এসো খড়ে সুঁই খুঁজি

Custom Search

Thursday, July 11, 2019

অধ্যায় ৭: আমরা কি পৃথিবীতে টিকে থাকতে পারবো? [স্টিফেন হকিং: বড় প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত উত্তর] [Stephen Hawking: Brief Answers to the Big Questions]


অধ্যায় ৭: আমরা কি পৃথিবীতে টিকে থাকতে পারবো?

২০১৮ সালের জানুয়ারিতে, প্রথম পারমাণবিক ক্ষেপনাস্ত্র তৈরির করার জন্য ম্যানহাটন প্রকল্পে (Manhattan Project) কাজ করা পদার্থবিজ্ঞানীদের কয়েকজন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত Bulletin of the Atomic Scientists জার্নাল, বিপর্যয়দিনের ঘড়িকে (Doomsday Clock) মধ্যরাতের দিকে দুই মিনিট এগিয়ে দিয়েছে। বিপর্যয়দিনের ঘড়ি হচ্ছে আমাদের গ্রহের সম্মুখীন সামরিক অথবা পরিবেশগত   নৈকট্য বিপর্যয়ের পরিমাপ।

ঘড়িটির একটি আকর্ষণীয় ইতিহাস আছে। এটি ১৯৪৭ সালে চালু করা হয়েছিলো, যে সময়ে পরমাণু যুগ সবে শুরু হয়েছিলো। রবার্ট ওপেনহেইমার, ম্যানহাটন প্রকল্পের প্রধান বিজ্ঞানী, দুই বছর আগের ১৯৪৫ সালের জুলাই মাসে প্রথম পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের পরে বলেছিলেন, আমরা জানতাম যে পৃথিবী আর একই থাকবে না। কয়েকজন লোক হেসেছিলো, কয়েকজন কেঁদেছিলো, বেশিরভাগ লোক চুপ করেছিলো। আমার হিন্দু ধর্মগ্রন্থ, ভগবদ্গীতা থেকে এই পংক্তিটি মনে পড়েছিলো, এখন, আমি মৃত্যু, পৃথিবী ধ্বংসকারী হয়েছি।

১৯৪৭ সালে ঘড়িটি মধ্যরাত থেকে সাত মিনিট বাকি -তে চালু করা হয়েছিলো। এটি এখন ১৯৫০ এর দশকে ঠাণ্ডা যুদ্ধের শুরু থেকে অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বিপর্যয়দিনের সবচেয়ে কাছাকাছি। ঘড়িটি এবং এটির গতিবিধি, অবশ্যই, সম্পূর্ণরূপে প্রতীকী, তবে আমি অঙ্গুলিনির্দেশ করার তাগিদ অনুভব করি যে অন্যান্য বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে এই ধরণের সতর্কবাণীমূলক বার্তা, অন্তত ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনের ফলে যা জোরদার হয়েছে, অবশ্যই গুরুত্ব সহকারে নেওয়া উচিত। ঘড়িটি, এবং মানবজাতির জন্য সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে অথবা সময় টিকটিক করছে এই ধারণা কি বাস্তবসম্মত নাকি আতঙ্কসৃষ্টিকারী? এটি কি সময় মতো সতর্ক করছে নাকি সময় নষ্ট করছে?

সময় নিয়ে আমার খুব ব্যক্তিগত আগ্রহ আছে। প্রথমত, আমার সর্বাধিক বিক্রিত বই, এবং যে প্রধান কারণে আমি বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়ের বাইরে পরিচিত, সেটি হচ্ছে A Brief History of Timeতাই অনেকে মনে করতে পারেন যে আমি একজন সময় বিশেষজ্ঞ, তবে অবশ্যই আজকালকার দিনে একজন বিশেষজ্ঞ হওয়া নেহাৎ খুব ভালো জিনিস নয়। দ্বিতীয়ত, একজন যাকে একুশ বছর বয়েসে তার ডাক্তাররা বলেছিলো যে তার আর মাত্র পাঁচ বছর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা আছে, এবং যে ২০১৮ সালে ৭৬ বছর বয়েসী হয়েছে, অন্য অর্থে আমি একজন সময় বিশেষজ্ঞ, অনেক ব্যক্তিগতভাবে। আমি অস্বস্তিকরভাবে, সময়ের বহে যাওয়া সম্পর্কে সচেতন, এবং আমার জীবনের বেশিভাগ সময় এই ধারণা নিয়ে বাস করেছি যে আমাকে যে সময় দেওয়া হয়েছে, তা তারা যেমন বলে, ধার করা সময়। 

কোনো সন্দেহ নেই যে আমার স্মৃতিতে অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে আমাদের বিশ্ব এখন রাজনৈতিকভাবে অনেক বেশি অস্থির। সংখ্যাগরিষ্ঠ বেশিরভাগ লোক মনে করেন যে তারা অর্থনৈতিক ও সামাজিক উভয়ভাবে পিছিয়ে আছেন। ফলস্বরূপ, তারা লোকগ্রাহ্য (populist), অন্তত জনপ্রিয়- রাজনীতিবিদদের দিকে ঝুঁকছেন, যাদের সরকার পরিচালনার অভিজ্ঞতা সীমিত এবং যাদের কোনো সংকটের মুহূর্তে সুস্থির সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এখনো যাচাই করা হয় নি। সুতারাং, অর্থ হচ্ছে যে বিপর্যয়দিনের ঘড়ির কাঁটা একটি সংকটপূর্ণ বিন্দুর আরো কাছাকাছি সরানো উচিত, যেহেতু যত্নহীন অথবা বিদ্বেষপরায়ণ শক্তির বিস্তৃতিতে শুভ অশুভের সর্বশেষ রণক্ষেত্রের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

পৃথিবী বিভিন্ন দিক থেকে এতো বেশি হুমকির মুখে পড়েছে যে আমার পক্ষে ইতিবাচক হওয়া কঠিনএই হুমকিগুলো খুব বড় এবং অসংখ্য।

প্রথমত, পৃথিবী আমাদের জন্য খুব ছোট হয়ে উঠছে। আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদসমূহ একটি বিপদজনক হারে শেষ হয়ে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যয়মূলক উপহার আমরা আমাদের গ্রহকে দিয়েছি। ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা, মেরু অঞ্চলের বরফ হ্রাস, বন উজাড়, অতিরিক্ত জনসংখ্যা, রোগ, যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, পানির অভাব এবং প্রাণী প্রজাতিসমূহের বিলুপ্তি; এইসব সমাধানযোগ্য কিন্তু এখনো পর্যন্ত সমাধান করা হয় নি।

বিশ্বব্যাপী উষ্ণতা বৃদ্ধি আমাদের সবার কারণে ঘটেছে। আমরা চাই গাড়ি, ভ্রমণ এবং জীবনযাত্রার একটি ভালোতর মান। সমস্যা হচ্ছে, লোকেরা যখন বুঝে উঠতে পারবে যে কী ঘটছে, তখন খুব দেরী হয়ে যেতে পারে। যতোই আমরা দ্বিতীয় পারমাণবিক যুগ এবং অভূতপূর্ব জলবায়ু পরিবর্তনের সময়ের তীরে দাঁড়িয়ে আছি, জনসাধারণকে অভিহিত করার এবং মানবতাবিরোধী বিপদগুলো সম্পর্কে নেতাদের পরামর্শ দেওয়ার জন্য বিজ্ঞানীদের একটি বিশেষ দায়িত্ব আছে। বিজ্ঞানীদের মতো, আমরা পারমাণবিক অস্ত্রের বিপদ এবং তাদের বিধ্বংসী প্রভাবগুলো বুঝতে পারি, এবং আমরা শিখছি কীভাবে মানুষের কার্যকলাপ এবং প্রযুক্তিগুলো জলবায়ু ব্যবস্থাসমূহকে প্রভাবিত করছে এমন এক ভাবে যাতে পৃথিবীতে চিরকালের জন্য জীবনের পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। পৃথিবীর নাগরিক হিসেবে, আমাদের এই জ্ঞান ভাগ করে নেওয়ার এবং জনসাধারণকে প্রতিদিনের অপ্রয়োজনীয় ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে সতর্ক করার দায়িত্ব রয়েছে। আমরা বড় বিপদের আশংকা করি যদি না সরকারগুলো এবং সমাজসমূহ পারমাণবিক অস্ত্র রোধে এবং আরো জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করার জন্য এখনই পদক্ষেপ নেয়।

একই সময়ে, সেই একই রাজনীতিবিদদের অনেকে মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের বাস্তবতাকে অস্বীকার করছেন, অথবা অন্তত এটিকে বিপরীতমুখী করতে মানুষের ক্ষমতাকে প্রত্যাখ্যান করছেন, ঠিক যেই মুহূর্তে আমাদের বিশ্ব ক্রমে পরিবেশগত জটিল সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে। বিপদজনক ব্যাপার হচ্ছে যে বিশ্বব্যাপী উষ্ণতা বৃদ্ধি একটি নিজে থেকে বজায় থাকা বা চলতে থাকা (self-sustaining) ব্যাপার হয়ে যেতে পারে, যদি এটি ইতিমধ্যেই না হয়ে থাকে। উত্তর মেরু এবং দক্ষিণ মেরুর বরফের গলন মহাকাশে সৌরশক্তি প্রতিফলিত হওয়ার অংশকে হ্রাস করে, ফলে তাপমাত্রা আরো বৃদ্ধি করেজলবায়ু পরিবর্তন আমাজন এবং অন্যান্য বৃষ্টিপ্রধান বনাঞ্চলকে ধ্বংস করতে পারে এবং বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড অপসারণের অনেকগুলো উপায়ের একটিকে অপসারিত করতে পারে। সমুদ্রের তাপমাত্রা বৃদ্ধি বিপুল পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মুক্তির সূত্রপাত করতে পারে। এই দুটো ঘটনাই গ্রীনহাউস প্রভাব বৃদ্ধি করবে, এবং ফলে বিশ্বব্যাপী উষ্ণতা বৃদ্ধিকে বাড়াবেদুটো প্রভাবই আমাদের জলবায়ুকে শুক্রগ্রহের মতো করতে পারে: ফুটন্ত গরম এবং সালফিউরিক অ্যাসিডের বৃষ্টিপাত, ২৫০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা হতে পারে (৪৮২ ডিগ্রী ফারেনহাইট)। মানব জীবন অস্থিতিশীল হবে। আমাদের ১৯৯৭ সালে গৃহীত আন্তর্জাতিক চুক্তি কিয়োটো খসড়াচুক্তির (Kyoto Protocol) বেশি করতে হবে এবং এখনই কার্বন নির্গমন কমাতে হবে। আমাদের প্রযুক্তি আছে। আমাদের শুধু রাজনৈতিক ইচ্ছা প্রয়োজন।

আমরা অনেক অজ্ঞ, চিন্তাশক্তিহীন হতে পারি। আমরা আমাদের ইতিহাসে আগে যখন অনুরূপ সংকটে পৌঁছেছি, আমাদের অন্য কোথাও উপনিবেশের জায়গা ছিলো। কলম্বাস ১৪৯২ সালে এটি করেছিলেন যখন তিনি নতুন পৃথিবী (New World) আবিষ্কার করেছিলেন। কিন্তু এখন নতুন কেনো পৃথিবী নেই। কাছাকাছি কোনো আনন্দলোক নেই। আমাদের স্থানসংকুলান হচ্ছে না এবং যাওয়ার জন্য যে জায়গাগুলো আছে সেগুলো হচ্ছে অন্য পৃথিবী।

মহাবিশ্ব একটি হিংস্র জায়গা। নক্ষত্রগুলো গ্রহসমূহকে গ্রাস করে, মহাকাশ জুড়ে অতিকায় নবজ্যোতিষ্কগুলো প্রাণঘাতী রশ্মি ত্যাগ করে, কৃষ্ণগহ্বরগুলো একে অন্যের সাথে ধাক্কা খায়, এবং গ্রহাণুগুলো প্রতি সেকেন্ডে শত শত মাইল বেগে চারদিকে ধাবিত হয়। মানি যে এইসব ঘটনাবলি মহাবিশ্বকে খুব অতিপরায়ণ হিসেবে তুলে ধরে না, কিন্তু ঠিক এই কারণগুলোর কারণেই আমাদের উচিত যে অবস্থায় আছি সেই অবস্থায় না থেকে মহাবিশ্বের অন্যত্র স্থানান্তরিত হওয়া। একটি গ্রহাণুর সংঘর্ষের বিরুদ্ধে আমাদের কোনো প্রতিরক্ষা নেই। সর্বশেষ এইরকম বড় সংঘর্ষ হয়েছিলো প্রায় ৬৬ মিলিয়ন বছর আগে এবং মনে করা হয় যে সেটি ডাইনোসরকে মেরে ফেলেছিলো, এবং এটি আবার ঘটবে। এটি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী নয়, এটি পদার্থবিজ্ঞান এবং সম্ভাবনার সূত্রাবলি দ্বারা নিশ্চিত।

পারমাণবিক যুদ্ধ এখনো বর্তমান সময়ে মানবতার জন্য সম্ভবত সবচেয়ে বড় হুমকি। এটি যে একটি বিপদ আমরা বরং সেটি ভুলে গেছি। রাশিয়া এবং আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র এখন আর সামান্য উস্কানিতে সহিংস পন্থা অবলম্বন করতে প্রস্তুত নয়, কিন্তু ধরুণ যে একটি দুর্ঘটনা ঘটেছে, অথবা সন্ত্রাসীরা এই দেশগুলোর অস্ত্রাবলি দখলে নিয়েছে। এবং ঝুঁকি বাড়বে আরো বেশি দেশ পারমাণবিক অস্ত্র লাভ করলে। এমনকি ঠাণ্ডা যুদ্ধের শেষে-ও, আমরা আমাদের বহুবার হত্যা করার জন্য যথেষ্ট সংখ্যক পারমাণবিক অস্ত্র মজুদ রয়েছে, এবং নতুন পারমাণবিক দেশগুলো অস্থিতিশীলতা যোগ করবে। সময়ের সাথে সাথে, পারমাণবিক হুমকি হয়তো হ্রাস পেতে পারে, তবে অন্যান্য হুমকির বিকাশ ঘটবে, তাই আমাদের অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে।

এক বা অন্যভাবে, আমি এটি প্রায় অনিবার্য বলে মনে করি যে একটি পরমাণু সংঘাত অথবা পরিবেশগত বিপর্যয় আগামী ১০০০ বছরে, যা ভূতাত্ত্বিক সময়ে শুধুমাত্র চোখের একটি পলক, পৃথিবীকে পঙ্গু করবে। সেই সময় নাগাদ আমি আশা করি এবং বিশ্বাস করি যে আমাদের প্রতিভাশালী জাতি পৃথিবীর রুক্ষপ্রকৃতির বন্ধনকে ছেড়ে যাওয়ার একটি উপায় খুঁজে বের করবে এবং অতএব দুর্যোগ থেকে বাঁচবে। অবশ্যই পৃথিবীতে বসবাসকারী লক্ষ লক্ষ অন্যান্য প্রজাতির জন্য এটি হয়তো সম্ভব নয়, এবং একটি প্রজাতি হিসেবে সেটি আমাদের বিবেকে লাগবে।

আমি মনে করি আমরা পৃথিবীতে আমাদের ভবিষ্যতের জন্য অপরিণামদর্শী উদাসীনতার সাথে কাজ করছি। এই মুহূর্তে আমাদের অন্য কোথাও যাওয়ার নেই, কিন্তু দীর্ঘ কালে মানবজাতির উচিত নয় সব ডিম এক ঝুড়িতে রাখার বা এক গ্রহের মধ্যে থাকার। আমি শুধু আশা করি আমরা পৃথিবী থেকে কীভাবে পালাতে পারি তা শেখার আগে হাত থেকে (ডিমের) ঝুড়ি পড়ে যাওয়া যেনো এড়াতে পারি। কিন্তু আমরা প্রকৃতিগতভাবে অভিযাত্রী। কৌতূহল দ্বারা প্রেরিত। এটি অনন্যভাবে একটি মানবগুণ। এই চালিত কৌতূহলই অনুসন্ধানকারীদের পৃথিবী যে সমতল নয় সেটি প্রমাণ করতে প্রেরিত করেছে এবং একই প্রবৃত্তিই আমাদের চিন্তার গতিতে নক্ষত্রসমূহের কাছে প্রেরণ করে এবং বাস্তবে সেখানে যেতে আহবান করছে। এবং যখন আমরা চাঁদে অবতরণের মতো একটি বড় নতুন অগ্রগতি করি, তখন আমরা মানবতাকে উন্নীত করি, মানুষজন এবং বিভিন্ন জনগোষ্ঠীকে একত্রিত করি, নতুন আবিষ্কার এবং নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করি। পৃথিবী ত্যাগ করার জন্য একটি সমন্বিত বিশ্বব্যাপী পরিকল্পনা প্রয়োজন- প্রত্যেকেরই যোগদান করা উচিতআমাদের ১৯৬০ এর দশকে মহাকাশ ভ্রমণের প্রথম দিককার দিনগুলোর উত্তেজনাকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। প্রযুক্তি প্রায় আমাদের নাগালের মধ্যে। এখন সময় অন্যান্য সৌর ব্যবস্থা অন্বেষণের। ছড়িয়ে পড়াই হয়তো একমাত্র উপায় যা আমাদের নিজেদের থেকে রক্ষা করবে। আমি নিশ্চিত যে মানূষের পৃথিবী ছাড়তে হবে। যদি আমরা থেকে যাই, আমরা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি নিবো।

*
সুতারাং, মহাকাশ-অনুসন্ধানের জন্য আমার প্রত্যাশা বাদে, ভবিষ্যত কেমন হবে এবং বিজ্ঞান কীভাবে আমাদের সাহায্য করতে পারে?

ভবিষ্যতে বিজ্ঞানের জনপ্রিয় রূপ স্টার ট্রেকের (Star Trek) মতো বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী সিরিজে দেখানো হয়। স্টার ট্রেকের প্রযোজকরা আমাকে-ও অংশ নিতে অনুপ্রাণিত করেছিলো, এমন নয় যে সেটি কঠিন ছিলো।

সেই উপস্থিতি অনেক মজার ছিলো, কিন্তু আমি এটি উল্লেখ করছি একটি গুরুতর কথা বলতে। এইচ. জি. ওয়েলস (H. G. Wells) থেকে শুরু করে আমাদের কাছে উপস্থাপিত ভবিষ্যতের প্রায় সব দৃষ্টিভঙ্গিই ছিলো মূলত স্থিততারা দেখায় যে একটি সমাজ যা অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমাদের থেকে অনেক এগিয়ে, বিজ্ঞানে, প্রযুক্তিতে, এবং রাজনৈতিক সংগঠনে (শেষটি কঠিন না-ও হতে পারে) এখন এবং তখনকার সময়ের মধ্যে নিশ্চয় বড় পরিবর্তন ঘটেছে, সেগুলোর বিরাজমান উত্তেজনা এবং বিপর্যয়সমূহ নিয়ে। কিন্তু, যতক্ষণ নাগাদ আমাদের ভবিষ্যত দেখানো হয়, তখন বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, এবং সমাজের সংগঠন প্রায় পরিপূর্ণতার মাত্রা অর্জন করেছে বলে ধরে নেয়া হয়।

আমি এই রূপকে প্রশ্নবিদ্ধ করি এবং জিজ্ঞেস করি আমরা কি কখনো বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির একটি চূড়ান্ত স্থায়ী অবস্থানে পৌঁছাবো। শেষ বরফ যুগের পরে গত ১০ হাজার বছর বা তার-ও বেশি সময় ধরে কখনোই না মানবজাতি ধ্রুব জ্ঞান এবং স্থিত প্রযুক্তির অবস্থানে ছিলো। অনেকগুলো বিপত্তি বা অবস্থার অবনতি হয়েছিলো, যেমন রোমান সাম্রাজ্য পতনের পর, যা আমরা অন্ধকার যুগ বলে থাকি। কিন্তু বিশ্বের জনসংখ্যা, যা আমাদের জীবন রক্ষা এবং নিজেদেরকে খাওয়ানোর প্রযুক্তিগত সামর্থ্যের একটি পরিমাপ, ব্ল্যাক ডেথের (Black Death) এর মতো কিছু প্রকোপের সাথে-ও অবিচিলিতভাবে বেড়ে চলেছে। গত ২০০ বছরে এই বৃদ্ধি প্রায়শই সূচকীয় (exponential) হয়েছে- এবং বিশ্বের জনসংখ্যা ১ বিলিয়ন থেকে ৭.৬ বিলিয়নে ছাড়িয়ে গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের অন্যান্য পরিমাপ হচ্ছে বিদ্যুতের ব্যবহার, অথবা বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্রের সংখ্যা। সেগুলো-ও প্রায়-সূচকীয় বৃদ্ধি প্রদর্শন করে। প্রকৃতপক্ষে, এখন আমাদের এমন উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রত্যাশা হয়েছে যে কিছু কিছু লোক রাজনীতিবিদ এবং বিজ্ঞানীদের দ্বারা প্রতারিত হয়েছে এমনটি বোধ করে কারণ আমরা ভবিষ্যতের কল্পলোকের স্বপ্নগুলো ইতিমধ্যেই অর্জন করি নি। উদাহরণস্বরূপ, চলচ্চিত্র 2001: A Space Odyssey চাঁদে আমাদের একটি ভিত্তি স্থাপন এবং বৃহস্পতিগ্রহের দিকে মানুষ্যবাহী অভিযান দেখিয়েছিলো।

বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত বিকাশ অদূর ভবিষ্যতে নাটকীয়ভাবে হ্রাস পাবে এবং থেমে যাবে এমন কোনো চিহ্ন বা আলামত নেই। স্টার ট্রেকের সময় নাগাদ অবশ্যই নয়, যা প্রায় ৩৫০ বছর ভবিষ্যতেকিন্তু বর্তমানের এই প্রবৃদ্ধি পরবর্তী সহস্রাব্দের জন্য চলতে পারে না। ২৬০০ নাগাদ বিশ্বের জনসংখ্যা কাঁধে কাঁধ লাগার মতো অবস্থা হবে এবং বিদ্যুতের ব্যবহার পৃথিবীকে লোহিত তপ্ত করে তুলবে। আপনি যদি নতুন প্রকাশিত বইগুলোকে বর্তমানে প্রকাশের হারে একে অপরের পাশে স্তুপীকৃত করেন তবে আপনাকে ঘণ্টায় নয় মাইল বেগে দৌড়াতে হবে লাইনের শেষের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে। অবশ্যই, ২৬০০ সাল নাগাদ নতুন শৈল্পিক এবং বৈজ্ঞানিক কাজ বস্তুগত বই এবং কাগজপত্রের পরিবর্তে বৈদ্যুতিক রূপগুলোতে আসবে। তবুও, যদি সূচকীয় প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকে, আমার তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে প্রতি সেকেন্ডে দশটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হবে এবং সবগুলো পড়ার সময় হবে না

স্পষ্টতই বর্তমানের সূচকীয় বৃদ্ধি অনির্দিষ্টকালের জন্য চলতে পারে না। তাহলে কী হবে? একটি সম্ভাবনা হলো আমরা পারমাণবিক যুদ্ধের মতো কোনো বিপর্যয়ের মাধ্যমে নিজেদেরকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলবো। যদি আমরা আমাদের সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস না-ও করি, তবুও সম্ভাবনা আছে আমরা নৃশংসতা ও বর্বরতার অবস্থানে নেমে আসতে পারি, Terminator এর শুরুর দৃশ্যের মতো।

পরবর্তী সহস্রাব্দে আমরা কীভাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে উন্নতি করবো? এই উত্তর দেয়া খুব কঠিন। কিন্তু আমাকে ঝুঁকি নিতে দেন এবং ভবিষ্যতের জন্য আমার ভবিষ্যদ্বাণী উপস্থাপন করতে দেন। আগামী শত বছরের ক্ষেত্রে আমার সঠিক হওয়ার কিছু সম্ভাবনা আছে, কিন্তু সহস্রাব্দের অবশিষ্টাংশের ক্ষেত্রে হবে প্রচণ্ড জল্পনাকল্পনা। 

বিজ্ঞান সম্পর্কে আমাদের আধুনিক উপলব্ধির শুরু হয়েছিলো উত্তর আমেরিকায় ইউরোপীয় বসতি স্থাপনের একই সময়ে এবং উনবিংশ শতাব্দীর শেষ নাগাদ মনে হয়েছিলো যে আমরা এখন যা চিরায়ত সূত্রাবলি নামে পরিচিত সেগুলো অনুসারে মহাবিশ্বের একটি সম্পূর্ণ উপলব্ধি অর্জন করতে চলেছি। কিন্তু, আমরা যেমনটি দেখেছি, বিংশ শতাব্দীতে পর্যবেক্ষণগুলো দেখানো শুরু করলো যে শক্তি কোয়ান্টা নামক পৃথক পৃথক প্যাকেট বা গুচ্ছে আসে এবং কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞান নামক একটি নতুন ধরণের তত্ত্ব মাক্স প্লাংক এবং অন্যান্যরা প্রণয়ন করেছিলো। এটি বাস্তবতার একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র উপস্থাপন করেছিলো যেখানে জিনিসগুলোর একটি অনন্য (একক) ইতিহাস নেই, বরং প্রতিটি সম্ভাব্য ইতিহাস আছে সেটির নিজস্ব সম্ভাব্যতা নিয়ে। যখন আপনি স্বতন্ত্র কণাগুলোর ব্যাপারে চিন্তা করবেন, তখন সম্ভাব্য কণার ইতিহাসগুলোতে আলোর চেয়ে দ্রুততর ভ্রমণ করে এমন পথসমূহ এবং অতীতে ভ্রমণের পথসমূহকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। কিন্তু যে পথসমূহ অতীতে ফিরে যায় সেগুলো শুধুমাত্র একটি পিনের উপর কতোগুলো দেবদূত নাচতে পারে বা অপ্রাসঙ্গিক খুঁটিনাটি নিয়ে ক্লান্তিকর বিবরণের মতো নয়। সেগুলোর বাস্তব পর্যবেক্ষণমূলক ফলাফল আছে। এমনকি আমরা যেটিকে শূন্যস্থান বলে মনে করি সেটি স্থান এবং কালে বন্ধ লুপে (closed loop) চলমান কণাসমূহে পরিপূর্ণঅর্থাৎ, তারা লুপের এক পাশে সময়ে সামনের দিকে অগ্রসর হয় এবং লুপের অন্য পাশে সময়ে পিছন দিকে অগ্রসর হয়।

অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে যে যেহেতু স্থান এবং সময়ে অসীম সংখ্যক বিন্দু আছে তাই কণাসমূহের অসীম সংখ্যক সম্ভাব্য বন্ধ লুপ আছে। এবং কণাসমূহের অসীম সংখ্যক সম্ভাব্য বন্ধ লুপগুলোর অসীম পরিমাণ শক্তি থাকবে এবং স্থান এবং কালকে একটি একক বিন্দুতে কুঁচিত করবে বা কুণ্ডলী পাকাবে। এমনকি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী-ও এটির মতো অদ্ভুত কিছু কল্পনা করে নি। এই অসীম পরিমাণ শক্তি নিয়ে কাজ করার জন্য কিছুটা সৃজনশীল হিসাবরক্ষণের প্রয়োজন, এবং গত বিশ বছরে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের বেশিরভাগ কাজ এমন একটি তত্ত্বের সন্ধান করছে যেখানে স্থান এবং কালে অসীম সংখ্যক বন্ধ লুপগুলো পরস্পরকে সম্পূর্ণভাবে বাতিল করে। শুধুমাত্র তখনই আমরা আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার সাথে কোয়ান্টাম তত্ত্বকে একত্রিত করতে এবং মহাবিশ্বের মৌলিক সূত্রাবলির বা বিধিসমূহের একটি সার্বিক তত্ত্ব অর্জন করতে সক্ষম হবো।

আগামী সহস্রাব্দে আমরা এই সার্বিক তত্ত্ব আবিষ্কার করবো এমন সম্ভাবনা কতোটুকু? আমি বলবো যে সেই সম্ভাবনা খুব ভালো, কিন্তু আবার আমি একজন আশাবাদী মানুষ। ১৯৮০ সালে আমি বলেছিলাম যে আমি মনে করেছিলাম ৫০-৫০ সম্ভাবনা ছিলো যে আমরা পরবর্তী বিশ বছরে একটি সম্পূর্ণ সার্বিক তত্ত্ব আবিষ্কার করবো। সেই সময় থেকে আমরা কিছু অসাধারণ অগ্রগতি করেছি, কিন্তু একটি সার্বিক তত্ত্ব এখনো একই দূরে বলে মনে হয়। পদার্থবিদ্যার হলি গ্রেইল (Holy Grail) কি সবসময় আমাদের নাগালের বাইরে থেকে যাবে? আমি মনে করি না।

বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে আমরা প্রকৃতির কাজগুলো চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানের স্কেলে বুঝতে পেরেছিলাম যা এক মিলিমিটারের একশত ভাগের এক ভাগ স্কেলে কাজ করে। শতাব্দীর প্রথম ত্রিশ বছরে পারমাণবিক পদার্থবিজ্ঞানে অগ্রগতি আমাদের বোঝাকে এক মিলিমিটার দৈর্ঘ্যের দশ লক্ষ ভাগের এক ভাগ স্কেলে নিয়েছে। তারপর থেকে, পারমাণবিক ও উচ্চ-শক্তি পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণা আমাদের বোঝাকে আরো এক বিলিয়নের অধিকতর ছোট স্কেলে নিয়ে গেছে। এটি মনে হতে পারে যে আমরা সর্বদা ছোট এবং আরো ছোট দৈর্ঘ্যের স্কেলে কাঠামো আবিষ্কার করে যেতে পারি। কিন্তু এই সিরিজের একটি সীমা আছে, যেমনটি একটির ভেতরে আরেকটি খাপ খায় এইরকম রাশিয়ান পুতুল (nested Russian dolls) সিরিজের ক্ষেত্রে আছে। একসময় একজন সবচেয়ে ছোট একটি পুতুলে গিয়ে পৌঁছে যেটি আর পৃথক করা যায় না। পদার্থবিজ্ঞানে এই ক্ষুদ্রতম পুতুলটি বলা হয় প্লাংক দৈর্ঘ্য (Plank length), যা এক মিলিমিটারের ১০০০০০ বিলিয়ন বিলিয়ন বিলিয়ন ভাগের এক ভাগ। আমরা এমন কণা ত্বরক তৈরি করতে যাচ্ছি না যেটি এতো ছোট দূরত্ব অনুসন্ধান করতে পারে। সেই কণা ত্বরককে সৌরজগতের চেয়ে বিশাল হতে হবে এবং বর্তমান আর্থিক অবস্থায় এটি বানানোর অনুমোদন পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। যাইহোক, আমাদের তত্ত্বগুলোর অনেক ভবিষ্যদ্বাণী আছে যেগুলো আরো ছোট আকারের মেশিন দ্বারা পরীক্ষা করা যেতে পারে।

পরীক্ষাগারে প্লাংক দৈর্ঘ্য তদন্ত করা সম্ভব হবে না, যদিও আমরা পৃথিবীতে যা অর্জন করতে পারি তার চেয়ে আমরা মহাবিস্ফোরণকে অধ্যয়ন করতে পারি উচ্চ শক্তি এবং ক্ষুদ্র দৈর্ঘ্যের স্কেলে পর্যবেক্ষণমূলক প্রমাণ লাভের জন্য। যাইহোক, একটি বড় ব্যাপ্তিতে আমাদের গাণিতিক সৌন্দর্য এবং সামঞ্জস্যের উপর নির্ভর করতে হবে সবকিছুর একটি সার্বিক তত্ত্ব খুঁজে পেতে।

ভবিষ্যত সম্পর্কে স্টার ট্রেকের দৃষ্টিভঙ্গি যেখানে আমরা উন্নত কিন্তু মূলত স্থিত পর্যায় অর্জন করি সেই পর্যায় মহাবিশ্বকে পরিচালনা করা মৌলিক সূত্রাবলি বা বিধিসমূহ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের ক্ষেত্রে আসতে পারে। কিন্তু আমি মনে করি না যে আমরা এই সূত্রাবলি বা বিধিসমূহ ব্যবহার করার ক্ষেত্রে কখনো একটি স্থিত পর্যায় বা অবস্থায় পৌঁছবো। চূড়ান্ত তত্ত্বটি আমরা তৈরি করতে পারি এমন ব্যবস্থাসমূহের জটিলতার উপর কোনো সীমাবদ্ধতা আরোপ করবে না, এবং এই জটিলতার মধ্যে আমি মনে করি আগামী সহস্রাব্দের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন হবে।

*
এখন পর্যন্ত আমাদের সবচেয়ে যে জটিল ব্যবস্থা আছে তা হচ্ছে আমাদের নিজেদের শরীর। জীবন চার বিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীকে আচ্ছাদিত আদিম মহাসাগর থেকে উদ্ভূত হয়েছে বলে মনে হয়। আমরা জানি না কীভাবে এটি ঘটেছে। এটি হতে পারে যে পরমাণুসমূহের মাঝে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ থেকে মাইক্রো-অণুগুলো তৈরি হয়েছে যেগুলো নিজেদেরকে পুনরুৎপাদন করতে পারে এবং নিজেদের আরো জটিলতম কাঠামোতে সন্নিবেশিত করতে পারে। আমরা যা জানি তা হচ্ছে যে সাড়ে তিন বিলিয়ন বছর আগে ডিএনএ নামক অত্যন্ত জটিল অণু আবির্ভূত হয়েছিলো। ডিএনএ পৃথিবীতে সকল প্রাণের ভিত্তি। এটির একটি দ্বি-কম্বুরেখ আকৃতি রয়েছে, অনেকটা সর্পিল আকারের সিঁড়ির মতো, যা ফ্রান্সিস ক্রিক এবং জেমস ওয়াটসন ১৯৫৩ সালে কেমব্রিজের ক্যাভেন্ডিশ পরীক্ষাগারে আবিষ্কার করেছিলেন। দ্বি-কম্বুরেখ কাঠামোর দুটো হার নাইট্রোজেন বেইস দ্বারা সংযুক্ত থাকে, সর্পিল সিঁড়িতে ধাপের মতো। চার ধরণের নাইট্রোজেন বেইস আছে: সাইটোসিন, গুয়ানিন, এডেনিন, এবং থাইমিন। সর্পিল সিঁড়ি বরাবর বিভিন্ন নাইট্রোজেন বেইস যে ক্রমে থাকে সেটি জেনেটিক তথ্য বহন করে যা ডিএনএ অণুকে একটি জীব সন্নিহিত করতে এবং নিজেকে পুনরুৎপাদন করতে সক্ষম করে। ডিএনএ নিজের প্রতিলিপি করার সময় নাইট্রোজেন বেইসগুলোর ক্রমে মাঝে মাঝে ক্রটি ঘটে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনুলিপি বা প্রতিলিপি করার ক্ষেত্রে হওয়া ভুলগুলো ডিএনএ অণুকে পুনরুৎপাদন করতে অক্ষম করে ফেলে। সেই জেনেটিক ক্রটি বা পরিবর্তন অবলুপ্ত হয়ে যাবে। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভুলগুলো বা পরিবর্তনগুলো ডিএনএর বেঁচে থাকা এবং পুনরুৎপাদনের সম্ভাবনাকে বৃদ্ধি করবে। সুতারাং নাইট্রোজন বেইসগুলোর ক্রমে তথ্যের পরিমাণ ধীরে ধীরে বিবর্তিত হবে এবং জটিলতা বৃদ্ধি পাবে। পরিবর্তনের এই প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রথমে আরেকজন কেমব্রিজবাসী, চার্লস ডারউইন প্রস্তাব করেছিলেন, যদিও তিনি এটির প্রক্রিয়া জানতেন না।

যেহেতু জৈবিক বিবর্তন মূলত সমস্ত জেনেটিক সম্ভাবনার স্থানে একটি এলোমেলো হাঁটার মতন, তাই এটি খুব ধীরে হয়েছে। জটিলতা বা ডিএনএতে সংহিত তথ্যাবলির সংখ্যা অণুটিতে নাইট্রোজেন বেইসগুলো্র সংখ্যার সাথে সম্পর্কিতপ্রতি বিট তথ্যকে একটি হ্যাঁ/না প্রশ্নের উত্তর হিসেবে মনে করা যেতে পারে। প্রথম দুই বিলিয়ন বছর বা সেইরকম সময়ে জটিলতা বৃদ্ধির হার প্রতি শত বছরে এক বিট তথ্যের মতন ছিলো। ডিএনএতে জটিলতা বৃদ্ধির হার ক্রমে বেড়ে গত কয়েক মিলিয়ন বছর ধরে এক বছরে এক বিট বৃদ্ধির মতো হয়েছে। কিন্তু এখন আমরা একটি নতুন যুগের সূচনাতে যেটিতে আমরা আমাদের ডিএনএর জটিলতা বাড়াতে পারবো জৈবিক বিবর্তনের ধীর প্রক্রিয়ার জন্য অপেক্ষা না করেই। গত ১০ হাজার বছর ধরে মানব ডিএনএতে অপেক্ষাকৃত কম পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু এটি সম্ভব যে আমরা এটিকে সম্পূর্ণরূপে পুনরায় নকশা করতে পারবো আগামী সহস্রাব্দে। অবশ্যই, অনেকে বলবেন যে মানুষের উপর জেনেটিক প্রকৌশল নিষিদ্ধ করা উচিত। কিন্তু আমি সন্দেহ প্রকাশ করি যে তারা এটি প্রতিরোধ করতে পারবে। গাছপালা এবং পশুপাখির জেনেটিক প্রকৌশল অনুমোদিত হবে অর্থনৈতিক কারণে, এবং কেউ একজন অবশ্যই এটি মানুষের উপর চেষ্টা করতে চাইবে। যদি না সারা বিশ্বে আমাদের সর্বব্যাপী একদল একমতবাদ আধিপত্য করে, কেউ না কেউ কোথাও উন্নত মানুষের নকশা করবে।

স্পষ্টভাবে উন্নত মানুষের উন্নয়ন বড় সামাজিক এবং রাজনৈতিক সমস্যা সৃষ্টি করবে অনুপযুক্ত মানুষদের সাথে। আমি মানব জেনেটিক প্রকৌশলকে একটি ভালো জিনিস হিসেবে সমর্থন করছি না, আমি শুধু বলছি যে আগামী সহস্রাব্দীতে এটি ঘটতে পারে, আমরা চাই অথবা না-চাই না কেনো। এই কারণে আমি স্টার ট্রেকের মতো বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীকে বিশ্বাস করি না যেখানে ভবিষ্যতে লোকেরা মূলত ৩৫০ বছর ধরে একই থাকে। আমি মনে করি মানবজাতি, এবং তার ডিএনএ, এটির জটিলতা বেশ দ্রুত বৃদ্ধি করবে

একভাবে, মানবজাতিকে তার মানসিক ও শারীরিক গুণগত মান উন্নত করতে হবে যদি মানবজাতি চারপাশের ক্রমবর্ধমান জটিল বিশ্বের মোকাবেলা করতে এবং মহাকাশ ভ্রমণের মতো নতুন চ্যালেঞ্জগুলোর সম্মুখীন হতে চায়। এবং মানবজাতিকে এর জটিলতা বৃদ্ধি করতে হবে যদি জৈবিক ব্যবস্থাগুলো বৈদ্যুতিক ব্যবস্থাগুলোর চেয়ে এগিয়ে থাকতে চায়। এই মুহূর্তে কম্পিউটারগুলোর গতির সুবিধা রয়েছে, কিন্তু সেগুলো বুদ্ধিমত্তার কোনো চিহ্ন দেখায় না। এটি আশ্চর্যজনক নয় কারণ আমাদের বর্তমান কম্পিউটারগুলো কেঁচোর মস্তিস্কের চেয়ে-ও কম জটিল, যদিও কেঁচো তার বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতার জন্য সুপরিচিত নয়। কিন্তু কম্পিউটারগুলো মোটামুটিভাবে মুরের সূত্রের (Moores Law) একটি সংস্করণ মেনে চলে, যা নির্দেশ করে যে তাদের গতি এবং জটিলতা প্রতি আঠার মাসে দ্বিগুণ হয়। এটি সূচকীয় বৃদ্ধিসমূহের একটি যা স্পষ্টভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য চলতে পারে না, এবং প্রকৃতপক্ষে এটি ইতিমধ্যে ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে শুরু করেছে। যাইহোক, উন্নতির গতি দ্রুত চলতে থাকবে যতোক্ষণ পর্যন্ত না কম্পিউটারগুলো মানুষের মস্তিষ্কের অনুরূপ জটিলতা লাভ করে। কিছু কিছু লোক বলেন যে কম্পিউটারগুলো কখনোই প্রকৃত বুদ্ধিমত্তা দেখাতে পারবে না, সেটি যাইহোক না কেনো। কিন্তু আমার মনে হয় যে যদি খুব জটিল রাসায়নিক অণুগুলো মানুষকে বুদ্ধিমান করতে পরিচালিত করতে পারে তবে সমানভাবে জটিল বৈদ্যুতিক বর্তনীগুলো কম্পিউটারগুলোকে বুদ্ধিমানভাবে কাজ করতে পরিচালিত করতে পারে। এবং যদি সেগুলো বুদ্ধিমান হয় তবে সেগুলো সম্ভবত এমন কম্পিউটারগুলো নকশা করতে পারে যেগুলোর আরো জটিলতা এবং বুদ্ধিমত্তা রয়েছে।

এই কারণে আমি একটি উন্নত কিন্তু ধ্রুবক ভবিষ্যতের বৈজ্ঞানিক-কল্পকাহিনীর চিত্রে বিশ্বাস করি না। পরিবর্তে, আমি জৈবিক এবং বৈদ্যুতিক উভয় ক্ষেত্রে, দ্রুত হারে জটিলতা বৃদ্ধি হওয়া আশা করি। আগামী শত বছরে এর অনেক কিছুই ঘটবে না, যা আমরা নির্ভরযোগ্যভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারি। কিন্তু আগামী সহস্রাব্দের শেষে, আমরা যদি সেই নাগাদ যেতে পারি, পরিবর্তন হবে মৌলিক ধরণের বা ভিত্তিগত।

লিঙ্কন স্টিফেন্স (Lincoln Steffens) একবার বলেছিলেন, আমি ভবিষ্যত দেখেছি এবং এটি কাজ করে। তিনি আসলে সোভিয়েত ইউনিয়নের কথা বলেছিলেন, যা আমরা এখন জানি যে খুব ভালোভাবে কাজ করে নি। তবুও, বর্তমান বিশ্বের একটি ভবিষ্যত আছে, তবে এটি খুব ভিন্ন হবে।

এই গ্রহের ভবিষ্যতের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় হুমকি কী?

একটি গ্রহাণু সংঘর্ষ যে হুমকির বিরুদ্ধে আমাদের কোনো প্রতিরক্ষা নেই। কিন্তু এই ধরণের শেষ বড় গ্রহাণু সংঘর্ষ হয়েছিলো ৬৬ মিলিয়ন বছর আগে এবং ডাইনোসরদেরকে মেরে ফেলেছিলো। একটি আরো তাৎক্ষণিক বিপদ হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন। মহাসাগরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি মেরু অঞ্চলের বরফের চাকতিগুলোকে গলিয়ে ফেলবে এবং বিপুল পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে মুক্ত করবে। উভয় প্রভাবই আমাদের আবহাওয়াকে শুক্রগ্রহের মতো ২৫০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় (৪৮২ ডিগ্রী ফারেনহাইট) নিয়ে যেতে পারে।

No comments:

Post a Comment

কী নিয়ে মাতামাতি...

13 Reasons Why (1) ADHD (1) Alzheimer's disease (1) Antibiotic Resistance (1) Anxiety (1) Autism (1) Brexit (1) Brief Answers to the Big Questions (10) Britain (1) Bruce Peninsula (1) Cades Cove Scenic Drive (1) Canada (2) Clingsman Dome (1) District 9 (1) Dopamine (1) Dyer's Bay (1) Federico Garcia Lorca (1) Fierté Montréal (2) Gaspé & Percé Rock (1) Global Warming (2) Great Smoky Mountains (2) Heatwave (1) Hemianopia (1) infographics (1) Instagram (104) International Balloon Festival (1) Interstate 77 (1) Lift (1) Links (1) Maple syrup boiling down (1) Maple syrup harvesting (1) Marconi Union (1) Mike Krath (1) Montmorency Falls (2) Montreal International Jazz Festival (1) Montreal Pride Parade (2) Mother Teresa (1) Movies (1) Music (2) Netflix (1) Niagara Falls (3) Nickelback (1) Nirvana (1) North Carolina (1) nutella (1) Photography (2) Photos (104) Poets of the Fall (2) Psychology (1) Rain storm in Montreal (1) Rape (1) Reading List (1) Saint-Remi (1) Samuel de Champlain Bridge (1) Sandra Crook (1) Schizophrenia (1) Sci-Fi (1) Sci-Hub (1) Shortest Sci-Fi (1) Smoky Mountains (1) Stephen Hawking (15) Sunshine 2007 (1) Tennessee (1) The Beatles (1) The Danish Girl (1) The Grand Design (8) The Handsome Family (1) Tobermory (1) Toronto (2) Transexualism (1) True Detective (1) Tyrannosaurus rex (1) Wallingford Back Mine – Mulgrave et Derry (1) West Island (1) Womenchapter (1) অটিজম (3) অটোয়া (1) অণুগল্প (7) অনুবাদ (17) অভিগীতি (12) অভিলিপি (9) অর্থনীতি (2) অ্যালকোহল (1) আইন ও বিচারব্যবস্থা (1) আইসিস (2) আচরণগত স্নায়ুবিজ্ঞান (1) আত্মহত্যা (2) আলঝেইমারের রোগ (3) আলোকচিত্র (6) আলোকবাজি (9) ইচ্ছেকথা (3) ইন্সটাগ্রাম (104) উইমেন-চ্যাপ্টার (1) উদ্বেগ (1) উবার (1) একুশে বইমেলা (1) এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধ (1) এম-তত্ত্ব (5) কবিতা (95) কম্পিউটার বিজ্ঞান (1) করোনাভাইরাস (6) কলাম (5) কানাডা (4) কাব্যালোচনা (2) কাসেম বিন আবুবাকার (1) কিশোরতোষ (1) কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (1) কৃষ্ণগহ্বর (1) কোভিড-১৯ (8) ক্যান্সার (1) ক্রসফায়ার (1) ক্লোনিং (1) খাদ্যব্যবস্থা (1) গণতন্ত্র (1) গবেষণা (1) গবেষণাপত্র (1) গর্ভপাত (1) গল্প (8) গাঁজা (1) গান (17) গুজব (1) গ্যাব্রিয়েলা মিস্ট্রাল (1) চলচ্চিত্র (4) ছড়া (5) ছবি (104) ছোটগল্প (5) জঙ্গিবাদ (1) জনস্বাস্থ্য (2) জিকা ভাইরাস (1) জীববিজ্ঞান (1) জীবাণু (1) ট্রান্সসেক্সুয়াল (1) ট্রান্সসেক্সুয়ালিজম (1) ডাইনোসর (1) ডাউনলোড (1) ডোপামিন (1) তাপমাত্রা (1) তিল-গপ্পো (17) তুষার দত্ত (2) তেজস্ক্রিয়তা চিকিৎসা (1) দূরবীন (2) দৃষ্টিশক্তি (1) ধর্ম (3) ধর্ষণ (2) নায়াগ্রা ফলস জলপ্রপাত (1) নারী (3) নারী স্বাধীনতা (1) নুটেলা (1) নৈতিকতা (1) পরিবেশ (1) পাঁচমিশালী (1) পাঠসূচি (1) পাম তেল (1) পাহাড় (1) পুস্তক (1) পেডোফিলিয়া (1) প্রকৃতি (1) প্রবন্ধ (2) প্রবাস (2) প্রাইমেট (1) ফটোগ্রাফী (1) ফেসবুক (1) ফ্রান্স (1) বই (2) বড় প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত উত্তর (10) বয়ঃসন্ধি (1) বর্ণবাদ (1) বাঙলাদেশ (18) বাবা (1) বাংলাদেশ (1) বিজ্ঞপ্তি (1) বিজ্ঞান (13) বিটলস (1) বিষণ্নতা (3) বুরকিনি (1) বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি (7) বৈশ্বিক উষ্ণতা (1) ব্যক্তিত্ব (1) ব্যথা (1) ভাইটামিন ডি (1) ভাইরাস (1) ভালোবাসা (1) ভুয়া খবর (1) ভেন্টিলেটর (1) ভ্রমণ (3) মনস্তত্ত্ব (1) মনোবিজ্ঞান (19) মন্ট্রিয়াল (1) মন্ট্রিয়াল আন্তর্জাতিক জ্যাজ উৎসব (2) মস্তিষ্ক ক্যান্সার (1) মহিমান্বিত নকশা (3) মাদক (1) মাদকাসত্তি (2) মাদার তেরেসা (1) মানসিক স্বাস্থ্য (5) মুক্তগদ্য (3) মুক্তচিন্তা (3) মুক্তিযুদ্ধ (3) মৌলবাদ (1) যাপিত জীবন (2) যুগান্তর পত্রিকা (1) যৌনতা (1) রাজনীতি (1) রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প (3) রূপান্তরকাম (1) রৌদ্রস্নান (1) লিওনার্ড ম্লোডিনো (5) লিংক (2) লিঙ্গরূপান্তর (1) লিঙ্গরূপান্তরকারী (1) লিথিয়াম (1) লিফট (1) শিক্ষাব্যবস্থা (1) শিশুতোষ (3) সংগীত (3) সন্ত্রাসবাদ (1) সংবাদমাধ্যম (1) সময়ভ্রমণ (1) সমালোচনা (1) সর্দিগর্মি (1) সানশাইন (1) সামাজিক দূরত্ব (1) সাম্প্রতিক দেখা চলচ্চিত্র (1) সার্স-কোভ-২ ভাইরাস (4) সাহিত্য (4) স্কিৎসোফ্রেনিয়া (1) স্টিফেন হকিং (16) স্ট্রোক (1) স্নায়ুবিজ্ঞান (12) স্নায়ুবিষ (1) স্বাস্থ্যসেবা (1) হলুদ (1)
রোদের অসুখ © 2008 Por *Templates para Você*