অধ্যায় ৬: সময়ভ্রমণ কি সম্ভব?
বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীতে, স্থান এবং কালের কুঞ্চণ (warp)
একটি সাধারণ ব্যাপার। সেগুলোকে ছায়াপথ জুড়ে দ্রুত ভ্রমণ কিংবা সময়-ভ্রমণের জন্য
ব্যবহার করা হয়। কিন্তু আজকের বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী প্রায়শই আগামীকালে বিজ্ঞানের সত্য
ব্যাপার হয়ে যায়। তাই সময় ভ্রমণের সম্ভাবনা কী?
স্থান এবং কালকে বাঁকানো বা কুঞ্চণ করা
যায় এই ধারণা খুব সাম্প্রতিককালের। দুই হাজার বছরের অধিক সময় ধরে ইউক্লিডিয়ান জ্যামিতির
উপপাদ্যগুলো স্বীয়-প্রতীয়মান বলে মনে করা হয়েছিলো। আপনাদের মধ্যে যাদেরকে ইস্কুলে
জ্যামিতি শিখতে বাধ্য করা হয়েছিলো তাদের হয়তো মনে আছে যে, এই উপপাদ্যগুলোর
ফলাফলসমূহের একটি হচ্ছে যে একটি ত্রিভূজের কোণগুলো যোগ করলে ১৮০ ডিগ্রী হয়।
তবে গত শতাব্দীতে লোকজন উপলব্ধি করা শুরু
করেছিলো যে জ্যামিতির অন্যান্য রূপ সম্ভব যেখানে একটি ত্রিভূজের কোণগুলোর যোগফল
১৮০ ডিগ্রী না-ও হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, পৃথিবীর পৃষ্ঠদেশের কথা বিবেচনা করুন।
পৃথিবীর পৃষ্ঠে একটি সোজা রেখার সবচেয়ে কাছাকাছি জিনিসটিকে একটি বৃহৎ বৃত্ত (great circle) বলা হয়। এগুলো হচ্ছে দুটো বিন্দু বা স্থানের মধ্যবর্তী সবচেয়ে ছোট পথ তাই
বিমান-পথে এই গমনপথ ব্যবহার করা হয়। এখন বিবেচনা করুন পৃথিবীর পৃষ্ঠে নিরক্ষরেখায়
গঠিত ত্রিভূজটি, লন্ডনের মধ্য দিয়ে ০ ডিগ্রি দ্রাঘিমাংশের রেখা এবং বাঙলাদেশের
মধ্য দিয়ে ৯০ ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশের রেখা। দ্রাঘিমাংশের এই দুটো রেখা নিরক্ষরেখায়
একটি সমকোণে বা ৯০ ডিগ্রিতে মিলিত হয়। দ্রাঘিমাংশের এই দুটো রেখা উত্তর মেরুতে-ও
সমকোণে বা ৯০ ডিগ্রিতে মিলিত হয়। সুতারাং তিনটি সমকোণ নিয়ে একটি ত্রিভূজ আছে। এই
ত্রিভূজের কোণগুলোর যোগফল ২৭০ ডিগ্রি, যা স্পষ্টভাবে একটি সমতল পৃষ্ঠে একটি
ত্রিভূজের জন্য ১৮০ ডিগ্রি থেকে-ও বেশি। যদি কেউ একটি ঘোড়ার জিন-আকৃতির (saddle-shaped) পৃষ্ঠে একটি ত্রিভূজ আঁকে তবে দেখা যাবে যে কোণগুলোর যোগফল ১৮০ ডিগ্রীর
কম।
পৃথিবীর পৃষ্ঠকে একটি দ্বি-মাত্রিক স্থান (two-dimensional space) বলা হয়। অর্থাৎ, পৃথিবীর পৃষ্ঠে আপনি দুই দিকে যেতে পারবেন যা পরষ্পরের
সমকোণে: আপনি উত্তর-দক্ষিণে অথবা পূর্ব-পশ্চিমে যেতে পারেন।
কিন্তু অবশ্যই এই দুই দিকের সমকোণে তৃতীয় আরেকটি দিক রয়েছে, উপরে বা নীচের দিকে। অন্যভাবে
বললে, পৃথিবীর পৃষ্ঠ ত্রিমাত্রিক স্থানে বিদ্যমান। এই ত্রিমাত্রিক স্থান সমতল। অন্যভাবে
বলতে গেলে এটি ইউক্লিডিয়ান জ্যামিতি মান্য করে। একটি ত্রিভূজের কোণগুলোর যোগফল ১৮০
ডিগ্রী হয়। যাইহোক, কেউ একজন এক দ্বিমাত্রিক প্রাণীর প্রজাতিকে কল্পনা করতে পারে
যারা পৃথিবীর পৃষ্ঠে চলাফেরা করতে পারে কিন্তু উপর বা নীচের তৃতীয় দিকটি অনুভব
করতে পারে না। তারা সমতল ত্রিমাত্রিক স্থান সম্পর্কে জানবে না যা পৃথিবীর
পৃষ্ঠদেশ। তাদের জন্য স্থান বাঁকা হবে এবং জ্যামিতি অ-ইউক্লিডিয়ান হবে।
কিন্তু একজন যেমন পৃথিবীর পৃষ্ঠে
দ্বি-মাত্রিক জীবের কথা চিন্তা করতে পারে তেমনি একজন আমরা যে ত্রিমাত্রিক স্থানে
বাস করি সেটিকে আমরা দেখতে পাই না এমন অন্য একটি মাত্রার গোলকের (sphere)
পৃষ্ঠ হিসেবে কল্পনা করতে পারে। যদি গোলকটি অনেক বড় হয়, তবে স্থান প্রায়
সমতল হবে এবং ছোট দূরত্বে ইউক্লিডিয়ান জ্যামিতি খুব ভালোভাবে প্রায় সঠিক পরিমাপ
দেবে। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করবো যে বড় দূরত্বের ক্ষেত্রে ইউক্লিডিয়ান জ্যামিতি ভেঙে
পড়ে। এই ব্যাপারটি উদাহরণ হিসেবে কল্পনা করুন যে একটি বিশাল বলের পৃষ্ঠে একদল
চিত্রশিল্পী রঙ লাগাচ্ছে।
রঙের স্তরের বেধ (thickness) বাড়লে পৃষ্ঠ ক্ষেত্র বেড়ে যাবে। যদি বলটি একটি সমতল ত্রিমাত্রিক স্থানে
হয়ে থাকে তবে একজন যতো ইচ্ছে ততো রঙের আস্তরণ লাগাতে পারে এবং বলটি বড় থেকে আরো বড়
হবে। কিন্তু যদি ত্রিমাত্রিক স্থানটি আরেকটি মাত্রায় একটি গোলকের পৃষ্ঠ হয়ে থাকে
তবে এটির আয়তন বড় হবে কিন্তু সীমাবদ্ধ হবে। যখন একজন রঙের আরো স্তর যোগ করবে তখন
বলটি একসময় স্থানের অর্ধেক অংশ পূরণ করে ফেলবে। এরপর চিত্রশিল্পীরা দেখবেন যে তারা
সর্বদা হ্রাস-পাচ্ছে এমন একটি স্থানে আটকা পড়েছেন এবং প্রায় সমগ্র স্থানটি বল ও এর
রঙের স্তর দ্বারা দখল করা। সুতারাং তখন তারা জানবে যে তারা একটি বক্র স্থানে বাস
করছেন এবং একটি সমতল স্থানে নয়।
এই উদাহরণ তুলে ধরে যে কেউ একজন প্রাচীন
গ্রীকরা যেভাবে চিন্তা করেছিলো সেভাবে অনুমান বা চিন্তা করে পৃথিবীর জ্যামিতি
সম্পর্কে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেন না। বরং আমরা যে স্থানে বাস করি সেটিকে
পরিমাপ করতে হবে এবং সেটির জ্যামিতি পরীক্ষা করে বের করতে হবে। যদিও ১৮৫৪ সালে
জার্মান বের্নহার্ট রিমান (Bernhard Riemann) বক্র স্থানসমূহের জ্যামিতি
বর্ণনা করার একটি উপায় বের করে করেছিলেন, এটি ৬০ বছর ধরে গণিতের একটি অংশ হিসেবে
পড়ে ছিলো। এটি বিমূর্ত বক্র স্থানসমূহকে বর্ণনা করতে পারতো, কিন্তু আমরা যে ভৌত
স্থানে বাস করি সেটি যে বক্র হবে এটি মনে করার কোনো কারণ ছিলো না। এই কারণটি এলো
যখন ১৯১৫ সালে আইনস্টাইন আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব প্রকাশ করেছিলেন।
সাধারণ আপেক্ষিকতা একটি বড় বৌদ্ধিক বিপ্লব
ছিলো যা যেভাবে আমরা মহাবিশ্বকে নিয়ে চিন্তা করি সেটিকে রূপান্তরিত করেছিলো। এটি
শুধুমাত্র একটি বক্র স্থানের তত্ত্ব নয় বরং বক্র অথবা কুঞ্চিত কাল বা সময়ের-ও একটি
তত্ত্ব। আইনস্টাইন ১৯০৫ সালে যখন স্থান এবং কালকে পরষ্পরের সাথে সম্পর্কিত করে তার
বিশেষ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব প্রকাশ করেছিলেন তখন তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে স্থান এবং
সময় একে অপরের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। একজন একটি ঘটনার অবস্থান (location) চারটি সংখ্যা দ্বারা বর্ণনা করতে পারেন। তিনটি সংখ্যা ঘটনাটির স্থানিক
অবস্থান (position) বর্ণনা করে। সেগুলো অক্সফোর্ড সার্কাসের
উত্তরে ও পূর্ব দিকে অবস্থান এবং সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা হতে পারে। একটি বৃহৎ
স্কেলে সেগুলো ছায়াপথীয় অক্ষাংশ এবং দ্রাঘিমাংশ এবং ছায়াপথের কেন্দ্র থেকে দূরত্ব
হতে পারে।
চতুর্থ সংখ্যাটি হচ্ছে ঘটনাটির সময় বা
কাল। সুতারাং একজন স্থান এবং সময়কে একসাথে স্থান-কাল নামক একটি চার-মাত্রিক অস্তিত্ব
হিসেবে চিন্তা করতে পারে। স্থান-কালের প্রতিটি বিন্দু চারটি সংখ্যা দ্বারা প্রকাশ
করা যায় যেগুলো এর স্থান এবং কালে বিন্দুটির অবস্থান নির্দেশ করে। স্থান এবং কালকে
স্থান-কালে একত্র করা অসার হবে যদি কেউ এক অনন্য উপায়ে আলাদাভাবে তাদের জট খুলতে
পারে। অন্যভাবে বলতে গেলে, যদি প্রতিটি ঘটনার স্থান এবং কালকে সংজ্ঞায়িত করার একটি
অনন্য উপায় থাকে। তবে, ১৯০৫ সালে সুইস পেটেন্ট অফিসে করণিকের কাজ করার সময় এক
অসাধারণ গবেষণাপত্রে আইনস্টাইন দেখিয়েছিলেন যে, যে স্থান এবং কালে একটি ঘটনা ঘটেছে
বলে একজন মনে করে সেটি নির্ভর করে সেইজন কীভাবে চলছে তার উপর। এর মানে হচ্ছে যে
স্থান এবং কাল অচ্ছেদভাবে পরস্পরের সাথে জড়িত।
ভিন্ন ভিন্ন পর্যবেক্ষকরা ঘটনাবলি যে
সময়সমূহে ঘটেছে বলে উল্লেখ করেন সেগুলো মিলবে যদি পর্যবেক্ষকরা একে অপরের
আপেক্ষিকে না চলেন। কিন্তু যদি তাদের আপেক্ষিক গতি পরস্পরের চেয়ে দ্রুত হয় তবে
তাদের উল্লেখ করা সময় ততো ভিন্ন হবে। সুতারাং একজন জানতে চাইতে পারে যে একজন
পর্যবেক্ষককে কতো দ্রুত যেতে হবে যাতে অন্য পর্যবেক্ষকের সময় সাপেক্ষে প্রথম
পর্যবেক্ষকের সময় পেছনের দিকে (backward) যাবে। এই উত্তর নিম্নলিখিত
কৌতূকপূর্ণ ছড়ায় দেওয়া আছে:
There was a young lady of Wight
Who travelled much faster than light
She departed one day
In a relative way
And arrived on the previous night.
সুতারাং সময় ভ্রমণের জন্য আমাদের প্রয়োজন
একটি মহাকাশযান যা আলোর চেয়ে বেশি দ্রুত যেতে পারবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, একই গবেষণাপত্রে
আইনস্টাইন দেখিয়েছিলেন যে একটি মহাযানের গতিবৃদ্ধি করার জন্য রকেটের যে শক্তি
দরকার তা ততো বেশি এবং বেশি হতে থাকে এটির গতি যতো বেশি আলোর কাছাকাছি পৌঁছে। সুতারাং
আলোর গতির চেয়ে বেশি গতিবৃদ্ধি করার জন্য এক অসীম পরিমাণ শক্তি লাগবে।
আইনস্টাইনের ১৯০৫ সালের গবেষণাপত্রটি
অতীতে সময় ভ্রমণের সম্ভাবনা বাতিল করে দিয়েছিলো বলে মনে হয়। এটি আরো নির্দেশ
করেছিলো যে অন্যান্য নক্ষত্রের দিকে মহাকাশভ্রমণ খুব ধীর এবং ক্লান্তিকর ব্যাপার
হবে। যদি একজন আলোর গতির চেয়ে বেশি জোরে না যেতে পারে তবে আমাদের নিকটবর্তী
নক্ষত্রে যেতে এবং ফিরে আসতে সময় লাগবে অন্তত আট বছর এবং ছায়াপথের কেন্দ্রের
ক্ষেত্রে প্রায় ৫০ হাজার বছর। যদি মহাকাশযানটি আলোর গতির কাছাকাছি গতিতে চলে তবে
ভেতরের যাত্রীদের মনে হবে যে ছায়াপথের কেন্দ্র পর্যন্ত যেতে মাত্র কয়েক বছর সময়
লেগেছে। কিন্তু এটি খুব বেশি সান্তনাসূচক হবে না যখন দেখবেন যে পৃথিবীতে আপনাকে
যারা চিনতো তারা সবাই মারা গেছেন এবং আপনাকে ভুলে যাওয়া হয়েছে আপনি ফিরে আসার
হাজার হাজার বছর আগেই। ব্যাপারটি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর লেখকদের জন্য-ও ভালো কিছু
হবে না তাই লেখকরা চিন্তা করতে লাগলেন এই সমস্যাকে কীভাবে সামাল দেয়া যায়।
১৯১৫ সালে আইনস্টাইন দেখিয়েছিলেন যে
মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবসমূহ বর্ণনা করা যায় এটি ধরে নিয়ে যে স্থান-কাল এর ভেতরের
বস্তু বা পদার্থ এবং শক্তি দ্বারা কুঞ্চিত বা দোমড়ানো, এবং এই তত্ত্ব সাধারণ
আপেক্ষিকতা হিসেবে পরিচিত। আমরা আসলে সূর্যের ভর দ্বারা উৎপাদিত স্থান-কালের এই
কুঞ্চণ সূর্যের কাছ দিয়ে যাওয়া আলো কিংবা রেডিও তরঙ্গগুলোর সামান্য বেঁকে যাওয়াতে
পর্যবেক্ষণ করতে পারি।
এটি নক্ষত্র অথবা রেডিও তরঙ্গের উৎসের
আপাত অবস্থানকে সামান্য স্থানান্তর করে ফেলে যখন সূর্য পৃথিবী এবং উৎসের মাঝখানে
পড়ে। এই স্থানান্তর খুবই সামান্য, এক ডিগ্রীর এক হাজার ভাগের প্রায় এক ভাগ, যা এক
মাইল দূরত্বের ক্ষেত্রে এক ইঞ্চি নড়াচড়ার সমান। যাইহোক, এটি অনেক নির্ভুলতার সাথে
পরিমাপ করা যেতে পারে এবং এটি সাধারণ আপেক্ষিকতার পূর্বাভাসের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।
আমাদের কাছে পরীক্ষালব্ধ প্রমাণ আছে যে স্থান এবং কাল কুঞ্চিত বা মোচড়ানো (warped)।
আমাদের আশপাশে কুঞ্চণের পরিমাণ খুবই কম কারণ
সৌরজগতের সমস্ত মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র দুর্বল। যাইহোক, আমরা জানি যে খুব শক্তিশালী
ক্ষেত্র হতে পারে, যেমন মহাবিস্ফোরণে কিংবা কৃষ্ণগহ্বরে। তাহলে স্থান এবং কাল কি
যথেষ্ট কুঞ্চিত বা মোচড়ানো হতে পারে যে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীতে উল্লেখিত হাইপারস্পেস
ড্রাইভ (hyperspace drive), ক্ষুদ্রবিবর (Wormhole), কিংবা সময় ভ্রমণ সম্ভব? প্রথম দর্শনে এগুলো সব সম্ভব বলে মনে হয়।
উদাহরণস্বরূপ, ১৯৪৮ সালে কার্ট গডেল (Kurt Gödel)
আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার ক্ষেত্র সমীকরণগুলোর একটি সমাধান খুঁজে পেয়েছিলেন
যা এমন একটি মহাবিশ্বকে তুলে ধরে যেখানে সমস্ত বস্তু বা পদার্থ ঘূর্ণায়মান। এই
মহাবিশ্বে আপনি একটি মহাকাশযানে করে গিয়ে আপনি আপনার যাত্রা শুরু করার আগে আবার ফিরে
আসতে পারবেন। গডেল প্রিন্সটনের Institute of Advanced Study –এ ছিলেন, যেখানে আইনস্টাইন তার জীবনের শেষ
বছরগুলো কাটিয়েছিলেন। তিনি বিখ্যাত ছিলেন এটি প্রমাণ করার জন্য যে আপনি সবকিছু
সত্য প্রমাণ করতে পারবেন না, এমনকি পাটীগণিতের মতো আপাতদৃষ্টিতে সহজ বিষয়-ও। কিন্তু
সময় ভ্রমণকে বিধিসম্মত বলে সাধারণ আপেক্ষিকতা সম্পর্কে তিনি যা প্রমাণ করেছিলেন তা
সত্যিই আইনস্টাইনকে অসন্তুষ্ট করেছিলো, যিনি মনে করেছিলেন যে এটি সম্ভব হবে
না।
আমরা এখন জানি যে গডেলের সমাধানটি আমরা যে
মহাবিশ্বে বাস করি সেটিকে তুলে ধরে নি কারণ সেটি আমাদেরটির মতো প্রসারিত হচ্ছিলো
না। সেটিতে মহাজাগতিক ধ্রুবক (cosmological constant) নামক একটি রাশির
মোটামুটি বড় মান ছিলো যা সাধারণত খুব ছোট হয় বলে মনে করা হয়। যাইহোক, সময় ভ্রমণ
সম্ভব –এর আপাত
যুক্তিসঙ্গত আরো সমাধান পাওয়া গেছে। একটি আগ্রহোদ্দীপক সমাধান হচ্ছে তন্তু তত্ত্ব
(string
theory) নামক পদ্ধতি থেকে, যেটিতে দুটি মহাজাগতিক তন্তু আলোর গতির
কিছুটা কমে পরস্পরের বিপরীতে চলন্ত। মহাজাগতিক তন্তুসমূহ তাত্ত্বিক
পদার্থবিজ্ঞানের অসাধারণ ধারণা যা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর লেখকেরা এখনো ধরে উঠতে
পারে নি বলে মনে হয়। তাদের নাম যেমন নির্দেশ করে, তারা তন্তুর মতন এই অর্থে যে
তাদের দৈর্ঘ্য অথচ একটি ক্ষুদ্র আড়াআড়ি অংশ বা খণ্ড (cross-section) রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে তারা অনেকটা রাবারের ব্যান্ডের মতন কারণ তারা বিশাল
চাপের মধ্যে থাকে, যেমন এক শত বিলিয়ন বিলিয়ন বিলিয়ন টন। সূর্যের সাথে সংযুক্ত একটি
মহাজাগতিক তন্তু সূর্যকে শূন্য থেকে ষাটে ত্বরান্বিত করবে এক সেকেন্ডের ত্রিশভাগের
এক ভাগে।
মহাজাগতিক তন্তুগুলো আষাঢ়ে-গল্প এবং
বিশুদ্ধ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর মতো শোনাতে পারে, কিন্তু এগুলোতে বিশ্বাস করার ভালো
বৈজ্ঞানিক কারণ আছে যে সেগুলো মহাবিস্ফোরণের পরে মহাবিশ্বের প্রথম দিকে গঠিত হয়ে
থাকতে পারে। যেহেতু তারা অনেক চাপে আছে তাই একজন তাদেরকে প্রায় আলোর গতির কাছাকাছি
ত্বরান্বিত হতে পারে বলে আশা করতে পারে।
গডেলের মহাবিশ্ব এবং দ্রুত-গতিতে চলমান
মহাজাগতিক-তন্তুর স্থান-কালের মধ্যে একটি মিল হচ্ছে যে তারা এতো কুঞ্চিত এবং বক্র
ভাবে শুরু করে যে স্থান-কাল নিজের উপরে নিজে বেঁকে যাওয়া এবং অতীতে ভ্রমণ করা
সবসময় সম্ভব। ঈশ্বর হয়তো এমন একটি কুঞ্চিত মহাবিশ্ব সৃষ্টি করে থাকতে পারেন,
কিন্তু তিনি এমন করেছেন এটি ভাবার কোনো কারণ নেই। সমস্ত প্রমাণ হচ্ছে যে মহাবিশ্ব
মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে শুরু হয়েছিলো সময় ভ্রমণের জন্য প্রয়োজনীয় কুঞ্চণ ছাড়াই।
যেহেতু আমরা মহাবিশ্ব কীভাবে শুরু হয়েছিলো সেটি পরিবর্তন করতে পারবো না, তাই সময় ভ্রমণ
সম্ভব কিনা এই প্রশ্নটি আমরা পরবর্তী সময়ে স্থান-কালকে এতো বেশি কুঞ্চিত করতে
পারবো কিনা যে অতীতে ফিরে যাওয়া সম্ভব হবে এমন একটি প্রশ্ন। আমি মনে করি এটি
গবেষণার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কিন্তু একজনকে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে
যেনো খামখেয়ালি হিসেবে অ্যাখ্যায়িত না হওয়ার ব্যাপারে। যদি কেউ সময় ভ্রমণের উপর
গবেষণা করার জন্য একটি গবেষণা অনুদানের আবেদন করে তবে এটি অবিলম্বে বাতিল করা হবে।
মনে হয় না কোনো সরকারি সংস্থার সময় ভ্রমণের মতো ব্যাপারে জনগণের অর্থ ব্যয় করা
দেখানোর সাহস হতে পারে। পরিবর্তে কাউকে “বন্ধ সময়-রূপ রেখাচিত্রের” মতো প্রায়োগিক
শব্দাবলি ব্যবহার করতে হবে, যা সময় ভ্রমণের সংকেত হিসেবে কাজ করবে। তবুও এটি একটি
গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। যেহেতু সাধারণ আপেক্ষিকতা সময় ভ্রমণ অনুমোদন করে, এটি কি আমাদের
মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে করে? যদি না করে, তবে কেনো নয়?
সময় ভ্রমণের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত ব্যাপার
হচ্ছে স্থানে এক অবস্থান থেকে অন্য অবস্থানে দ্রুত যেতে পারা। আমি আগে যেমন
বলেছিলাম, আইনস্টাইন দেখিয়েছিলেন যে আলোর গতির চেয়ে বেশি দ্রুত যেতে হলে একটি
মহাকাশযানের অসীম পরিমাণ শক্তি লাগবে। তাই ছায়াপথের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে
একটি যুক্তিসঙ্গত সময়ের মধ্যে যাওয়ার একমাত্র উপায় মনে হচ্ছে যে যদি আমরা
স্থান-কালকে এতো বেশি কুঞ্চিত বা বাঁকাতে পারি যে আমরা একটি নল অথবা ক্ষুদ্রবিবর তৈরি
করতে পারি। এটি ছায়াপথের দুটো অংশকে একে অন্যের সাথে এক সাথে সংযুক্ত করবে এবং আপনার
বন্ধুরা জীবিত থাকাকালীন সময়েই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় আসা-যাওয়ার জন্য একটি
সংক্ষিপ্ত-পথ (short-cut) হিসেবে কাজ করবে। ভবিষ্যত
সভ্যতার ক্ষমতার মধ্যে এই ধরণের ক্ষুদ্রবিবরের সম্ভাবনা থাকার কথা গুরুত্ব সহকারে প্রস্তাব
করা হয়েছে। কিন্তু যদি আপনি ছায়াপথের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে এক সপ্তাহ
কিংবা দুই সপ্তাহে যেতে পারেন তবে আপনি আরেকটি ক্ষুদ্রবিবর দিয়ে গিয়ে আপনার যাত্রা
শুরু করার আগে পৌঁছে যেতে পারবেন। আপনি এমনকি একটি মাত্র ক্ষদ্রবিবর দিয়ে অতীতে
ভ্রমণ করতে পারবেন যদি এটির দুটো প্রান্ত পরস্পরের আপেক্ষিকে চলমান হয়।
একটি ক্ষুদ্রবিবর সৃষ্টি করার জন্য একজনকে
সাধারণভাবে বস্তু বা পদার্থসমূহ স্থান-কালকে যেভাবে কুঞ্চিত করে তার বিপরীভাবে
কুঞ্চিত করতে হবে। সাধারণ পদার্থসমূহ স্থান-কালকে নিজের উপরে বাঁকিয়ে ফেলে, অনেকটা
পৃথিবীর পৃষ্ঠের মতো। কিন্তু একটি ক্ষুদ্রবিবর সৃষ্টি করতে একজনের দরকার এমন বস্তু
বা পদার্থসমূহ যা স্থান-কালকে বিপরীতভাবে কুঞ্চিত করে, অনেকটা ঘোড়ার জিনের বা
স্যাডলের পৃষ্ঠের মতো। একই ব্যাপার অতীতে ভ্রমণকে সম্ভব করে এমন স্থান-কালের
কুঞ্চণের যেকোনো উপায়ের ক্ষেত্রে-ও সত্য, যদি মহাবিশ্ব সময় ভ্রমণ সম্ভব হবে এইরকম এতো
বেশি কুঞ্চিতভাবে শুরু না হয়ে থাকে। যাত্রাপথে স্থান-কালকে কুঞ্চিত করার জন্য একজনের যা দরকার
হবে তা হচ্ছে ঋণাত্মক ভর (negative mass) এবং ঋণাত্মক শক্তির ঘনত্ব (negative
energy density)।
শক্তি অনেকটা অর্থের মতো। যদি আপনার ব্যাংকে
ধনাত্মক ব্যালেন্স থাকে তবে আপনি এটি বিভিন্ন উপায়ে বিতরণ করে পারেন। কিন্তু চিরায়ত
সূত্রাবলি অনুসারে খুব সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত-ও বিশ্বাস করা হতো যে, আপনি শক্তির একটি
ওভারড্রাফট (overdraft) রাখতে পারবেন না। তাই এই চিরায়ত সূত্রাবলি সময়
ভ্রমণের জন্য প্রয়োজনীয়, পথে মহাবিশ্বকে কুঞ্চিত করা আমাদের পক্ষে সক্ষম হওয়ার
সম্ভাবনাকে বাতিল করে দিয়েছিলো। কিন্তু চিরায়ত সূত্রাবলি কোয়ান্টাম তত্ত্ব দ্বারা ক্ষমতাচ্যুত
হয়েছে, সাধারণ আপেক্ষিকতা ছাড়া যা আমাদের মহাবিশ্বকে বোঝার ক্ষেত্রে অন্যতম বড়
বিপ্লব। কোয়ান্টাম তত্ত্ব অনেক দিলখোলা এবং আপনার এক বা দুই হিসাবখাতায় ওভারড্রাফট
থাকা অনুমোদন করে। যদি ব্যাংকগুলো শুধু এইরকম অমায়িক হতো! অন্য কথায়, কোয়ান্টাম
তত্ত্ব কিছু স্থানে শক্তির ঘনত্ব ঋণাত্মক হতে দেয় যদি অন্যথায় এটি ধনাত্মক হয়ে
থাকে।
যে কারণে কোয়ান্টাম তত্ত্ব শক্তির ঘনত্ব
ঋণাত্মক হওয়া অনুমোদন করে তা হচ্ছে যে এটি অনিশ্চয়তা নীতির উপর নির্ভর করে। এটি
বলে যে একটি কণার অবস্থান এবং গতির মতো কিছু রাশির মান একসাথে ভালোভাবে নিরূপণ করা
যায় না। একটি কণার অবস্থান যতো সঠিকভাবে নিরূপণ করা হবে এটির গতিতে ততো বেশি
অনিশ্চয়তা পাওয়া যাবে এবং তদ্বিপরীতভাবে। অনিশ্চয়তা
নীতি তড়িৎচুম্বকীয় ক্ষেত্র অথবা মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের মতো ক্ষেত্রগুলোর ক্ষেত্রে-ও
প্রযোজ্য। এটি বোঝায় যে এই ক্ষেত্রগুলো একদম শূন্য হতে পারে না, এমনকি আমরা
শূন্যস্থান বলতে যা বুঝি সেখানে-ও। যদি তাদেরকে একদম শূন্য হতে হয় তবে তাদের
সঠিকভাবে নিরূপণ করা অবস্থানের মানগুলো শূন্য হবে এবং সঠিকভাবে নিরূপণ করা গতির
মানগুলো-ও শূন্য হবে। কিন্তু এটি অনিশ্চয়তা নীতির লঙ্ঘন হবে। পরিবর্তে
ক্ষেত্রগুলোর একটি নির্দিষ্ট ন্যূনতম পরিমাণ তারতম্য থাকতে হবে। কেউ একজন এই
তথাকথিত শূন্যস্থানের তারতম্যসমূহকে (vacuum fluctuations) ব্যাখ্যা করতে পারে
কণাসমূহ এবং প্রতিকণাসমূহের জোড়াগুলো হিসেবে যেগুলো হঠাৎ এক সাথে আবির্ভূত হয়, সরে
যায় এবং আবার একত্রে ফিরে আসে এবং একে অপরকে ধ্বংস করে ফেলে।
এই কণা-প্রতিকণার জোড়াগুলোকে অসদ বলে মনে
করা হয় কারণ কেউ এগুলোকে একটি কণা সনাক্তকরণ যন্ত্র দ্বারা সরাসরি পরিমাপ করতে
পারে না। যাইহোক, তাদের প্রভাব পরোক্ষভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায়। এটি করার একটি উপায়
হচ্ছে কাসিমির প্রভাব (Casimir effect) নামক উপায়ে। মনে করুন যে
একটি স্বল্প দূরত্বে দুটো সমান্তরাল ধাতব ফলক আছে। এই ফলকগুলো অসদ কণাসমূহ এবং
প্রতিকণাসমূহের জন্য আয়নার মতো কাজ করে। এর মানে হচ্ছে যে ফলকগুলোর মাঝামাঝি অংশটি
কিছুটা একটি অর্গান নলের (organ pipe) মতো এবং শুধুমাত্র নির্দিষ্ট
অনুরণন কম্পাঙ্কের (resonant frequencies) আলোক তরঙ্গগুলোকে
প্রবেশ করতে দেবে। অর্থাৎ ফলকগুলোর মাঝামাঝি অংশে ভিন্ন সংখ্যক শূন্যস্থানের
তারতম্যসমূহ অথবা অসদ কণাসমূহ আছে বাইরের তুলনায়, যেখানে শূন্যস্থানের তারতম্যসমূহ
যেকোনো তরঙ্গদৈর্ঘ্যের হতে পারে। ফলকগুলোর বাইরের তুলনায় ফলকগুলোর মধ্যে অসদ
কণাসমূহের সংখ্যাতে পার্থক্যের মানে হচ্ছে যে তারা ফলকগুলোর এক পাশে অন্য পাশের
তুলনায় একই চাপ প্রয়োগ করে না। তাই সামান্য কিছু বল ফলকগুলোকে একত্রে ধাক্কা
দিচ্ছে। এই বল পরীক্ষামূলকভাবে পরিমাপ করা গেছে। সুতারাং, অসদ কণাসমূহ আসলেই
বিদ্যমান এবং বাস্তবিক প্রভাব উৎপাদন করে।
যেহেতু ফলকগুলোর মাঝখানে বাইরের তুলনায়
অল্প সংখ্যক অসদ কণাসমূহ বা শূন্যস্থানের তারতম্যসমূহ রয়েছে, তাই বাইরের তুলনায়
মাঝখানে শক্তির ঘনত্বের পরিমাণ কম। কিন্তু ফলকগুলো থেকে দূরে শূন্যস্থানের মোট
শক্তির ঘনত্ব শূন্য হতে হবে। অন্যথায় এটি স্থান-কালকে কুঞ্চিত করবে এবং মহাবিশ্ব
প্রায় সমতল হবে না। তাই ফলকগুলোর মাঝখানের শক্তির ঘনত্ব অবশ্যই ঋণাত্মক হতে হবে।
এভাবে আমরা আলোর বক্রতা থেকে পরীক্ষামূলক
প্রমাণ পেয়েছি যে স্থান-কাল বক্র, এবং কাসিমির প্রভাব থেকে নিশ্চিতকরণ পেয়েছি যে
আমরা এটিকে ঋণাত্মক দিকে কুঞ্চিত করতে পারি। তাই এটি মনে হতে পারে যে আমরা বিজ্ঞান
এবং প্রযুক্তিতে অগ্রগতি করলে আমরা হয়তো ক্ষুদ্রবিবর সৃষ্টি করতে পারবো অথবা স্থান
এবং কালকে অন্য কোনোভাবে কুঞ্চিত করতে পারবো যাতে আমরা অতীতে ভ্রমণ করতে সক্ষম
হবো। যদি এটি হতো তবে এটি অনেক প্রশ্নের এবং সমস্যার জন্ম দিতো। সেগুলোর একটি
হচ্ছে যদি ভবিষ্যতে সময় ভ্রমণ সম্ভব হয়ে থাকে তবে কেনো ভবিষ্যত থেকে কেউ এসে
আমাদের বলে না কীভাবে এটি করতে হয়।
যদিও আমাদের অজ্ঞতায় রাখার জন্য যথেষ্ট
কারণ থাকতে পারে, কিন্তু মানব প্রকৃতি এমন যে এটি বিশ্বাস করা কঠিন যে কেউ একজন এটি
জাহির করবে না এবং আমাদের মতো হতদরিদ্র অন্ধাকারাচ্ছন্ন গেঁয়ো লোকদের সময় ভ্রমণের
গোপন কথা বলবে না। অবশ্যই, কিছু লোক দাবি করবে যে আমাদের ইতিমধ্যেই ভবিষ্যত থেকে
পরিদর্শন করে গেছে। তারা বলবে যে ইউএফও ভবিষ্যত থেকে এসেছে এবং সরকারগুলো এই
পরিদর্শকরা যে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান নিয়ে আসে তা শুধু নিজেদের জন্য রেখে দেওয়ার জন্য
এবং সব কিছু ধামাচাপা দেওয়ার এক বিশাল ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত। আমি বলতে পারি যে
সরকার যদি কিছু লুকিয়ে রাখে তবে তারা ভিনগ্রহবাসীদের থেকে দরকারী তথ্য সংগ্রহের
ক্ষেত্রে একটি বাজে কাজ করছে। আমি ষড়যন্ত্র তত্ত্বের ব্যাপারে খুব সন্দেহগ্রস্থ।
ইউএফও দেখতে পাওয়ার প্রতিবেদনগুলো সবগুলো পৃথিবীবহির্ভূতদের কারণে হতে পারে না
কারণ তারা পারস্পরিক দ্বন্দ্বপূর্ণ। কিন্তু আপনি যদি একবার স্বীকার করেন যে
সেগুলোর কিছু কিছু ভুল প্রতিবেদন কিংবা বিভ্রান্তির কারণে হয়েছে, তবে এটি কি বেশি
সম্ভাব্য নয় যে ছায়াপথের অন্য দিক থেকে কিংবা ভবিষ্যত থেকে আমাদের সাথে দেখা করতে
লোক এসেছে এই তুলনায় সবগুলো রিপোর্টই ভুল বা বিভ্রান্তিকর প্রতিবেদন? যদি তারা
সত্যিই পৃথিবীতে উপনিবেশ স্থাপন করতে চায় অথবা আমাদের কোনো বিপদ সম্পর্কে সতর্ক
করতে চায় তবে তারা বরং অকার্যকর।
ভবিষ্যত থেকে আমাদের দেখতে কোনো পরিদর্শক
আসে নি এই তথ্যের সাথে সময় ভ্রমণের মিলনসাধনের একটি সম্ভাব্য উপায় যে এই ধরণের
ভ্রমণ শুধু ভবিষ্যতেই ঘটতে পারে। এইক্ষেত্রে বলা যায় যে আমাদের অতীতে স্থান-কাল স্থায়ী
বা অপরিবর্তনীয় কারণ আমরা এটি পর্যবেক্ষণ করে ফেলেছি এবং দেখেছি যে এটি অতীতে সময়
ভ্রমণ অনুমোদন করার মতো যথেষ্ট পরিমাণে কুঞ্চিত নয়। অন্যদিকে, ভবিষ্যত উন্মুক্ত
আছে। আমরা হয়তো এটিকে যথেষ্ট কুঞ্চিত করতে সক্ষম হবো যে সময় ভ্রমণ সম্ভব হবে।
কিন্তু যেহেতু আমরা শুধুমাত্র স্থান-কালকে ভবিষ্যতে কুঞ্চিত করতে পারবো, তাই আমরা
বর্তমান সময়ে বা এর পূর্বে ভ্রমণ করে ফিরে আসতে পারবো না।
এটি ব্যাখ্যা করবে কেনো আমরা ভবিষ্যত থেকে
আসা পর্যটকদের ভীড়ে পড়ি নি। কিন্তু এতে এখনো প্রচুর আপার্তবৈপরীতা থেকে যায়। ধরুন এটি
সম্ভব ছিলো যে একটি মহাকাশযানে করে গিয়ে আপনি যাত্রা শুরু করার আগে ফিরে আসতে
পারবেন। তবে আপনাকে উড্ডয়ন মঞ্চে (lunch pad) মহাকাশযানটি বিস্ফোরিত করা থেকে
কিংবা নিজেকে প্রথমেই যাত্রা শুরু করা থেকে কী আটকাবে? এই আপার্তবৈপরীতার অন্যান্য
সংস্করণ আছে, যেমন আপনার জন্মের আগে গিয়ে আপনার বাবা-মাকে মেরে ফেলা, কিন্তু
সবগুলো সংস্করণ মূলত একই। দুটি সম্ভাব্য সমাধান আছে বলে মনে হচ্ছে।
একটি হচ্ছে যাকে আমি
সামঞ্জস্যপূর্ণ-ইতিহাস পদ্ধতি (consistent-histories approach) বলি। এটি বলে
যে একজনকে পদার্থবিজ্ঞানের সমীকরণগুলোর একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ সমাধান খুঁজে বের করতে
হবে যদি স্থান-কাল এতো বেশি কুঞ্চিত হয় যে অতীতে সময় ভ্রমণ সম্ভব হয়। এই ক্ষেত্রে
আপনি মহাকাশযানে করে অতীতে যাত্রা করতে পারবেন না যদি না আপনি ইতিমধ্যে ফিরে
এসেছেন এবং উড্ডয়ন মঞ্চে মহাকাশযানটিকে উড়িয়ে দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। এটি একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ
ছবি, তবে এটি বোঝাবে যে আমরা সম্পূর্ণভাবে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বা নির্ধারিত ছিলাম: আমরা আমাদের মন পরিবর্তন করতে পারি নি। মুক্ত ইচ্ছার (free will) জন্য এতো কিছু।
অন্য সম্ভাবনা হচ্ছে যাকে আমি
বিকল্প-ইতিহাস পদ্ধতি (alternative-histories approach) বলি। এটি পদার্থবিজ্ঞানী
ডেভিড ডুয়েস (David Deutsch) দ্বারা প্রবর্তিত এবং মনে হচ্ছে
এটি Back to the Future এর পরিচালকের মনে যা ছিলো সেইরকম। এই ক্ষেত্রে,
একটি বিকল্প ইতিহাসে মহাকাশযান যাত্রা শুরু করার আগে ভবিষ্যত থেকে কোনো ফিরে আসা
নেই তাই মহাকাশযান বিস্ফোরিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু যখন ভ্রমণকারী ভবিষ্যত
থেকে ফিরে আসে তখন তিনি অন্য একটি বিকল্প ইতিহাসে প্রবেশ করেন। এতে মানবজাতি একটি
মহাকাশযান বানানোর জন্য ভীষণ চেষ্টা করে কিন্তু এটি ঊড্ডয়নের আগে ছায়াপথের অন্যত্র
থেকে আরেকটি একই ধরণের মহাকাশযান আবির্ভূত হয় এবং সেটিকে ধ্বংস করে।
ডেভিড ডুয়েস পদার্থবিজ্ঞানী রিচার্ড
ফাইনম্যান দ্বারা উপস্থাপিত ইতিহাসগুলোর-সমষ্টি (sum-over-histories) ধারণা
থেকে বিকল্প-ইতিহাস পদ্ধতির পক্ষে সমর্থন দাবি করেন। ধারণাটি হচ্ছে যে কোয়ান্টাম
তত্ত্ব অনুসারে মহাবিশ্বের কোনো একক অনন্য ইতিহাস নেই। পরিবর্তে মহাবিশ্বের
প্রতিটি একক সম্ভাব্য ইতিহাস রয়েছে, প্রতিটির নিজস্ব সম্ভাবনাসহ। এমন একটি
সম্ভাব্য ইতিহাস অবশ্যই হতে পারে যেখানে মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি রয়েছে,
যদিও সম্ভবত সম্ভাবনা কম।
কিছু কিছু ইতিহাসে স্থান-কাল এতো বেশি
কুঞ্চিত হবে যে মহাকাশযানের মতো বস্তুসমূহ তাদের অতীতে ভ্রমণ করতে সক্ষম হবে।
কিন্তু প্রতিটি ইতিহাস সম্পর্ণ এবং স্বনির্ভর, কেবল বক্র স্থান-কাল নয় বরং এতে
বস্তুগুলোকে-ও বর্ণনা করে। তাই একটি মহাকাশযান এক ইতিহাস থেকে অন্য ইতিহাসে
স্থানান্তর হতে পারবে না যখন এটি ফিরে আসে। এটিকে এখনো একই ইতিহাসে
স্ব-সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। তাই ডুয়েসের দাবি সত্ত্বেও আমি মনে করি ইতিহাসগুলোর-সমষ্টি
ধারণাটি বিকল্প-ইতিহাস ধারণার পরিবর্তে সামঞ্জস্যপূর্ণ-ইতিহাসের উপপ্রমেয়কে সমর্থন করে।
সুতারাং মনে হচ্ছে আমরা
সামঞ্জস্যপূর্ণ-ইতিহাসের ধারণা নিয়ে আটকা পড়েছি। তবে নিয়তিবাদ কিংবা মুক্ত ইচ্ছার
ক্ষেত্রে এটি সমস্যা সৃষ্টি করবে না যদি যেসব ইতিহাসসমূহে স্থান-কাল এতো বেশি
কুঞ্চিত যে বিশাল অঞ্চলে (macroscopic region) সময় ভ্রমণ সম্ভব সেগুলোর
জন্য সম্ভাব্যতাগুলো খুব কম হয়। আমি এটিকে কালক্রম সংরক্ষণ ধারণা (Chronology Protection Conjecture) বলি: পদার্থবিজ্ঞানের বিধিসমূহ বা সূত্রাবলি একটি
বিশাল স্কেলে সময় ভ্রমণ ব্যাহত করতে সমাপতন ঘটায় বা একযোগে কাজ করে।
কী ঘটে এই ব্যাপারে এটি মনে হচ্ছে যে যখন
স্থান-কাল অতীতে সময় ভ্রমণ অনুমোদন করার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ কুঞ্চিত হয় তখন অসদ কণাসমূহ
নির্দিষ্ট আবক্র পথ (closed trajectories) অনুসরণ করে বাস্তব কণায়
পরিণত (প্রায়) হতে পারে। অসদ কণাসমূহের ঘনত্ব এবং তাদের শক্তি অনেক বড় হয়। এর মানে হচ্ছে
যে এই ইতিহাসগুলোর সম্ভাব্যতা খুব কম। যেনো মনে হয় যে ইতিহাসবিদদের জন্য বিশ্বকে
নিরাপদ রাখার জন্য একটি কালক্রম সংরক্ষণ সংস্থা কাজ করছে। কিন্তু স্থান এবং কালের
কুঞ্চণ সংক্রান্ত এই বিষয় এখনো শৈশবাবস্থায়। এম-তত্ত্ব নামে পরিচিত তন্তু তত্ত্বের
একটি সার্বিক তত্ত্ব, যা সাধারণ আপেক্ষিকতা এবং কোয়ান্টাম তত্ত্বকে একত্রিত করার
ক্ষেত্রে আমাদের সেরা আশা, অনুসারে স্থান-কালের এগারটি মাত্রা থাকা উচিত, আমরা
যেভাবে চার মাত্রা অনুভব করি সেইরকম নয়। ধারণাটি হচ্ছে যে এই এগারটি মাত্রার সাতটি
এমন একটি ক্ষুদ্র স্থানে কুণ্ডলী বা আকুঁচিত থাকে যা আমরা লক্ষ্য করি না। অন্যদিকে
অবশিষ্ট চারটি দিক মোটামুটি সমতল এবং একেই আমরা স্থান-কাল বলে থাকি। যদি এই চিত্র
সঠিক হয়ে থাকে তবে এটি হয়তো সুবিন্যস্ত করা সম্ভব যে চারটি সমতল দিক সাতটি অত্যন্ত বক্র বা মোড়ানো
দিকগুলোর সাথে বিমিশ্রিত হতে পারে। এর ফলে কী হবে তা আমরা এখনো জানি না। কিন্তু
এটি অনেক উত্তেজনাপূর্ণ সম্ভাবনার কথা বলে।
উপসংহারে, স্থান
এবং সময়ে দ্রুত ভ্রমণ এবং ফিরে আসার সম্ভাবনা আমাদের বর্তমান জ্ঞান অনুযায়ী বাতিল
করা যায় না। সেগুলো বড় যৌক্তিক সমস্যা সৃষ্টি করবে, তাই আশা করি একটি কালক্রম
সংরক্ষণ আইন আছে যা লোকজনের অতীতে যাওয়া এবং তাদের পিতামাতাকে হত্যা করা প্রতিরোধ
করে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর ভক্তদের মন খারাপের কিছু নেই। এম-তত্ত্বে ভরসা
আছে।
সময় ভ্রমণকারীদের জন্য
একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করার কোনো মানে আছে? আপনি আশা করেন কেউ যোগ দেবে?
২০০৯ সালে আমি
আমার কলেজে, কেমব্রিজের গনভিল এবং কাইয়াসে, সময় ভ্রমণকারীদের জন্য একটি অনুষ্ঠানের
আয়োজন করেছিলাম, সময় ভ্রমণ সম্পর্কিত একটি চলচ্চিত্রের জন্য। শুধুমাত্র আসল সময়
ভ্রমণকারীরা যেনো আসে তা নিশ্চিত করার জন্য, আমি অনুষ্ঠানের শেষ না হওয়া পর্যন্ত
কোনো নিমন্ত্রণ পত্র পাঠাই নি। অনুষ্ঠানের দিন, আমি কলেজে আশা করে বসে ছিলাম,
কিন্তু কেউ আসে নি। আমি হতাশ হয়েছিলাম, কিন্তু অবাক হয় নি, কারণ আমি দেখিয়েছিলাম
যে যদি সাধারণ আপেক্ষিকতা সঠিক হয়ে থাকে এবং শক্তির ঘনত্ব ধনাত্মক হয়ে থাকে, তবে
সময় ভ্রমণ সম্ভব নয়। আমার অনুমিতিসমূহের যদি একটি-ও ভুল হতো তবে আমি আনন্দিত হতাম।
No comments:
Post a Comment