১
মাসুদ মহিউদ্দীন মিতুল নামের একজন ফলোয়ার ধর্ষণ-বিষয়ে যুগান্তরে প্রকাশিত এই লেখাটি [https://goo.gl/Zf9XS6] শেয়ার করে জানতে চেয়েছেন এটিতে উল্লেখিত তত্ত্ব, মনোবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা সঠিক কিনা। মোট বিচারে বলতে গেলে লেখাটির কিছু কিছু অংশ সঠিক, কিন্তু লেখাটিতে ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মনোবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও গবেষণার ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছেন, এবং ফ্রয়েডের ব্যাখ্যা যা কিনা আধুনিক মনোবিজ্ঞান ও স্নায়ুবিজ্ঞান সমর্থন করে না সেটি ব্যবহার করে তার বক্তব্য চালিয়ে দিতে চেয়েছেন।
২
তিনি পাভলভিয়ান কন্ডিশনিঙের (Pavlovian Conditioning/Classical Conditioning) ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছেন। আমার নিজের গবেষণা এই নিয়ে, বিশেষ করে এই পাভলভিয়ান কন্ডিশনিঙের স্নায়ুবিজ্ঞান নিয়ে, আরো বিশেষভাবে বলতে গেলে মস্তিষ্কের ডোপামিনারজিক (যেসব স্নায়ুকোষ প্রধানত ডোপামিন নামক স্নায়ুট্রান্সমিটার নিঃসরণ করে) স্নায়ুব্যবস্থা কীভাবে পাভলভিয়ান কন্ডিশনিংকে নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাবিত করে। তাই এই বিষয়ে আমি কিছু বলার যোগ্যতা রাখি।
মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী নানাভাবে শিখে। মানুষের শেখা অনেক জটিল, মানুষ দেখে শেখে, ঠেকে পড়ে শিখে, ভুল থেকে শিখে, অন্যকে দেখে শিখে, নিজে চেষ্টা করে শিখে, এবং কোনো কিছু না করে-ও শুধু পড়ে শিখতে পারে; এইসব কারণে অন্যান্য প্রাণী থেকে মানুষ আলাদা এবং এগিয়ে আছে (মানুষের মস্তিষ্ককে সাধুবাদ জানান)।
এতো কিছুর পরে-ও পাভলভিয়ান কন্ডিশনিং মাধ্যমে মানুষ শেখে, এটি খুবই মৌলিক শিক্ষার মাধ্যম, বিবর্তনের মাধ্যমে এটি মানুষে রয়ে গেছে। যেকোনো প্রাণীর উদ্দেশ্য মূলত দুটো- প্রতিকূল পরিবেশ টিকে থাকা (শারীরিক মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখা, নিজের প্রভাব প্রতিপত্তি সম্পদ বাড়ানো ও টিকিয়ে রাখা) ও বংশবৃদ্ধি করে নিজের জিনকে ছড়িয়ে দেয়া (সন্তান জন্মদান, লালন-পালন ইত্যাদি)। পাভলভিয়ান কন্ডিশনিং এককোষী প্রাণী থেকে শুরু করে বিশাকার নীল তিমি সব-প্রাণীতেই দেখা যায়, তাই এটি মৌলিক শিক্ষার মাধ্যম, যা তার বিবর্তনের মূল উদ্দেশ্য দুটো পূরণে সাহায্য করে। পাভলভিয়ান কন্ডিশনিং-এ প্রাণিকে নিজে কিছু করতে হয় না (মানে এফোর্ট লাগে না), যা কিনা ইন্সট্রুমেন্টাল কন্ডিশনিঙে লাগে (Instrumental conditioning- যেমন আপনি প্রেমিকার সাথে দেখা করতে গেলেন, কিন্তু প্রেমিকা থাকে দশতলায় এবং লিফট কাজ করে না, তাই প্রেমিকার সাথে দেখা করার জন্য দশতলা সিঁড়ি ভেঙে উঠলেন)। অন্যদিকে পাভলভিয়ান কন্ডিশনিং-এ প্রাণির এফোর্ট লাগে না, যেমন প্রেমিকা ও আপনি একই ইস্কুলে একই ক্লাসে পড়েন, এবং সেখানে দেখা করলেন।
পাভলভের মূল গবেষণাটা এইরকম- পাভলভ তার গবেষণাগারের কুকুরদের খাবার দেয়ার আগে একটি ঘণ্টা বাজাতেন। খাবার দেখলে মানুষ, কুকুর ইত্যাদি প্রাণীর লালা জমে, লালা ঝরে, যা মূলত খাবার গ্রহণের প্রক্রিয়াকে সহজ করার জন্য মস্তিষ্ক থেকে শরীরকে সংকেত প্রদানের মাধ্যমে হয় (চিন্তা করে দেখেন লালা না থাকলে আপনি খাবার চাবাইতে কিংবা গিলতে পারতেন?)। এই লালা ঝরা হচ্ছে খাবার দেখার ফলে সৃষ্ট অবস্থা বা Unconditioned response। খাবার হচ্ছে Unconditioned stimulus। তো পাভলভ বিশাল জ্ঞানী ছিলেন, তার মাথায় কী ভূল চাপলো যে তিনি কুকুরদের খাবার দেয়ার আগে একটি ঘণ্টা বাজাতেন, এবং দিনের পর দিন চলতে লাগলো একই কাহিনি, প্রতিবার খাবার দেয়ার আগে ঘণ্টা বাজানো। একদিন পাভলভ ঘণ্টা বাজালেন কিন্তু কোনো খাবার দিলেন না, তারপর-ও দেখা গেলো যে কুকুরের লালা ঝরে; অর্থাৎ ঘন্টা ও খাবারের মধ্যকার সম্পর্ক শেখার পরে (অর্থাৎ, ঘন্টা খাবারকে প্রিডিকট করে, মানে কুকুর শেখে যে ঘন্টা বাজা মানে খাবার আসার সময়, তাই মস্তিষ্ক লালা ঝরানোর সংকেত দেয় খাবারগ্রহণের প্রস্তুতির জন্য) খাবার না দিলে-ও ঘণ্টা বাজালে কুকুরের লালা ঝরে; যে ঘণ্টা আগে লালা ঝরাতো না সেই ঘন্টা এখন লালা ঝরায়, অর্থাৎ ঘণ্টা neutral stimulus / uncondtioned stimulus থেকে conditioned stimulus এ পরিণত হয়েছে। এইভাবে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী তার পরিবেশের অনেক কিছু শেখে। যেমন, কোন জায়গায় কখন গেলে কী খাবার পাওয়া যাবে (অর্থাৎ পরিবেশের বিভিন্ন উপাদান conditioned stimulus হিসেবে কাজ করে), যেমন এক বন্ধু সিগারেট খায় সেটা দেখে আপনি সিগারেট খাওয়া শিখলেন এবং এখন সেই বন্ধুকে দেখলেই আপনার সিগারেট খেতে ইচ্ছে করে কিংবা দুজনে মিলে সিগারেট খান। মাদক গ্রহণ, যৌনতা, শেখা ইত্যাদি নানা আচরণ ও আচরণের অংশাবলি পাভলভিয়ান কন্ডিশনিং, এমনকি শেয়ার বাজারের কিছু কিছু অবস্থা-ও।
কথা হচ্ছে ধর্ষণ কি পাভলভিয়ান কন্ডিশনিং? যৌনতার অনেক বিষয় পাভলভিয়ান কন্ডিশনিং হলে-ও ধর্ষণ পুরোপুরি পাভলভিয়ান কন্ডিশনিং না। পাভলভিয়ান কন্ডিশনিঙের জন্য uncondtioned stimulus (এই ক্ষেত্রে ধর্ষণের শিকার হওয়া নারী অথবা পুরুষ) এর সাথে দীর্ঘমেয়াদি এগেজমেন্ট বা মিথস্ক্রিয়া হতে হবে, কিন্তু ধর্ষণের ক্ষেত্রে এটা হয় না, অধিকাংশ ধর্ষণের ক্ষেত্রেই আক্রান্ত নারী আগে যৌনতায় লিপ্ত হয় না ধর্ষকের সাথে, ধর্ষক তার শক্তি ও প্রভাব বিস্তার করে অসম্মতিতে যৌনতায় লিপ্ত হয়, এখানে এফোর্ট কাজ করে, যা বড়জোর instrumental conditioning হবে, পাভলভিয়ান কন্ডিশনিং না।
৩
লেখক মোহাম্মদ ইলিয়াস ফ্রয়েডের সাইকির স্ট্রাকচার (ইড-ইগো-সুপারইগো) ইত্যাদি ব্যবহার করে ধর্ষণ ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করেছেন। তবে বলে রাখি ফ্রয়েডের এই বক্তব্য আধুনিক মনোবিজ্ঞান ও স্নায়ুবিজ্ঞান সমর্থন করে না। বিজ্ঞানের মূল ভিত্তি হচ্ছে যেকোনো বক্তব্য তত্ত্বকে পরীক্ষা করার জন্য falsifiability (অর্থাৎ, proposition, statement, theory or hypothesis to be proven wrong) হতে হবে, অর্থাৎ আপনাকে মিথ্যা প্রমাণ করার সুযোগ থাকতে হবে। ফ্রয়েডের অধিকাংশ বক্তব্য ও "তত্ত্ব" গবেষণা করে মিথ্যা প্রমাণের উপযোগী না। যেমন ধরেন আমি যদি এখন দাবি করি যে আমার একটা ভূত আছে তবে এটি মিথ্যা প্রমাণ করার উপযোগী না (আপনি ভূত মাপছেন? দেখছেন?)। ধর্ম, ঈশ্বর ইত্যাদি নানা জিনিস এইরকম falsifiability -হীন, ফলে এগুলো বিজ্ঞানের গবেষণার উপযোগী না। ফ্রয়েড যৌনতার যেসব ব্যাখ্যা দিয়েছেন (যেমন তার সাইকোসেক্সুয়াল 'থিউরী") সেইসব ভুয়া, গাঁজাভুরি। এই বিষয়ে পড়তে চাইলে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্ডারগ্রাজুয়েটে পড়ায় এইরকম মনোবিজ্ঞানের একটি বই পড়ে দেখেন। আমি জানি বাঙলাদেশের মানুষ এখনো মনে করে মনোবিজ্ঞান মানে ফ্রয়েড, বলে রাখি যে এখনকার সময়ে মনোবিজ্ঞানের প্রাথমিক কোর্সগুলোতে ইতিহাসের অংশ হিসেবে ফ্রয়েডকে পড়ানো হয়, অনেকক্ষেত্রে তা-ও না। ইড-ইগো-সুপারইগোর ভারসাম্যহীনতার কারণে ধর্ষণ হয় না, ধর্ষণ হয় পুরুষতান্ত্রিক পরিবেশ ও মনোভাবে বড় হওয়া, যৌনশিক্ষা না পাওয়া ব্যক্তির বল ও প্রভাব বিস্তারের কারণে। ধর্ষণের মনোবিজ্ঞান নিয়ে আমার একটি বিস্তারিত লেখা আছে [ http://ashrafovi.blogspot.ca/2016/10/blog-post_17.html ], আগ্রহীরা পড়ে দেখতে পারেন ও শেয়ার করতে পারেন। তাই ধর্ষণ কেনো হয় সেই বিষয়ে একই কথা বারবার না বলে যেকথা বলতে চাই তা হচ্ছে যে বাঙলাদেশের প্রেক্ষাপটে ধর্ষণের আধিক্যের অন্যতম কারণ বিচারহীনতা ও যৌনশিক্ষার অভাব। আইনের প্রয়োগের অভাব ও ধর্ষকের শাস্তি নিশ্চিত করতে না পারা (আইনের প্রয়োগ অপরাধ কমায়, পিরিয়ড), এবং যৌনশিক্ষার অভাব। যৌনশিক্ষা মানে কীভাবে যৌনকাজ করতে হয় এমন নয়, বরং যৌনতায় সম্মতি ও সম্মতির সীমা, যৌনরোগ প্রতিরোধ, সংক্রামক ব্যাধি প্রতিরোধ, কিশোরীদের অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ রোধ ইত্যাদি নানা ব্যাপার আছে।
বাঙলাদেশের অনেক পুরুষ মনে করে নিজে প্রেমে পড়া মানে একটি মেয়ে আপনার সাথে শুতে বাধ্য, প্রেম করতে বাধ্য; মনে করে যৌন-কাজে লিপ্ত হতে নারীরা বাধ্য; মনে করে যে নারীর অধিকার ও সস্মান পুরুষের চেয়ে কম।
মূলত দুই ধরণের ধর্ষক হয়ে থাকে- মনোবিকারগ্রস্ত (psychopathic) ও অমনোবিকারগ্রস্ত (non-psychopathic)। প্রায় সব ধরণের ধর্ষকদের মাঝে কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য প্রায় লক্ষ্য করা যায়- নারীদের প্রতি উগ্র আচরণ বা মনোভাব, নারীদের দ্বারা প্রতারিত বা প্রভাবিত হয়েছে এমন ভুল ধারণা নিয়ে চলা, অথবা মনে করা যে জীবনের কোনো না কোনো সংকটময় ঘটনার জন্য একজন নারী দায়ী, বাবা-মায়ের শারীরিক ও বাক ঝগড়ার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে বড় হওয়া, এবং ছোটবেলায় শারীরিক অথবা যৌনভাবে নির্যাতনের শিকার হওয়া । কিছু কিছু ধর্ষকদের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে তারা নারীদের বন্ধুত্বতা বা সৌজন্যতাকে অন্য কিছুর আমন্ত্রণ হিসেবে ভুল পাঠ করেন, তারা মনে করেন যে সেই নারী অন্য কিছু চায়, অথচ বাস্তবে সেই নারী হয়তো কেবল সামাজিকতার জন্য কথা বলছে বা হাসছে। তবে অনেক ধর্ষকের প্রায় বিভিন্ন সামাজিক অবস্থা বা ঘটনায় কীরকম আচরণ করতে হবে সেই ধারণা থাকে না, আন্তর্সাম্পর্কিক কলাকৌশল জানা থাকে না, আত্মমর্যাদাহীন ও আত্মবিশ্বাসহীন হয়ে থাকে, এবং তারা অন্যদের প্রতি,বিশেষ করে ধর্ষিতার প্রতি সহমর্মিতা (empathy) অনুভব করে না । অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় যে অন্যদের প্রতি সহমর্মিতা অনুভব করলে-ও তারা শুধুমাত্র আক্রান্ত নারীর প্রতি সহমর্মিতা অনুভব করে না।
৪
লেখক মোহাম্মদ ইলিয়াসের জ্ঞানপাপ ধরা পড়ে তার লেখার "কীভাবে এই কন্ডিশনিং হচ্ছে?" অংশে এসে। তিনি পাঠ্যপুস্তক থেকে শুরু করে সাহিত্য সবকিছুকে দোষারোপ করে গেছেন। "নারীকে পণ্য হিসেবে উপস্থাপন ও "নৈতিক শিক্ষার অভাব" এই অংশ বাদে তার লেখা ভুল বক্তব্য ও ভুল ব্যাখ্যার উপস্থাপনা।
"একজন মিথ্যাবাদী, প্রতারক, উচ্চাভিলাষী, অল্প শিক্ষিত, চরিত্রহীন, পতিতা কোয়ালিটির মেয়েকে দেশের সেরা মেয়ে করার নষ্ট প্রতিযোগিতা" ও "নারীদের সভ্যভাবে চলতে উদ্বুদ্ধকরণ" এবং "নারীদের সভ্যভাবে চলতে না বলে, পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ না করে, শুধু পুরুষদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে ধর্ষণ বন্ধ হবে না" - তার ইত্যাদি বক্তব্য পড়ে মনে হয় তিনি বুদ্ধিজীবী পুরুষতান্ত্রিক ছাগু। নারীর চলাফেরার কারণে, নারীর পোষাকের কারণে ধর্ষণ হয় না, ধর্ষণ হয় ইনিয়েবিনিয়ে আপনার লেখার মতো লেখার মাধ্যমে ধর্ষণকে নরমালাইজেশনের কারণে। আপনি যেসব বক্তব্য দিয়েছেন সেটির সাথে উপরে উল্লেখিত অনেক ধর্ষকের মনোভাবের মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
৫
কথা হচ্ছে যে আমি এই বিশাল লেখা কেনো লিখলাম? দেখলাম যে যুগান্তরের মতো একটি দৈনিক এটি প্রকাশ করেছে, এটি শেয়ার হয়েছে প্রায় ২৪ হাজার, মানে পড়ছে তারচেয়ে আর-ও কয়েক গুণ মানুষ। এইসব মানুষকে "যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হতে হবে, তবে..." "দেশে অন্যকোনো বিচার হয় না, শুধু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার..." ধরণের লেখার মতন তার লেখা পড়ে ধর্ষণের কারণ সম্পর্কে ভুল ধারণা দেয়ার বিপরীতে আমার কিছু বলার ও শেয়ার করার দায়িত্ব আছে বলে মনে হলো।
No comments:
Post a Comment