-ও কাজের নয়।
জ্যোতির্বিদেরা-ও উত্তপ্ত, ক্ষুদ্রতম আদি মহাবিশ্ব ধারণার সমর্থনের পক্ষে বেশ কিছু প্রমাণ পেয়েছেন। উদাহরণ দিতে গেলে, প্রথম মিনিট বা ওই সময় ক্ষণে মহাবিশ্ব যে কোনো নক্ষত্রের কেন্দ্রের চেয়ে বেশি উত্তপ্ত ছিলো। সেই সময়ে পুরো মহাবিশ্ব একটি নিউক্লীয় ফিউশন চুল্লির মতো আচরণ করেছিলো। যখন মহাবিশ্বের প্রসারণে তাপমাত্রা কমে আসছিলো তখন বিক্রিয়াটি ক্ষান্ত হয়েছিলো, কিন্তু তত্ত্বটি ভবিষ্যদ্বাণী করে যে এর ফলে মহাবিশ্ব গঠিত হবে বহুলাংশে হাইড্রোজেন, প্রায় ২৩ শতাংশ হিলিয়াম, এবং লিথিয়ামের কিছু আলামত (ভারী মৌলগুলো আরো পরে নক্ষত্রের ভেতরে সৃষ্টি হয়েছে) নিয়ে। আমরা যে পরিমাণ হাইড্রোজেন, হিলিয়াম ও লিথিয়াম পর্যবেক্ষণ করি তার সাথে তত্ত্বটির হিসেবনিকেশ অনেক সঙ্গতিপূর্ণ।
হিলিয়ামের প্রাচুর্যের পরিমাপ এবং মঅপবি আদি মহাবিশ্ব সম্পর্কিত মহাবিস্ফোরণ ধারণার পক্ষে বড় প্রমাণ, কিন্তু আপনি মহাবিস্ফোরণকে আদি সময়ের গ্রহণযোগ্য বর্ণনা হিসেবে গ্রহণ করলে-ও আপনি ভুল করবেন যদি মনে করেন যে আইনস্টাইনের সমীকরণগুলো মহাবিশ্বের আদি রূপ ও উৎপত্তির পুরোপুরি সঠিক চিত্র সরবরাহ করছে। কারণ সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব অনুমান করে যে আদি সময়ের কোন এক মুহুর্তে মহাবিশ্বের তাপমাত্রা, ঘনত্ব, এবং বক্রতা সমস্তই অসীম, গণিতবিদেরা যাকে বলেন অসীমবিন্দু (singularity)। একজন পদার্থবিজ্ঞানির কাছে এর অর্থ হলো আইনস্টাইনের তত্ত্বটি এই জায়গায় এসে ভেঙে পড়ে এবং কীভাবে মহাবিশ্বের সূচনা হয়েছিলো সেটির অনুমানে ব্যবহার করা যাবে না, বরং সূচনা হওয়ার পরে কী ঘটে বা ঘটেছিলো সেটি ব্যাখ্যায় কার্যকরী। সুতারাং, যদিও আমরা সাধারণ আপেক্ষিকতার সমীকরণগুলো এবং গ্রহ-নক্ষত্রের পর্যবেক্ষণ কাজে লাগিয়ে মহাবিশ্বের শিশু সময়কালে কী ঘটেছিলো সেটি জানার জন্য ব্যবহার করতে পারি, তারপরও একেবারে শুরু পর্যন্ত ব্যবহার করা সঠিক হবে না।
মহাবিশ্বের উৎপত্তি নিয়ে আমরা একটু পরেই আলোচনা করবো, তবে তার আগে প্রসারণের প্রথম দশা নিয়ে কথা বলা দরকার। পদার্থবিজ্ঞানিরা একে বলেন মহাজাগতিক স্ফীতি (inflation)। স্ফীতি শব্দটি অতোটা বিস্ফোরক শোনাবে না যদি না আপনি জিম্বাবুয়ে বসবাস করেন- যেখানে সম্প্রতি মুদ্রাস্ফীতি ২ × ১০২ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু একদম রক্ষণশীল অনুমান মতে, মহাজাগতিক স্ফীতির সময় মহাবিশ্ব ১ × ১০-৩৫ সেকেন্ডে ১ × ১০৩০ গুণনীয়কে প্রসারিত হয়েছিলো। যেনো এক সেমি ব্যাসের একটি মুদ্রা হঠাৎ করে বিস্ফোরিত হয়ে মিল্কিওয়ে ছায়াপথের ব্যাসার্ধের দশ মিলিয়ন গুণ প্রশস্ত হয়ে গেছে। শুনে মনে হতে পারে যে এতে কোনো কিছু আলোর গতির চেয়ে দ্রুত চলতে পারে না অর্থ্যাৎ আপেক্ষিকতা নীতি ভঙ্গ হচ্ছে, কিন্তু গতির এই সীমা মহাবিশ্বের নিজস্ব প্রসারণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
এই ধরণের স্ফীতি যে ঘটে থাকতে পারে সেই ধারণা প্রথম প্রস্তাব করা হয়েছিলো ১৯৮০ সালে, আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের সীমা অতিক্রম করে কোয়ান্টাম তত্ত্ব ধারণার উপর ভিত্তি করে। আমাদের কাছে মহাকর্ষের একটি সম্পূর্ণ কোয়ান্টাম তত্ত্ব এখনো নেই, তবে এর বিশদ ব্যাখ্যার উপরে কাজ চলছে এবং পদার্থবিজ্ঞানিরা এখনো পুরোপুরি নিশ্চিত নন ঠিক কীভাবে স্ফীতি ঘটেছিলো। কিন্তু সনাতনী মহাবিস্ফোরণের তত্ত্ব অনুযায়ী, স্ফীতি সবদিকেই সমরূপে ঘটে নি। ফলে স্ফীতির ভিন্নতার কারণে বিভিন্ন দিকের মঅপবির মধ্যে হালকা পার্থক্য সৃষ্টি হওয়ার কথা। এই পার্থক্য ১৯৬০ সালের প্রযুক্তির জন্য পর্যবেক্ষণযোগ্য ছিলো না, কিন্তু ১৯৯২ সালে নাসার কোব (COBE) উপগ্রহের মাধ্যমে এটি প্রথম আবিস্কৃত হয়েছিলো, এবং পরবর্তীতে ২০০১ সালে উৎক্ষেপিত ডব্লিউএমএপি (WMAP) উপগ্রহের সাহায্যে পরিমাপ করা হয়েছিলো। ফলে, আমরা নিঃসংশয় যে স্ফীতি বাস্তবিকই ঘটেছিলো।
যদিও মঅপবিতে সূক্ষ্ম পার্থক্য স্ফীতির প্রমাণ, স্ফীতি যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা তার কারণ হচ্ছে মঅপবির তাপমাত্রার প্রায় নিখুঁত সমরূপতা। আপনি যদি একটি বস্তুর কোনো অংশকে পারিপার্শ্বিকতার চেয়ে গরম করেন, এবং অপেক্ষা করেন, তবে দেখবেন যে গরম অংশটি ক্রমে ঠাণ্ডা হবে এবং পারিপার্শ্বিক অংশগুলো তাপ গ্রহণ করে সমতাপীয় হবে। একইভাবে, আপনি হয়তো প্রত্যাশা করবেন যে মহাবিশ্বের সর্বত্র এক সময় সমরূপ তাপমাত্রা বিরাজ করবে। কিন্তু এই প্রক্রিয়াটি সময়সাপেক্ষ, এবং যদি স্ফীতি না ঘটতো, তবে মহাবিশ্বের ইতিহাসে সর্বত্র তাপমাত্রা সমান হওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় পাওয়া যেতো না, যেহেতু আলোর গতির চেয়ে তাপ প্রবাহিত হওয়ার গতি বেশি নয়। একটি অতিদ্রুত প্রসারণ (আলোর গতির চেয়ে-ও দ্রুততর) নিশ্চিত করে যে আদি মহাবিশ্বের সর্বত্র তাপমাত্রা সমরূপ হওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় পাওয়া গিয়েছিলো।
স্ফীতি মহাবিস্ফোরণের বিস্ফোরণ-সময় অংশটুকু ব্যাখ্যা করে, অন্ততপক্ষে তুলে ধরে যে স্ফীতির ফলে যে প্রসারণ ঘটেছিলো তা সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের সনাতনী মহাবিস্ফোরণ চিত্রের প্রসারণের চেয়ে আরো বেশি চরম ছিলো। সমস্যা হচ্ছে, স্ফীতি সম্পর্কিত আমাদের তাত্ত্বিক মডেলটি কাজ করছে দেখাতে হলে মহাবিশ্বের আদি অবস্থাকে একটি বিশেষ এবং অতি অভাবনীয় উপায়ে স্থাপন করার দরকার পড়ে। ফলে সনাতনী স্ফীতি তত্ত্ব কিছু সমস্যা সমাধান করলেও আরেকটি সমস্যার সৃষ্টি করে- একটি বিশেষ আদি অবস্থার আবশ্যকতা। আমরা মহাবিশ্বের সৃষ্টি সম্পর্কিত যে তত্ত্বটি পেশ করতে যাচ্ছি সেটিতে শূন্য-সময় সমস্যাটি দূর করা হয়েছে।
যেহেতু আমরা আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের সাহায্যে সৃষ্টির সূচনা ব্যাখ্যা করতে পারবো না, যদি আমরা মহাবিশ্বের উৎপত্তি বর্ণনা করতে চাই তবে আমাদের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বকে স্থলাভিষিক্ত করতে পারা একটি পূর্ণ তত্ত্বের দরকার হবে। সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব ভেঙে না পড়লেও আপনার আরেকটি পূর্ণ তত্ত্বের দরকার হতো, কারণ সাধারণ আপেক্ষিকতা পদার্থের অতিক্ষুদ্র গঠনকে (যা কোয়ান্টাম তত্ত্ব দ্বারা পরিচালিত হয়) হিসেবে ধরে না। আমরা চতুর্থ অধ্যায়ে উল্লেখ করেছি যে মহাবিশ্বকে বৃহৎ পাল্লায় অধ্যায়ন করার ক্ষেত্রে কোয়ান্টাম তত্ত্ব খুব বেশি প্রাসঙ্গিক নয় কারণ এটি প্রকৃতির আণুবীক্ষণিক মাপনী ও বর্ণনার বেলায় প্রযোজ্য। যদি আপনি যথেষ্ট অতীতে যান যখন সমগ্র মহাবিশ্বের আকার প্লাঙ্ক ধ্রুবকের মানের সমান অর্থাৎ এক সেমির বিলিয়ন-ট্রিলিয়ন-ট্রিলিয়ন ভাগের এক ভাগের সমান, সেক্ষেত্রে কোয়ান্টাম তত্ত্বকে অবশ্যই হিসেবে ধরতে হবে। তাই যদিও আমাদের কাছে মহাকর্ষের একটি সম্পূর্ণ কোয়ান্টাম তত্ত্ব নেই, তবুও আমরা অবশ্যই জানি যে মহাবিশ্বের উৎপত্তি একটি কোয়ান্টাম ঘটনা। ফলে, স্ফীতি তত্ত্ব আহরণ করতে আমরা যেভাবে কোয়ান্টাম তত্ত্ব ও সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বকে আপাতত মিলিয়েছি তেমনি ভাবে আমরা যদি আরো অতীতে গিয়ে মহাবিশ্বের উৎপত্তি বুঝতে চাই তবে আমাদের আপেক্ষিকতা তত্ত্বের জ্ঞানের সাথে কোয়ান্টাম তত্ত্বকে মেশাতে হবে।
এটি কীভাবে কাজ করে সেটি দেখতে হলে আমাদের বুঝতে হবে কীভাবে মহাকর্ষ স্থান এবং সময়কে বাঁকিয়ে বা গুটিয়ে ফেলে। সময়ের বক্রতার চেয়ে স্থানের বক্রতা কল্পনা করা সহজতর। কল্পনা করুন যে মহাবিশ্ব একটি সমতল বিলিয়ার্ড টেবিলের পৃষ্ঠভাগ। টেবিলের পৃষ্ঠভাগ একটি সমতল স্থান, অন্ততপক্ষে দুই মাত্রায়। আপনি যদি টেবিলের উপর একটি বলকে গড়িয়ে দেন তবে বলটি সরলপথে চলবে। কিন্তু টেবিলটি যদি নিচের চিত্রের মতন কোন জায়গায় বাঁকানো বা টোল ধরানো হয়, তবে বলটি বাঁকা চলবে।
এই উদাহরণে সহজে দেখা যায় কীভাবে বিলিয়ার্ড টেবিলটির পৃষ্ঠভাগ বেঁকে যায়, কারণ এটি বাইরের একটি তৃতীয় মাত্রায় বেঁকে যাচ্ছে যা আমরা দেখতে পাচ্ছি। যেহেতু আমরা আমাদের স্থান-কালের বাইরে পা বাড়িয়ে দেখতে পারবো না তাই মহাবিশ্বের স্থান-কালের বক্রতা কল্পনা করা বেজায় কঠিন। আপনি বাইরে না যেতে পারলেও এই বক্রতা সনাক্ত করতে পারবেন এবং আরো একটি বড় স্থানের অবস্থানগত দিক থেকে দেখতে পারবেন। কল্পনা করুন যে একটি আণুবীক্ষণিক পিঁপড়ে টেবিলটির পৃষ্ঠে আটকে গেছে। টেবিলটি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা না থাকলেও পিঁপড়েটি সতর্কতার সাথে বিভিন্ন দূরত্বের রেখাচিত্রের মাধ্যমে বক্রতা সনাক্ত করতে পারবে। যেমন, সমতলের উপর একটি বৃত্তের পরিধি বৃত্তের ব্যাসের তিন গুণের কিছু বেশি (প্রকৃতভাবে π গুণ বেশি)। কিন্তু পিঁপড়েটি যদি টেবিলের উপর টোলটির এদিক থেকে ওদিক পর্যন্ত একটি বৃত্তের পরিধি মাপে তবে দেখবে যে এটি আসল মানের চেয়ে বেশি। প্রকৃতপক্ষে, টোলটি যদি যথেষ্ট গভীর হয়ে থাকে তবে পিঁপড়েটি দেখবে বৃত্তের চারিদিকের দূরত্ব বৃত্তের এদিক থেকে ওদিকের দূরত্বের চেয়ে ছোট। একই ব্যাপার আমাদের মহাবিশ্বের বক্রতার ক্ষেত্রে-ও সত্য, এটি স্থানের দুটো বিন্দুর মধ্যবর্তী দূরত্বকে টেনে বিস্তৃত করে অথবা ঠেসে ছোট করে, ফলে স্থানের আকার বা জ্যামিতিতে পরিবর্তন ঘটে এবং এটি আমাদের মহাবিশ্বের ভেতর থেকেই পরিমাপযোগ্য। সময় বা কালের বক্রতা সময়ের বিরতি বা কালান্তরকে অনুরূপভাবে টেনে বিস্তৃত করে বা ঠেসে ছোট করে।
এই ধারণাগুলোকে বগলদাবা করে চলুন আমরা মহাবিশ্বের উৎপত্তির আলোচনায় ফিরে যাই। আমরা স্থান এবং কাল সম্পর্কে আলাদাভাবে কথা বলতে পারি, যেমন আমরা ধীর গতি ও দুর্বল মহাকর্ষ পরিস্থিতির বেলায় করেছিলাম। সাধারণত, স্থান ও কাল পরস্পর পাকিয়ে যেতে পারে, ফলে তাদের সংকোচন ও প্রসারণের ক্ষেত্রে কিছু পরিমাণ মিশ্রণ ঘটতে পারে। এই সংমিশ্রণ আদি মহাবিশ্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং সময়ের সূচনাকে বোঝার জন্য একটি চাবিকাঠি।
সময়ের প্রারম্ভের ধারণাটি অনেকটা পৃথিবীর প্রান্তসীমার ধারণার মতো। যখন মানুষ ভেবেছিলো পৃথিবী সমতল, তখন কেউ হয়তো চিন্তা করতো যে পৃথিবীর প্রান্তসীমায় সমুদ্দুরগুলো নির্গত হয়ে যায় কি না। পরীক্ষা করে দেখা গেছে: কেউ একজন পৃথিবীর প্রান্তসীমার চারপাশে ঘোরাঘুরি করলেও পড়ে যাবেন না। পৃথিবীর প্রান্তসীমায় কী ঘটে সেটির সমাধান পাওয়া গিয়েছিলো যখন মানুষ উপলব্ধি করলো যে পৃথিবী সমতল কোনো বাসনের মতো নয়, বরং এর পৃষ্ঠ বক্র। অন্যদিকে সময়কে একটি মডেল রেলপথের মতো মনে হয়েছিলো। যদি এর সূচনা থাকে, তবে কেউ একজন (যেমন- ঈশ্বর) নিশ্চয় সময়ের ট্রেন চালু করে দিয়েছিলো। আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব সময় ও স্থানের ধারণাকে একীভূত করেছে স্থান-কাল হিসেবে, এবং স্থান-কালের নির্দিষ্ট সংমিশ্রণ সম্পর্কে আলোকপাত করলেও নির্দেশ করে যে সময় স্থানের চেয়ে ভিন্ন অর্থাৎ হয় সময়ের সূচনা ও শেষ আছে না হয় চিরদিন চলতে থাকে। তাছাড়া, আমরা আমরা কোয়ান্টাম তত্ত্বের সাথে সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের সংযোজন করি তবে চরম অবস্থাসমূহে সময়ের বক্রতা এতো বিশাল ব্যাপ্তিতে ঘটে যে সময় স্থানের আরেকটি মাত্রা হিসেবে আচরণ করে।
আদি মহাবিশ্বে- যখন মহাবিশ্ব যথেষ্ট ক্ষুদ্র ছিলো বলে সাধারণ আপেক্ষিকতা এবং কোয়ান্টাম তত্ত্ব উভয়ই দ্বারা পরিচালিত হতো- তখন কার্যকরভাবে স্থানের চারটি মাত্রা ছিলো এবং সময়ের কোনো মাত্রা ছিলো না। অর্থাৎ আমরা যখন মহাবিশ্বের “সূচনার” কথা বলি তখন আমরা একটি নিগূঢ় প্রসঙ্গ পাশ কাটিয়ে যাই- আমরা সময়কে যে রকম বলে জানি আদি মহাবিশ্বে তেমন সময়ের অস্তিত্ব ছিলো না! আমাদের অবশ্যই মেনে নিতে হবে যে আমাদের নিত্যনৈমিত্তিক স্থান-কালের ধারণাগুলো আদি মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক নয়। এটি আমাদের অভিজ্ঞতার বাইরে, কিন্তু আমাদের কল্পনা অথবা আমাদের গণিতের বাইরে নয়। যদি আদি মহাবিশ্বে চারটি মাত্রাই স্থানের মাত্রার মতো আচরণ করে থাকে, তবে সময়ের সূচনা কীভাবে ঘটেছিলো?
সময় যে স্থানের আরেকটি মাত্রার মতন আচরণ করতে পারে এই উপলব্ধি থেকে আপনি সময়ের সূচনা সমস্যার সমাধান পেতে পারেন, ঠিক যেমন আমরা পৃথিবীর প্রান্তসীমা সমস্যার সমাধান পেয়েছি। মনে করুন যে মহাবিশ্বের সূচনা পৃথিবীর দক্ষিণমেরুর মতন, অক্ষাংশের ডিগ্রীগুলো সময়ের ভূমিকা পালন করছে। কেউ যদি উত্তর দিকে চলে, তবে মহাবিশ্বের আকারকে প্রতিনিধিত্ব করা ধ্রুব অক্ষাংশের বৃত্তগুলো প্রসারিত বা বাড়তে থাকবে। মহাবিশ্ব দক্ষিণমেরুর কোনো একটি বিন্দু হিসেবে সূচনা করবে, কিন্তু দক্ষিণমেরুর বিন্দুটি কমবেশি অন্য সব বিন্দুর মতোই।
মহাবিশ্বের সূচনার পূর্বে কী ঘটেছিলো সেটি জানতে চাওয়া দক্ষিণমেরুর দক্ষিণে কী আছে সেটি জানতে চাওয়ার মতোই অর্থহীন। এই চিত্রে স্থান-কালের কোনো সীমারেখা নেই- প্রকৃতির নিয়মাবলি দক্ষিণমেরুর মতো সর্বত্রই প্রযোজ্য। অনুরূপভাবে, কেউ যদি সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বকে কোয়ান্টাম তত্ত্বের সাথে সংযুক্ত করে তবে মহাবিশ্বের সূচনার আগে কী ঘটেছিলো সেই প্রশ্ন দাখিল করা অর্থহীন হয়ে যায়। ইতিহাস আবদ্ধ সীমারেখাহীন একটি পৃষ্ঠ হবে- এই ধারণাকে বলা হয় সীমারেখাহীন শর্ত (no-boundary condition) ।
অনেক শতাব্দি ধরে অ্যারিস্টটল সহ অনেকে মহাবিশ্বের সূচনা কীভাবে ঘটেছিলো সেই প্রশ্ন পাশ কাটাতে বিশ্বাস করতেন যে মহাবিশ্ব সব সময়েই অস্তিত্বমান ছিলো। অন্যান্যরা বিশ্বাস করতেন যে মহাবিশ্বের একটি প্রারম্ভ ছিলো, এবং এটিকে ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে একটি যুক্তি হিসেবে ব্যবহার করতো। সময় যে স্থানের মতো আচরণ করে এই উপলব্ধি একটি নতুন বিকল্প উপস্থাপন করে। এটি মহাবিশ্বের সূচনা থাকা না থাকার বিরোধিতা দূর করে, কিন্তু একই সাথে বোঝায় যে মহাবিশ্বের সূচনা ঘটেছিলো বৈজ্ঞানিক সূত্রাবলির কারণে এবং মহাবিশ্বের সূচনাকে শুরু করতে কোনো ঈশ্বরের প্রয়োজন নেই।
যদি মহাবিশ্বের উৎপত্তি একটি কোয়ান্টাম ঘটনা হয়, তবে এটি নির্ভুলভাবে ফাইনম্যানের ইতিহাসের যোগফল দ্বারা বর্ণনাযোগ্য। কোয়ান্টাম তত্ত্বকে সমগ্র মহাবিশ্বের উপর প্রয়োগ করা দুরূহ- যেখানে পর্যবেক্ষকও পর্যবেক্ষিত ব্যবস্থার একটি অংশ, কিন্তু চতুর্থ অধ্যায়ে আমরা দেখেছি যে কীভাবে দ্বিচিড়ের মধ্য দিয়ে পর্দায় বর্ষিত কণিকাগুলো জলতরঙ্গের মতো ব্যতিচারী নকশা সৃষ্টি করে। ফাইনম্যান দেখিয়েছিলেন যে এমনটি ঘটার কারণ একটি কণিকার একক ইতিহাস নেই। বরং, যদি একটি কোনো সূচনাবিন্দু ক থেকে শেষবিন্দু খ তে যায়, তবে এটি একটি সুনির্দিষ্ট পথ ধরে চলে না, বরং বিন্দু দুটোকে সংযোগকারী সম্ভাব্য সমস্ত পথকে যুগপৎভাবে চলে। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, ব্যতিচার কোনো বিস্ময়কর ব্যাপার নয় কারণ উদাহরণস্বরূপ কণিকাটি উভয় চিড় দিয়ে একই সময়ে যেতে পারে এবং নিজের সাথে নিজে ব্যতিচার ঘটাবে। কণিকার গতিপথের উপর ফাইনম্যানের পদ্ধতির প্রয়োগ আমাদের বলে যে কোনো নির্দিষ্ট শেষবিন্দুর সম্ভাব্যতা নির্ণয় করতে হলে আমাদেরকে কণিকাটি সূচনাবিন্দু থেকে শেষবিন্দু পৌঁছার সম্ভাব্য সব ইতিহাসকে গণনায় ধরতে হবে। মহাবিশ্বের পর্যবেক্ষণের জন্য কোয়ান্টাম সম্ভাব্যতা হিসেব করার জন্যও কেউ একজন ফাইনম্যানের পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারেন। যেহেতু সমগ্র মহাবিশ্বের উপর পদ্ধতি প্রয়োগ করার সময় কোনো ক বিন্দু (সূচনাবিন্দু) থাকে না, তাই আমরা সীমারেখাহীন শর্তকে সন্তুষ্ট করে এমন সব ইতিহাসকে যোগ করে বর্তমান মহাবিশ্বে এসে পৌঁছাই।
এই মতানুসারে, মহাবিশ্বের আবির্ভাব ঘটেছিলো স্বতস্ফূর্তভাবে, সম্ভাব্য সব সূচনার মাধ্যমে। সেগুলোর অধিকাংশই ছিলো অন্যান্য মহাবিশ্বের মতন। কিছু কিছু মহাবিশ্ব আমাদের মহাবিশ্বের মতন, কিছু কিছু খুবই ভিন্ন। সেইসব মহাবিশ্ব কেবল বিশেষ ঘটনা বা ক্ষেত্র যেমন এলভিস কি আসলেই অল্প বয়েসে মারা গিয়েছে কি না কিংবা শালগম ভোজনের পরে খাওয়া যায় কি না ইত্যাদি ব্যাপারেই ভিন্ন নয়, বরং সেগুলো ভিন্ন ভিন্ন প্রত্যক্ষ প্রাকৃতিক নিয়মাবলির কারণে ভিন্ন। প্রকৃতপক্ষে, বিভিন্ন মহাবিশ্ব ভৌত নিয়মাবলির বিভিন্ন সেট নিয়ে অস্তিত্বমান। অনেকে এই ধারণাটিকে বহু মহাবিশ্ব বা অগণন-মহাবিশ্ব (multiverse) নামকরণ করে রহস্য সৃষ্টি করেন, কিন্তু সেগুলো কেবল ফাইনম্যানের ইতিহাসসমূহের যোগফলের ভিন্ন একটি প্রকাশ।
ব্যাপারটি উপলব্ধি করতে আসুন এডিংটনের বেলুন উপস্থাপনায় কিছুটা পরিবর্তন করি, এবং প্রসারণমান মহাবিশ্বকে একটি বুদবুদের পৃষ্ঠ হিসেবে কল্পনা করুন। মহাবিশ্বের স্বতঃস্ফূর্ত কোয়ান্টাম সৃষ্টি সম্পর্কিত আমাদের চিত্রটি তাহলে অনেকটা ফুটন্ত জলে বাষ্পের বুদবুদ সৃষ্টির মতো মনে হবে। নানা ক্ষুদ্র বুদবুদ আবির্ভূত হয়ে মিলিয়ে যায়। এগুলো ছোট-মহাবিশ্বকে প্রতিনিধিত্ব করে, যেসব প্রসারিত হয় বটে কিন্তু আণুবীক্ষণিক আকারে থাকা অবস্থাই ভেঙে পড়ে। এগুলো প্রতিনিধিত্ব করছে সম্ভাব্য বিকল্প মহাবিশ্বসমূহের, কিন্তু সেগুলো আমাদের আগ্রহের বিষয় নয় কারণ সেগুলো ছায়াপথ, নক্ষত্রাবলি ইত্যাদি গঠন ও বুদ্ধিমান জীবনের উপযোগী নয়। তা সত্ত্বেও, ছোট বুদবুদগুলোর কোনো কোনোটি যথেষ্ট বড় হয়ে উঠবে, ফলে সেগুলোর ভেঙে পড়া রোধ হবে। সেগুলো ক্রমেই প্রসারিত হয়ে পর্যবেক্ষণযোগ্য বাষ্প বুদবুদ সৃষ্টি করবে। এই বুদবুদগুলো দ্রুত হারে প্রসারিত হবে অর্থাৎ স্ফীতি অবস্থা দেখা দেবে এমন মহাবিশ্বগুলোরই প্রতিনিধিত্ব করে।
আমরা যেমন বলেছিলাম, স্ফীতির ফলে সৃষ্ট প্রসারণ সর্বত্র সমরূপে হবে না। ইতিহাসের যোগফলে, কেবল একটিমাত্র সম্পূর্ণ সমরূপ এবং প্রতিসম ইতিহাসের সম্ভাব্যতা সবচেয়ে বেশি, কিন্তু হালকা অপ্রতিসম অন্যান্য অনেক ইতিহাসসমুহের সম্ভাব্যতাও প্রায় সর্বোচ্চ হবে। এই কারণেই স্ফীতি তত্ত্ব অনুমান করে যে আদি মহাবিশ্ব হালকা অপ্রতিসম বা সমরূপ নয়, যা কিনা মঅপবিতে পর্যবেক্ষিত তাপমাত্রার অল্প পার্থক্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। আদি মহাবিশ্বে এই অপ্রতিসমতা আমাদের জন্য সৌভাগ্যজনক ছিলো। কেনো? সমঘনত্ব ভালো যদি আপনি আপনার দুধ থেকে সর আলাদা করতে না চান, কিন্তু একটি প্রতিসম মহাবিশ্ব বিরক্তিকর। আদি মহাবিশ্বের জন্য অপ্রতিসমতা গুরুত্বপূর্ণ কারণ যদি কোনো অঞ্চলের ঘনত্ব অন্যান্য অঞ্চলগুলোর থেকে বেশি হতো, তবে সেই বাড়তি ঘনত্বের মহাকর্ষীয় আকর্ষণ পারিপার্শ্বিকতার চেয়ে প্রসারণকে শ্লথ করে দিতো। এভাবেই মহাকর্ষ বল ধীরে ধীরে পদার্থকে আকর্ষণ করে ক্রমে ছায়াপথ, নক্ষত্র, গ্রহ এবং অন্তত এক সময় মানুষ সৃষ্টি করেছে। মহাকাশের অণুতরঙ্গের মানচিত্রটি ভালোভাবে লক্ষ্য করুন। এটি মহাবিশ্বের সব কাঠামোর জন্য নীলনকশা স্বরূপ। আমরা আদি মহাবিশ্বে কোয়ান্টাম অস্থিতির ফসল। কোনো ধার্মিক হয়তো বলবেন যে ঈশ্বর বাস্তবিকই পাশা খেলেন।
এই ধারণা মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের প্রচলিত ধারণার চেয়ে ভিন্ন এক মনোভঙ্গির দিকে ধাবিত করে, মহাবিশ্বের ইতিহাস সম্পর্কে আমরা যেভাবে চিন্তাভাবনা করি তার পরিবর্তন করা আবশ্যক হয়ে পড়ে। মহাবিশ্বতত্ত্ব অনুযায়ী ভবিষ্যদ্বাণী করতে হলে আমাদেরকে বর্তমান সময়ে সমগ্র মহাবিশ্বের বিভিন্ন অবস্থার সম্ভাব্যতা গণনা করতে হবে। পদার্থবিজ্ঞানে সাধারণত কেউ একজন একটি সিস্টেমের জন্য কিছু আদি অবস্থান অনুমান করে নেয়, এবং গাণিতিক সমীকরণ ব্যবহার করে সময়ের সাথে সাথে সিস্টেমটি কীভাবে বিবর্তিত হবে তা নির্ণয় করে। যে কোনো সময়ে একটি সিস্টেমের অবস্থা দেয়া থাকলে, কেউ একজন পরবর্তী কোনো এক সময়ে সিস্টেমটির অবস্থা কী রূপ হবে তার সম্ভাব্যতা গণনা করে। মহাবিশ্বতত্ত্বে একটি প্রচলিত অনুমান হলো যে মহাবিশ্বের একটি একক সুনির্দিষ্ট ইতিহাস রয়েছে। পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রাবলি ব্যবহার করে কেউ একজন গণনা করতে পারবে কীভাবে সময়ের সাথে সাথে এই ইতিহাস পরিস্ফুট হয়েছে। মহাবিশ্বতত্ত্বে আমরা এটিকে বলি “নিচ-থেকে-উপর” পদ্ধতি (“bottom-up” approach)। কিন্তু যেহেতু আমাদেরকে অবশ্যই ফাইনম্যানের ইতিহাসের যোগফলে বর্ণিত মহাবিশ্বের কোয়ান্টাম প্রকৃতিকে হিসেবে ধরতে হবে, তাই সম্ভাব্যতার বিস্তার অর্থাৎ মহাবিশ্ব একটি নির্দিষ্ট অবস্থায় পৌঁছানোর সকল ইতিহাসের অবদান যোগ করতে হবে- যা সীমারেখাহীন শর্ত মানে এবং বর্তমান অবস্থায় এসে পৌঁছায়। অন্যভাবে বললে, মহাবিশ্বতত্ত্বে, কারো উচিত নয় মহাবিশ্বের ইতিহাস অতীত-থেকে-বর্তমান পদ্ধতি অনুসরণ করা কারণ সেক্ষেত্রে অনুমান করা হয় যে মহাবিশ্বের একটি একক ইতিহাস রয়েছে, সুনির্দিষ্ট উৎসবিন্দু থেকে বিবর্তন ঘটেছে। সুতারাং, ইতিহাসকে বর্তমান-থেকে-অতীতে পদ্ধতিতে অনুসন্ধান করা উচিত। কিছু কিছু ইতিহাস অন্যসব ইতিহাস থেকে বেশি সম্ভাব্য হবে, এবং যোগফল সাধারণত একটি একক ইতিহাস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে- যে ইতিহাস মহাবিশ্বের সৃষ্টিলগ্নে শুরু হয়েছিলো এবং বিভিন্ন হেতু সাপেক্ষে বর্তমান শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছেছে। কিন্তু বর্তমান সময়ে বিভিন্ন সম্ভাব্য অবস্থার জন্য বিভিন্ন ইতিহাস রবে। এটি মহাবিশ্বতত্ত্ব, এবং মিথস্ক্রিয়া সম্পর্কিত ধারণাসমূহে আমূল পরিবর্তন আনে। যেসব ইতিহাস ফাইনম্যানের যোগফলে অবদান রাখে সেগুলোর স্বাধীন অস্তিত্ব নেই, ব্যাপারটি বরং কী পরিমাপ করা হচ্ছে তার উপর নির্ভর করে। আমরা আমাদের পর্যবেক্ষণ দ্বারা ইতিহাস সৃষ্টি করি, ইতিহাস আমাদের সৃষ্টি করে না।
মহাবিশ্বের যে একটি অদ্বিতীয় পর্যবেক্ষক-নির্ভরতাহীন ইতিহাস নেই এই ধারণা আমাদের জ্ঞাত অনেক বিষয়ের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ মনে হতে পারে। এমন কোনো বিকল্প ইতিহাস সম্ভব যেখানে চাঁদ পনির দিয়ে তৈরি। কিন্তু আমরা পর্যবেক্ষণ করেছি যে চাঁদ আসলেই পনির নিয়ে গঠিত নয় (ইঁদুরের জন্য খারাপ খবর)। সুতারাং, যে ইতিহাসে চাঁদ পনির দিয়ে তৈরি সেই ইতিহাস আমাদের মহাবিশ্বের বর্তমান অবস্থায় কোনো অবদান রাখে না, হতে পারে সেটি অন্যত্র প্রভাব বিস্তার করছে। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির মতো শোনালে-ও, এটিই সত্য।
বর্তমান-থেকে-অতীত পদ্ধতির একটি গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য হচ্ছে যে প্রকৃতির প্রত্যক্ষ নিয়মাবলি মহাবিশ্বের ইতিহাসের উপর নির্ভরশীল! অনেক বিজ্ঞানি বিশ্বাস করেন যে একটি একক ইতিহাসের অস্তিত্ব রয়েছে এবং সে অনুযায়ী প্রকৃতির নিয়মাবলি ও প্রাকৃতিক ধ্রুবকগুলো যেমন- ইলেকট্রনের ভরের মান অথবা স্থান-কালের মাত্রা ইত্যাদি ব্যাখ্যা করেন। কিন্তু বর্তমান-থেকে-অতীত মহাবিশ্বতত্ত্ব নির্দেশ করে যে ভিন্ন ভিন্ন ইতিহাসের জন্য প্রকৃতির প্রত্যক্ষ নিয়মাবলি ভিন্ন ভিন্ন।
মহাবিশ্বের প্রত্যক্ষ মাত্রার কথা বিবেচনা করুন তো। এম-তত্ত্ব মতে, স্থান-কালের দশটি স্থানের মাত্রা এবং একটি সময়ের মাত্রা রয়েছে। ধারণাটি এইরকম- স্থানের সাতটি মাত্রা এতো ক্ষুদ্রভাবে কুণ্ডলী পাকিয়ে আছে যে আমরা সেগুলো দেখতে পাই না, এবং আমাদের সম্মুখে বাদবাকি বৃহৎ তিনটি মাত্রার বিভ্রম হাজির। এম-তত্ত্বের একটি প্রধান প্রশ্ন হচ্ছে: কেনো আমাদের মহাবিশ্বে তিনটির বেশি বৃহৎ মাত্রা নেই এবং কেনো অন্য মাত্রাগুলো কুণ্ডলী পাকানো?
অনেক লোকজনই বিশ্বাস করতে পছন্দ করবেন যে বিশেষ কোনো প্রক্রিয়ার কারণে তিনটি বাদে অন্য মাত্রাগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেঁকে পাকিয়ে গেছে। বিকল্পভাবে, হয়তোবা সব মাত্রায় অতিক্ষুদ্র থেকে শুরু হয়েছিলো, কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে তিনটি মাত্রা প্রসারিত হয়েছে ও অন্যগুলো পারে নি। তারপরও মনে হয় যে গতিবিদ্যার এমন কোনো কারণ নেই যার কারণে মহাবিশ্ব শুধু আপাতত চতুর্মাত্রিকই হবে। বরঞ্চ, বর্তমান-থেকে-অতীত মহাবিশ্বতত্ত্ব পদ্ধতি অনুমান করে যে পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মাবলি দ্বারা বৃহৎ মাত্রাগুলোর সংখ্যা নিয়ন্ত্রিত নয়। শূন্য থেকে দশ পর্যন্ত স্থানের সকল মাত্রার জন্য একটি করে কোয়ান্টাম সম্ভাব্যতা বিস্তার থাকবে। এই ধারণাগুলো মহাবিশ্বের প্রতিটি সম্ভাব্য ইতিহাসের জন্য ফাইনম্যানের যোগফল দ্বারা অনুমোদিত, কিন্তু পর্যবেক্ষণ অর্থাৎ আমাদের মহাবিশ্বের যে তিনটি বৃহৎ স্থানিক মাত্রা রয়েছে সেটি ইতিহাসগুলোর পর্যবেক্ষণযোগ্য উপশ্রেণী থেকে বেছে নেয়া। অন্যভাবে বললে, মহাবিশ্বের যে তিনটি বৃহৎ স্থানিক মাত্রার চেয়ে কম বা বেশি বৃহৎ মাত্রা থাকতে পারে সেটির কোয়ান্টাম সম্ভাব্যতা নির্ণয় অবান্তর কারণ আমরা ইতিমধ্যে নির্ণয় করে ফেলেছি যে আমরা তিনটি বৃহৎ স্থানের মাত্রায় বসবাস করছি। তাই যতক্ষণ পর্যন্ত এই তিনটি বৃহৎ স্থানের মাত্রার কোয়ান্টাম সম্ভাব্যতা বিস্তারের মান পুরোপুরি শূন্য না হচ্ছে, অন্য মাত্রাগুলোর সম্ভাব্যতা বিস্তার অপেক্ষা এই মানগুলো কতো ছোট সেই তুলনা করে লাভ নেই। বিষয়টা অনেকটা এইরকম: যেনো জানতে চাওয়া হচ্ছে বর্তমান পোপ চৈনিক হওয়ার কোয়ান্টাম সম্ভাব্যতা বিস্তারের মান কতো। আমরা জানি যে বর্তমান পোপ জার্মান, কিন্তু চৈনিক লোকসংখ্যা জার্মান লোকসংখ্যার চেয়ে বেশি হওয়ার কারণে সে জার্মান অপেক্ষা চৈনিক হওয়ার সম্ভাব্যতার বিস্তার বেশি হলে-ও কোনো লাভ নেই। অনুরূপভাবে, আমরা যে মহাবিশ্ব দেখি সেটি ত্রিমাত্রিক, ফলে অন্য কোনো মাত্রা বৃহৎ হওয়ার সম্ভাব্যতা বিস্তারের মান এই তিনটি মাত্রার মানের চেয়ে বেশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে-ও কোনো লাভ নেই, কারণ আমরা আগেই ঠিক করে ফেলেছি যে আমরা কেবল ত্রিমাত্রিক মহাবিশ্বে আছি।
বেঁকে গিয়ে পাকানো মাত্রাগুলোর বেলায় কী ঘটবে? স্মরণ করুন যে এম-তত্ত্বে বাদবাকি কুণ্ডলী পাকানো মাত্রাগুলোর যথাযথ আকার-আকৃতি অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ স্থানই নির্ধারণ করে ভৌত গুণাবলি যেমন ইলেকট্রনের আধান এবং মৌলিক কণিকাসমূহের মধ্যকার মিথস্ক্রিয়া, প্রাকৃতিক বলসমূহ। সবকিছু ঠিকঠাকই হতো যদি এম-তত্ত্ব মতে কুণ্ডলী পাকানো মাত্রাগুলোর একটি বা অল্প কয়েকটি করে আকার-আকৃতি থাকতো। অথচ, এম-তত্ত্ব মতে, প্রায় ১০৫০০ টি ভিন্ন ভিন্ন অভ্যন্তরীণ স্থানের সম্ভাব্যতা বিস্তার রয়েছে, যেটির কারণে ভিন্ন ভিন্ন নিয়মাবলি থাকবে এবং ভৌত ধ্রুবকগুলোর মান বিভিন্ন হবে।
কেউ যদি মহাবিশ্বের ইতিহাসকে অতীত-থেকে-বর্তমান পদ্ধতিতে গণনা করেন, তবে কোনো কারণ নেই যে কণিকা মিথস্ক্রিয়ার কারণে আমাদের পর্যবেক্ষণ করা মহাবিশ্ব এমন অভ্যন্তরীণ স্থানে উপনীত হবে। কিন্তু বর্তমান-থেকে-অতীত পদ্ধতিতে আমরা মানি যে মহাবিশ্ব সম্ভাব্য সকল অভ্যন্তরীণ স্থানগুলো নিয়েই অস্তিত্বমান। কোনো মহাবিশ্বে হয়তো ইলেকট্রনের ওজন গলফ বলের সমান এবং মহাকর্ষ বল তড়িচ্চুম্বকীয় বলের চেয়ে শক্তিশালী। তবে আমাদের মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে প্রমিত মডেলই প্রযোজ্য। ইচ্ছে করলে কেউ একজন সীমারেখাহীন শর্তের উপর নির্ভর করে এমন একটি অভ্যন্তরীণ স্থানের সম্ভাব্যতার বিস্তার গণনা করতে পারেন যেটি প্রমিত মডেলের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তিনটি বৃহৎ স্থানের মাত্রার মহাবিশ্বের সম্ভাব্যতার মতো, এই অভ্যন্তরীণ স্থানের সম্ভাব্যতার বিস্তার গণনাই কোনো লাভ নেই কারণ আমরা ইতিমধ্যে পর্যবেক্ষণ করে ফেলেছি যে প্রমিত মডেল আমাদের মহাবিশ্বকে বর্ণনা করতে পারে।
আমরা যে তত্ত্বটি এই অধ্যায়ে পেশ করেছি সেটি পরীক্ষণীয়। পূর্ববর্তী উহারণগুলোতে আমরা জোর দিয়েছি যে আমূল ভিন্ন মহাবিশ্ব যেমন যেগুলোতে ভিন্ন সংখ্যার বৃহৎ স্থানিক মাত্রা রয়েছে সেগুলোর জন্য তুলনামূলক সম্ভাব্যতা বিস্তার গণনায় খুব বেশি কিছু যায় আসে না। তবে পাশ্ববর্তী (প্রায় অনুরূপ) মহাবিশ্বগুলোর জন্য তুলনামূলক সম্ভাব্যতা বিস্তার গণনা গুরুত্বপূর্ণ। সীমারেখাহীন শর্ত অনুযায়ী, যে সব ইতিহাসে মহাবিশ্বের সূচনা হয়েছে খুবই নির্ঝঞ্ঝাটভাবে, সেগুলোর সম্ভাব্যতা বিস্তার সর্বোচ্চ হবে। অবিন্যস্ত বা অপ্রতিসম মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে বিস্তারের মান অনেক কম। অর্থাৎ আমাদের আদি মহাবিশ্ব অনেকাংশে নির্ঝঞ্ঝাট ছিলো, কিন্তু কিছু অপ্রতিসমতাও ছিলো। আমরা যেমন উল্লেখ করেছি, মহাকাশের বিভিন্ন দিক থেকে আসা অণুতরঙ্গ থেকে আমরা এই অপ্রতিসমতাসমূহ খুব সূক্ষ্ম পার্থক্যাকারে পর্যবেক্ষণ করতে পারি। দেখা গিয়েছে যে সেইসব গণনা স্ফীতি তত্ত্বের অনুমানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ; তারপরেও বর্তমান-থেকে-অতীত পদ্ধতি বা তত্ত্বকে আলাদা করার জন্য অথবা সমর্থন করার জন্য আরো নির্ভুল বা যথাযথ পরিমাপের প্রয়োজন। ভবিষ্যতে কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে সেটি করা হতে পারে।
শত শত বছর আগে মানুষ ভেবেছিলো পৃথিবী অদ্বিতীয়, এবং মহাবিশ্বের কেন্দ্রে অবস্থিত। বর্তমানে আমরা জানি যে আমাদের ছায়াপথে শত শত বিলিয়ন নক্ষত্র আছে, সেগুলোর অনেকগুলোতে সৌরজগত আছে; এবং এই ধরণের শত শত বিলিয়ন ছায়াপথ রয়েছে। এই অধ্যায়ে বর্ণিত ফলাফল মতে আমাদের মহাবিশ্বই অগণন মহাবিশ্বের একটি, এবং আমাদের প্রত্যক্ষ নিয়মাবলি অন্যন্য কিছু নয়। যারা একটি সার্বিক তত্ত্বের আশা করতো তাদের জন্য ব্যাপারটি হতাশাজনক। যেসব বৃহৎ স্থানিক মাত্রার সংখ্যা অথবা অভ্যন্তরীণ স্থান আমাদের পর্যবেক্ষণীয় ভৌত গুণাবলি (যেমন- ইলেকট্রনের ভর ও আধান এবং অন্যান্য মৌলিক কণিকাগুলো) নির্ধারণ করে সেইগুলোর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বা বিষয়গুলো আমরা অনুমান করতে পারি না। বরং, আমরা ওই সংখ্যাগুলোকে ব্যবহার করি যেসব ইতিহাস ফাইনম্যানের যোগফলে অংশ নেয় বা অবদান রাখে সেসব ইতিহাসকে বাছাই করতে।
যেনো আমরা বিজ্ঞানের ইতিহাসের এক সংকট-বিন্দুতে উপস্থিত, যেখানটায় আমাদের লক্ষ্যের পরিকল্পনা এবং একটি ভৌত তত্ত্ব কী কী বিষয়ের কারণে গ্রহণযোগ্য হবে সেই ধারণার পরিবর্তন করতে হবে। যেনো মৌলিক ধ্রুবকগুলো এবং প্রকৃতির প্রত্যক্ষ নিয়মগুলো কোনো যুক্তি অথবা ভৌত নীতি মেনে চলছে না। যেনো ধ্রুবকগুলো স্বাধীনভাবে অনেক মান এবং নিয়মগুলো যে কোনো রূপ গ্রহণ করতে পারে যা ক্রমশ একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ গাণিতিক তত্ত্বের দিকে এগিয়ে নেয়; এবং আমরা দেখেছি তারা অবশ্যই বিভিন্ন মহাবিশ্বে বিভিন্ন মান ও বিভিন্ন রূপ গ্রহণ করে। এটি হয়তো মহাবিশ্বে মানবজাতির বিশেষ স্থানকে খর্ব করে কিংবা পদার্থবিজ্ঞানের সব নিয়মাবলির একটি সার্বিক তত্ত্বের প্রত্যাশা পূরণ করে না; তারপরও এটিই প্রকৃতির রূপ।
মনে হচ্ছে সম্ভাব্য মহাবিশ্বের একটি বিশাল সম্ভাবনা আছে। কিন্তু আমরা পরবর্তী অধ্যায়ে দেখবো যে আমাদের মতো জীবনের অস্তিত্ব থাকতে পারে এমন মহাবিশ্বের সংখ্যা নগণ্য বা দুর্লভ। আমরা যে মহাবিশ্বে আছি সেটি যদি সামান্যতম ভিন্ন হতো তবে আমাদের মতো সত্তার অস্তিত্বও সম্ভব হতো না। আমরা এই সূক্ষ্ম-সঙ্গতি থেকে কী ধারণা করতে পারি? এটি কি কোনো প্রমাণ যে সর্বশেষে মহাবিশ্ব একজন দয়ালু সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক পরিকল্পিত? নাকি বিজ্ঞান অন্য কোনো ব্যাখ্যা দাখিল করে?
No comments:
Post a Comment