এসো খড়ে সুঁই খুঁজি

Custom Search

Tuesday, June 18, 2019

অধ্যায় ৪: আমরা কি ভবিষ্যৎ পূর্বাভাস করতে পারি? [স্টিফেন হকিং: বড় প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত উত্তর] [Stephen Hawking: Brief Answers to the Big Questions]


অধ্যায় ৪: আমরা কি ভবিষ্যৎ পূর্বাভাস করতে পারি?

প্রাচীনকালে, পৃথিবীকে নিশ্চয় বিধিবহির্ভূত বা খামখেয়ালী মনে হতো। বন্যা, মহামারী, ভূমিকম্প বা আগ্নেয়গিরির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা বিপর্যয় কোনো সতর্কতা বা স্পষ্ট কারণ ছাড়াই ঘটতো বলে মনে হতো। আদিম মানুষেরা এই ধরণের প্রাকৃতিক ঘটনাকে দেবদেবীদের, যারা খামখেয়ালী এবং অদ্ভুতভাবে আচরণ করতো, তাদের কাজ হিসেবে গণ্য করতো। তারা কী করবে তা ভবিষ্যদ্বাণী করার কোনো উপায় ছিলো না, এবং একমাত্র উপায় ছিলো কোনো উপহার কিংবা কর্মের মাধ্যমে তাদের অনুগ্রহ লাভ করা। অনেক মানুষ এখন-ও আংশিকভাবে এই বিশ্বাসে সম্মতি দান করে এবং ভাগ্যের সঙ্গে চুক্তি করতে চেষ্টা করে। তারা ভালো আচরণ করার কিংবা আরো দয়ালু হওয়ার ঘোষণা দেয় শুধুমাত্র তারা যদি কোনো বিষয়ে এ-ঘরনার (A-grade) ফলাফল পেতে পারে অথবা তাদের গাড়ি চালানোর পরীক্ষা পাস করতে পারে।

তবে ধীরে ধীরে মানুষ প্রকৃতির আচরণে অবশ্যই নিয়মিত ব্যাপারগুলো লক্ষ্য করা শুরু করে। এই নিয়মিত ব্যাপারগুলো আকাশ জুড়ে বিভিন্ন গ্রহ-নক্ষত্রের গতিতে সবচেয়ে স্পষ্ট ছিলো। তাই জ্যোতির্বিজ্ঞান ছিলো প্রথম বিকাশিত বিজ্ঞান। এটি ৩০০ বছরের-ও আগে নিউটন দ্বারা একটি দৃঢ় গাণিতিক ভিত্তিতে স্থাপন করা হয়েছিলো, এবং আমরা আজ-ও প্রায় সব গ্রহ-নক্ষত্র বা মহাকাশীয় বস্তুর গতি পূর্বাভাসের জন্য তার মাধ্যাকর্ষণের তত্ত্ব ব্যবহার করি। জ্যোতির্বিজ্ঞানের উদাহরণ অনুসরণ করে পাওয়া গেলো যে অন্যান্য প্রাকৃতিক ঘটনাগুলো-ও নির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক সূত্রাবলি মেনে চলে। এটি বৈজ্ঞানিক নিয়তিবাদের (scientific determinism) ধারণাকে তুলে ধরে, যা ফরাসি বিজ্ঞানী পিয়ের-সিমোঁ ল্যাপ্লাস (Pierre-Simon Laplace) দ্বারা প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হয়েছিলো। আমি আপনার কাছে ল্যাপ্লাসের প্রকৃত বক্তব্য উদ্ধৃতি করতে চাই, কিন্তু ল্যাপ্লাস অনেকটা প্রুস্তের (Proust) মতন ছিলেন যে তিনি অযৌক্তিক দৈর্ঘ্যের এবং জটিল বাক্য লিখেছিলেন। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি উদ্ধৃতিটি শব্দান্তরিত করারএক অর্থে তিনি বলেছিলেন যে যদি এক সময়ে আমরা মহাবিশ্বের সমস্ত কণার অবস্থান এবং গতি জানতাম তবে আমরা অতীত অথবা ভবিষ্যতের অন্য কোনো সময়ে তাদের আচরণের হিসাব করতে সক্ষম হতাম। সম্ভবত এটি একটি অপ্রামাণিক গল্প যে ল্যাপ্লাসকে নেপোলিয়ন যখন জিজ্ঞেস করেছিলেন যে এই ব্যবস্থায় ঈশ্বরের ভূমিকা কী তখন তিনি নেপোলিয়নকে জবাব দিয়েছিলেন, স্যার, আমার এই অনুজ্ঞার প্রয়োজন ছিলো না। আমি মনে করি না যে ল্যাপ্লাস দাবি করেছিলেন যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব ছিলো না। বরং এটি যে ঈশ্বর বিজ্ঞানের বিধিনিয়ম ভাঙতে হস্তক্ষেপ করেন না। প্রত্যেক বিজ্ঞানীর এই অবস্থান হওয়া উচিত। একটি বৈজ্ঞানিক বিধি একটি বৈজ্ঞানিক বিধি নয় যদি এটি শুধুমাত্র যখন কোনো অতিপ্রাকৃতিক সত্তা জিনিসপত্র বা বস্তুসমূহ চলতে দেয় এবং হস্তক্ষেপ না করার সিদ্ধান্ত নেয়।

এই ধারণা যে কোনো এক সময়ে মহাবিশ্বের অবস্থা অন্য সব সময়ে মহাবিশ্বের অবস্থা নির্ধারণ করে এই ব্যাপারটি ল্যাপ্লাসের সময় থেকেই বিজ্ঞানের একটি প্রধান মতবাদ হিসেবে চলে আসছে। এটি ইঙ্গিত দেয় যে আমরা ভবিষ্যত পূর্বাভাস করতে পারি, অন্ততপক্ষে তাত্ত্বিকভাবে। বাস্তবে, যাইহোক, আমাদের ভবিষ্যত পূর্বাভাস করার ক্ষমতা গুরুতরভাবে সীমাবদ্ধ সমীকরণের জটিলতার কারণে, এবং আরেকটি বিষয় হচ্ছে যে সেগুলোতে বিশৃঙ্খলা (chaos) নামক একটি বৈশিষ্ট্য থাকে। আপনারা যারা Jurassic Park দেখেছেন তারা জানবেন যে এর মানে হচ্ছে যে একটি স্থানে অতি ক্ষুদ্র ব্যাঘাত বা বিশৃঙ্খলা অন্য স্থানে বড়সড় পরিবর্তন সৃষ্টি করতে পারে। অস্ট্রেলিয়াতে একটি প্রজাপতির ডানা ঝাপটানোর কারণে নিউ ইয়র্কের কেন্দ্রীয় উদ্যানে বৃষ্টি হতে পারে। সমস্যা হচ্ছে যে, এটি পুনরাবৃত্তিযোগ্য নয়। পরবর্তী সময়ে প্রজাপতি যখন তার ডানা ঝাপটাবে তখন অন্যান্য অনেক কিছু ভিন্ন হবে, যা আবহাওয়াকে প্রভাবিত করবে। এই বিশৃঙ্খলার কারণে আবহাওয়ার পূর্বাভাস এতো অনির্ভরযোগ্য হয়।

এই বাস্তব সমস্যাগুলো সত্ত্বেও, উনিশ শতক জুড়ে বৈজ্ঞানিক নিয়তিবাদ প্রধান মতবাদ হিসেবে টিকে ছিলো। কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে দুটো নতুন অগ্রগতি ঘটে যা দেখালো যে ল্যাপ্লাসের দর্শন, অর্থাৎ ভবিষ্যতের সম্পূর্ণ পূর্বাভাস, সম্ভব হবে না। এই দুই অগ্রগতির প্রথমটি ছিলো কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞান এটি ১৯০০ সালে জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক (Max Planck) একটি অসামান্য আপার্তবৈপরীতা (paradox) সমাধান করতে গিয়ে একটি বিশেষ অনুজ্ঞা (ad hoc hypothesis) হিসেবে উপস্থাপন করেন। ল্যাপ্লাসের সময়ে উনবিংশ শতাব্দীর প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, একটি উত্তপ্ত বস্তু, যেমন একটি লাল-উত্তপ্ত ধাতু, বিভিন্ন বিকিরণ করবে। এটি রেডিও তরঙ্গ, অবলোহিত তরঙ্গ, দৃশ্যমান আলো, অতিবেগুনি, এক্সরে এবং গামা রশ্মি, ইত্যাদি হিসেবে শক্তি হারাবে সব একই হারে। এর অর্থ এই যে আমরা সবাই শুধু যে ত্বকের ক্যান্সারে মারা যাবো তা নয়, কিন্তু একইভাবে মহাবিশ্বের সবকিছুর তাপমাত্রা একই হবে, যা স্পষ্টভাবে সম্ভব নয়।

যাইহোক, প্লাঙ্ক দেখালেন যে এই দুর্যোগ এড়ানো যেতে পারে যদি কেউ এই বিকিরণের পরিমাণ যে কোনো মানের হতে পারে এই ধারণা বাদ দেয়, এবং পরিবর্তে বলা হয় যে বিকিরণ একটি নির্দিষ্ট আকারের প্যাকেটে বা কোয়ান্টায় হয়। এটি অনেকটা এই বলার মতো যে আপনি বাজারে গিয়ে চিনি খুচরো খুচরো কিনতে পারবেন না, কিনতে হবে কিলোগ্রামের ব্যাগে। প্যাকেট বা কোয়ান্টায় অতিবেগুনি এবং এক্স-রশ্মির জন্য শক্তি অবলোহিত এবং দৃশ্যমান আলোর চেয়ে বেশি। এর মানে হলো যে যদি না একটি বস্তু খুব বেশি উত্তপ্ত হয়, যেমন সূর্যের মতন, এটির এমনকি অতিবেগুনি কিংবা এক্স-রশ্মির একটি একক কোয়ান্টাম ছেড়ে দেওয়ার মতো যথেষ্ট শক্তি থাকবে না। এই কারণেই আমরা এক কাপ কফি থেকে রৌদ্রদগ্ধ হই না।     

প্লাঙ্ক কোয়ান্টার ধারণাটিকে কেবল একটি গাণিতিক কৌশল হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন, এবং কোনো প্রাকৃতিক বাস্তবতা থাকতে পারে এমন ভাবেন নি। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানীরা অন্যান্য আচরণ বা অবস্থা খুঁজে পেতে শুরু করেছিলেন যা শুধুমাত্র ক্রমাগতভাবে পরিবর্তনশীল মানের (value) পরিবর্তে পৃথক (discrete) অথবা কোয়ান্টিত (quantised) মানের পরিমাণে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, এটি পাওয়া গিয়েছে যে মৌলিক কণাগুলো একটি অক্ষে ঘূর্ণমান লাটিমের মতো আচরণ করে। কিন্তু ঘূর্ণনের পরিমাণ শুধু যে কোনো মানের হতে পারে না। এটিকে একটি মৌলিক এককের গুণিতক হতে হবে। যেহেতু এই এককটি খুবই ছোট, আপনি এটি খেয়াল করবেন না যে একটি সাধারণ লাটিম একটি একটানা ঘূর্ণনের পরিবর্তে কতোগুলো পৃথক ধাপে দ্রুত ক্রমে ধীর হয়ে যায়। কিন্তু পরমাণুর মতো ক্ষুদ্র লাটিমের ক্ষেত্রে, ঘূর্ণনের পৃথক প্রকৃতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।  

বৈজ্ঞানিক নিয়তিবাদের ক্ষেত্রে এই কোয়ান্টাম আচরণের প্রভাব বুঝতে লোকজনের কিছু সময় লেগেছিলো। এটি ১৯২৭ সাল পর্যন্ত না যখন আরেকজন জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ নির্দেশ করেছিলেন যে আপনি একই সাথে একটি কণার অবস্থান এবং গতি উভয় সঠিকভাবে পরিমাপ করতে পারবেন না। একটি কণা কোথায় আছে সেটি দেখতে কণার উপর আলো ফেলতে হবে। কিন্তু প্লাঙ্কের তত্ত্ব অনুসারে কেউ একজন ইচ্ছাকৃতভাবে যে কোনো খুব অল্প পরিমাণ আলো ব্যবহার করতে পারবে না। অন্ততপক্ষে এক কোয়ান্টাম ব্যবহার করতে হবে। এটি কণাটিকে ব্যাঘাত করবে এবং কণাটির গতি এমনভাবে পরিবর্তন করবে যা পূর্বাভাস করা যাবে না। কণাটির অবস্থান সঠিকভাবে মাপতে হলে, আপনাকে ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো ব্যবহার করতে হবে, যেমন অতিবেগুনি, এক্স-রশ্মি অথবা গ্যামা রশ্মির। কিন্তু আবার, প্লাঙ্কের তত্ত্ব অনুসারে, আলোর এইসব রূপের কোয়ান্টা দৃশ্যমান আলোর চেয়ে বেশি শক্তিযুক্ত। সুতারাং, এগুলো কণাটির গতিকে ব্যাঘাত ঘটাবে আরো বেশি। এটি একটি না-জয় পরিস্থিতি: আপনি যতো সঠিকভাবে একটি কণার অবস্থান মাপতে চাইবেন, আপনি ততো ভুল্ভাবে কণাটির গতি জানবেন এবং তদ্বিপরীতভাবেএটি হাইজেনবার্গের প্রণয়ন করা অনিশ্চয়তা নীতিতে সংকলিত; একটি কণার অবস্থানের অনিশ্চয়তা এবং এটির গতির অনিশ্চয়তার গুণফল সবসময় প্লাঙ্ক ধ্রুবক নামক একটি মানকে কণাটির ভরের দ্বিগুণ দ্বারা ভাগফলের চেয়ে বড়।

ল্যাপ্লাসের বৈজ্ঞানিক নিয়তিবাদের দর্শনের সাথে কোনো এক সময়ে মহাবিশ্বের কণাগুলোর অবস্থান এবং গতি জানার ব্যপার জড়িত ছিলো। তাই হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি দ্বারা এটির ভিত্তি গুরুতরভাবে দুর্বল হয়েছিলো। কীভাবে একজন ভবিষ্যত পূর্বাভাস করবে যখন বর্তমান সময়ে কেউ কণাগুলোর অবস্থান এবং গতি উভয় সঠিকভাবে পরিমাপ করতে পারে না? যতো শক্তিশালী কম্পিউটার আপনার থাকুক না কেনো, আপনি যদি বাজে উপাত্ত ইনপুট করেন তবে আপনি বাজে পূর্বাভাস পাবেন।

আইনস্টাইন প্রকৃতির এই আপাত বিশৃঙ্খলা বা যদৃচ্ছতা নিয়ে খুব অসন্তুষ্ট ছিলেন। তার দৃষ্টিভঙ্গি তার বিখ্যাত উক্তি ঈশ্বর পাশা খেলেন না এ প্রকাশ পেয়েছিলোতিনি মনে করেছিলেন যে অনিশ্চয়তা সাময়িক কিছু এবং একটি অন্তর্নিহিত বাস্তবতা আছে, যেখানে কণাগুলোর সুনির্দিষ্ট অবস্থান এবং গতি থাকবে এবং সেগুলো ল্যাপ্লাসের নিয়তিবাদ সূত্রানুসারে বিবর্ধিত হবে। এই বাস্তবতা ঈশ্বরের জানা থাকতে পারে, কিন্তু আলোর কোয়ান্টাম প্রকৃতি আমাদের এটি দেখতে বাধা দেয়, শুধুমাত্র অন্ধকারে একটি কাঁচের মধ্য দিয়ে ছাড়া।

আইনস্টাইনের এই দৃষ্টিভঙ্গিকে এখন গুপ্ত চলরাশি তত্ত্ব (hidden variable theory) বলা হয়। গুপ্ত চলরাশি তত্ত্বগুলোকে পদার্থবিজ্ঞানে অনিশ্চয়তা নীতিকে অন্তর্ভুক্ত করার সবচেয়ে সুস্পষ্ট উপায় বলে মনে হতে পারে। সেগুলো বিভিন্ন বিজ্ঞানী এবং বিজ্ঞানের অধিকাংশ দার্শনিকরা মহাবিশ্ব সম্পর্কে যে মানসিক চিত্র ধারণ করেন তার ভিত্তি তৈরি করে। কিন্তু এই গুপ্ত চলরাশি তত্ত্বগুলো ভুল। ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী জন বেল (John Bell) একটি ব্যবহারিক পরীক্ষা চিন্তা করেছিলেন যেগুলো গুপ্ত চলরাশি তত্ত্বগুলোকে ভুল প্রমাণিত করতে পারে। যখন পরীক্ষাটি সঠিকভাবে সম্পন্ন করা হয়, প্রাপ্ত ফলাফল গুপ্ত চলরাশি তত্ত্বের সাথে অসামঞ্জস্য ছিলো। সুতারাং এটি মনে হয় যে এমনকি ঈশ্বর নিজেই অনিশ্চয়তা নীতি দ্বারা সীমাবদ্ধ, একটি কণার অবস্থান এবং গতি উভয়ই এক সাথে জানতে পারবেন না। সমস্ত প্রমাণ নির্দেশ করে যে ঈশ্বর একজন পাকা জুয়াড়ি যিনি প্রত্যেক সম্ভাব্য ক্ষেত্রে জুয়ার গুটি ছোঁড়েন।

অনেক বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের চেয়ে বেশি প্রস্তুত ছিলেন উনবিংশ শতাব্দীর প্রচলিত চিরায়ত বৈজ্ঞানিক নিয়তিবাদ পরিবর্তন করার জন্য। হাইজেনবার্গ, অস্ট্রিয়ার এর্ভিন শ্র্যোডিঙার (Erwin Schrödinger) এবং ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী পল ডিরাক মিলে একটি নতুন তত্ত্ব, কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞান তুলে ধরেন। ডিরাক কেমব্রিজের লুকাসিয়ান প্রফেসর হিসেবে আমার পূর্বসূরী ছিলেন। যদিও কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞান গত সত্তর বছর ধরে চলে আসছে, এটি এখনো সাধারণভাবে উপলব্ধ অথবা সঠিকভাবে মূল্যায়িত হয় না, এমনকি যারা এটিকে ব্যবহার করেন বিভিন্ন গণনার কাজে তাদের দ্বারা-ওকিন্তু এটি আমাদের সবার চিন্তার ব্যাপার হওয়া উচিত, যেহেতু এটি ভৌত মহাবিশ্ব এবং বাস্তবতার চিরায়ত বা প্রচলিত চিত্র থেকে সম্পূর্ণভাবে ভিন্ন। কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞানতে, কণাগুলোর সুনির্দিষ্ট অবস্থান এবং গতি নেই। বরং, তাদেরকে প্রকাশ করা হয় তরঙ্গ ফাংশন দ্বারাএটি স্থানের প্রতিটি বিন্দুতে একটি সংখ্যা। তরঙ্গ ফাংশনের আকার কণাটি সেই অবস্থানে পাওয়া যাওয়ার সম্ভাব্যতা নির্দেশ করে। যে হারে বিন্দু থেকে বিন্দুতে তরঙ্গ ফাংশনটি তারতম্য হয় সেটি কণার গতি নির্দেশ করে। একটি তরঙ্গ ফাংশন থাকতে পারে যেটি ক্ষুদ্র অংশে খুব প্রবলভাবে তীক্ষ্মমুখী (peaked)তারমানে হচ্ছে যে এইক্ষেত্রে অবস্থানের অনিশ্চয়তা ছোট। কিন্তু তরঙ্গ ফাংশনটি শিখরের কাছাকাছি খুব দ্রুত পরিবর্তিত হবে, এক দিকে উপরে এবং অন্য দিকে নিচে। তাই গতির অনিশ্চয়তা বড় হবে। একইভাবে একটি তরঙ্গ ফাংশন থাকতে পারে যেখানে গতিতে অনিশ্চয়তা ছোট কিন্তু অবস্থানের অনিশ্চয়তা বড় হতে পারে।

কণাটি সম্পর্কে আমরা যা জানতে পারি তা এটির তরঙ্গ ফাংশনে রয়েছে, এটির গতি এবং অবস্থান উভয়ই। যদি আপনি একটি সময়ে তরঙ্গ ফাংশনটি জানেন, তবে অন্য সময়ে এর মানগুলো শ্র্যোডিঙার সমীকরণ (Schrödinger equation) দ্বারা নির্ধারিত হয়। সুতারাং এখনো এক ধরণের নিয়তিবাদ রয়েছে, কিন্তু এটি ল্যাপ্লাস যা চিন্তা করেছিলেন সেই রকম নয়। কণাগুলোর গতি এবং অবস্থান পূর্বাভাস করার পরিবর্তে আমরা তরঙ্গ ফাংশনটি পূর্বাভাস করতে পারি। এর মানে হচ্ছে যে উনিশ শতকের প্রচলিত শাস্ত্র অনুসারে আমরা যা পূর্বাভাস করতে পারতাম বাস্তবে মাত্র তার অর্ধেক পূর্বাভাস করতে পারবো।

যদিও যখন আমরা অবস্থান এবং গতি উভয় পূর্বাভাস করার চেষ্টা করি তখন কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞান অনিশ্চয়তার দিকে পরিচালিত করে তবে এটি এখনো নিশ্চয়তার সাথে আমাদের অবস্থান এবং গতির একটি সমাহারকে (combination) পূর্বাভাস করতে দেয়। কিন্তু, এই রূপ নিশ্চয়তা-ও সাম্প্রতিক কালের অগ্রগতির কারণে হুমকির মুখে পড়ছে। সমস্যা সৃষ্টি হয় যেহেতু মাধ্যাকর্ষণ স্থান-কালকে এতোটাই বাঁকিয়ে দিতে (warp) পারে যে স্থানে কিছু কিছু অঞ্চল থাকতে পারে যেগুলো আমরা পর্যবেক্ষণ করতে পারি না।

এই অঞ্চলগুলো কৃষ্ণগহ্বরের অভ্যন্তরে। এর মানে হচ্ছে যে, তত্ত্ব অনুসারে, আমরা কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে কণাগুলোকে পর্যবেক্ষণ-ও করতে পারবো না। তাই আমরা সেগুলোর অবস্থান অথবা গতি কিছুই পরিমাপ করতে পারবো না। এটি আরেকটি সমস্যা সৃষ্টি করে যেহেতু এটি কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞানর বাইরে-ও আরেক অনিশ্চয়তা উপস্থাপন করে।

উপসংহারে, ল্যাপ্লাসের দ্বারা উপস্থাপিত চিরায়ত দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে, একটি সময়ে যদি কেউ কণাগুলোর অবস্থান এবং গতি জানতো তবে কণাগুলোর ভবিষ্যত গতি সম্পূর্ণভাবে নির্ধারণ সম্ভব ছিলোএই দৃষ্টিভঙ্গি সংশোধন করতে হয়েছিলো যখন হাইজেনবার্গ তার অনিশ্চয়তার নীতি তুলে ধরেন, যেটি উল্লেখ করে যে কেউ অবস্থান এবং গতি উভয় সঠিকভাবে জানতে পারবেন না। কিন্তু তখনো সম্ভাবনা ছিলো যে হয়তো অবস্থান এবং গতির একটি সমাহার পূর্বাভাস করা যাবে। কিন্তু এই সীমিত পূর্বাভাস করার ক্ষমতা-ও ভেস্তে যায় যদি কৃষ্ণগহ্বরকে সমীকরণে বিবেচনা করা হয়।

মহাবিশ্বকে পরিচালনা করা সূত্রাবলি বা বিধিসময় কি আমাদের ভবিষ্যতে কী ঘটবে তা ভবিষ্যদ্বাণী করতে দেয়?

সংক্ষিপ্ত উত্তর হচ্ছে না, এবং হ্যাঁ। তাত্ত্বিকভাবে, বিধিসমূহ আমাদের ভবিষ্যত পূর্বাভাস করতে দেয়। কিন্তু বাস্তবে সেই গণনা প্রায়শ অনেক জটিল।

No comments:

Post a Comment

কী নিয়ে মাতামাতি...

13 Reasons Why (1) ADHD (1) Alzheimer's disease (1) Antibiotic Resistance (1) Anxiety (1) Autism (1) Brexit (1) Brief Answers to the Big Questions (10) Britain (1) Bruce Peninsula (1) Cades Cove Scenic Drive (1) Canada (2) Clingsman Dome (1) District 9 (1) Dopamine (1) Dyer's Bay (1) Federico Garcia Lorca (1) Fierté Montréal (2) Gaspé & Percé Rock (1) Global Warming (2) Great Smoky Mountains (2) Heatwave (1) Hemianopia (1) infographics (1) Instagram (104) International Balloon Festival (1) Interstate 77 (1) Lift (1) Links (1) Maple syrup boiling down (1) Maple syrup harvesting (1) Marconi Union (1) Mike Krath (1) Montmorency Falls (2) Montreal International Jazz Festival (1) Montreal Pride Parade (2) Mother Teresa (1) Movies (1) Music (2) Netflix (1) Niagara Falls (3) Nickelback (1) Nirvana (1) North Carolina (1) nutella (1) Photography (2) Photos (104) Poets of the Fall (2) Psychology (1) Rain storm in Montreal (1) Rape (1) Reading List (1) Saint-Remi (1) Samuel de Champlain Bridge (1) Sandra Crook (1) Schizophrenia (1) Sci-Fi (1) Sci-Hub (1) Shortest Sci-Fi (1) Smoky Mountains (1) Stephen Hawking (15) Sunshine 2007 (1) Tennessee (1) The Beatles (1) The Danish Girl (1) The Grand Design (8) The Handsome Family (1) Tobermory (1) Toronto (2) Transexualism (1) True Detective (1) Tyrannosaurus rex (1) Wallingford Back Mine – Mulgrave et Derry (1) West Island (1) Womenchapter (1) অটিজম (3) অটোয়া (1) অণুগল্প (7) অনুবাদ (17) অভিগীতি (12) অভিলিপি (9) অর্থনীতি (2) অ্যালকোহল (1) আইন ও বিচারব্যবস্থা (1) আইসিস (2) আচরণগত স্নায়ুবিজ্ঞান (1) আত্মহত্যা (2) আলঝেইমারের রোগ (3) আলোকচিত্র (6) আলোকবাজি (9) ইচ্ছেকথা (3) ইন্সটাগ্রাম (104) উইমেন-চ্যাপ্টার (1) উদ্বেগ (1) উবার (1) একুশে বইমেলা (1) এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধ (1) এম-তত্ত্ব (5) কবিতা (95) কম্পিউটার বিজ্ঞান (1) করোনাভাইরাস (6) কলাম (5) কানাডা (4) কাব্যালোচনা (2) কাসেম বিন আবুবাকার (1) কিশোরতোষ (1) কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (1) কৃষ্ণগহ্বর (1) কোভিড-১৯ (8) ক্যান্সার (1) ক্রসফায়ার (1) ক্লোনিং (1) খাদ্যব্যবস্থা (1) গণতন্ত্র (1) গবেষণা (1) গবেষণাপত্র (1) গর্ভপাত (1) গল্প (8) গাঁজা (1) গান (17) গুজব (1) গ্যাব্রিয়েলা মিস্ট্রাল (1) চলচ্চিত্র (4) ছড়া (5) ছবি (104) ছোটগল্প (5) জঙ্গিবাদ (1) জনস্বাস্থ্য (2) জিকা ভাইরাস (1) জীববিজ্ঞান (1) জীবাণু (1) ট্রান্সসেক্সুয়াল (1) ট্রান্সসেক্সুয়ালিজম (1) ডাইনোসর (1) ডাউনলোড (1) ডোপামিন (1) তাপমাত্রা (1) তিল-গপ্পো (17) তুষার দত্ত (2) তেজস্ক্রিয়তা চিকিৎসা (1) দূরবীন (2) দৃষ্টিশক্তি (1) ধর্ম (3) ধর্ষণ (2) নায়াগ্রা ফলস জলপ্রপাত (1) নারী (3) নারী স্বাধীনতা (1) নুটেলা (1) নৈতিকতা (1) পরিবেশ (1) পাঁচমিশালী (1) পাঠসূচি (1) পাম তেল (1) পাহাড় (1) পুস্তক (1) পেডোফিলিয়া (1) প্রকৃতি (1) প্রবন্ধ (2) প্রবাস (2) প্রাইমেট (1) ফটোগ্রাফী (1) ফেসবুক (1) ফ্রান্স (1) বই (2) বড় প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত উত্তর (10) বয়ঃসন্ধি (1) বর্ণবাদ (1) বাঙলাদেশ (18) বাবা (1) বাংলাদেশ (1) বিজ্ঞপ্তি (1) বিজ্ঞান (13) বিটলস (1) বিষণ্নতা (3) বুরকিনি (1) বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি (7) বৈশ্বিক উষ্ণতা (1) ব্যক্তিত্ব (1) ব্যথা (1) ভাইটামিন ডি (1) ভাইরাস (1) ভালোবাসা (1) ভুয়া খবর (1) ভেন্টিলেটর (1) ভ্রমণ (3) মনস্তত্ত্ব (1) মনোবিজ্ঞান (19) মন্ট্রিয়াল (1) মন্ট্রিয়াল আন্তর্জাতিক জ্যাজ উৎসব (2) মস্তিষ্ক ক্যান্সার (1) মহিমান্বিত নকশা (3) মাদক (1) মাদকাসত্তি (2) মাদার তেরেসা (1) মানসিক স্বাস্থ্য (5) মুক্তগদ্য (3) মুক্তচিন্তা (3) মুক্তিযুদ্ধ (3) মৌলবাদ (1) যাপিত জীবন (2) যুগান্তর পত্রিকা (1) যৌনতা (1) রাজনীতি (1) রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প (3) রূপান্তরকাম (1) রৌদ্রস্নান (1) লিওনার্ড ম্লোডিনো (5) লিংক (2) লিঙ্গরূপান্তর (1) লিঙ্গরূপান্তরকারী (1) লিথিয়াম (1) লিফট (1) শিক্ষাব্যবস্থা (1) শিশুতোষ (3) সংগীত (3) সন্ত্রাসবাদ (1) সংবাদমাধ্যম (1) সময়ভ্রমণ (1) সমালোচনা (1) সর্দিগর্মি (1) সানশাইন (1) সামাজিক দূরত্ব (1) সাম্প্রতিক দেখা চলচ্চিত্র (1) সার্স-কোভ-২ ভাইরাস (4) সাহিত্য (4) স্কিৎসোফ্রেনিয়া (1) স্টিফেন হকিং (16) স্ট্রোক (1) স্নায়ুবিজ্ঞান (12) স্নায়ুবিষ (1) স্বাস্থ্যসেবা (1) হলুদ (1)
রোদের অসুখ © 2008 Por *Templates para Você*