আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি
১০০০০০ জনে ৬ জনের মস্তিষ্ক ক্যান্সার হয়, এবং জাতীয় ক্যান্সার প্রতিষ্ঠানের
মতে প্রতিবছর প্রায় ২৪ হাজার জন নতুন করে মস্তিষ্ক ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। বিভিন্ন
ধরণের ক্যান্সারের মধ্যে অবশ্য নারীদের ক্ষেত্রে স্তন ক্যান্সার সবচেয়ে ভয়াবহ,
যাতে প্রতি ১০০০০০ জনে ১২৫ জন আক্রান্ত হন। এবং পুরুষদের ক্ষেত্রে অণ্ডকোষের
ক্যান্সার সবচেয়ে ভয়াবহ, প্রতি ১০০০০০ জনে ১২০ জন আক্রান্ত হন। যাহোক, স্তন
ক্যান্সার কিংবা অণ্ডকোষের ক্যান্সারের তুলনায় মস্তিষ্ক ক্যান্সার কম হলে-ও মস্তিষ্ক
ক্যান্সারের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে যে এটি সনাক্ত করতে দেরি হয়ে
যায়, এবং ততদিনে ক্যান্সার গুরুতর পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে যে চিকিৎসা করে আরোগ্য করে
তোলা কঠিন। মস্তিষ্ক ক্যান্সারের ৮০% হচ্ছে গ্লিয়োমা (glioma)।
মস্তিস্কে স্নায়ুকোষের পাশাপাশি স্নায়ুকোষকে সাহায্য করার জন্য গ্লিয়া বা গ্লিয়াল
কোষ (glial cell) নামক অন্য ধরণের (অ-স্নায়ুকোষ) কোষসমূহ
থাকে, যেগুলো স্নায়ুকোষকে সাহায্য করে, পুষ্টি যোগায়, এবং স্নায়ুকোষকে সুরক্ষিত
করে, তাদের উপর চর্বির আস্তরণ সৃষ্টি করে, ফলে স্নায়ু-যোগাযোগ দ্রুততর হয়। যাহোক,
এই গ্লিয়া কোষের ক্যান্সারই হচ্ছে গ্লিয়োমা।
তো মস্তিস্কের ক্যান্সার ধরা পড়লে অধিক
ব্যবহৃত চিকিৎসা উপায় হচ্ছে তেজস্ক্রিয়তা বা রেডিয়েশন। অর্থাৎ, তেজস্ক্রিয়তা
ব্যবহার করে আক্রান্ত ক্যান্সার কোষকে ধ্বংস করে ফেলা, কিন্তু এর ফলে আশপাশের অনেক
ভালো কোষ-ও মারা যায়, ক্ষতিগ্রস্ত হয়; এবং বাজে ব্যাপার হচ্ছে মস্তিস্কের
রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা এই অস্বাভাবিক ব্যাপারকে “রোগ বা রোগ-সৃষ্টিকারী ব্যাপার” হিসেবে ধরে নিয়ে আক্রমণ করে, ফলে আর-ও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়
সংলগ্ন অংশ। তেজস্ক্রিয়তা চিকিৎসা ব্যবহারের ফলে শিশু এবং বয়স্ক দুই ধরণের বয়েসসীমার
রোগীদেরই চিন্তাগত কার্যাবলি (cognitive function) উল্লেখযোগ্যভাবে
প্রভাবিত হয়, লোপ পায় কিংবা স্বাভাবিকের চেয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়, বিশেষ করে
শিশু (যাদের মস্তিষ্ক এখনো বিকশিত হচ্ছে) এবং বয়স্কদের (যাদের মস্তিস্কের অবস্থা
এমনতেই অবনতির দিকে) ক্ষেত্রে এই প্রভাব বেশি (প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায়)। যেমন,
শিশুদের ক্ষেত্রে তেজস্ক্রিয়তার ফলে আইকি (বুদ্ধিমত্তার “মাপার” একটি ইন্ডেক্স) ৮-১২ পয়েন্ট কমে যায় তেজস্ক্রিয়তা চিকিৎসা
নেয়ার এক বছরের পরেই, যা কিনা অনেক বড় হ্রাস। তাদের সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে,
দীর্ঘমেয়াদি স্মৃতি তৈরি ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রে, মস্তিস্কের নির্বাহী কার্যকলাপের
ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিতে শুরু করে। এছাড়া রোগীদের আচরণে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য
করা যায়, অনেকে আবেগপ্রবণ বা ঝোঁকের বশে নানা আচরণ করেন (জুয়া খেলা বা নেশা করা,
অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনা ইত্যাদি), নেতিবাচক আবেগ, যেমন রাগ দেখানো ইত্যাদি আচরণ
বেশি লক্ষ্য করা যায়।
তেজস্ক্রিয়তা চিকিৎসা কীভাবে এবং কেনো
চিন্তাগত কার্যাবলিকে প্রভাবিত (হ্রাস) করে তা জানার জন্য সাম্প্রতিক এক গবেষণায় Xi Feng, Sharon Liu,
David Chen, Susanna Rosi, Nalin Gupta নামক স্নায়ুবিজ্ঞানী এবংগবেষকরা ইঁদুর-জাতীয় প্রাণীর মডেল ব্যবহার করেন।
মস্তিস্কে এক ধরণের কোষ আছে যাদেরকে
ক্ষুদ্রগ্লিয়া বা মাইক্রোগ্লিয়া (microglia) বলে, এরা মস্তিস্কের রোগপ্রতিরোধ
ব্যবস্থার ‘সেনাদল’। পূর্ববর্তী গবেষণায় দেখা গেছে যে
তেজস্ক্রিয়তা চিকিৎসার ফলে মস্তিস্কে এই কোষগুলো বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে, অর্থাৎ,
তেজস্ক্রিয়তা চিকিৎসার বিরুদ্ধে মস্তিষ্ক “প্রতিরোধ” গড়ছে, ফলে
মস্তিস্কের স্নায়ুসন্ধি (স্নায়ুসন্ধি হচ্ছে স্নায়ুকোষগুলোর মধ্যে যোগাযোগের জন্য
ক্ষুদ্র “সন্ধিস্থান” বা জায়গা, যার মধ্য দিয়ে বিভিন্ন
রাসায়নিক পদার্থ এক কোষ থেকে অন্য কোষে যায় এবং যোগাযোগ সম্পন্ন হয়) ক্ষতিগ্রস্ত
হয়। তবে তেজস্ক্রিয়তা চিকিৎসার ফলে মস্তিস্কের রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থা সক্রিয় হয়ে
ওঠে খারাপ নয়, সমস্যা সৃষ্টি হয় এটি যখন থামার তখন থামে না, এবং দীর্ঘদিন ধরে
সক্রিয় থাকলে স্নায়ুকোষগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে, এমনকি ভালো স্নায়ুকোষগুলোকে-ও
আক্রমণ করা শুরু করে। ব্যাপারটিকে এভাবে দেখতে পারেন, আপনাদের পাড়াতে পাড়ার
মাস্তান প্রায় সমস্যা করে, এদের দমন করার জন্য পুলিশ আসলো, কিন্তু এই দমন
কার্যকলাপ দীর্ঘদিন ধরে চললে পাড়ার সবাই প্রভাবিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে- এই রকম।
যেহেতু গ্লিয়াকোষের ক্যান্সারে এবং
তেজস্ক্রিয়তা চিকিৎসা দুইয়ের ফলে মস্তিস্কের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা সক্রিয় হয়ে ওঠে তাই
গবেষকরা ঠিক জানতো না একটি ক্যান্সার-মুক্ত মস্তিস্কে এবং ক্যান্সার-আক্রান্ত
মস্তিস্কে রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা তেজস্ক্রিয়তা চিকিৎসার ক্ষেত্রে একইভাবে সক্রিয়
হয়ে ওঠে কিনা। এটি নির্ণয় করার জন্য গবেষকরা ইঁদুর-জাতীয় প্রাণীর মডেল ব্যবহার করেন,
যা মানুষের ক্ষেত্রে ক্লিনিকে যেমন ঘটে সেটি প্রতিফলনের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে।
তারা ভালো রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থার ইঁদুরদের মস্তিস্কে ক্যান্সার সৃষ্টি করেন যে
ক্যান্সার কোষগুলোর ক্ষেত্রে রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা একই ধরণের।
কথা হচ্ছে যে মস্তিস্কের ক্যান্সারের ফলে
নাকি তেজস্ক্রিয়তা চিকিৎসার ফলে চিন্তাগত কার্যাবলি হ্রাস পায়? এটি নির্ণয় করার
জন্য গবেষকরা ক্যান্সার-আক্রান্ত দুই দল ইঁদুরদের মধ্যে একদলকে তেজস্ক্রিয়তা
চিকিৎসা দেন, এবং অন্যদলকে দেন নি; এবং দুই দলের চিন্তাগত কার্যাবলি পরীক্ষা করে
ইঁদুরদের উপযোগী নতুন বস্তু সনাক্তকরণ পরীক্ষা (novel object recognition (NOR) test) ব্যবহার করেন। ইঁদুর জাতীয় প্রাণীদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে তাদেরকে একটি
নতুন জিনিস বা বস্তু দেখালে বা দিলে তারা সেটিতে আগ্রহ বোধ করে বেশি, বেশি সময়
কাটায় বা বেশি সময় খেলা করে সেটির সাথে, পুরানো একটি জিনিস বা বস্তুর তুলনায়। তাই
যদি নতুন বস্তু সনাক্তকরণ পরীক্ষায় যদি
একটি ইঁদুর বেশি সময় না কাটায় তবে এর মানে হচ্ছে যে বস্তুটি যে নতুন সেটি ইঁদুরটি
ঠাহর করতে পারছে না, অর্থাৎ, পুরানো এবং নতুন বস্তুর মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করতে
পারছে না, যা কিনা স্মৃতিশক্তির একটি পরীক্ষা।
যাহোক, গবেষকরা দেখেন যে সেসব ইঁদুর তেজস্ক্রিয়তা
চিকিৎসা পেয়েছে সেগুলো নতুন স্মৃতি তৈরির ক্ষেত্রে সমস্যা দেখায়, এবং যেসব
ইঁদুরগুলো কোনো তেজস্ক্রিয়তা চিকিৎসা পায় নি সেগুলো চিন্তাগত কার্যকলাপে পরিবর্তন
দেখায় নি। অর্থাৎ, তেজস্ক্রিয়তা চিকিৎসার ফলে চিন্তাগত কার্যাবলি হ্রাস পায়,
শুধুমাত্র ক্যান্সার-আক্রান্তের ফলে নয়। বিশেষ করে মস্তিস্কের হিপোক্যাম্পাস নামে
একটি অংশ, যা স্মৃতি তৈরি ও সংরক্ষণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, সেটি তেজস্ক্রিয়তা চিকিৎসার
ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়; মস্তিস্কের বহিঃস্তরগুলো, যেগুলো স্মৃতি সংরক্ষণ কিংবা শেখার
ক্ষেত্রে তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয় সেগুলো তেজস্ক্রিয়তা চিকিৎসার ফলে তেমন ক্ষতিগ্রস্ত
হয় না; অর্থাৎ তেজস্ক্রিয়তা চিকিৎসা মস্তিস্কের শেখা ও নতুন স্মৃতি তৈরিতে জড়িত
অংশগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
যেহেতু তেজস্ক্রিয়তা চিকিৎসার সময়ে বা পরে
মস্তিস্কের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থার সক্রিয় হওয়াতে চিন্তাগত কার্যাবলি হ্রাস পায় তাই
এরপর গবেষকরা একদল ইঁদুরদেরকে তেজস্ক্রিয়তা চিকিৎসা দেওয়ার আগে ক্যালিফোর্নিয়ার Plexxikon Inc. নামক একটি কোম্পানির উদ্ভাবন করা PLX5622 নামক যৌগ প্রদান
করে, যা মস্তিস্কের CSF-1R নামক
রিসেপ্টরকে দমন করে। CSF-1R নামক
রিসেপ্টর সক্রিয় হয় মস্তিস্কে কোনো ক্ষতির পর, যা মস্তিস্কের রোগপ্রতিরোধ
ব্যবস্থাকে সক্রিয় করে তোলে। অর্থাৎ, গবেষকরা তেজস্ক্রিয়তা চিকিৎসা দেওয়ার আগে
রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাকে দমিয়ে রাখতে চেয়েছেন।
গবেষকরা অভূতপূর্বভাবে দেখেন যে তেজস্ক্রিয়তা
চিকিৎসা দেওয়ার আগে রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাকে দমিয়ে তারা মস্তিস্কে ক্যান্সারের
টিউমারকে তেজস্ক্রিয়তা ব্যবহার করে কমাতে পারেন, চিন্তাগত কার্যাবলি প্রভাবিত না
করে; অর্থাৎ রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা সক্রিয় না হওয়াতে (CSF-1R নামক রিসেপ্টরকে ওষুধের মাধ্যমে দমিয়ে রেখে) আশপাশের ভালো কোষগুলো ও
অংশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয় নি।
এখন কথা হচ্ছে মানুষের ক্ষেত্রে কী প্রভাব
রাখতে পারে এই গবেষণা? মস্তিস্কের ক্যান্সার-আক্রান্ত রোগীদের তেজস্ক্রিয়তা
চিকিৎসা দেওয়ার আগে তাদেরক CSF-1R নামক রিসেপ্টর
দমিয়ে রাখার ওষুধ কিংবা ইঞ্জেকশন প্রদান করে রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাকে সক্রিয় না করে
তেজস্ক্রিয়তা চিকিৎসা দিলে তেজস্ক্রিয়তা ও রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থার অতিরিক্ত
সক্রিয়তার কারণে স্বাভাবিকভাবে যে ভয়াবহ চিন্তাগত কার্যাবলির হ্রাস দেখা যায় তা
হবে না! CSF-1R নামক রিসেপ্টরকে দমিয়ে রাখে
এইরকম আরেকটি যৌগ ব্যবহার করে ইতিমধ্যে আরেকটি রোগের জন্য ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল
চলছে!
তথ্যসূত্র
Feng, X., Liu, S., Chen, D., Rosi, S., & Gupta, N. (2018). Rescue of cognitive function following fractionated brain irradiation in a novel preclinical glioma model. eLife, 7, e38865.
No comments:
Post a Comment