কীভাবে সব শুরু হয়েছিলো?
হ্যামলেট বলেছে, “আমি বাদামের খোসায় আবদ্ধ হতে পারি, এবং নিজেকে অসীম মহাকাশের
রাজা হিসেবে-ও
গণ্য করতে পারি।” আমি মনে করি সে আসলে বলতে
চেয়েছিলো যে আমরা মানুষেরা শারীরিকভাবে বেশ সীমিত, বিশেষ করে
আমার নিজের ক্ষেত্রে, কিন্তু আমাদের
মন সমগ্র মহাবিশ্ব অন্বেষণে, এবং যেখানে স্টার ট্রেক (Star Trek) পদস্থাপনে ভয়
পায় সেখানে-ও
সাহসীভাবে যেতে মুক্ত। মহাবিশ্ব কি আসলেই অসীম, নাকি শুধু খুব বিশাল? এর কি কোনো
সূচনা ছিলো? এটি কি চিরদিনের জন্য স্থায়ী নাকি শুধু কিছু সময়ের জন্য? কীভাবে
আমাদের সসীম মন অসীম মহাবিশ্বকে বুঝতে পারে? সেই চেষ্টা করা কি আমাদের জন্য
দাম্ভিকতা নয়?
প্রমিথিউস (Prometheus), যিনি
কিনা মানুষের ব্যবহারের জন্য প্রাচীন দেবতাদের কাছ থেকে আগুন চুরি করেছিলেন, এর ভাগ্য
ভারাক্রান্ত করার ঝুঁকি নিয়ে, আমি বিশ্বাস
করি আমরা পারি, এবং আমাদের উচিত, মহাবিশ্বকে বোঝার চেষ্টা করা। প্রমিথিউসের শাস্তি
ছিলো চিরকালের জন্য একটি শিলার সাথে শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে থাকা, যদিও আনন্দের সাথে
অবশেষে তিনি হারকিউলিসের মাধ্যমে মুক্ত হয়েছিলেন। আমরা মহাবিশ্বকে বোঝার ক্ষেত্রে
ইতিমধ্যে অসাধারণ অগ্রগতি করেছি। আমাদের এখনো একটি সম্পূর্ণ ছবি নেই। আমি চিন্তা
করতে পছন্দ করি যে আমরা খুব বেশি দূরে-ও না।
মধ্য আফ্রিকার বসোংগো (Boshongo) জনগণের মতে, সৃষ্টির
শুরুতে শুধু ছিলো অন্ধকার, জল, এবং মহান দেবতা বাম্বা (Bumba)। একদিন বাম্বা
পেট ব্যাথার কারণে সূর্যকে বমি করে দিলেন। সূর্য কিছু জলকে শুকিয়ে ফেললো, ফলে ভূমির সৃষ্টি হলো। তখনো
ব্যথায় কাতর, বাম্বা বমি করলেন চাঁদা, নক্ষত্রসমূহ, এবং তারপরে কিছু জন্তুজানোয়ার-
চিতাবাঘ, কুমির, কচ্ছপ এবং অবশেষে মানুষ।
সৃষ্টির এইসব পৌরণিক কথা গল্প, অনেকের মতো,
আমরা যে সব প্রশ্ন করি সেগুলো উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করে। আমরা এখানে কেনো? আমরা
কোথা থেকে এসেছি? সাধারণভাবে উত্তর দেওয়া হয়েছিলো যে মানুষ তুলনামূলকভাবে সাম্প্রতিক কালে উদ্ভূত হয়েছে কারণ এটি অবশ্যই স্পষ্ট ছিলো
যে মানবজাতি তখনো তার
জ্ঞান ও প্রযুক্তি উন্নত করছে। সুতারাং মানবজাতি দীর্ঘ সময় ধরে উদ্ভূত নয় কারণ তাহলে মানবজাতি আরো বেশি অগ্রগতি লাভ করতো। উদাহরণস্বরূপ,
বিশপ আসশার (Bishop Ussher) এর মতে, আদিপুস্তক (the Book of Genesis) সময়ের শুরু হিসেবে নির্ধারণ করেছিলো ২২ অক্টোবর, ৪০০৪
খ্রিস্টপূর্বাব্দ, সন্ধ্যা ছয়টা বাজে। অন্যদিকে, ভৌত চারপাশ, যেমন পাহাড়পর্বত এবং
নদীনালা, মানুষের জীবনকালে খুব কম পরিবর্তিত হয়। অতএব মনে করা হলো যে সেইসব ধ্রুবক
পটভূমি, এবং হয়তো খালি
ভূ-অঞ্চলগুলো
সর্বদা ছিলো, নয়তো মানুষের মতো একই সময়ে সৃষ্টি করা হয়েছিলো।
মহাবিশ্বের যে একটি সূচনা ছিলো এই ধারণা
নিয়ে সবাই কিন্তু খুশি ছিলেন না। যেমন, গ্রীক দার্শনিকদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত
অ্যারিস্টটল বিশ্বাস করেছিলেন যে মহাবিশ্ব চিরকাল ধরে বিদ্যমান ছিলো। কিছু সৃষ্টি
হয়েছে এই ধারণার চেয়ে কোনো কিছু
শাশ্বত এই ধারণা বেশি
নিখুঁত। তিনি প্রস্তাব করেছিলেন যে আমরা যে অগ্রগতি দেখতে পাই তার কারণ হচ্ছে যে
বন্যা, অথবা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগসমূহ সভ্যতাকে বারবার পেছনে শুরুর দিকে নিয়ে গিয়েছিলো। এক শাশ্বত
মহাবিশ্বে বিশ্বাস করার প্রেরণা ছিলো মহাবিশ্বের সৃষ্টি এবং এটির চালুর জন্য
দরকারী ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপের ধারণা এড়ানো। বিপরীতভাবে, যারা বিশ্বাস করেছিলেন যে
মহাবিশ্বের সূচনা ছিলো তারা এই ধারণাকে ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষের যুক্তির জন্য মহাবিশ্বের প্রথম
কারণ বা প্রধান প্রস্তাবক (prime
mover) হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন।
যদি কেউ বিশ্বাস করে থাকেন যে মহাবিশ্বের
সূচনা ছিলো, তবে সুস্পষ্ট প্রশ্ন হচ্ছে যে,
“শুরুর
আগে কী হয়েছিলো? মহাবিশ্ব তৈরির আগে ঈশ্বর কী করছিলেন? তিনি কি যারা এইসব প্রশ্ন
করছে তাদের জন্য নরক প্রস্তুত করছিলেন?” মহাবিশ্বের শুরু ছিলো কি ছিলো
না এই সমস্যা জার্মান দার্শনিক ইম্মানুয়েল কান্টের (Immanuel Kant) মাথাব্যথার
কারণ ছিলো। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন
যে উভয় ক্ষেত্রেই
যৌক্তিক দ্বন্দ্ব (logical
contradiction) বা খাদ (antimony) ছিলো।
যদি মহাবিশ্বের শুরুই থেকে থাকে তবে এটি কেনো শুরুর আগে অসীম সময় অপেক্ষা করেছিলো?
তিনি এই বক্তব্যকে বললেন থিসিস। অন্যদিকে, যদি মহাবিশ্ব অন্তত কাল ধরে বিদ্যমান
থেকেই থাকে, তবে বর্তমান অবস্থায় পৌঁছানোর আগে এটি অসীম সময় নিলো কেনো? তিনি এই
বক্তব্যকে বললেন অ্যান্টিথিসিস। প্রায় সবার ক্ষেত্রে যেমন, থিসিস এবং
অ্যান্টিথিসিস নির্ভর করেছিলো কান্টের অনুমিতির (assumptions) উপর, যে সময় ছিলো পরম বা প্রকৃত (absolute) কিছু। অর্থাৎ, বিদ্যমান অথবা
বিদ্যমান নয় এমন
যেকোনো মহাবিশ্বে সময় অসীম
অতীত থেকে অসীম ভবিষ্যতে স্বাধীনভাবে বয়ে গিয়েছে।
আজকালকার অনেক বিজ্ঞানীর মনে-ও এই ধারণা।
কিন্তু ১৯১৫ সালে আইনস্টাইন তার বৈপ্লবিক আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব প্রকাশ
করেছিলেন। এই তত্ত্বে, স্থান এবং সময় আর পরম বা প্রকৃত কিছু ছিলো না, ঘটনাবলির জন্য আর একটি
নির্দিষ্ট পটভূমি হিসেবে ছিলো না। বরং সেগুলো মহাবিশ্বের বস্তু এবং শক্তি দ্বারা
নির্ধারিত গতিশীল রাশিমালা (dynamical
quantities)। সেগুলো শুধুমাত্র মহাবিশ্বের মধ্যে সংজ্ঞায়িত, তাই মহাবিশ্বের শুরুর আগের সময় নিয়ে কথা
বলার কোনো মানে হয় না। এটি দক্ষিণ মেরুর দক্ষিণে একটি বিন্দু সম্পর্কে জিজ্ঞাসা
করার মতো হবে। যা
সংজ্ঞায়িত নয়।
যদিও আইনস্টাইনের তত্ত্ব সময় এবং স্থানকে একত্রিত
করেছে, তবে এটি স্থান সম্পর্কে আমাদের অনেক কিছুই জানায় নি। স্থান সম্পর্কে একটি
সুস্পষ্ট ব্যাপার মনে হয় যে এটি ছড়িয়ে আছেই তো আছেই। আমরা প্রত্যাশা করি না যে
মহাবিশ্ব এটি একটি ইটের দেয়ালে গিয়ে শেষ হবে, যদিও এটি না-ও হওয়ার-ও কোনো যৌক্তিক
কারণ নেই। কিন্তু হাবল মহাকাশ দূরবীনের (Hubble
space telescope) মতো আধুনিক যন্ত্রপাতিসমূহ আমাদের স্থানের বা মহাকাশের
গভীরে অনুসন্ধানের সুযোগ দেয়। আমরা যা দেখি তা হচ্ছে যে কোটি কোটি এবং কোটি কোটি
ছায়াপথ (galaxies), বিভিন্ন আকার আয়তনের। বিভিন্ন বিশাল
উপবৃত্তাকার ছায়াপথ আছে, এবং আমাদের ছায়াপথের মতো সর্পিলাকার ছায়াপথ-ও আছে।
প্রতিটি ছায়াপথে আছে কোটি কোটি এবং কোটি কোটি নক্ষত্র, যেগুলোর অনেকগুলোর চারপাশে
গ্রহগুলো আবর্তন করে। আমাদের নিজেদের ছায়াপথ কিছু নির্দিষ্ট দিকে আমাদের দেখার
সুযোগে বাধা সৃষ্টি করে, কিন্তু এছাড়া কিছু স্থানীয় ঘন অবস্থা এবং শূন্যতা ছাড়া ছায়াপথগুলো
মহাবিশ্বের বিভিন্ন স্থানে মোটামুটি সমভাবে (uniformly) ছড়িয়ে আছে। অনেক বেশি দূরের
ছায়াপথগুলোর ঘনত্ব কম বলে মনে হয়, কিন্তু এটি মনে হয় কারণ যে সেগুলো এতো বেশি দূরে
এবং অস্পষ্ট (অনুজ্জ্বল) যে আমরা ঠিক করে ঠাহর করতে বা বুঝতে পারি না। যতোদূর বলা
যায়, মহাবিশ্ব মহাশূন্যে ছড়িয়ে আছেই তো আছেই এবং মোটামুটি একইভাবে ছড়িয়ে আছে যতো
দূরেই ছড়িয়ে থাকুক না কেনো।
যদিও মহাশূন্যের প্রতিটি অবস্থানে
মহাবিশ্বকে একই মনে হয়, এটি অবশ্যই সময়ের সাথে পরিবর্তিত হচ্ছে। গত শতাব্দীর প্রথম
দিকের আগে পর্যন্ত কেউ এটি উপলব্ধি করে নি। মনে করা হতো যে মহাবিশ্ব সব সময়ে মূলত
ধ্রুব ছিলো। এটি যদি একটি অসীম সময় ধরে বিদ্যমান থেকে থাকে, তবে এটি একটি অদ্ভুত
সিদ্ধান্তের দিকে নির্দেশ করে। যদি নক্ষত্রসমূহ অসীম সময় ধরে তাপ বিকিরণ করে থেকে
থাকে, তবে তারা মহাবিশ্বকে তাদের বর্তমান তাপমাত্রায় আসা পর্যন্ত উত্তপ্ত করে
থাকবে। এমনকি, রাতে-ও সমগ্র আকাশ সূর্যের মতন উজ্জ্বল হয়ে থাকবে, কারণ যেদিকে চোখ
রাখবেন সেটি হয়তো কোনো নক্ষত্র অথবা ধুলোর কোনো মেঘ হবে যেগুলো ওই নক্ষত্রগুলোর
সমান উত্তপ্ত হওয়া পর্যন্ত উত্তপ্ত হয়ে উঠছিলো। তাই আমরা রাতের আকাশ যে অন্ধকার
দেখি এই পর্যবেক্ষণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি নির্দেশে করে যে মহাবিশ্ব আমরা আজ
যেভাবে দেখতে পাচ্ছি সেভাবে সর্বদা বিদ্যমান থেকে থাকতে পারে না। অতীতে একটি
নির্দিষ্ট সময় পূর্বে নক্ষত্রগুলোকে চালু করার জন্য নিশ্চিত কিছু ঘটেছিলো। নতুবা
দূরবর্তী নক্ষত্রগুলো থেকে আসা আলো আমাদের কাছে এখনো এসে পৌঁছানোর সময় পেতো না।
এটি ব্যাখ্যা করে
কেনো রাতের আকাশ সব দিকে জ্বলজ্বল করে না।
যদি নক্ষত্রসমূহ সেখানে সর্বদা থেকেই থাকে,
তবে কেনো তারা কয়েক বিলিয়ন বছর আগে হঠাৎ করে জ্বলে উঠেছিলো? কী সেই ঘড়ি ছিলো যা
তাদের নির্দেশ করেছিলো যে জ্বলে ওঠার তখনই সময়? এটি ইম্মানুয়েল কান্টের মতন
দার্শনিকদেরকে ধাঁধায় ফেলেছিলো, তারা বিশ্বাস করতেন যে মহাবিশ্ব চিরকাল ধরে
বিদ্যমান ছিলো। কিন্তু অধিকাংশ মানুষের জন্য এটি মহাবিশ্বকে সৃষ্টি করা হয়েছে এই
ধারণার সাথে মিলে, মাত্র কয়েক হাজার বছর আগে যেমন বিশপ আসশার সিদ্ধান্তে উপনীত
হয়েছিলেন তেমন। কিন্তু
এই ধারণার মধ্যে বৈপরীত্য দেখা শুরু হয়েছিলো ১৯২০ সালে মাউন্ট উইলসনে (Mount Wilson) অবস্থিত
শত-ইঞ্চি দূরবীনে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে। প্রথমত, এডুইন হাবল (Edwin Hubble)
আবিস্কার করেছিলেন যে আলোর অনেক অস্পষ্ট টুকরো, যেগুলো নীহারিকা
নামে পরিচিত, অন্যান্য ছাপাপথগুলো আসলে, আমাদের সূর্যের মতন অগণিত
নক্ষত্রের পুঞ্জ, কিন্তু খুব দূরে অবস্থিত। তাদের এতো ক্ষুদ্র এবং অস্পষ্ট দেখানো জন্য তাদের অবস্থান এতো
দূরে হওয়া দরকার যে তাদের কাছ থেকে আমাদের কাছে আলো আসার জন্য মিলিয়ন মিলিয়ন অথবা
বিলিয়ন বিলিয়ন বছর লাগবে। এটি নির্দেশ করে যে মহাবিশ্বের সূচনা মাত্র কয়েক হাজার
বছর আগে হতে পারে না।
কিন্তু দ্বিতীয় যে ব্যাপারটি হাবল আবিষ্কার
করেছিলেন তা আরো অসাধারণ ছিলো। অন্যান্য ছায়াপথগুলো থেকে আসা আলো বিশ্লেষণ করে
হাবল পরিমাপ করতে পেরেছিলেন যে সেগুলো
আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে না কি আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। তার কাছে
দুর্দান্তভাবে অবাক করা ব্যাপার যে তিনি দেখতে পেলেন যে প্রায় সবগুলো ছায়াপথ
আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। অন্য কথায়, মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে। ছায়াপথগুলো
একে অন্যের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের আবিস্কার বিংশ
শতাব্দীর গুরুত্বপূর্ণ বৌদ্ধিক বিপ্লবগুলোর অন্যতম ছিলো। এটি সম্পূর্ণ আশ্চর্যজনক ব্যাপার হিসেবে ধরা দিয়েছিলো, এবং
মহাবিশ্বের সূচনা সম্পর্কে আলোচনা পুরোপুরি পাল্টে দিয়েছিলো। যদি ছায়াপথগুলো পরষ্পর
থেকে সরেই যাচ্ছে, তবে নিশ্চিত তারা অতীতে পরষ্পরের নিকটে ছিলো। বর্তমান সময়ের
সম্প্রসারণের হার থেকে, আমরা গণনা করতে পারি যে তারা পরষ্পরের আরো খুব নিকটে
ছিলো, বাস্তবিকভাবেই, ১০ থেকে ১৫ বিলিয়ন বছর আগে। সুতারাং মনে হচ্ছে যে মহাবিশ্ব
তখন শুরু হয়ে থাকতে পারে, সবকিছু স্থানে একই অবস্থান থেকে।
কিন্তু অনেক বিজ্ঞানী মহাবিশ্বের শুরু থাকতে
পারে এই ধারণা নিয়ে অসন্তুষ্ট ছিলেন, কারণ এটি মনে হচ্ছিলো যে সেইসময়ে পদার্থবিদ্যা ভেঙে পড়েছে। মহাবিশ্বের
সূচনা কীভাবে হয়েছিলো তা নির্ধারণ করার জন্য আপনাকে একটি বহিঃস্থ সংস্থাকে আবাহন করতে
হবে, যাকে সুবিধার জন্য ঈশ্বর হিসেবে ডাকতে পারেন। ফলে তারা এইসব তত্ত্ব প্রস্তাব ও উন্নত করতে
লাগলেন যেগুলোতে মহাবিশ্ব বর্তমান সময়ের মতো প্রসারিত হচ্ছিলো, কিন্তু কোনো শুরু
ছিলো না। এইসব তত্ত্বের অন্যতম ছিলো ১৯৪৮ সালে হারম্যান বন্ডি (Hermann Bondi), থমাস
গোল্ড (Thomas Gold), এবং ফ্রেড হোয়েল (Fred
Hoyle) দ্বারা প্রস্তাবিত স্থির-অবস্থা তত্ত্ব (Steady-state
theory)।
ধারণা এই যে, স্থির-অবস্থা তত্ত্বে, ছায়াপথগুলো
যখন দূরে সরে
যাচ্ছিলো, মহাবিশ্বের সর্বত্র ক্রমাগতভাবে সৃষ্টি হওয়া বস্তু থেকে নিত্য নতুন
ছায়াপথ সৃষ্টি হচ্ছিলো। ফলে মহাবিশ্ব
চিরকালের জন্য বিদ্যমান থাকবে, এবং সর্বদা একই রকম দেখাবে। এই শেষ বৈশিষ্ট্যটির
একটি নির্দিষ্ট ভবিষ্যদ্বাণী হওয়ার বিশেষ গুণাবলি ছিলো যা পরে পর্যবেক্ষণের
মাধ্যমে পরীক্ষা করা যেতে পারে। কেমব্রিজ বেতার জ্যোতির্বিদ্যা (radio astronomy) দল,
মার্টিন রাইলের (Martin Ryle) অধীনে ১৯৬০ দশকের প্রথম
দিকে বেতার তরঙ্গসমূহের দুর্বল উৎসসমূহের একটি জরিপ করেছিলেন। তরঙ্গগুলো মহাকাশ
জুড়ে মোটামুটি সমভাবে বন্টিত ছিলো, যা নির্দেশ করে যে অধিকাংশ উৎস আমাদের ছায়াপথের
বাইরে অবস্থিত ছিলো। দুর্বল উৎস, গড়ে, অনেক দূরের হয়ে থাকবে।
স্থির-অবস্থা তত্ত্ব উৎস সংখ্যা এবং সেগুলোর
শক্তির মধ্যকার একটি সম্পর্কের পূর্বাভাস করেছিলো। কিন্তু পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে
পূর্বাভাসের চেয়ে বেশি অস্পষ্ট উৎস, যা নির্দেশ করে যে অতীতে উৎসসমূহের ঘনত্ব বেশি
ছিলো। এটি ছিলো স্থির-অবস্থা তত্ত্বের মৌলিক অনুমান, সবকিছু সময়ে ধ্রুব ছিলো, এর
বিপরীত। এই এবং অন্যান্য কারণে, স্থির-অবস্থা তত্ত্ব পরিত্যাগ করা হয়।
মহাবিশ্বের সূচনা ছিলো এই ধারণা এড়ানোর
আরেকটি প্রচেষ্টা ছিলো এই প্রস্তাব যে [মহাবিশ্বের] একটি পূর্ব সংকোচন কাল ছিলো,
কিন্তু ঘূর্ণন এবং স্থানীয় অসঙ্গতির কারণে পদার্থ (matter) সব একই স্থানে থাকে নি। বরং, পদার্থের
বিভিন্ন অংশ একে অন্যকে মিস করবে, এবং মহাবিশ্ব পুনরায় প্রসারিত হবে সবসময় সসীম ঘনত্ব
নিয়ে। দুইজন
রাশিয়ান, ইভেনি লিফশিৎস (Evgeny
Lifshitz) এবং ইশাক খালাতনিকভ (Isaak Khalatnikov) প্রকৃতপক্ষে দাবি করেছিলেন যে তারা প্রমাণ করেছে্ন যে নির্দিষ্ট
প্রতিসাম্য ছাড়া একটি সাধারণ সংকোচন সবসময় একটি পূর্বাবস্থায় ফিরে আসবে, ঘনত্ব
সবসময় সসীম থাকবে। এই ফলাফলটি মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের পক্ষে
খুব সুবিধাজনক ছিলো, কারণ এটি মহাবিশ্বের সৃষ্টির বিষয়ে বেমানান প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে
পেরেছিলো। তাই এটি সোভিয়েত বিজ্ঞানীদের জন্য বিশ্বাসের (faith) একটি নিবন্ধ হয়ে ওঠেছিলো।
মহাবিশ্ববিজ্ঞানে আমি আমার গবেষণা শুরু করেছিলাম
ঠিক সেই সময়ে যখন লিফশিৎস এবং খালাতনিকভ তাদের উপসংহার, মহাবিশ্বের কোনো সূচনা
নেই, প্রকাশ করেছিলেন। আমি উপলব্ধি করেছিলাম যে এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন,
কিন্তু আমি লিফশিৎস এবং খালাতনিকভ যে সব যুক্তি ব্যবহার করেছিলেন সেগুলো দ্বারা প্রণোদিত (convinced) ছিলাম না।
আমরা এই ধারণায় অভ্যস্ত যে ঘটনাসমূহ পূর্বের
ঘটনাগুলোর কারণে ঘটে, যেগুলো আরো পূর্বের ঘটনাগুলোর কারণে ঘটে। অতীত পর্যন্ত
বিস্তৃত কার্যকারণের একটি শিকল। কিন্তু মনে করেন যে এই শিকলের একটি শুরু রয়েছে,
মনে করুন যে একটি প্রথম ঘটনা ছিলো। এই প্রথম ঘটনার কারণ কী? এটি অনেক বিজ্ঞানী কাজ
করতে চেয়েছিলেন এমন
একটি প্রশ্ন ছিলো না। তারা এটি এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলেন, হয় রাশিয়ান এবং স্থির-অবস্থা
তত্ত্ববিদদের মতন দাবি করেছিলেন যে মহাবিশ্বের কোনো সূচনা ছিলো না অথবা এই পক্ষ
সমর্থন করেছিলেন যে মহাবিশ্বের উৎপত্তি পদার্থবিজ্ঞানের এখতিয়ারে পড়ে না, বরং অধিবিদ্যা (metaphysics) অথবা ধর্মের
অন্তর্গত। আমার মতে, এই বক্তব্য কোনো প্রকৃত বিজ্ঞানীর গ্রহণ করা উচিত না। যদি
বিজ্ঞানের বিধিসমূহ মহাবিশ্বের শুরুতে স্থগিত হয়ে থাকেই, তবে কি সেগুলো অন্যান্য সময়ে-ও
ব্যর্থ হওয়ার কথা না? একটি বিধি বা সূত্র কখনোই বিধি বা সূত্র নয় যদি এটি কখনো
কখনো সত্য হয়ে থাকে। আমি বিশ্বাস করি যে আমাদের উচিত মহাবিশ্বের শুরু বিজ্ঞানের
ভিত্তিতে বোঝার চেষ্টা করা। এটি হয়তো আমাদের ক্ষমতার বাইরে, তারপর-ও আমাদের অন্তত
প্রচেষ্টা করা উচিত।
রজার পেনরোজ এবং আমি জ্যামিতিক উপপাদ্যসমূহ
প্রমাণের মাধ্যমে দেখাতে সক্ষম হয়েছি যে মহাবিশ্বের অবশ্যই একটি সূচনা থাকা উচিত
যদি আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব সঠিক হয়ে থাকে, এবং নির্দিষ্ট কিছু
যুক্তিসঙ্গত অবস্থা (বা শর্ত) মেলে। একটি গাণিতিক উপপাদ্যের সাথে তর্ক করা কঠিন,
তাই অবশেষে লিফশিৎস এবং খালাতনিকভ স্বীকার করেছিলেন যে মহাবিশ্বের শুরু থাকা উচিত।
যদিও মহাবিশ্বের সূচনার ধারণা সাম্যবাদী ধারণাসমূহের কাছে খুব বেশি স্বাগত নাও হতে
পারে, কিন্তু মতার্দশকে কখনোই পদার্থবিজ্ঞানের বিজ্ঞানের সামনে দাঁড়াতে দেওয়া হয়
নি। বোমার জন্য পদার্থবিজ্ঞানের প্রয়োজন ছিলো, এবং এটি গুরুত্বপূর্ণ ছিলো যে এটি
কাজ করে। কিন্তু সোভিয়েত মতার্দশ জিনতত্ত্বের (genetics) সত্যকে অস্বীকার করে জীববিজ্ঞানের
অগ্রগতিকে প্রতিরোধ করেছিলো।
যদিও রজার পেনরোজ এবং আমি যে উপপাদ্যগুলো
প্রমাণ করেছিলাম সেগুলো দেখিয়েছিলো যে মহাবিশ্বের অবশ্যই একটি সূচনা ছিলো, সেগুলো
সেই শুরুর প্রকৃতি সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য প্রদান করে নি। সেগুলো নির্দেশ করেছিলো
যে মহাবিশ্ব মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে শুরু হয়েছিলো, যে মুহূর্তে সমগ্র মহাবিশ্ব এবং
এর মধ্যের সবকিছু একটি অসীম ঘনত্বের একটি বিন্দুতে সংকুচিত ছিলো, স্থান-কালের একটি
এককত্ব। এই মুহূর্তে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব ভেঙে পড়বে। তাই এটিকে
মহাবিশ্বের শুরু কীভাবে হয়েছিলো তা ভবিষ্যদ্বাণী করার জন্য ব্যবহার করা যাবে না।
মহাবিশ্বের উৎপত্তি সম্ভবত বিজ্ঞানের পরিধির বাইরে থেকে যায়।
মহাবিশ্বের যে একটি খুব ঘন সূচনা ছিলো সেই
ধারণাকে নিশ্চিত করার পর্যবেক্ষণমূলক প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিলো ১৯৬৫ সালের অক্টোবরে,
আমার প্রথম এককত্ব ফলাফল প্রকাশের কয়েক মাস পরে, অণুতরঙ্গের একটি অপষ্ট পটভূমি
আবিষ্কারের সাথে। এই অণুতরঙ্গগুলো আপনার মাইক্রোওয়েভ চুলার মতোই, তবে খুব কম
শক্তিশালী। এগুলো আপনার পিজ্জাকে কেবলমাত্র -২৭০.৪ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড (-৫১৮.৭২ ডিগ্রী ফারেনহাইট) পর্যন্ত গরম করবে, যা পিজ্জাকে হিমানীমুক্ত করার (defrost) জন্য খুব ভালো
ব্যবস্থা নয়, রান্না করা তো দূরের কথা। আপনি এই অণুতরঙ্গগুলোকে নিজেই পর্যবেক্ষণ
করতে পারবেন। আপনাদের যাদের এনালগ টেলিভিশনের কথা মনে আছে তারা নিশ্চিত এই অণুতরঙ্গগুলো
পর্যবেক্ষণ করেছেন। আপনি যদি আপনার টেলিভিশনকে কখনো একটি খালি চ্যানেলে দিয়ে
থাকেন, তবে পর্দায় যে সাদা সাদা রিনিঝিনি দেখেছিলেন তার কয়েক শতাংশ এই অণুতরঙ্গগুলোর
পটভূমির কারণে ঘটেছিলো। এই পটভূমির একমাত্র যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা হচ্ছে যে এটি
মহাবিশ্বের শুরুর খুব উত্তপ্ত এবং ঘন অবস্থা থেকে বিকিরিত বিকিরণের অবশিষ্ট।
মহাবিশ্ব প্রসারিত হওয়ার ফলে, বিকিরণ শীতল হতে হতে আমরা বর্তমানে যে অস্পষ্ট
অবশিষ্টাংশ দেখি সেই অবধি শীতল হয়েছে।
মহাবিশ্ব একটি এককত্ব থেকে শুরু হয়েছিলো এই
ধারণা এমন ছিলো না যে আমি অথবা অন্যান্য আরো কিছু মানুষ এই নিয়ে খুশি ছিলো। যে
কারণে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা মহাবিস্ফোরণের সময়ে ভেঙে পড়ে তা হচ্ছে যে এটি
একটি সরল ও চিরায়ত (classical) তত্ত্ব।
অর্থাৎ, এটি পরোক্ষভাবে মনে করে, যা সাধারণ জ্ঞান থেকে সুস্পষ্ট মনে হয়, যে
প্রতিটি কণার একটি সুনির্দিষ্ট অবস্থান এবং একটি সুনির্দিষ্ট গতি আছে। এই তথাকথিত
একটি সরল ও চিরায়ত
তত্ত্বে, কেউ যদি সব কণার অবস্থান এবং গতি জানেন মহাবিশ্বের একটি নির্দিষ্ট সময়ে,
তবে তিনি অন্য যেকোনো সময়ে, অতীত কিংবা ভবিষ্যতে সেইসব কণার অবস্থান এবং গতি কী
হবে তা গণনা করে বের করতে পারবেন। কিন্তু, বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বিজ্ঞানীরা
আবিষ্কার করেছিলেন যে খুব কম দূরত্বে কী ঘটবে তা তারা গণনা করতে পারছিলেন না। এটি
শুধু যে তাদের ভালো তত্ত্বের প্রয়োজন তা ছিলো না। আমাদের তত্ত্বগুলো যতোই ভালো হোক
না কেনো প্রকৃতিতে একটি নির্দিষ্ট মাত্রার বিশৃঙ্খলা বা যদৃচ্ছতা অথবা অনিশ্চয়তা
আছে বলে মনে হয় যা সরিয়ে ফেলা যায় না। একে ১৯২৭ সালে জার্মান বিজ্ঞানী ওয়ার্নার
হাইজেনবার্গ (Werner
Heisenberg) দ্বারা প্রস্তাবিত অনিশ্চয়তা নীতিতে সংক্ষেপিত করা
যেতে পারে। একজন একটি কণার অবস্থান এবং গতি উভয় সঠিকভাবে পূর্বাভাস করতে পারবেন
না। যতো নির্ভুল্ভাবে অবস্থান পূর্বাভাস করা হয়, ততো কম নির্ভুল্ভাবে আপনি গতির
পূর্বাভাস করতে সক্ষম হবেন এবং তদ্বিপরীতভাবে।
মহাবিশ্ব দৈবঘটনা দ্বারা পরিচালিত এই ধারণা
আইনস্টাইন দৃঢ়ভাবে বিরোধিতা করেছিলেন। তার অনুভূতিগুলো তার বাণীতে ফুটে ওঠেছে, “ঈশ্বর পাশা খেলেন না।”
কিন্তু সব প্রমাণ নির্দেশ করে ঈশ্বর পুরোপুরি একজন জুয়াড়ি। মহাবিশ্ব যেনো একটি
বিশাল তাসঘর (casino) যেখানে প্রতি মুহূর্তে পাশা গড়ানো হচ্ছে অথবা চাকাগুলো ঘুরানো হচ্ছে।
একজন তাসঘরের মালিক প্রতিবার যখন পাশা গড়ানো কিংবা রুলেটের (roulette) চাকা ঘুরানো হয় তখন টাকা হারানোর ঝুঁকিতে থাকেন। কিন্তু বিপুল সংখ্যক
বাজিতে সম্ভাবনা গড়ে হয় (average out) এবং তাসঘরের মালিক
নিশ্চিত করেন যে এই গড়ে হওয়া যেনো তার পক্ষে হয়। এই কারণে তাসঘরের মালিকেরা এতো
ধনী। তাদের বিরুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার আপনার একমাত্র সুযোগ হলো আপনার সব টাকা অল্প
কয়েকটি পাশা গড়ানো কিংবা চাকা ঘুরানোর পক্ষে বাজি ধরা।
মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে-ও একই ব্যাপার। যখন
মহাবিশ্ব বিশাল, তখন বিপুল সংখ্যক পাশার দান থাকে, এবং ফলাফলগুলো গড়ে হয় বলে কেউ
একজন পূর্বাভাস করতে পারে। কিন্তু যখন মহাবিশ্ব অনেক ক্ষুদ্র, যেমন মহাবিস্ফোরণের
সময়, তখন শুধুমাত্র অল্প কিছু সংখ্যক পাশার দান থাকে, এবং অনিশ্চয়তার নীতি তখন
খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই মহাবিশ্বের শুরুর অবস্থা বোঝার জন্য আপনাকে আইনস্টাইনের
আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বের সাথে অনিশ্চয়তার নীতি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। গত ত্রিশ
বছর ধরে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যায় এটি একটি বড় সমস্যা। আমরা এটি এখনো সমাধান করতে
পারি নি, কিন্তু আমরা অনেক অগ্রগতি করেছি।
এখন ধরুন আমরা ভবিষ্যতের পূর্বাভাস করার
চেষ্টা করি। যেহেতু আমরা শুধুমাত্র একটি কণার অবস্থান এবং গতির কিছু সমাবেশ (combination) সম্পর্কে জানি,
আমরা কণাগুলোর ভবিষ্যত অবস্থান এবং গতি সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট ভবিষ্যদ্বাণী করতে
পারবো না। আমরা শুধুমাত্র গতিসমূহ এবং অবস্থানমূহের একটি বিশেষ সমাবেশের প্রতি
সম্ভাবনা অর্পণ করতে পারবো। কিন্তু এখন ধরুন আমরা একই ভাবে অতীত বুঝতে চেষ্টা করছি।
আমরা এখন যেসব পর্যবেক্ষণগুলো করছি সেগুলোর
প্রকৃতি অনুসারে, আমরা যা করতে পারি তা হচ্ছে যে মহাবিশ্বের একটি বিশেষ ইতিহাসের
সম্ভাব্যতা নির্ণয় করা। তাই মহাবিশ্বের অনেক সম্ভাব্য ইতিহাস থাকতে হবে, প্রতিটির
নিজস্ব সম্ভাব্যতাসহ। মহাবিশ্বের এমন ইতিহাস রয়েছে যেখানে ইংল্যান্ড আবার বিশ্বকাপ
জিতেছে, যদিও সেই সম্ভাবনা কম। মহাবিশ্বের বিভিন্ন ইতিহাস রয়েছে এই ধারণাটি
বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির মতো শোনাতে পারে, কিন্তু এটি এখন বৈজ্ঞানিক তথ্য হিসেবে
গ্রহণযোগ্য। এটি রিচার্ড ফাইনম্যানের (Richard
Feynman) কারণে, যিনি অত্যন্ত সম্মানিত ক্যালিফোর্নিয়ার
ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে কাজ করেছিলেন এবং কাছের একটি বিবস্ত্র-নাচঘরে (strip
joint) বঙ্গো ঢোল (bongo drum) বাজাতেন।
কোনো কিছু কীভাবে কাজ করে এই ব্যাপারে ফাইনম্যানের পদ্ধতি ছিলো যে প্রতিটি
সম্ভাব্য ইতিহাসের প্রতি একটি বিশেষ সম্ভাব্যতা আরোপ করা, এবং তারপর এই ধারণাটিকে
ব্যবহার করে পূর্বাভাস করা। এটি ভবিষ্যতের পূর্বাভাসের জন্য চমৎকারভাবে কাজ করে। তাই
আমরা ধরে নিই যে এটি অতীতের ক্ষেত্রে-ও কাজ করে।
বিজ্ঞানীরা এখন কাজ করছেন আইনস্টাইনের
আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বের সাথে ফাইনম্যানের একাধিক ইতিহাসের ধারণাকে একত্রিত
করে একটি সার্বিক তত্ত্ব পেশ করায়, যেটি মহাবিশ্বের যা কিছু ঘটে তা বর্ণনা করতে
পারবে। এই সার্বিক তত্ত্ব আমাদের কীভাবে মহাবিশ্বের বিকাশ ঘটবে তা গণনা করতে সক্ষম
করবে, যদি আমরা একটি সময়ে মহাবিশ্বের অবস্থা সম্পর্কে জানি। কিন্তু এই সার্বিক
তত্ত্ব নিজেই আমাদের বলবে না কীভাবে মহাবিশ্বের সূচনা হয়েছিলো, কিংবা প্রারম্ভিক
অবস্থা কী ছিলো। সেটির জন্য, আমাদের আরো অতিরিক্ত কিছু প্রয়োজন। আমাদের দরকার যা সীমাবস্থা
(boundary conditions) হিসেবে পরিচিত, যা আমাদের মহাবিশ্বের সীমানায়, স্থান এবং কালের
প্রান্তে কী ঘটে তা জানায়। যদি মহাবিশ্বের সীমানা কেবলমাত্র স্থান এবং কালের একটি
সাধারণ বিন্দু হয়ে থাকে তবে আমরা এটি অতিক্রম করে যেতে পারি এবং অতিক্রম করা
অঞ্চলটিকে মহাবিশ্বের অংশ হিসেবে দাবি করতে পারি। অন্যদিকে, মহাবিশ্বের সীমানা যদি
বন্ধুর প্রান্ত হয়ে থাকে যেখানে স্থান অথবা কাল সংকুচিত হয়ে আছে, এবং ঘনত্ব অসীম,
তবে অর্থপূর্ণ সীমাবস্থা সংজ্ঞায়িত করা কঠিন হয়ে যাবে। সুতারাং এটি স্পষ্ট নয় যে কী
ধরণের সীমাবস্থার প্রয়োজন। সীমাবস্থার একটি সেট (অন্য সেটের বদলে) বাছাই করার জন্য
কোনো যৌক্তিক ভিত্তি নেই বলে মনে হয়।
যাইহোক, সান্তা বারবারার ক্যালিফোর্নিয়া
বিশ্ববিদ্যালয়ের (University
of California, Santa Barbara) জিম হার্টল (Jim Hartle) এবং আমি উপলব্ধি করেছিলাম যে তৃতীয় আরেকটি সম্ভাবনা আছে। হয়তো
মহাবিশ্বের স্থান এবং কালে কোনো সীমাবস্থা নেই। প্রথম চিন্তায় মনে হতে পারে যে এটি
আমি আগে যেসব জ্যামিতিক উপপাদ্যগুলোর উল্লেখ করেছিলাম সেগুলোর সাথে সরাসরি অসঙ্গতিতে। সেগুলো দেখিয়েছিলো যে মহাবিশ্বের
অবশ্যই একটি সূচনা ছিলো, সময়ে একটি সীমা ছিলো। তবে, ফাইনম্যানের কৌশলগুলোকে
গাণিতিকভাবে সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করার জন্য, গণিতবিদগণ কাল্পনিক সময় (imaginary time) নামে একটি
ধারণা বিকশিত করেছিলেন। যার
সাথে আমরা যে বাস্তব সময় অনুভব করি তার কোনো সম্পর্ক নেই। গণনার হিসেব মেলানোর
জন্য এটি একটি গাণিতিক কৌশল এবং যা আমরা বাস্তব যে সময় অনুভব করি সেটিকে
প্রতিস্থাপন করে। আমাদের প্রস্তাব ছিলো যে কাল্পনিক সময়ে কোনো সীমা ছিলো না। ফলে
সীমাবস্থা আবিষ্কারের জন্য চেষ্টার দরকার ছিলো না। আমরা একে অসীমানা প্রস্তাব (no-boundary proposal)
হিসেবে অভিহিত করলাম।
মহাবিশ্বের সীমাবস্থা যদি কাল্পনিক সময়ে অসীমানার হয়ে থাকে, তবে মহাবিশ্বের কেবল
একটি ইতিহাস থাকবে না। কাল্পনিক সময়ে অনেকগুলো ইতিহাস আছে, এবং তাদের প্রতিটি
বাস্তব সময়ে একটি ইতিহাস নির্ধারণ করবে। সুতারাং আমাদের কাছে মহাবিশ্বের জন্য
সুপ্রচুর ইতিহাসসমূহ রয়েছে। মহাবিশ্বের সম্ভাব্য সব ইতিহাসসমূহের সেট থেকে একটি
বিশেষ ইতিহাস কিংবা আমরা যেসব ইতিহাসগুলোতে বাস করি সেটির সেটকে কী বাছাই করে?
একটি ব্যাপার আমরা দ্রুত লক্ষ্য করতে পারি
যে এই মহাবিশ্বের এই সম্ভাব্য ইতিহাসগুলোর অনেকগুলো ছায়াপথগুলো এবং নক্ষত্রসমূহ
গঠন করার ক্রম অনুসারে যাবে না, যা আমাদের নিজস্ব বিকাশের জন্য অপরিহার্য ছিলো।
এটা হতে পারে যে বুদ্ধিমান সত্তা ছায়াপথগুলো এবং নক্ষত্রসমূহ ছাড়াই বিকশিত হতে
পারে, কিন্তু এটি অসম্ভব মনে হয়। সুতারাং আমরা “কেনো মহাবিশ্ব যেভাবে আছে সেইরকমই?” এই
প্রশ্ন করতে পারে এমন সত্তা হিসেবে বিদ্যমান সেটি আমরা যে ইতিহাসে বাস করি তার জন্য
একটি সীমাবদ্ধতা। এর অর্থ এই যে
এটি ইতিহাসসমূহের অল্প সংখ্যক যেগুলোতে ছায়াপথগুলো এবং নক্ষত্রসমূহ আছে সেগুলোর
একটি। এটি মানবীয় তত্ত্ব (Anthropic
Principle) নামে পরিচিত তত্ত্বের একটি উদাহরণ। মানবীয় তত্ত্ব
নির্দেশ করে যে মহাবিশ্বকে আমরা যেভাবে দেখি এটিকে কম বা বেশি সেই রকমই হতে হবে, কারণ
এটি যদি ভিন্ন হতো তবে এটিকে পর্যবেক্ষণের জন্য এখানে (আমাদের মতো) কেউ থাকতো না।
অনেক বিজ্ঞানী মানবীয় তত্ত্ব অপছন্দ করেন,
এটি শুধু মুখরোচক ব্যাপার বলে মনে হয়, এবং এর বেশি ভবিষ্যদ্বাণীপূর্ণ ক্ষমতা নেই বলে মনে হয়। কিন্তু
মানবীয় তত্ত্বকে সুনির্দিষ্ট সূত্রবদ্ধকরণ করা যায়, এবং মহাবিশ্বের উৎপত্তি নিয়ে
কাজ করার সময় এটিকে অপরিহার্য মনে হয়। এম-তত্ত্ব (M-theory), যা আমাদের একটি পূর্ণাঙ্গ সার্বিক
তত্ত্বের জন্য সেরা প্রার্থী, মহাবিশ্বের জন্য একটি বড় সংখ্যক সম্ভাব্য
ইতিহাসসমূহকে অনুমোদন করে। এই ইতিহাসসমূহের অধিকাংশই বুদ্ধিমান জীবনের বিকাশের
জন্য মোটামুটি অনুপযুক্ত। হয় সেগুলো শূন্য, বা খুব ক্ষণস্থায়ী, অথবা খুব বেশি
বাঁকা, অথবা অন্য কোনোভাবে নিয়মবিরুদ্ধ। তবুও, রিচার্ড ফাইনম্যানের একাধিক-ইতিহাস
ধারণা অনুযায়ী, এই বসতিহীন ইতিহাসগুলোর উচ্চ সম্ভাবনা থাকতে পারে।
আমরা আসলে গ্রাহ্য করি না কতোগুলো ইতিহাস
আছে যেগুলোতে কোনো বুদ্ধিমান প্রাণ বা সত্তা নেই। আমরা শুধুমাত্র আগ্রহী এই
ইতিহাসগুলোর কতোগুলোতে বুদ্ধিমান প্রাণ বিকশিত হয়। এই বুদ্ধিমান প্রাণ মানুষের
মতোই হতে হবে এমন কোনো মানে নেই। ছোট সবুজ মানুষ হলে-ও চলবে। আসলে, তারা বরং ভালো
করতে পারে। মানবজাতির বুদ্ধিমান আচরণের খুব ভালো নথি বা প্রমাণ নেই।
মানবীয় তত্ত্বের ক্ষমতার উদাহরণ হিসেবে, স্থানের অভিমুখ
বা দিকের সংখ্যার কথা চিন্তা করুন। এটি একটি সাধারণ অভিজ্ঞতা যে আমরা ত্রিমাত্রিক
স্থানে বাস করি। বলতে গেলে, স্থানে একটি বিন্দুর অবস্থান আমরা তিনটি সংখ্যা দ্বারা
নির্দেশ করতে পারি। উদাহরণস্বরূপ, অক্ষাংশ (latitude), দ্রাঘিমাংশ (longitude), এবং সমুদ্রপৃষ্ঠ
থেকে উচ্চতা। কিন্তু স্থান কেনো ত্রিমাত্রিক? কেনো বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির মতো দুই,
অথবা চার, অথবা অন্য কোনো সংখ্যক মাত্রার নয়? প্রকৃতপক্ষে, এম-তত্ত্বে স্থানের
দশটি মাত্রা আছে (সেই সাথে তত্ত্বে সময়ের একটি মাত্রা রয়েছে), কিন্তু এটি মনে করা
হয় যে দশটি স্থানিক মাত্রার সাতটি খুব ক্ষুদ্র হয়ে কুণ্ডলী পাকানো (curled
up) থাকে, বাকি তিনটি মাত্রা বড় এবং প্রায় সমতল। এটি পানীয়
খাওয়ার একটি স্ট্র’র মতো। একটি স্ট্র’র পৃষ্ঠ দ্বিমাত্রিক। কিন্তু, একটি দিক একটি ছোট বৃত্তের
মধ্যে কুণ্ডলী পাকানো থাকে, ফলে দূর থেকে দেখতে মনে হয় যে স্ট্রটি এক-মাত্রার একটি
রেখা।
কেনো আমরা এমন একটি ইতিহাসে বাস করি না
যেখানে ছোট আকারে আটটি মাত্রা কুণ্ডলী পাকানো থাকে, বাকি শুধু দুটো মাত্রা যা আমরা লক্ষ্য
করি? একটি দ্বি-মাত্রিক প্রাণীর জন্য খাদ্য হজম একটি কঠিন কাজ হবে। যদি এটির অন্ত্র
থাকে, আমাদের যেমন আছে, তবে তা প্রাণীটিকে দুই ভাগে ভাগ করে ফেলবে এবং বেচারা
প্রাণীটি ভেঙে পড়বে। সুতারাং দুটো সমতল দিক বা মাত্রা বুদ্ধিমান প্রাণের মতো জটিল
কিছুর জন্য যথেষ্ট নয়। তিন মাত্রা সম্পর্কে বিশেষ ব্যাপার আছে। তিন মাত্রায় গ্রহসমূহের
নক্ষত্রদের চারপাশে আবর্তনের জন্য স্থিতিশীল কক্ষপথ থাকতে পারে। এটি ১৬৬৫ সালে
রবার্ট হুক (Robert Hooke) দ্বারা আবিষ্কৃত এবং পরে আইজ্যাক নিউটন দ্বারা বিস্তারিত বর্ণনা করা
মহাকর্ষের বিপরীত বর্গের সূত্র (inverse square law) মেনে
চলার ফল। একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে অবস্থিত দুটো বস্তুর মধ্যকার মহাকর্ষ বলের কথা
চিন্তা করুন। যদি দূরত্ব দ্বিগুণ হয়, তবে তাদের মধ্যকার মহাকর্ষ বল চার দিয়ে ভাগ
হবে। যদি দূরত্ব তিন গুণ হয় তবে বল নয় দিয়ে ভাগ হবে। যদি দূরত্ব চার গুণ হয় তবে বল
ষোল দিয়ে ভাগ হবে এবং ইত্যাদি। এর ফলে গ্রহের স্থিতিশীল কক্ষপথ হয়। এখন চার
মাত্রার স্থানের কথা চিন্তা করুন। সেখানকার মহাকর্ষ একটি বিপরীত ঘনের (inverse
cube) সূত্র মেনে চলবে। যদি দুটো বস্তুর মধ্যকার দূরত্ব দ্বিগুণ
হয়, তবে মহাকর্ষ বল আট দ্বারা ভাগ হবে, দূরত্ব তিন গুণ হলে ২৭ দ্বারা ভাগ হবে, এবং
দূরত্ব চার গুণ হলে ৬৪ দ্বারা ভাগ হবে। বিপরীত ঘনের সূত্রের এই পরিবর্তন গ্রহগুলোকে
তাদের নক্ষত্রদের ঘিরে স্থিতিশীল কক্ষপথ থাকার ক্ষেত্রে বাধা দেয়। হয় তারা তাদের
নক্ষত্রে পতিত হবে নতুবা বাইরে অন্ধকার এবং ঠাণ্ডার দিকে ফসকে যাবে। একইভাবে,
পরমাণুতে ইলেকট্রনের কক্ষপথ স্থিতিশীল হবে না, ফলে আমরা বস্তু বলতে যা জানি তা
অস্তিত্বমান থাকবে না। সুতারাং যদিও একাধিক-ইতিহাস ধারণা যেকোনো সংখ্যক প্রায় সমতল
দিক বা মাত্রা অনুমোদন করে তবে শুধুমাত্র তিনটি সমতল মাত্রার ইতিহাসগুলোতে বুদ্ধিমান
প্রাণ বা সত্তা থাকবে। শুধুমাত্র এই ধরণের ইতিহাসে “স্থানের
কেনো তিন মাত্রা আছে?” এই ধরণের প্রশ্ন উত্থাপন করা হবে।
আমাদের পর্যবেক্ষণ করা মহাবিশ্বের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অ্যার্নো
পেনজিয়াস (Arno Penzias) এবং রবার্ট উইলসনের (Robert Wilson) আবিষ্কৃত অণুতরঙ্গ পটভূমি। এটি মূলত মহাবিশ্ব অল্প বয়েসে কেমন ছিলো সেটির
“জীবাশ্ম” নথি। এই পটভূমি প্রায় সব দিকেই দেখতে
প্রায় একই। বিভিন্ন দিকের মধ্যকার পার্থক্যসমূহ হচ্ছে ১/১০০০০০ অংশ। এই
পার্থক্যসমূহ অবিশ্বাস্যভাবে ক্ষুদ্র এবং ব্যাখ্যার দাবি রাখে। এই মসৃণতার সাধারণভাবে
গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা হচ্ছে যে মহাবিশ্বের ইতিহাসের খুব প্রথমদিকে মহাবিশ্ব কিছু
সময়ের জন্য খুব দ্রুত প্রসারণের মধ্যে দিয়ে গেছে, কমপক্ষে এক বিলিয়ন বিলিয়ন বিলিয়ন
গুণকের। এই প্রক্রিয়া মহাস্ফীতি (inflation) নামে পরিচিত, আমাদের প্রায়ই বিপদে
ফেলে দেয় যে মূল্যস্ফীতি সেটার তুলনায় এই স্ফীতি মহাবিশ্বের জন্য ভালো ছিলো। যদি
তাই হয়ে থাকে, তবে অণুতরঙ্গ বিকিরণ সব দিকে সম্পূর্ণভাবে একই হওয়ার কথা। তবে
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পার্থক্য কোথা থেকে এসেছে?
১৯৮২ সালের প্রথম দিকে, আমি একটি
গবেষণাপত্র লিখেছিলাম এই প্রস্তাব করে যে এই পার্থক্যসমূহ এসেছে স্ফীতির সময়ে
কোয়ান্টাম তারতম্য (quantum fluctuation) থেকে। কোয়ান্টাম তারতম্য ঘটে অনিশ্চয়তা
নীতির ফলে। উপরন্তু, এই তারতম্য ছিলো আমাদের মহাবিশ্বের বিভিন্ন কাঠামো: ছায়াপথগুলো,
নক্ষত্রসমূহ, এবং আমাদের জন্য বীজস্বরূপ। এই ধারণা মূলত
কৃষ্ণগহ্বরের ঘটনাদিগন্ত থেকে আসা তথাকথিত হকিং বিকিরণের মতো একই পদ্ধতির, যা আমি
এক দশক আগে (১৯৮২ সালের আগে) পূর্বাভাস করেছিলাম, পার্থক্য হচ্ছে যে এখন এটি একটি
মহাজাগতিক দিগন্ত থেকে আসছে, যে পৃষ্ঠ মহাবিশ্বকে ভাগ করেছে যেসব অংশ আমরা দেখতে
পাই এবং যেসব অংশ আমরা পর্যবেক্ষণ করতে পারি না এই দুভাগে। সেই গ্রীষ্মে কেমব্রিজে
আমরা একটি কর্মশালার আয়োজন করেছিলাম, এই ক্ষেত্রের বড় বড় বিজ্ঞানীরা উপস্থিত
ছিলেন। এই সভায়, আমরা মহাস্ফীতির বর্তমান চিত্রের অধিকাংশটুকু পেশ করেছিলাম,
অতি-গুরুত্বপূর্ণ ঘনত্ব তারতম্য-ও (density fluctuations), যা ছায়াপথ গঠনে এবং
ফলে আমাদের অস্তিত্বের উত্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয়। অনেক বিজ্ঞানী চূড়ান্ত উত্তরের
ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন। এটি ছিলো ১৯৯৩ সালে কোবি উপগ্রহ (COBE satellite) দ্বারা অণুতরঙ্গ পটভূমিতে ওঠানামা আবিষ্কার করার দশ বছর আগে, সুতারাং
তত্ত্ব পরীক্ষানিরীক্ষার চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিলো।
মহাবিশ্ববিজ্ঞান (Cosmology) যথাযথ বিজ্ঞান হয়ে ওঠে আরো দশ বছর পরে, ২০০৩ –এ, ডব্লুএমএপি উপগ্রহ (WMAP satellite) থেকে প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে। উপগ্রহটি মহাজাগতিক অণুতরঙ্গ আকাশের
তাপমাত্রার একটি চমৎকার মানচিত্র তৈরি করেছিলো, যা মহাবিশ্বের বর্তমান বয়েসের একশত
ভাগের এক ভাগের স্ন্যাপশট। এই মানচিত্রে যে অসঙ্গতি বা অস্বাভাবিকতা (irregularities) দেখা যায় সেগুলো মহাস্ফীতি দ্বারা পূর্বাভাসিত এবং এর অর্থ এই যে
মহাবিশ্বের কিছু কিছু অঞ্চল অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বেশি ঘনত্বের। অতিরিক্ত
ঘনত্বের মহাকর্ষীয় আকর্ষণ সেই অঞ্চলের প্রসারণকে ধীর করে তোলে এবং অবশেষে ছায়াপথ
এবং নক্ষত্র গঠিত হতে পারে। তাই অণুতরঙ্গ আকাশের মানচিত্র সযত্নে দেখুন। এটি
মহাবিশ্বের সমস্ত কাঠামোর নীলনকশা। আমরা মহাবিশ্বের খুব গোড়ার দিকের কোয়ান্টাম তারতম্যের
ফসল। ঈশ্বর সত্যিই পাশা খেলেন।
ডব্লুএমএপি উপগ্রহকে স্থলাভিষিক্ত করেছে
প্ল্যাঙ্ক উপগ্রহ, যা মহাবিশ্বের অনেক উচ্চ-রেজোলুশনের মানচিত্র উৎপন্ন করে।
প্ল্যাঙ্ক উপগ্রহ আমাদের তত্ত্ব নিষ্ঠার সাথে পরীক্ষা করছে, এবং এমনকি হয়তো
মহাস্ফীতি দ্বারা পুর্বাভাসিত মহাকর্ষীয় তরঙ্গের ছাপ সনাক্ত করতে পারে। এটি হবে
আকাশ জুড়ে লেখা কোয়ান্টাম মাধ্যাকর্ষণ।
অন্যান্য মহাবিশ্ব-ও থাকতে পারে।
এম-তত্ত্ব ভবিষ্যদ্বাণী করে যে বহুসংখ্যক মহাবিশ্ব কোনো কিছু না হতে সৃষ্টি হয়েছে,
যা বিভিন্ন সম্ভাব্য ইতিহাসের সাথে সম্পর্কিত। প্রতিটি মহাবিশ্বের অনেকগুলো
সম্ভাব্য ইতিহাস এবং অনেক সম্ভাব্য অবস্থা রয়েছে, যতো বর্তমান বয়েসী হয় এবং ভবিষ্যতের
দিকে এগিয়ে যায়। এই অবস্থাগুলোর অধিকাংশ আমাদের পর্যবেক্ষণ করা মহাবিশ্বের চেয়ে
ভিন্ন হবে।
এখন-ও আশা করা যায় যে আমরা এম-তত্ত্বের
প্রথম প্রমাণ দেখবো জেনেভার সার্নে (CERN) এলএইচসি কণা ত্বরকে (LHC
particle accelerator; Large Hadron Collider)। এম-তত্ত্বের
দৃষ্টিকোণ থেকে, এই কণা ত্বরক কেবল নিম্ন শক্তি পরীক্ষা করে, তবে আমরা ভাগ্যবান
হতে পারি এবং অতিপ্রতিসাম্য (supersymmetry) এর মতো মৌলিক তত্ত্বের একটি
দুর্বল সংকেত দেখতে পারি। আমি মনে করি পরিচিত কণার অতিপ্রতিসম (Supersymmetric)
জোড়া/দোসর আবিষ্কার করা আমাদের মহাবিশ্ব বোঝার ক্ষেত্রে আমূল
পরিবর্তন সাধন করবে।
২০১২ সালে জেনেভার সার্নে এলএইচসি দ্বারা
হিগস কণা (Higgs particle) আবিষ্কারের ঘোষণা দেয়া হয়েছিলো। এটি ছিলো বিংশ
শতাব্দীতে আবিষ্কৃত প্রথম একটি নতুন মৌলিক (elementary) কণা। এখনো কিছু আশা
আছে যে এলএইচসি অতিপ্রতিসাম্য আবিষ্কার করবে। কিন্তু যদি এলএইচসি নতুন আর কোনো
মৌলিক কণা আবিষ্কার না করে-ও তবে বর্তমানে নির্মাণাধীন পরবর্তী প্রজন্মের কণা
ত্বরকগুলো হয়তো অতিপ্রতিসাম্য আবিষ্কার করবে।
অত্যুষ্ণ মহাবিস্ফোরণের সময়ে মহাবিশ্বের
সূচনা নিজেই এম-তত্ত্ব এবং স্থান-কাল ও বস্তুর মৌলিক উপাদানসমূহ সম্পর্কে আমাদের ধারণাগুলো
পরীক্ষার জন্য একটি চুড়ান্ত উচ্চ-শক্তি পরীক্ষাগার। বিভিন্ন তত্ত্ব মহাবিশ্বের
বর্তমান কাঠামোর মাঝে বিভিন্ন ছাপ (fingerprint) রেখে যায়, তাই
জ্যোতির্পদার্থবিদ্যার (astrophysical) উপাত্তগুলো প্রকৃতির সব বলসমূহের একীকরণ সম্পর্কে আমাদেরকে
রহস্যের সূত্র দিতে পারে। সুতারাং অন্যান্য মহাবিশ্ব (মহাবিশ্বের সূচনা পরীক্ষার
জন্য) থাকতে পারে, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমরা কখনোই সেগুলোকে অন্বেষণ করতে পারবো
না।
আমরা মহাবিশ্বের উৎপত্তি সম্পর্কে জেনেছি।
কিন্তু দুটো বড় প্রশ্ন থেকে যায়: মহাবিশ্বের কি সমাপ্তি আছে? আমাদের
মহাবিশ্ব কি অনন্য?
তাহলে মহাবিশ্বের সবচেয়ে সম্ভাব্য
ইতিহাসগুলোর ভবিষ্যত অবস্থা/আচরণ কী হবে? বুদ্ধিমান সত্তার আবির্ভাবের সাথে
সামজ্ঞস্যপূর্ণ অনেকেগুলো সম্ভাবনা আছে বলে মনে হচ্ছে। সেগুলো নির্ভর করে
মহাবিশ্বে বস্তু বা পদার্থ (matter) কতোটুকু তার উপর। যদি একটি নির্দিষ্ট
সংকটপূর্ণ (critical) পরিমাণের পদার্থ থাকে, তবে ছায়াপথগুলোর
মধ্যকার মহাকর্ষীয় আকর্ষণ মহাবিশ্বের সম্প্রসারণকে হ্রাস করবে।
অবশেষে তারা একে অপরের উপর পতিত হবে এবং
সব এক সঙ্গে এসে মিলবে, মহাসংকোচনে (Big Crunch)। এটি হবে
বাস্তব সময়ে মহাবিশ্বের ইতিহাসের সমাপ্তি। যখন আমি পূর্ব এশিয়াতে ছিলাম তখন আমাকে
অনুরোধ করা হলো মহাসংকোচনের কথা না উল্লেখ করতে, কারণ এটি শেয়ার বাজারের উপর
প্রভাব ফেলতে পারে। কিন্তু শেয়ার বাজারের পতন হলোই, হয়তো খবর কোনোভাবে প্রকাশিত
হয়ে গিয়েছিলো। ব্রিটেনের লোকজন বিশ বিলিয়ন বছর পরের সম্ভাব্য সমাপ্তি নিয়ে খুব
বেশি উদ্বিগ্ন বলে মনে হয় নি। তার আগে আপনি যতো খুশি খাওয়াদাওয়া, পান করা, এবং মজার অনেক
কিছু করতে পারেন।
যদি মহাবিশ্বের ঘনত্ব একটি নির্দিষ্টি
সংকটপূর্ণ মানের কম হয়ে থাকে, তবে ছায়াপথগুলো মহাবিশ্বের চির সম্প্রসারণ থামানোর
জন্য খুব দুর্বল হবে। সব নক্ষত্র অবশেষে ফুরিয়ে যাবে, এবং মহাবিশ্ব ক্রমে শূন্য
থেকে শূন্যতর হবে, এবং শীতল থেকে শীতলতর হবে। সুতারাং, একইভাবে, সবকিছুর সমাপ্তি
ঘটবে, কিন্তু কিছুটা কম নাটকীয় ভাবে। এখনো আমাদের হাতে কয়েক বিলিয়ন বছর সময় আছে।
এই অধ্যায়ে
আমি চেষ্টা করেছি মহাবিশ্বের উৎস, ভবিষ্যত এবং প্রকৃতি সম্পর্কে কিছু ব্যাখ্যা
করার। অতীতের মহাবিশ্ব ছিলো ক্ষুদ্র, এবং ঘন, এবং এটি আমি যে বাদামের খোসা নিয়ে
বলা নিয়ে শুরু করেছিলাম অনেকটা সেটির মতোই ছিলো। কিন্তু এতে বাস্তবে যা কিছু ঘটে তার
সমস্ত কিছু ছিলো। সুতারাং হ্যামলেট বেশ সঠিক ছিলেন। আমরা একটি
বাদামের খোসায় আবদ্ধ হয়ে থাকতে পারি এবং আমাদের নিজেদেরকে অসীম মহাবিশ্বের রাজা
হিসেবে গণ্য করতে পারি।
মহাবিস্ফোরণের পূর্বে
কী ছিলো?
অসীমানা
প্রস্তাব (no-boundary proposal) অনুসারে, মহাবিস্ফোরণের আগে কী ছিলো তা
জিজ্ঞাসা করা অর্থহীন, অনেকটা দক্ষিণ মেরুর দক্ষিণে কী আছে তা জিজ্ঞাসা করার মতন-
কারণ উল্লেখ করার বা শরণ নেওয়ার মতো সময়ের কোনো ধারণা ছিলো না তখন। সময়ের ধারণা
শুধুমাত্র আমাদের মহাবিশ্বের মধ্যে বিদ্যমান।
No comments:
Post a Comment