১
সারা পৃথিবীতে প্রায় ৩০ মিলিয়ন মানুষ আলঝেইমারের রোগে
আক্রান্ত, যার অন্যতম রূপ হচ্ছে স্মৃতিভ্রংশ বা ডেমেনশা (dementia)। এখনো পর্যন্ত আলঝেইমারের রোগের কোনো চিকিৎসা নেই, রোগ সারানোর জন্য
সেইরকম কোনো ওষুধ নেই; যা আছে তা হচ্ছে রোগের উপসর্গকে কমানো অথবা “সহ্য” করার উপশমের জন্য, কিংবা রোগকে শ্লথ করার জন্য। আলঝেইমারের
রোগ হওয়া মানে গড়ে ৫-১০ বছরের মাঝে মৃত্যুবরণ করা।
তবে কিছু কিছু গবেষণা মতে আলঝেইমারের রোগ হওয়ার পেছনে
হার্পীজ (হার্পীস) বা বিসর্প ভাইরাসের হাত থাকতে পারে। যদি তাই হয় তবে কার্যকরী
এবং নিরাপদ প্রতি-ভাইরাল ওষুধ দিয়ে রোগটির চিকিৎসা করা যাবে কিংবা প্রতিরোধ করা
যাবে। এবং সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে যে আমরা শিশু বা বাচ্চাদের ভ্যাকসিন দিতে পারবো
যেনো তারা রোগে আক্রান্ত না হয়! আলঝেইমারের রোগের ক্ষেত্রে যে ভাইরাসকে দায়ী করা
হয় সেটি হচ্ছে herpes simplex virus type 1 (HSV1), যার
আক্রমণের ফলে মুখ বা ঠোঁটের কোণে জ্বরঠোসা বা ফোসকা বা ঘা
হয়।
২
অধিকাংশ মানুষই ছোটবেলায় এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়, বিশেষ করে
মায়ের কাছ থেকে গর্ভের সন্তান বা স্তন্যপানের মাধ্যমে সন্তানের শরীরের সংক্রামিত
হতে পারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটি প্রান্তিক স্নায়ুতন্ত্রে (peripheral nervous
system; মস্তিস্ক ও মেরুদণ্ড ছাড়া সারা শরীরে ছড়িয়ে থাকা স্নায়ু ও
স্নায়ুতন্ত্রের অংশ নিয়ে প্রান্তিক স্নায়ুতন্ত্র গঠিত) এটি সুপ্ত অবস্থায় থাকে।
কিন্তু যখন আপনি পীড়া বা স্ট্রেসের কারণে দুর্বল অনুভব করেন অথবা আপনার
রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা একটু দুর্বল হয়ে ওঠে তখন এই ভাইরাস জেগে ওঠে, ফলে ফোসকা ঘা
ইত্যাদি হয়।
১৯৯১ সালের দিকে ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক Ruth Itzhaki এবং তার গবেষণার দল আবিষ্কার করে যে বয়স্ক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এই ভাইরাস
মস্তিস্কে-ও লুকিয়ে থাকে! এবং ১৯৯৭ সালের দিকে তারা আরো আবিষ্কার করে যে যেসব
ব্যক্তির APOE4 জিনটি আছে তাদের মস্তিস্কে এই ভাইরাস থাকলে
তাদের আলঝেইমারের রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক গুণ বেড়ে
যায়!
মস্তিস্কে ভাইরাসটি সুযোগ বুঝে জেগে ওঠে এবং বারেবার
বংশবৃদ্ধি করে বিভিন্ন স্নায়ুকোষকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। বিশেষ করে যেসব ব্যক্তির APOE4
জিন আছে এবং তাদের মস্তিষ্কে এই ভাইরাসের আলামত পাওয়া যায় তাদের ক্ষেত্রে
আলঝেইমারের রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ১২ গুণ বেশি, যাদের এই জিনটি কিংবা
মস্তিস্কে এই ভাইরাসটি নেই তাদের তুলনায়।
কথা হচ্ছে যে কীভাবে এই ভাইরাস স্নায়ুকোষদের ক্ষতিগ্রস্ত
করে এবং আলঝেইমারের রোগ সৃষ্টি করে? গবেষক দল পরবর্তীতে আবিষ্কার করেন যে এই
ভাইরাসের কারণে বেটা-অ্যামিলয়েড (beta-amyloid) এবং অস্বাভাবিক টাউ
প্রোটিন (abnormal tau proteins) জমা হতে শুরু করে। এই
প্রোটিনগুলোর অস্বাভাবিক জট পাকানো বা জমা হওয়া আলঝেইমারের রোগের অন্যতম উপসর্গ।
যেহেতু বয়েসের সাথে সাথে মানুষের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমতে শুরু করে এবং
রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে আসে তখন এই ভাইরাস আর সুপ্ত থাকে না, দুর্বলতার
সুযোগ নিয়ে মস্তিস্কে প্রবেশ করে শরীরের অন্যান্য অংশ থেকে (সাধারণত রক্ত-মস্তিষ্ক
বন্ধক বা blood-brain
barrier এর কারণে মস্তিস্কে সহজে কিছু প্রবেশ করতে পারে না, কিন্তু
বয়েসের সাথে সাথে এই বন্ধকের ক্ষমতা কমে আসে)। এবং মস্তিস্কে প্রবেশের পরে এই
ভাইরাস বার বার সক্রিয় হয়ে অনেক স্নায়ুকোষকে আক্রমণ করে এবং ফলে ভাইরাস-জনিত
প্রদাহের সৃষ্টি করে, ধীরে ধীরে বারবার ক্ষতিগ্রস্ততার কারণে স্নায়ুকোষগুলো মারা
যেতে শুরু করে, এবং যাদের APOE4 জিন আছে তাদের অবস্থা আরো
খারাপ হয়ে থাকে, জিনের কারণে পূর্ব-ঝুঁকির কারণে।
৩
এখন উপায় কী?
যেহেতু এখানে ভাইরাস দায়ী তাই প্রতি-ভাইরাস বা অ্যান্টি-ভাইরাল ওষুধ দিয়ে
আলঝেইমারের রোগের চিকিৎসা হতে পারে। তবে যেকোনো অ্যান্টি-ভাইরাল ওষুধ ব্যবহার
করলেই হবে না, রোগীকে ভালো চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণে থাকতে হবে, কারণ অনেক ক্ষেত্রে অ্যান্টি-ভাইরাল
ওষুধ ক্ষতিকর প্রভাব বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।
গবেষকরা দেখেন যে অ্যান্টি-হার্পীজ অ্যান্টি-ভাইরাল ওষুধ, acyclovir, এই HSV1 ভাইরাসের ডিএনএ প্রতিলিপি
সৃষ্টিতে বাঁধা সৃষ্টি করতে পারে, এবং ফলে গবেষণাগারে কোষ কালচারে HSV1 ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট
বেটা-আমিলয়েড এবং টাউ প্রোটিনের মাত্রা কমে যায়!
এখানে বলে রাখা ভালো যে উপরে উল্লেখিত গবেষণাগুলো হার্পীজ ভাইরাস এবং
আলঝেইমারের রোগের মধ্যে সম্পর্ক পেয়েছে, তার মানে এই নয় যে এই ভাইরাসই রোগটি হওয়ার
একমাত্র কারণ। তবে আশার কথা হচ্ছে যে তাইওয়ানে পরিচালিত এক গবেষণা মতে অ্যান্টি-হার্পীজ
ওষুধ ব্যবহার করে বিশালভাবে আলঝেইমারের রোগ সফলভাবে প্রতিরোধ করা গেছে। এই ধরণের
গবেষণা আসলেই আশার আলো দেখায়।
No comments:
Post a Comment