১
মন্ট্রিয়ালের আজকের তাপমাত্রা ৩৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস, ফিলস
লাইক হচ্ছে ৩৮, কালকে তাপমাত্রা আরো বাড়বে কয়েক ডিগ্রী। বাঙলাদেশে-ও দেখলাম অনেকে
এই নিয়ে অভিযোগ করছেন। বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হচ্ছে গ্রীনহাউস
গ্যাসের নিঃসরণ।
বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে যে অহরহ ঝড়বৃষ্টি
বন্যা হচ্ছে, জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে সেইসব প্রতিরোধে আপনি অনেকভাবে অবদান রাখতে
পারেন। অনেকে হয়তো ভাবেন যে আপনি সাধারণ একজন মানুষ, বৃহত্তম সব বাণিজ্যিক
প্রতিষ্ঠান, কারখানা, রাষ্ট্রীয় প্রহসনের বিপরীতে আপনার কর্ম কীভাবে তাপমাত্রা
বৃদ্ধি রোধে সাহায্য করতে পারে? পারে, আপনি একজন, অন্য আরেকজন এভাবেই মিলে আমরা
প্রায় ৮ বিলিয়ন মানুষ এখন সারা বিশ্বে।
প্রথমত, যে বড় পদক্ষেপটি নিতে পারেন সেটি হচ্ছে বাচ্চা বা
সন্তান না নেয়া। একজন বা দুইজন সন্তান নেয়া মানে পৃথিবীতে আরেকজন বা দুইজন মানুষ
বৃদ্ধি পাওয়া, তাদের কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পদাঙ্ক (carbon-dioxide
footprint) যোগ হবে পৃথিবীর দূষণে। বাচ্চা পালন করা ইদানীং কালের জীবনে
অনেক প্যারাময়, অনেক কঠিন, খরচ অনেক বেশি; এতো ঝামেলায় না গিয়ে নিজে-ও সুখী জীবন
কাটাতে পারেন, এবং পৃথিবীকে রক্ষায় অবদান রাখতে পারেন! বিশ্বাস করেন, আপনি সন্তান
না নিলে পৃথিবীর কিচ্ছু যাবে আসবে না, পৃথিবীর ৪.৫ বিলিয়ন বছরের তুলনায় আপনার
সম্ভাব্য সন্তান অতি নগণ্য। সবচেয়ে বড় কথা, এই রেষারেষির, এই দূষণের, এই অনিশ্চিত
পরিবেশের পৃথিবীতে নতুন একটি প্রাণকে জন্ম দিয়ে তার দায় না নিতে পারলে কেনো তবে
সেই প্রাণের জন্ম দেবেন?
২
দ্বিতীয়ত, প্রচুর গাছ লাগান। এক গবেষণার গণনায় দেখা গেছে যে
আমরা যদি ২০৩০ সালের মধ্যে এক ট্রিলিয়ন গাছ লাগাতে পারি তবে এই তাপমাত্রা বৃদ্ধি
হয়তো (এখনো ভালো সম্ভাবনা আছে) ঠেকাতে পারবো। এক ট্রিলিয়ন গাছগাছালি
সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইড বায়ুমণ্ডল থেকে সরাতে
পারবে, এমনকি শেকড়ের মাধ্যমে সঞ্চিত করতে পারবে ভূগর্তে (ভূগর্ভে)। গাছের অবদানের
কথা নিশ্চয় স্মরণ করিয়ে দিতে হবে না! ফিলিপিনস কিছুদিন আগে দারুণ একটি উদ্যোগ
নিয়েছে, তারা নিয়ম করেছে যে শিক্ষার্থীদের পাশ করা কেবল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার
মাধ্যমে হবে না, প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে গ্র্যাজুয়েশনের অংশ হিসেবে দুটো করে গাছ
লাগাতে হবে! কী দারুণ উদ্যোগ, তাই না? বাঙলাদেশে প্রতি বছর বিভিন্ন পর্যায়ে লাখ
লাখ শিক্ষার্থী পাশ করে, তাদের সবাই যদি দুটো করে গাছ লাগায় তাহলে কী বনায়ন না
সৃষ্টি হবে! তবে হ্যাঁ, গাছ লাগানোর ক্ষেত্রে একটি ব্যাপার মনে রাখতে হবে: এমন
গাছ লাগাতে হবে যারা দীর্ঘবর্ষী, যেসব গাছ কয়েক বছরেই মারা যায় সেগুলো লাগালে
সেগুলোর মৃত্যুর পর কার্বন-ডাই-অক্সাইড পুনরায় বায়ুমণ্ডলে ফিরে যাবে, তাই এমন গাছ
লাগাতে হবে যেগুলো দীর্ঘ বছর বাঁচে, ফলে দীর্ঘ দিন ধরে বায়ুমণ্ডলের কার্বন-ডাই-অক্সাইড
শোষণ করে নিতে পারবে এবং সংরক্ষণ করতে পারবে।
৩
তৃতীয় যে কাজটি করতে পারেন, এবং এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ,
সেটি হচ্ছে যে কাপড়চোপড় কম কেনা এবং যেসব কাপড়চোপড় কিনবেন সেগুলো যেনো দীর্ঘদিন ধরে
ব্যবহার করতে পারেন, অর্থাৎ টেকসই কাপড়চোপড় কিনতে হবে। হালনাগাদের ফ্যাশনের সাথে
তাল মিলিয়ে যদি কাপড় কিনে থাকেন তবে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে আপনি বড় ভূমিকা
রাখছেন! Nature Climate Change জার্নালের এক গবেষণা মতে হাল ফ্যাশনের
কাপড়চোপড়, যেগুলো আপাতভাবে সস্তা হয়, কিন্তু সর্বশেষ ক্যাটওয়াক ডিজাইনকে অনুলিপি
করে বানানো হয়- সেগুলোর বিকিকিনি গত দুই দশকে উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে গেছে, এবং
সৃষ্টি হচ্ছে বিপুল পরিমাণ বর্জ্যের, যা সরাসরি বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে
ভূমিকা রাখছে, যেহেতু এইসব ফ্যাশনের জামাকাপড় ব্যবহারকারীরা কয়েকবার ব্যবহার করে
ফেলে দেন কিংবা আর পরিধান করেন না। McKinsey নামক
কনসালট্যান্সি প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদন অনুসারে, ২০০০ সালের সময়ের তুলনায় বর্তমানে
একজন সাধারণ ক্রেতা ৬০ শতাংশ বেশি জামাকাপড় কেনেন, যেগুলোর অধিকাংশ হাল ফ্যাশনের,
ফলে সেগুলো ২০০০ সালের তুলনায় মাত্র অর্ধেক সময় ব্যবহার করেন! কথা হচ্ছে যে
পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে জামাকাপড় বা টেক্সটাইল শিল্পের ভূমিকা কী? মূলত কাপড়
উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ (এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো) অনবায়নযোগ্য (পুনর্নবীকরণযোগ্য
নয়) উৎস থেকে সম্পদ বা কাঁচামাল ব্যবহার করে, ফলে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণে
বিশাল ভূমিকা রাখছে। এছাড়া, হাল আমলের ফ্যাশনে, জামাকাপড়ে বিভিন্ন ধরণের বুনন,
বস্ত্র, ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়, ফলে ব্যবহার করার পরে পোশাকটিকে পুনর্ব্যবহারযোগ্য
(recycling) করে তোলা কঠিন। Ellen MacArthur
Foundation এর প্রতিবেদন অনুসারে শুধুমাত্র ২০১৫ সালেই ফ্যাশন শিল্প
১.২ বিলিয়ন টন গ্রীনহাউস গ্যাস উৎপাদন করেছে! ১.২ বিলিয়ন টন গ্রীনহাউস গ্যাস! তাই পারবেন না হাল আমলের জামাকাপড় কিনে টাকা
না উড়িয়ে পরিবেশ রক্ষায় অবদান রাখতে?
আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে যে বাঙলাদেশের পোশাকশিল্প। যেহেতু
পোশাকশিল্প বাঙলাদেশের অন্যতম রপ্তানী আয়ের উৎস, আমাদের এখনই চিন্তাভাবনা করা
দরকার কীভাবে টেকসই পরিবেশবান্ধব উপাদানের মাধ্যমে পোশাক পণ্য তৈরি একই ধরণের (বা
বেশি) রপ্তানী হার বজায় রেখে পোশাকশিল্পের উৎপাদিত গ্রীনহাউস গ্যাসের পরিমাণ কমানো
যায়।
৪
কথা হচ্ছে যে আপনি এইসব কেনো করবেন? মহত্তর কল্যাণে!
মানবজাতি ৩.৩ বিলিয়ন বছরের বিবর্তনের ফসল, অথচ পৃথিবীর ৪.৫ বিলিয়ন বছরের ইতিহাসে আমরা গত ২০০ বছরে পৃথিবীকে যে অস্তিত্ববিপন্ন
অবস্থায় নিয়ে এসেছি সেটি কি আমাদের ৩.৩ বিলিয়ন বছরের
বিবর্তনের ইতিহাসের কাছে লজ্জাকর নয়? আমাদের পূর্বপুরুষেরা টিকে গেছে, আমাদের
পিতামহ, মাতামহ, আমরা, তবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমরা কি একটু সচেতন হতে
পারি না? সন্তান না নিয়ে নিজের জিনকে না হয় না-ই ছড়িয়ে দিতে পারলেন, কিন্তু
মানবজাতির জিনকে টিকিয়ে রাখতে কাজ করবেন না?
No comments:
Post a Comment