অধ্যায় ৫: কৃষ্ণগহ্বরে কী আছে?
বলা হয় যে কখনো কখনো ফ্যাক্ট (fact) কল্পনার
চেয়েও অদ্ভুত, এবং কৃষ্ণগহ্বরের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটি অনেক বেশি
সত্য। কৃষ্ণগহ্বর বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী লেখকদের স্বপ্নের চেয়ে-ও অদ্ভুত,
যদিও সেগুলো দৃঢ়ভাবে বৈজ্ঞানিক সত্য নির্ভর।
কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে প্রথম আলোচনা হয়েছিলো ১৭৮৩
সালে, একজন কেমব্রিজবাসী, জন মিশেল দ্বারা। তার যুক্তি ছিলো
নিম্নরূপ। যদি কেউ একটি ক্ষুদ্র খণ্ড, যেমন একটি কামানের গোলা, উল্লম্বভাবে উপরের দিকে ছুঁড়ে মারেন, এটি মাধ্যাকর্ষণ
দ্বারা ধীর হয়ে যাবে। অবশেষে, খণ্ডটির উপরের দিকে ওঠা থেমে যাবে, এবং মাটিতে পড়ে যাবে। কিন্তু, যদি প্রাথমিক উর্ধ্বগামী বেগ কিছুটা সংকটপূর্ণ
বেগ বা মুক্তিবেগের (escape velocity) চেয়ে বেশি হয়, তবে মাধ্যাকর্ষণ খণ্ডটিকে থামাতে পারবে না, এবং এটি দূরে চলে যাবে।
পৃথিবীর ক্ষেত্রে মুক্তিবেগ প্রতি সেকেন্ডে ১১ কিলোমিটারের চেয়ে একটু বেশি, এবং
সূর্যের ক্ষেত্রে প্রতি সেকেন্ডে ৬১৭ কিলোমিটার। কিন্তু এই দুটো বেগই একটি বাস্তব
কামানের গোলার গতির তুলনায় অনেক বেশি। কিন্তু আলোর গতির তুলনায় কম, যা প্রতি
সেকেন্ডে ৩০০০০০ কিলোমিটার। তাই পৃথিবীর কিংবা সূর্য থেকে কোনো অসুবিধা ছাড়াই আলো
দূরে যেতে পারে। কিন্তু মিশেল যুক্তি দিয়েছিলেন যে সূর্যের তুলনায় অনেক বিশালাকার
নক্ষত্র থাকতে পারে যে যেটির মুক্তিবেগ আলোর গতির চেয়ে-ও বেশি হতে পারে। আমরা
সেগুলো দেখতে সক্ষম হবো না, কারণ সেগুলো থেকে যে আলো বিচ্ছুরিত হবে তা মাধ্যাকর্ষণ
টেনে নিয়ে আনবে। মাইকেল সেগুলোকে কৃষ্ণ নক্ষত্র (dark stars) নাম দিয়েছিলেন, যেগুলোকে আমরা এখন কৃষ্ণগহ্বর বলি।
সেগুলোকে বুঝতে, আমাদের মাধ্যাকর্ষণ নিয়ে
আলোচনা শুরু করতে হবে। মাধ্যাকর্ষণকে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বে
বর্ণনা করা হয়েছে, যা স্থান এবং কালের এবং একই সঙ্গে মাধ্যাকর্ষণের তত্ত্ব। স্থান
এবং কালের প্রকৃতি আইনস্টাইনের সমীকরণ নামক কতোগুলো সমীকরণ দ্বারা পরিচালিত হয়, যা
১৯১৫ সালে আইনস্টাইন প্রকাশ করেছিলেন। যদিও মাধ্যাকর্ষণ প্রকৃতির জ্ঞাত বলগুলোর
মধ্যে সবচেয়ে দুর্বলতম, এটির অন্যান্য বলের তুলনায় দুটো গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা
রয়েছে। প্রথমত, এটি দীর্ঘ পরিসরে কাজ করে। পৃথিবী ৯৩ মিলিয়ন মাইল দূরে অবস্থিত
সূর্যের কক্ষপথে থাকে, এবং সূর্য প্রায় ১০ হাজার আলোকবর্ষ দূরের ছায়াপথের
কেন্দ্রস্থলের চারপাশে কক্ষপথে থাকে। দ্বিতীয় সুবিধা হচ্ছে যে মাধ্যাকর্ষণ সবসময়
আকর্ষণ-ধর্মী, বৈদ্যুতিক শক্তি যা কিনা হয় আকর্ষণ-ধর্মী কিংবা বিকর্ষণ-ধর্মী তার
তুলনায় ভিন্ন। এই ব্যাপারগুলো সত্ত্বেও, বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায় বুঝতে দেরি করেছিলো
যে বিশালাকার নক্ষত্র তাদের নিজস্ব মাধ্যাকর্ষণের কারণে নিজের উপর পতিত হতে পারে
এবং বিদ্যমান বস্তুটি কীভাবে আচরণ করবে সেটি নির্ণয় করতে দেরি করেছিলো। এমনকি
অ্যালবার্ট আইনস্টাইন ১৯৩৯ সালে একটি গবেষণামূলক রচনা লিখে দাবি করেছিলেন যে
নক্ষত্রসমূহের মাধ্যাকর্ষণের কারণে পতন ঘটতে পারে না, কারণ বস্তু বা পদার্থকে একটি
নির্দিষ্ট সীমার বেশি সংকুচিত করা যাবে না। অনেক বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের অনুভূতি ভাগ
করেছিলেন। মূল ব্যতিক্রম ছিলেন আমেরিকান বিজ্ঞানী জন হুইলার (John Wheeler), যিনি নানা ভাবে কৃষ্ণগহ্বর ‘গল্পের’ নায়ক। ১৯৫০
এবং ১৯৬০ –এর দশকে তার
কাজে, তিনি জোর দিয়েছিলেন যে অধিকাংশ নক্ষত্র অবশেষে ধসে পড়বে, এবং তাত্ত্বিক
পদার্থবিজ্ঞানের জন্য এটি যে সমস্যাগুলো জাহির করবে তিনি সেগুলো অন্বেষণ করেছিলেন। তিনি আরো
দেখেছিলেন যে ধসিত নক্ষত্রগুলো যে বস্তুতে পরিণত হবে সেটির অনেকগুলো বৈশিষ্ট্য হচ্ছে
কৃষ্ণগহ্বরের!
একটি সাধারণ নক্ষত্রের জীবনকালের অধিকাংশ
সময়ে, কয়েক বিলিয়ন বছর জুড়ে, এটি নিজের মাধ্যাকর্ষণের বিরুদ্ধে নিজেকে টিকিয়ে রাখে
হাইড্রোজনকে হিলিয়ামে রূপান্তরিত করা পারমাণবিক প্রক্রিয়ার কারণে সৃষ্ট তাপীয়
চাপের মাধ্যমে। কিন্তু অবশেষে, তারকা বা নক্ষত্রটির পারমাণবিক জ্বালানি শেষ হয়ে
যাবে। নক্ষত্রটি সংকুচিত হবে। কিছু ক্ষেত্রে, এটি একটি সাদা বামন তারকা (white dwarf star) বা একটি নাক্ষত্রিক মূলের ঘন অবশিষ্টাংশ হিসেবে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে
পারবে। কিন্তু, সুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখর (Subrahmanyan Chandrasekhar) ১৯৩০ সালে দেখিয়েছিলেন যে, একটি সাদা বামন তারকার সর্বোচ্চ ভর সূর্যের
প্রায় ১.৪ গুণ। রাশিয়ার পদার্থবিজ্ঞানী ল্যেভ লান্দাউ (Lev
Landau) একই রকম সর্বোচ্চ ভর গণনা করেছিলেন সম্পূর্ণভাবে নিউট্রন (neutron) দ্বারা তৈরি তারকার ক্ষেত্রে।
সেইসব অগণিত নক্ষত্রদের ভাগ্যে কী ঘটবে
যখন তারা তাদের সব পারমাণবিক জ্বালানী শেষ করে ফেলে তখন তাদের ভর একটি সাদা বামন
তারকা বা নিউট্রন তারকার সর্বোচ্চ ভরের চেয়ে বেশি? সমস্যাটি পরে পরমাণু বোমা
বানানোর ক্ষেত্রে খ্যাতি পাওয়া রবার্ট ওপেনহেইমার (Robert Oppenheimer) দ্বারা
অন্বেষিত হয়েছিলো। ১৯৩৯ সালে কয়েকটি গবেষণামূলক রচনায়, জর্জ ভলকফ (George
Volkoff) এবং হার্টল্যান্ড স্নাইডার (Hartland Snyder) মিলে তিনি দেখিয়েছিলেন যে এই ধরণের তারকা চাপের সাহায্যে টিকে থাকতে
পারবে না। এবং কেউ যদি এই চাপকে উপেক্ষা করে, একটি একরূপ গোলাকার কাঠামোবদ্ধ প্রতিসম
তারকা (a uniform spherically systematic symmetric star)
অসীম ঘনত্বের একটি একক বিন্দুতে সংকুচিত হবে। এইরকম একটি বিন্দুকে এককত্ব (singularity) বলে। স্থান সম্পর্কে আমাদের সমস্ত তত্ত্ব তৈরি হয়েছে এই অনুমান করে যে
স্থান-কাল মসৃণ এবং প্রায় সমতল, তাই তারা এককত্বে এসে ভেঙে যায়, যেখানে
স্থান-কালের বক্রতা অসীম। প্রকৃতপক্ষে, এটি স্থান এবং কালের শেষ চিহ্নিত করে। এটিই
আইনস্টাইন আপত্তিকর মনে করেছেন।
তারপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলো।
রবার্ট ওপেনহেইমারসহ অধিকাংশ বিজ্ঞানী পারমাণবিক পদার্থবিজ্ঞানের দিকে মনোযোগ
দিয়েছিলেন তখন এবং মহাকর্ষীয় পতন (gravitational collapse) বিষয়টি মূলত ভুলে
যাওয়া হয়েছিলো। এই বিষয়ে আগ্রহ পুনরুজ্জীবিত হয় কোয়েজার (quasar) নামক দূরবর্তী বস্তুসমূহের আবিষ্কারের সাথে। প্রথম কোয়েজার ৩সি২৭৩ (3C273) আবিষ্কৃত হয়েছিলো ১৯৬৩ সালে। আরো অনেক কোয়েজার শীঘ্রই আবিস্কৃত হয়েছিলো।
পৃথিবী থেকে বিশাল দূরত্বে হওয়া সত্ত্বেও সেগুলো ছিলো খুব উজ্জ্বল। পারমাণবিক
প্রক্রিয়া তাদের শক্তি উৎপাদন পুরোপরি ব্যাখ্যা করতে পারে না, কারণ তারা তাদের
স্থির ভরের (rest mass) মাত্র এক ভগ্নাংশ বিশুদ্ধ শক্তি
হিসেবে ছাড়ে। একমাত্র বিকল্প হচ্ছে যে মহাকর্ষীয় পতনের ফলে মুক্ত হওয়া মহাকর্ষীয়
শক্তি।
নক্ষত্র বা তারকাদের মহাকর্ষীয় পতন পুনরায়
আবিস্কৃত হয়েছিলো। যখন এটি ঘটে তখন বস্তুটির মাধ্যাকর্ষণ এর পার্শ্ববর্তী ভরসমূহকে
নিজের দিকে আকর্ষণ করে। এটি পরিষ্কার ছিলো যে একটি একরূপ গোলাকার তারকা অসীম
ঘনত্বের একটি বিন্দুতে, এককত্বে সংকুচিত হবে। কিন্তু কী ঘটবে যদি তারকাটি সর্বত্র
একরূপ এবং গোলাকার না হয়? তারকাটির ভরের অসম বন্টন কি একটি অভিন্ন (non-uniform) পতন ঘটাবে এবং এককত্ব এড়াবে? ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত একটি অসাধারণ
গবেষণাপত্রে রজার পেনরোজ দেখিয়েছিলেন যে তখনো এককত্ব ঘটবে, মাধ্যাকর্ষণ যে আকর্ষণ-ধর্মী
এই কারণে।
এককত্বে আইনস্টাইনের সমীকরণগুলোকে
সংজ্ঞায়িত করা যায় না। এর অর্থ হচ্ছে যে অসীম ঘনত্বের এই বিন্দুতে বা এই সময়ে
ভবিষ্যত পূর্বাভাস করা যায় না। এর মানে হচ্ছে যে একটি তারকা বা নক্ষত্র যখন পতিত
হয় তখন অদ্ভুত কিছু ঘটতে পারে। আমরা পূর্বাভাসের ভাঙন দ্বারা প্রভাবিত হবো না যদি
এককত্বসমূহ খোলামেলা না হয় (not naked)- অর্থাৎ, সেগুলো যদি বাইরে থেকে আবৃত
না হয়। পেনরোজ মহাজাগতিক বিবাচনা ধারণা (cosmic censorship conjecture) প্রস্তাব করেছিলেন: নক্ষত্র বা অন্যান্য বস্তুর
পতনের ফলে সৃষ্ট সকল এককত্বসমূহ কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরের দৃষ্টি থেকে লুকায়িত।
কৃষ্ণগহ্বর হচ্ছে একটি অঞ্চল যেখানে মাধ্যাকর্ষণ এতো বেশি শক্তিশালী যে আলো-ও
সেখান থেকে মুক্তি পায় না। মহাজাগতিক বিবাচনা ধারণাটি অবশ্যই প্রায় সত্য, কারণ এটিকে
ভুল প্রমাণ করার কয়েকটি প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।
১৯৬৭ সালে যখন জন হুইলার “কৃষ্ণগহ্বর” শব্দটি চালু করেছিলেন তখন এটি পূর্বের “হিমায়িত তারকা” (frozen star) নামটি প্রতিস্থাপিত করেছিলো।
নবোদ্ভাবিত শব্দটি জোর দিয়ে তুলে ধরেছিলো যে ধসে যাওয়া তারকাদের অবশিষ্টাংশ নিজে
থেকেই আগ্রহের বিষয়, যেগুলো যেভাবেই গঠিত হয়ে থাকুক না কেনো। নতুন নামটি দ্রুত
জন্মপ্রিয় হয়ে ওঠলো।
বাইরে থেকে আপনি বলতে পারবেন না
কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে কী আছে। আপনি যা কিছু নিক্ষেপ করেন না কেনো, কিংবা এটি যেভাবেই
গঠিত হয়ে থাকুক না কেনো, কৃষ্ণগহ্বরগুলো একই দেখায়। জন হুইলার এই ব্যাপারটিকে “একটি কৃষ্ণগহ্বরের কোনো লোম নেই” বলে প্রকাশ করেছিলেন বলে প্রচলিত আছে।
একটি কৃষ্ণগহ্বরের ঘটনাদিগন্ত বলে একটি
সীমানা আছে। এখানে মাধ্যাকর্ষণ যথেষ্ট শক্তিশালী যে এটি আলোকে টেনে ফিরিয়ে নিয়ে
আসতে পারে এবং মুক্তি পাওয়া থেকে প্রতিরোধ করে। যেহেতু কোনো কিছু আলোর গতির চেয়ে
বেশি দ্রুত ভ্রমণ করতে বা যেতে পারে না, অন্য সবকিছুকে-ও আবার টেনে ফিরে নিয়ে আসা
হবে। ঘটনাদিগন্তের মধ্য দিয়ে পতন হচ্ছে অনেকটা নায়াগ্রা জলপ্রপাতের উপরে ডিঙি নৌকো
নিয়ে যাওয়ার মতন। আপনি যদি জলপ্রপাতের উপরে থাকেন তবে হয়তো দ্রুত বৈঠা ঠেলে আপনি
যেতে পারবেন, কিন্তু আপনি যদি কিনারায় চলে যান তবে আপনি হারিয়ে যাবেন। ফিরে যাওয়ার
কোনো উপায় নেই। আপনি প্রপাতের (কিনারার) যতো কাছে যাবেন, জলের প্রবাহের গতি ততো
বেশি হবে। তার মানে হচ্ছে যে এটি ডিঙি নৌকার পেছনের চেয়ে সামনের দিকে বেশি টানবে। একটি বিপদ
হচ্ছে যে ডিঙি নৌকো টেনে ছিঁছড়ে হয়ে যাবে। কৃষ্ণগহ্বরের ক্ষেত্রে-ও একই ব্যাপার
ঘটে। আপনি যদি একটি কৃষ্ণগহ্বরে পড়তে থাকেন তবে মাধ্যাকর্ষণ আপনার মাথার চেয়ে
পায়ের দিকে বেশি টানবে কারণ আপনার পা কৃষ্ণগহ্বরের কাছাকাছি। ফলাফল হচ্ছে যে আপনি
দৈর্ঘ্য বরাবর টেনে লম্বা হয়ে যাবেন, এবং পার্শ্বদেশে চ্যাপ্টা হয়ে যাবেন। যদি কৃষ্ণগহ্বরের
আমাদের সূর্যের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি ভর থেকে থাকে, তবে আপনি ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবেন
এবং আপনি সেমাইতে পরিণত হবেন ঘটনাদিগন্তে পৌঁছার আগেই। কিন্তু আপনি যদি আমাদের
সূর্যের ভরের কয়েক মিলিয়ন গুণ বেশি ভরের একটি কৃষ্ণগহ্বরে পড়েন তবে মাধ্যাকর্ষণ
টান আপনার সমগ্র শরীর জুড়ে একই হবে এবং আপনি কোনো সমস্যা ছাড়া ঘটনাদিগন্তে পৌঁছতে
পারবেন। তাই আপনি যদি একটি কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে কী আছে তা অনুসন্ধান করতে চান তবে
নিশ্চিত করুন যে আপনি একটি বড়সড় কৃষ্ণগহ্বর বেছে নিয়েছেন। আমাদের ছায়াপথের
কেন্দ্রে আমাদের সূর্যের ভরের তুলনায় প্রায় চার মিলিয়ন গুণ বেশি ভরের একটি
কৃষ্ণগহ্বর আছে।
যদিও আপনি কৃষ্ণগহ্বরে পড়ার সময়ে আপনি
বিশেষ কিছু লক্ষ্য করবেন না, তবে আপনাকে দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করছেন এমন একজন
আপনাকে ঘটনাদিগন্ত অতিক্রম করতে দেখবে না। পরিবর্তে, আপনাকে দেখে মনে হবে যে আপনি
গতি ধীর করছেন এবং ঠিক বাইরে ঝুলে আছেন। আপনার ছবি ক্রমে অস্পষ্ট থেকে অস্পষ্টতর
এবং লাল থেকে আরো লাল হতে থাকবে, যতোক্ষণ পর্যন্ত না আপনি দৃষ্টিসীমানা থেকে
পুরোপুরি হারিয়ে গেছেন। বাইরের পৃথিবীর কাছে আপনি চিরতরে হারিয়ে গেছেন।
আমার মেয়ে লুসির জন্মের কিছুদিন পরে আমি
একটি ইউরেকা মুহূর্ত পেয়েছিলাম। আমি ক্ষেত্র উপপাদ্য (area theorem) আবিস্কার করেছিলাম। যদি সাধারণ আপেক্ষিকতা সঠিক হয়ে থাকে, এবং বস্তুর
শক্তির ঘনত্ব ধনাত্মক হয়ে থাকে, যা সাধারণত হয়েই থাকে, তবে ঘটনাদিগন্তের পৃষ্ঠভূমি
বা কৃষ্ণগহ্বরের সীমানার বৈশিষ্ট্য এই হয় যে এটি বাড়তে থাকে যখন নতুন কোনো বস্তু
বা পদার্থ অথবা বিকিরণ কৃষ্ণগহ্বরে পতিত হয়। তাছাড়া, যদি দুটো কৃষ্ণগহ্বরের সংঘর্ষ
ঘটে এবং ফলে একটি একক কৃষ্ণগহ্বর গঠিত হয় একত্রিত হয়ে, তবে নতুন সৃষ্ট
কৃষ্ণগহ্বরের ক্ষেত্র (area) আগের কৃষ্ণগহ্বর দুটোর
ঘটনাদিগন্তগুলোর ক্ষেত্রসমূহের সমষ্টির চেয়ে বড় হবে। ক্ষেত্র
তত্ত্ব পরীক্ষামূলকভাবে পরীক্ষা করা যেতে পারে এলআইজিও (Laser Interferometer
Gravitational-Wave Observatory; LIGO)
দ্বারা। ২০১৫ সালের সেপ্টম্বরের ১৪ তারিখে, এলআইজিও দুটো কৃষ্ণগহ্বরের সংঘর্ষ এবং
একত্র হওয়ার মহাকর্ষীয় তরঙ্গ সনাক্ত করেছিলো। তরঙ্গাকৃতি (waveform) থেকে, কেউ কৃষ্ণগহ্বরগুলোর ভর এবং কৌণিক ভরবেগ হিসেব করতে পারে এবং লোম-বিহীন
উপপাদ্য (no-hair theorem) দ্বারা এগুলো ঘটনাদিগন্তসমূহের
ক্ষেত্রগুলো নির্ধারণ করে।
এই বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরে যে প্রচলিত
পদার্থবিজ্ঞানের, বিশেষ করে তাপগতিবিদ্যার বিশৃঙ্খলা-মাত্রা ধারণার সাথে একটি
কৃষ্ণগহ্বরের ঘটনাদিগন্তের ক্ষেত্রের মিল বা সংযোগ আছে। বিশৃঙ্খলা-মাত্রাকে একটি
ব্যবস্থার বিশৃঙ্খলা বা বিক্ষিপ্ততার পরিমাপ, অথবা একইভাবে ব্যবস্থাটির
সুনির্দিষ্ট অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। তাপগতিবিদ্যার
বিখ্যাত দ্বিতীয় সূত্র নির্দেশ করে যে বিশৃঙ্খলা-মাত্রা সময়ের সাথে বাড়তে থাকে। এই
আবিষ্কারটি এই গুরুত্বপূর্ণ সংযোগের প্রথম ইঙ্গিত ছিলো।
কৃষ্ণগহ্বরের বৈশিষ্ট্যাবলি এবং
তাপগতিবিদ্যার সূত্রাবলির মধ্যকার সাদৃশ্য আরো বিস্তারিতভাবে বলা যেতে পারে। তাপগতিবিদ্যার
প্রথম সূত্র বলে যে একটি ব্যবস্থার বিশৃঙ্খলা-মাত্রার অল্প একটু পরিবর্তন ব্যবস্থাটির
শক্তিতে আনুপাতিক পরিবর্তনের সাথে সংশ্লিষ্ট। ব্র্যান্ডন কার্টার (Brandon Carter), জিম বারডিন (Jim Bardeen) এবং আমি একটি
কৃষ্ণগহ্বরের ভরের পরিবর্তনের সাথে ঘটনাদিগন্তের ক্ষেত্রের পরিবর্তনের সাথে
সম্পর্কিত একই সূত্র পেয়েছি। এখানে আনুপাতিকতার গুণক পৃষ্ঠ মাধ্যাকর্ষণ (surface
gravity) নামক একটি রাশি বা পরিমাণ, যা ঘটনাদিগন্তে মাধ্যাকর্ষণ
ক্ষেত্রের শক্তির পরিমাপ, এর সাথে জড়িত। কেউ যদি ধরে নেয় যে ঘটনাদিগন্তের ক্ষেত্র
বিশৃঙ্খলা-মাত্রার অনুরূপ, তবে এটি মনে হবে যে পৃষ্ঠ মাধ্যাকর্ষণ তাপমাত্রার
অনুরূপ। এই সংযোগ বা মিলের অন্যতম আরেকটি বিষয় হচ্ছে যে ঘটনাদিগন্তের সকল বিন্দুতে
পৃষ্ঠ মাধ্যাকর্ষণ একই, ঠিক যেমনটি তাপীয় সাম্যাবস্থায় (thermal
equilibrium) থাকা একটি বস্তু বা পদার্থের সর্বত্র একই তাপমাত্রা
থাকে।
যদিও বিশৃঙ্খলা-মাত্রা এবং ঘটনাদিগন্তের
ক্ষেত্রের মধ্যে স্পষ্ট মিল আছে, তবে আমাদের কাছে এটি সুস্পষ্ট নয় কীভাবে
ক্ষেত্রটিকে কৃষ্ণগহ্বরের নিজের বিশৃঙ্খলা-মাত্রা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। কৃষ্ণগহ্বরের
বিশৃঙ্খলা-মাত্রা বলতে কী বোঝায়? ১৯৭২ সালে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন
স্নাতকোত্তর ছাত্র জ্যাকব বেকেনস্টাইন (Jacob Bekenstein) একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব
করেছিলেন। যখন মহাকর্ষীয় পতনের ফলে একটি কৃষ্ণগহ্বরের সৃষ্টি হয়, এটি দ্রুত একটি
স্থির অবস্থায় থিতু হয়, যা তিনটি বৈশিষ্ট্যাবলি দ্বারা চিহ্নিত করা হয়: ভর, কৌণিক ভরবেগ, এবং বৈদ্যুতিক আধান।
এর ফলে মনে হয় যে যেনো কৃষ্ণগহ্বরের
চূড়ান্ত অবস্থা যে (কৃষ্ণগহ্বর গঠনে) বস্তুটি ধসে পড়েছে বা পতিত হয়েছে সেটি পদার্থ
বা প্রতি-পদার্থ (anti-matter) দিয়ে তৈরি কিনা অথবা সেটি আকৃতিতে গোলাকার কিংবা
অত্যন্ত অসমাঙ্গ ছিলো কিনা ইত্যাদির অনধীন (independent )। অন্যভাবে,
একটি প্রদত্ত ভর, কৌণিক ভরবেগ, এবং বৈদ্যুতিক আধানের একটি কৃষ্ণগহ্বর গঠিত হতে
পারে পদার্থের বিভিন্ন সংখ্যক কনফিগারেশনের যেকোনো একটির পতন বা ধসের ফলে। তাই
বিভিন্ন ধরণের নক্ষত্র বা তারকার পতনে একই ধরণের কৃষ্ণগহ্বর তৈরি হতে পারে।
প্রকৃতপক্ষে, যদি কোয়ান্টাম প্রভাবগুলো বাদ দেয়া হয়, তবে কনফিগারেশনের সংখ্যা অসীম
হবে যেহেতু কৃষ্ণগহ্বরটি গঠিত হতে পারে অনির্দিষ্ট ভরের অগণিত সংখ্যক কণার মেঘের
পতন বা ধসের ফলে। কিন্তু কনফিগারেশনের সংখ্যা কি সত্যিই অসীম হতে পারে?
কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞানে বিখ্যাতভাবে
অনিশ্চয়তা নীতি জড়িত। এটি বর্ণনা করে যে কোন বস্তুর অবস্থান এবং গতি উভয় একই সাথে
পরিমাপ করা অসম্ভব। যদি কেউ সঠিকভাবে কোনো কিছুর অবস্থান মাপে তবে এর গতি অনির্ধারিত
হয়। যদি কেউ কিছুর গতি মাপে, তবে সেটির অবস্থান অনির্ধারিত হয়। বাস্তবে, এর অর্থ
হচ্ছে যে কোনো কিছুর সঠিক স্থান নির্দেশ করা অসম্ভব। মনে করুন আপনি কোনো (চলন্ত) কিছুর
আকার পরিমাপ করতে চান, তবে আপনাকে নির্ণয় করতে হবে এই চলন্ত বস্তুটির প্রান্তগুলো
কোথায়। আপনি কখনো এটি সঠিকভাবে করতে পারবেন না, কারণ আপনাকে একই সময়ে সেটির
অবস্থান এবং গতি উভয়ের পরিমাপ করতে হবে। অর্থাৎ এক অর্থে, একটি বস্তুর আকার
নির্ধারণ করা অসম্ভব। আপনি যা করতে পারেন তা হচ্ছে যে বলতে পারেন যে অনিশ্চয়তা
নীতি কোনো কিছুর আকার কী তা সঠিকভাবে বলা অসম্ভব করে তোলে। অনিশ্চয়তা নীতি কোনো
কিছুর আকারের ক্ষেত্রে একটি সীমা চাপিয়ে দেয়। কিছু হিসাবনিকাশের পরে একজন দেখেন যে
একটি বস্তুর প্রদত্ত ভরের জন্য একটি সর্বনিম্ন আকার রয়েছে। ভারী বস্তুসমূহের জন্য
এই সর্বনিম্ন আকার ছোট হয়ে থাকে, কিন্তু হালকা থেকে হালকাতর বস্তুর ক্ষেত্রে এই
সর্বনিম্ন আকার বড় থেকে বড়তর হতে থাকে। এই সর্বনিম্ন আকারকে কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞানে
বস্তুকে হয় একটি তরঙ্গ অথবা একটি কণা হিসেবে চিন্তা করা যেতে পারে এই ব্যাপারটির ফল
হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। একটি বস্তু যতো হালকা, সেটির তরঙ্গদৈর্ঘ্য ততো বেশি
দীর্ঘ, এবং এটি ততো বেশি বিস্তৃত। একটি বস্তু যতো বেশি ভারী, এটির তরঙ্গদৈর্ঘ্য
ততো বেশি ক্ষুদ্র এবং সেটিকে ততো বেশি আঁটসাঁট মনে হয়। যখন এই ধারণাগুলোকে সাধারণ
আপেক্ষিকতার ধারণাসমূহের সাথে যোগ করা হয়, তখন এর অর্থ হচ্ছে যে শুধুমাত্র একটি
নির্দিষ্ট ওজনের চেয়ে ভারী বস্তু কৃষ্ণগহ্বর গঠন করতে পারবে। এই ওজন লবণের একটি
কণার প্রায় সমান। এই ধারণাগুলোর আরেকটি পরিণতি হচ্ছে যে যে সংখ্যক কনফিগারেশন একটি
প্রদত্ত ভর, কৌণিক ভরবেগ, এবং বৈদ্যুতিক আধানের কৃষ্ণগহ্বর গঠন করতে পারে, যদিও
অনেক সংখ্যক তারপর-ও সেই কনফিগারেশনগুলো সমীম সংখ্যক হবে। জ্যাকব বেকেনস্টাইন
প্রস্তাব করেছিলেন যে এই সীমিত সংখ্যা থেকে, একজন কৃষ্ণগহ্বরের বিশৃঙ্খলা-মাত্রা
ব্যাখ্যা করতে পারে। এটি হবে কৃষ্ণগহ্বর সৃষ্টির সময়ে পতন ঘটাকালীন পুনরূদ্বারের
অসাধ্য হারিয়ে যাওয়া তথ্যের পরিমাণের একটি পরিমাপ।
বেকেনস্টাইনের প্রস্তাবের মধ্যে স্পষ্টত
মারাত্মক ক্রটি ছিলো যে, যদি একটি কৃষ্ণগহ্বরের সসীম বিশৃঙ্খলা-মাত্রা থাকে যা এটি
ঘটনাদিগন্তের ক্ষেত্রের আনুপাতিক হয়, তবে এটির অ-শূন্য তাপমাত্রা থাকা উচিত যা এটির
পৃষ্ঠ মহাকর্ষের আনুপাতিক হবে। এটি বোঝায় যে একটি কৃষ্ণগহ্বর শূন্য ব্যতীত অন্য
কোনো তাপমাত্রায় তাপীয় বিকিরণের সাম্যাবস্থায় থাকতে পারে। কিন্তু প্রচলিত ধারণা
অনুসারে এইরকম সাম্যাবস্থা সম্ভব নয় যেহেতু কৃষ্ণগহ্বর এর উপর পতিত যেকোনো তাপীয়
বিকিরণকে শোষণ করবে কিন্তু সংজ্ঞা অনুসারে কোনো কিছু নির্গত করতে পারবে না। এটি
কোনো কিছু নির্গমন করতে পারে না, এটি তাপ নির্গমন করতে পারে না।
এটি কৃষ্ণগহ্বরের প্রকৃতি সম্পর্কে একটি আপার্তবৈপরীতা সৃষ্টি
করেছে, যা তারকা বা নক্ষত্রসমূহের পতনের ফলে অবিশ্বাস্যভাবে ঘনীভূত বস্তু। একটি
তত্ত্ব নির্দেশ করে যে একই ধরণের গুণাবলির কৃষ্ণগহ্বরগুলো একটি অগণিত সংখ্যক
বিভিন্ন ধরণের নক্ষত্র থেকে সৃষ্টি হতে পারে। আরেকটি নির্দেশ করে যে এই সংখ্যা
সসীম হতে পারে। এটি তথ্যের একটি সমস্যা- এই ধারণা যে মহাবিশ্বের প্রতিটি কণা এবং
প্রতিটি বলে তথ্য রয়েছে।
যেহেতু কৃষ্ণগহ্বরের কোনো লোম নেই,
বিজ্ঞানী জন হুইলার যেমনটি বলেছেন, বাইরে থেকে কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে কী আছে তা বলা
যাবে না, শুধুমাত্র এটির ভর, বৈদ্যুতিক আধান এবং ঘূর্ণন ছাড়া। এর মানে হচ্ছে যে
একটি কৃষ্ণগহ্বরে বাইরে থেকে লুকানো প্রচুর তথ্য রয়েছে। কিন্তু স্থানের একটি
অঞ্চলে কতোটুকু তথ্য জড়ো করা যায় তার একটি সীমা আছে। তথ্যের জন্য প্রয়োজন শক্তির,
এবং শক্তির ভর আছে আইনস্টাইনের বিখ্যাত সমীকরণ অনুসারে, E = mc2। তাই যদি স্থানের একটি অঞ্চলে খুব বেশি তথ্য থাকে তবে সেটি
একটি কৃষ্ণগহ্বরে পতিত হবে, এবং কৃষ্ণগহ্বরটির আকার তথ্যের পরিমাণকে প্রতিফলিত
করবে। এটি অনেকটা একটি পাঠাগারে বই এবং আরো বই স্তুপ করার মতন। অবশেষে, বইয়ের
তাকগুলো ক্ষান্ত দেবে এবং পাঠাগারটি ধসে বা পতিত হয়ে কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হবে।
যদি কৃষ্ণগহ্বরে লুকানো তথ্যের পরিমাণ এর
আকারের উপরের নির্ভর করে, তবে কেউ সাধারণ বিধি বা নীতি থেকে আশা করতে পারে যে
কৃষ্ণগহ্বরের তাপমাত্রা থাকবে এবং এটি একটি উত্তপ্ত ধাতব খণ্ডের মতন উজ্জ্বল বা
দীপ্ত হবে। কিন্তু এটি অসম্ভব, কারণ সবাই জানতো যে, কৃষ্ণগহ্বর থেকে কোনো কিছু বের
হতে পারে না। অথবা এটি মনে করা হতো।
এই সমস্যা ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত টিকে ছিলো,
যখন আমি কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞান অনুসারে কৃষ্ণগহ্বরের আশেপাশের বস্তুর আচরণ কী হবে তা
নিয়ে গবেষণা করছিলাম। অবাক করা ব্যাপার, আমি দেখলাম যে কৃষ্ণগহ্বর একটি নির্দিষ্ট
হারে কণা নির্গত করে। সেই সময়ের অন্য সকলের মতো, আমি এই বেদবাক্য স্বীকারে করে
নিয়েছিলাম যে একটি কৃষ্ণগহ্বর কোনো কিছু নির্গমন করতে পারে না। আমি তাই অনেক
চেষ্টা করলাম এই বিব্রতকর ফলাফল থেকে পরিত্রাণ পেতে। কিন্তু আমি এটি নিয়ে যতো
চিন্তা করতে লাগলাম, এটি ততো না-যেতে অস্বীকার করলো, এবং অবশেষে আমাকে এটিকে মেনে
নিতে হলো। এটি যে একটি ভৌত প্রক্রিয়া এই ব্যাপারে যা শেষ পর্যন্ত দৃঢ় বিশ্বাস
সৃষ্টি করেছিলো তা হচ্ছে যে এই নির্গত কণাগুলোর বর্ণালি রয়েছে যা ঠিক তাপীয়। আমার
হিসেব পূর্বাভাস করেছিলো যে একটি কৃষ্ণগহ্বর কণা এবং বিকিরণ সৃষ্টি এবং নির্গমন
করে, যেনো এটি একটি সাধারণ উত্তপ্ত বস্তু, তাপমাত্রা এটির পৃষ্ঠ মহাকর্ষের
আনুপাতিক এবং ভরের ব্যস্তানুপাতিক। এটি একটি কৃষ্ণগহ্বরের নির্দিষ্ট
বিশৃঙ্খলা-মাত্রা আছে, জ্যাকব বেকেনস্টাইনের এই সমস্যাযুক্ত প্রস্তাবকে পুরোপুরি
সামঞ্জস্যপূর্ণ করেছিলো, যেহেতু এটি বোঝায় যে একটি কৃষ্ণগহ্বর শূন্য ব্যতীত অন্য
কোনো নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় তাপীয় সাম্যাবস্থায় থাকতে পারে।
সেই সময় থেকে, কৃষ্ণগহ্বর যে তাপীয় বিকিরণ
করে তার গাণিতিক প্রমাণ বিভিন্ন জন বিভিন্ন পদ্ধতির মাধ্যমে নিশ্চিত করেছেন। এই
নির্গমনকে বোঝার একটি উপায় নিম্নরূপ। কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞান অনুসারে সমগ্র স্থান অসদ
(virtual) কণা এবং প্রতিকণার জোড়াসমূহ দ্বারা পরিপূর্ণ, যেগুলো জোড়ায় জোড়ায় প্রতিনিয়ত
বাস্তবে পরিণত হয়, আলাদা হয়, আবার একত্র হয় এবং পরস্পরকে ধ্বংস করে ফেলে। এই কণাগুলোকে
অসদ বলা হয়, কারণ, প্রকৃত কণার মতো, এগুলোকে সরাসরি কণা সনাক্তকরক যন্ত্র দ্বারা
পর্যবেক্ষণ করা যায় না। তাদের পরোক্ষ প্রভাব কিন্তু পরিমাপ করা যেতে পারে, এবং
তাদের অস্তিত্ব ল্যাম্ব অপসরণ (Lamb Shift) নামক ছোট অপসরণ দ্বারা নিশ্চিত
করা হয়েছে, যা তারা উত্তেজিত হাইড্রোজেন পরমাণু থেকে আলোর বর্ণালী শক্তিতে উৎপন্ন
করে। এখন, একটি কৃষ্ণগহ্বরের উপস্থিতিতে এই অসদ কণা-প্রতিকণা জোড়ার একটি হয়তো
কৃষ্ণগহ্বরে পতিত হতে পারে, ফলে অন্যটি পারস্পরিক ধ্বংসের জন্য প্রয়োজনীয় অংশীদার
ছাড়া থাকে। এই বিচ্ছিন্ন কণা অথবা প্রতিকণা হয়তো কৃষ্ণগহ্বরে পতিত হতে পারে এটির অংশীদারের
পিছু পিছু, কিন্তু এটি অসীমে পালিয়ে-ও যেতে বা মুক্তি পেতে-ও পারে, যেখানে এটিকে
কৃষ্ণগহ্বর দ্বারা নির্গত বিকিরণ বলে মনে হয়।
এই প্রক্রিয়াকে অন্যভাবে দেখার আরেকটি
উপায় হলো কণাগুলোর জোড়ার যে সদস্যটি কৃষ্ণগহ্বরে পতিত হয়, মনে করুন প্রতিকণাটি,
আসলে সময়ে অতীতের দিকে ভ্রমণকারী একটি কণা। তাই কৃষ্ণগহ্বরে প্রতিকণার পতনকে
কৃষ্ণগহ্বর থেকে বেরিয়ে আসা একটি কণা হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে তবে যেটি সময়ে অতীতের
দিকে ভ্রমণ করছে। যখন কণাটি সেই বিন্দুতে পৌঁছায় যেখানে কণা-প্রতিকণা জোড়া প্রথমে বাস্তবে
পরিণত হয়েছিলো, সেখানে এটি মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র দ্বারা বিক্ষিপ্ত হয়, যাতে এটি সময়ে
সামনের দিকে ভ্রমণ করে। সূর্যের ভরের সমান একটি কৃষ্ণগহ্বর এতো ধীর গতিতে কণা
নির্গমন করবে যে তা সনাক্ত করা অসম্ভব হবে। কিন্তু আরো ছোট আকারের কৃষ্ণগহ্বর
থাকতে পারে যেগুলোর ভর, ধরুন, একটি পাহাড়ের সমান। এগুলো মহাবিশ্বের প্রথম দিকে
গঠিত হয়ে থাকতে পারে, যখন মহাবিশ্ব বিশৃঙ্খল এবং অসম ছিলো। একটি পাহাড়-সমান
কৃষ্ণগহ্বর এক্স-রশ্মি এবং গামা-রশ্মি নির্গমন করবে, প্রায় এক মিলিয়ন মেগাওয়াট
হারে, যা মহাবিশ্বের বৈদ্যুতিক চাহিদা মেটানোর জন্য যথেষ্ট। তবে একটি ছোট
কৃষ্ণগহ্বর ব্যবহার করা বা আয়ত্ত করা সহজ হবে না। আপনি এটাকে একটি বৈদ্যুতিক
কেন্দ্রে রাখতে পারবেন না কারণ এটি মেঝে ফুড়ে পড়ে যাবে এবং পৃথিবীর কেন্দ্রে গিয়ে
পড়বে। যদি আমাদের এইরকম একটি কৃষ্ণগহ্বর থাকতো, তবে এটিকে ধরে রাখার একমাত্র উপায়
হতো এটিকে পৃথিবীর চারপাশে কক্ষপথে রাখা।
লোকজন এই ভরের একটি কৃষ্ণগহ্বর খুঁজছে,
কিন্তু এখনো পর্যন্ত একটিও পায় নি। এটি একটি দুঃখজনক ব্যাপার, কারণ যদি তারা খুঁজে
পেতো তবে আমি একটি নোবেল পুরস্কার পেতাম। কিন্তু আরেকটি সম্ভাবনা হচ্ছে যে আমরা
হয়তো স্থান-কালের অতিরিক্ত মাত্রায় একটি ক্ষুদ্র কৃষ্ণগহ্বর তৈরি করতে সক্ষম হতে
পারি। কিছু তত্ত্ব অনুসারে, আমরা যে মহাবিশ্ব অনুভব করি সেটি মূলত দশ অথবা
এগার-মাত্রিক স্থানে একটি চার-মাত্রিক পৃষ্ঠ। ইন্টারস্টেলার (Interstellar)
চলচ্চিত্রটিতে এই ধরণের কিছু ধারণা আছে। আমরা এই অতিরিক্ত মাত্রাগুলো দেখতে পাই
না, কারণ আলো সেগুলোর মধ্য দিয়ে যায় না কিন্তু শুধুমাত্র আমাদের মহাবিশ্বের চারটি
মাত্রার মধ্য দিয়ে যায়। তবে মাধ্যাকর্ষণ অতিরিক্ত মাত্রাগুলোকে প্রভাবিত করবে এবং আমাদের
মহাবিশ্বের তুলনায় অনেক শক্তিশালী হবে। তাই অতিরিক্ত মাত্রায় একটি ক্ষুদ্র
কৃষ্ণগহ্বর তৈরি করা সহজ হবে। সুইজারল্যান্ডের সার্নে (CERN)
এলএইচসিতে (LHC) এটি হয়তো পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হতে পারে।
এটি ২৭ কিলিমিটার দীর্ঘ একটি বৃত্তাকার সুড়ঙ্গ নিয়ে গঠিত। কণাসমূহের দুটো রশ্মি (beam) দুই দিক থেকে এই সুড়ঙ্গ ধরে ভ্রমণ করে এবং সংঘর্ষিত হয়। এই ধরণের
সংঘর্ষের কিছু কিছু ক্ষুদ্র কৃষ্ণগহ্বর তৈরি করতে পারে। ফলে কণাগুলো এমন একটি প্যাটার্নে
বিকিরিত হবে যে সেটি সনাক্তকরণ সহজ হবে। তাই আমি একটি নোবেল পুরস্কার অবশেষে পেতেই
পারি।*
একটি কৃষ্ণগহ্বর থেকে কণা নির্গমনের ফলে
কৃষ্ণগহ্বরটি ভর হারাবে এবং সংকুচিত হবে। এটি কণাসমূহের নির্গমনের হারকে আরো
বাড়াবে। অবশেষে, কৃষ্ণগহ্বর নিজের সমস্ত ভর হারাবে এবং উবে যাবে বা বিলীন হয়ে
যাবে। তবে কৃষ্ণগহ্বরে পতিত সকল কণাসমূহ এবং দুর্ভাগা মহাকাশচারীদের ভাগ্যে কী
ঘটে? তারা পুনরায় উত্থিত হতে পারবে না যখন কৃষ্ণগহ্বর বিলীন হয়ে যায়। কৃষ্ণগহ্বর
থেকে যে কণাগুলো নির্গত হয় সেগুলো সম্পূর্ণরূপে বিক্ষিপ্ত মনে হয় এবং যে জিনিস
পতিত হয়েছে সেটির সাথে সম্পর্কিত বলে মনে হয় না। এটি মনে হয় যে কী পতিত হয়েছে সেই
সম্পর্কিত তথ্য হারিয়ে যায়, শুধু মোট ভর এবং ঘূর্ণনের পরিমাণ ব্যতীত। কিন্তু যদি
তথ্য হারিয়েই যায় তবে সেটি একটি গুরুতর সমস্যা উত্থাপন করে যা আমাদের বিজ্ঞানের
বোঝার অন্তরে আঘাত করে। ২০০ বছরের অধিক সময় ধরে, আমরা বৈজ্ঞানিক নিয়তিবাদে বিশ্বাস
করেছি- অর্থাৎ, বিজ্ঞানের বিধিসমূহ বা সূত্রাবলি মহাবিশ্বের বিবর্তনকে নির্ধারণ
করে।
যদি কৃষ্ণগহ্বরে তথ্য বাস্তবিকই হারিয়ে
যায়, তবে আমরা ভবিষ্যতকে পূর্বাভাস করতে পারবো না, কারণ কৃষ্ণগহ্বর যে কোনো
সম্ভারের কণাসমূহ নির্গত করতে পারে। এটি একটি ভালো টেলিভিশন কিংবা শেক্সপীয়ারের
সম্পূর্ণ কাজের চামড়া-আবৃত সংগ্রহ নির্গমন করতে পারে, যদিও এই ধরণের চমকপ্রদ
নির্গমনের সম্ভাবনা খুব কম। এটির তাপীয় বিকিরণ নির্গমন করার সম্ভাবনা বেশি, অনেকটা
লাল-উত্তপ্ত ধাতু থেকে ভাস বা আভা নির্গমনের মতন। এটি মনে হতে পারে যে আমরা যদি
কৃষ্ণগহ্বর থেকে কী নির্গমন হবে তা পূর্বাভাস করতে না পারি তবে কিছু যায় আসে না।
আমাদের চারপাশে কোনো কৃষ্ণগহ্বর নেই। কিন্তু এটি একটি নীতির ব্যাপার। যদি বৈজ্ঞানিক
নিয়তিবাদ, মহাবিশ্বের পূর্বাভাস করার ক্ষমতা, কৃষ্ণগহ্বরের ক্ষেত্রে ভেঙে পড়ে, তবে
এটি অন্যান্য ক্ষেত্রে-ও ভেঙে পড়তে পারে। অসদ কৃষ্ণগহ্বর থাকতে পারে যেগুলো শূন্যস্থানে
তারতম্যে আবির্ভূত হতে পারে, এক সেট কণাকে শোষণ করে, অন্য সেটকে নির্গত করে,
শূন্যস্থানে আবার বিলীন হয়ে যেতে পারে। এমনকি আরো বাজে, যদি নিয়তিবাদ ভেঙে পড়ে,
তবে আমরা আমাদের অতীত ইতিহাস সম্পর্কে নিশ্চিত হতে-ও পারবো না। ইতিহাসের পুস্তক
এবং আমাদের স্মৃতিসমূহ কেবলই বিভ্রম হতে পারে। অতীত আমাদের বলে যে আমরা কে। এটি
ছাড়া, আমরা আমাদের পরিচয় হারিয়ে ফেলি।
এটি তাই নির্ণয় করা গুরুত্বপূর্ণ ছিলো যে
কৃষ্ণগহ্বরে তথ্য বাস্তবিকই হারিয়ে যায় কিনা, অথবা এটি কোনো কায়দায় পুনরুদ্ধার করা
যেতে পারে কিনা। অনেক বিজ্ঞানী অনুভব করেছেন যে তথ্যের হারিয়ে যাওয়া উচিত
নয়, কিন্তু দীর্ঘ বছর ধরে কেউ কোনো প্রক্রিয়া প্রস্তাব করতে পারে নি যার মাধ্যমে
এটি সংরক্ষিত থাকতে পারে। তথ্যের এই আপাত বিনাশ, যা তথ্য-বিনাশ আপার্তবৈপরীতা নামে পরিচিত,
গত চল্লিশ বছর ধরে বিজ্ঞানীদের সমস্যায় ফেলেছে এবং এখনো তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে অমীমাংসিত
সমস্যাগুলোর অন্যতম হিসেবে রয়েছে।
সাম্প্রতিককালে, তথ্য-বিনাশ আপার্তবৈপরীতার সম্ভাব্য
সমাধানে আগ্রহ পুনরুজ্জীবিত হয়েছে কারণ কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞান এবং মাধ্যাকর্ষণের
একীকরণের ক্ষেত্রে নতুন আবিষ্কার হয়েছে। এই সাম্প্রতিক সাফল্যের কেন্দ্রস্থলে
রয়েছে স্থান-কালের প্রতিসাম্য বুঝতে পারা।
মনে করুন যে কোনো মাধ্যাকর্ষণ ছিলো না এবং
স্থান-কাল সম্পূর্ণরূপে সমতল ছিলো। এটি একটি সম্পূর্ণ বৈশিষ্ট্যহীন মরুভূমির মতো
হবে। এই ধরণের জায়গার দুই ধরণের প্রতিসাম্য আছে। প্রথমটিকে বলা হয় স্থানান্তরণ
প্রতিসাম্য (translation symmetry)। যদি আপনি মরুভূমির এক বিন্দু থেকে অন্য বিন্দুতে গেলেন, তবে
আপনি কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করবেন না। দ্বিতীয় প্রতিসাম্য হচ্ছে ঘূর্ণন প্রতিসাম্য
(rotation
symmetry)। যদি আপনি মরুভূমির কোথাও দাঁড়িয়ে থাকেন এবং ঘুরতে শুরু করেন, তবে আপনি যা
দেখছেন তাতে কোনো পার্থক্য লক্ষ্য করবেন না। এই প্রতিসাম্যগুলো “সমতল” (flat) স্থান-কালে-ও পাওয়া যায়, কোনো পদার্থ
বা বস্তুর অনুপস্থিতিতে যে স্থান-কাল হয়।
যদি কেউ এই মরুভূমিতে কিছু রাখে, তবে এই
প্রতিসাম্যসমূহ ভেঙে পড়বে। মনে করুন, মরুভূমিতে একটি পাহাড়, একটি মরুদ্যান, এবং
কিছু ফণীমনসা ছিলো, তবে এটি বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন দিক থেকে বিভিন্ন রকম দেখাবে।
স্থান-কালের ক্ষেত্রে-ও এটি সত্য। যদি কেউ স্থান-কালে একটি বস্তু রাখে, তবে স্থানান্তরণ
প্রতিসাম্য এবং ঘূর্ণন প্রতিসাম্য ভেঙে পড়ে। এবং স্থান-কালে বিভিন্ন বস্তু যোগ
করার ফলেই মাধ্যাকর্ষণের সৃষ্টি হয়।
কৃষ্ণগহ্বর হচ্ছে স্থান-কালে একটি অঞ্চল
যেখানে মাধ্যাকর্ষণ অনেক শক্তিশালী, স্থান-কাল সেখানে প্রচণ্ডভাবে বিকৃত, এবং তাই
এটা আশা করা যায় যে এটির প্রতিসাম্যসমূহ ভাঙা। কিন্তু, যখন একজন কৃষ্ণগহ্বর থেকে
দূরে সরতে থাকে স্থান-কালের বক্রতা কমতে থাকে। কৃষ্ণগহ্বরের অনেক অনেক দূর থেকে
দেখতে স্থান-কালকে অনেকটাই সমতল স্থান-কালের মতন দেখায়।
১৯৬০ এর দশকে, হারম্যান বন্ডি (Hermann Bondi), কেনিথ মেটজনার (A. W. Kenneth Metzner), ভ্যান ডার
বার্গ (M. G. J. van der Burg) এবং রেইনার স্যাক (Rainer
Sachs) একটি সত্যিকারের উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার করেছিলেন যে যেকোনো
বস্তু বা পদার্থ থেকে অনেক দূরে স্থান-কালের অতিস্থানান্তকরণ (supertranslations) নামে পরিচিত প্রতিসাম্যসমূহের একটি সসীম সম্ভার আছে। এই প্রতিসাম্যগুলোর
প্রত্যেকটি অতিস্থানান্তকরণ আধান (supertranslation charges)
নামক একটি সংরক্ষিত রাশির (conserved quantity) সাথে
সম্পর্কিত। একটি সংরক্ষিত রাশি হচ্ছে যা ব্যবস্থার বিকাশের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়
না। এইগুলো হচ্ছে আরো পরিচিত সংরক্ষিত রাশির সাধারণীকরণ:
উদাহরণস্বরূপ, যদি সময়ে স্থান-কালের পরিবর্তন না হয়, তবে শক্তি সংরক্ষিত হয়। যদি
স্থান-কাল স্থানের বিভিন্ন বিন্দুতে একই রকম দেখায় তবে গতিবেগ সংরক্ষিত হয়।
অতিস্থানান্তকরণের আবিষ্কার সম্পর্কে যা
অসাধারণ ছিলো তা হচ্ছে যে একটি কৃষ্ণগহ্বর থেকে দূরে একটি অসীম সংখ্যক অনেকগুলো
সংরক্ষিত রাশি রয়েছে। এই সংরক্ষণ নীতি বা সূত্রসমূহ মহাকর্ষীয় পদার্থবিজ্ঞানের
প্রক্রিয়াতে একটি অসাধারণ এবং অপ্রত্যাশিত অন্তর্দৃষ্টি দিয়েছে।
২০১৬ সালে আমার সহযোগী ম্যালকম পেরি (Malcolm Perry) এবং অ্যান্ডি স্ট্রোমিংগার (Andy Strominger) মিলে আমি
এই নতুন ফলাফলগুলোর সাথে সম্পর্কিত সংরক্ষিত রাশিসমূহ নিয়ে কাজ করছিলাম তথ্য-বিনাশ
আপার্তবৈপরীতার একটি
সম্ভাব্য সমাধান বের করার জন্য। আমরা জানি যে কৃষ্ণগহ্বরগুলোর তিনটি স্পষ্টভাবে
প্রতীয়মান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সেগুলোর ভর, আধান, এবং কৌণিক ভরবেগ। এই ব্যাপারগুলো
দীর্ঘদিন ধরে উপলব্ধ হয়েছে। কিন্তু, কৃষ্ণগহ্বরগুলো অতিস্থানান্তকরণ আধান-ও বহন
করে। সুতারাং সম্ভবত কৃষ্ণগহ্বরগুলোর আমরা প্রথমে যা চিন্তা করেছিলাম তার চেয়ে আরো
অনেক কিছু আছে। তারা “লোমহীন” নয় কিংবা তাদের শুধু তিনটি “লোম” আছে এইরকম নয়, কিন্তু আসলে তাদের অনেক অতিস্থানান্তকরণ লোম
(supertranslation
hair) আছে।
এই অতিস্থানান্তকরণ লোমে হয়তো
কৃষ্ণগহ্বরের মধ্যে কী আছে সেই সম্পর্কে কিছু তথ্য সংকেতাক্ষরে থাকতে পারে। এটি
হতে পারে যে এই অতিস্থানান্তকরণ আধানগুলোর মধ্যে সব তথ্য না-ও থাকতে পারে, কিন্তু
বাদবাকি তথ্যগুলো হয়তো অন্যান্য সংরক্ষিত রাশিসমূহ, যেমন অতিঘূর্ণন আধানসমূহে (superrotation charges) থাকতে পারে, যা অতিঘূর্ণনসমূহ (superrotations)
নামক প্রতিসাম্যসমূহের সাথে সম্পর্কিত। অতিঘূর্ণন এখনো পর্যন্ত ভালোভাবে উপলব্ধ
নয়। যদি এটি সঠিক হয়ে থাকে, এবং একটি কৃষ্ণগহ্বরের সমস্ত তথ্য এটির “লোমগুলোর” মাধ্যমে বোঝা যায়, তবে সম্ভবত তথ্যের কোনো বিনাশ নেই বা তথ্য
হারিয়ে যায় না। এই ধারণাগুলো আমাদের অতিসাম্প্রতিক গণনা থেকে নিশ্চয়তা পেয়েছে।
স্ট্রোমিংগার, পেরি, আমি, এবং একজন স্নাতকোত্তর ছাত্র সাশা হাকো (Sasha Haco) মিলে আবিষ্কার করেছি যে এই অতিঘূর্ণন আধানগুলো একটি কৃষ্ণগহ্বরের সমস্ত
বিশৃঙ্খলা-মাত্রাকে ব্যাখ্যা করতে পারে। তাই কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞান কাজ করে, এবং
তথ্য ঘটনাদিগন্তে, কৃষ্ণগহ্বরের পৃষ্ঠে সংরক্ষিত থাকে।
কৃষ্ণগহ্বরগুলোকে এখনো শুধুমাত্র এগুলোর
ভর, ঘটনাদিগন্তের বাইরে বৈদ্যুতিক আধান এবং ঘূর্ণন দ্বারা চিহ্নিত করা হয় কিন্তু
ঘটনাদিগন্ত নিজেকেই তথ্য বহন করে যা আমাদের কৃষ্ণগহ্বরের এই তিনটি বৈশিষ্ট্যাবলির
চেয়ে-ও বেশি বলতে পারে কৃষ্ণগহ্বরে কী পতিত হয়েছে সেই সম্পর্কে। বিজ্ঞানীরা এখনো
এই বিষয়ের উপর কাজ করছেন এবং তথ্য-বিনাশ আপার্তবৈপরীতা এখনো অমীমাংসিত। কিন্তু
আমি আশাবাদি যে আমরা একটি সমাধানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। দেখে রাখুন।
* নোবেল পুরষ্কার
মৃত্যুবরণের পরে দেয়া সম্ভব না, তাই দুঃখজনকভাবে এই উচ্চাকাঙ্ক্ষা এখন আর কখনো
ফলপ্রসূ হবে না।
কৃষ্ণগহ্বরে পড়ে যাওয়া
কি একজন মহাকাশচারীর জন্য খারাপ খবর?
নিশ্চিতভাবে
খারাপ খবর। যদি এটি একটি নাক্ষত্রিক ভরের কৃষ্ণগহ্বর হয়ে থাকে, তবে আপনি ঘটনাদিগন্তে
পৌঁছার আগেই সেমাই হয়ে যাবেন। অন্যদিকে, এটি যদি বিশাল ভরের কৃষ্ণগহ্বর হয়ে থাকে,
তবে আপনি দিগন্তে পৌঁছাতে পারবেন সহজেই, কিন্তু এককত্বে আপনার অস্তিত্ব চূর্ণ হয়ে
যাবে।
No comments:
Post a Comment