অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার, মানসিক স্বাস্থ্যহানি, এবং বিষণ্নতার রোগ ও অটিজমের ঝুঁকি বৃদ্ধি
১
মনে করুন যে, আপনার ছোট ভাইবোন কিংবা সন্তানকে কোনো এক সংক্রমণের (infection) কারণে হাসপাতালে ভর্তি করালেন এবং সেখানার ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিকের ফলে, কিংবা মনে করুন যে অতিরিক্ত পাকনামি করে আপনার অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহারের (ডাক্তারের পরামর্শ অনুসরণ না করে) ফলে পরবর্তীতে মানসিক রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পেলো? শুনতে অদ্ভুত লাগে, তাই না?
কিন্তু JAMA Psychiatry (JAMA: Journal of the American Medical Association) –তে প্রকাশিত এক নতুন
গবেষণা মতে সংক্রমণের কারণে হাসপাতাল ভর্তি হওয়া আপনার পরবর্তীতে মানসিক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়াতে পারে। সারা ডেনমার্কে পহেলা জানুয়ারী, ১৯৯৫ থেকে ৩০ শে জুন, ২০১২ সাল নাগাদ ১০৯৮৯৩০ জন অংশগ্রহণকারীর (০-১৭ বছর বয়েসী; গড় বয়েস ৯ বছর) প্রাপ্ত উপাত্ত থেকে এই ফলাফল পাওয়া গেছে। গবেষণা মতে, সংক্রামণবিরোধী ওষুধ (anti-infective agents) ব্যবহার করে সারানো সংক্রামণ পরবর্তীতে মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়, এবং পরবর্তী মানসিক রোগের জন্য ব্যবহৃত ওষুধ ব্যবহারের সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে। সংক্রামণনিরোধক ওষুধসমূহের মধ্যে ব্যাকটেরিয়ানিরোধকের (অ্যান্টিব্যায়োটিক) ব্যবহারের ফলে পরবর্তীতে মানসিক রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাকে সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি করে। মানসিক রোগসমূহের মাঝে স্কিটসফ্রেনিয়া (schizophrenia spectrum disorders) বদ্ধসংস্কার-তাড়নাজনক ব্যাধি (অবসেসিভ-কম্পালসিভ ব্যাধি; obsessive-compulsive
disorder), ব্যক্তিত্ব ও আচরণগত ব্যাধি (personality and behavior disorders), মানসিক প্রতিবন্ধকতা (mental
retardation), অটিজম (autistic spectrum
disorder), মনোযোগ-ঘাটতি/অতিসক্রিয়তা ব্যাধি (এডিএসডি; attention-deficit/hyperactivity disorder), অবাধ্যকতা-সংক্রান্ত বৈকল্য (oppositional defiant disorder and conduct
disorder), এবং খিঁচুনি-সংক্রান্ত (tic disorders) ব্যাধিসমূহের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।
২
কথা হচ্ছে, সংক্রামণনিরোধক ওষুধসমূহ, যেমন ব্যাকটেরিয়ানিরোধক কীভাবে পরবর্তীতে মানসিক ব্যাধির সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে? গবেষকরা যদি-ও কারণ-প্রতিক্রিয়া (cause-and-effect) খতিয়ে দেখেন নি (গবেষণাটি সহসম্পর্কিত বা কোরিলেশনাল ধরণের ছিলো), তবে তারা ধারণা করছেন যে ব্যাকটেরিয়ানিরোধকের ব্যবহারের ফলে অন্ত্রের জৈবজীবাণুসমূহের (intestinal microbiome) তারতম্য ঘটে, যা পরে অস্বাভাবিক জৈবরাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মস্তিষ্কে পরিবর্তন ঘটিয়ে মানসিক রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। উল্লেখ্য যে, মস্তিষ্কের সাথে অন্ত্রের সরাসরি ও পরোক্ষ সংযোগ আছে তথ্যবিনিময়ের, এবং অন্ত্রকে অনেক স্নায়ুবিজ্ঞানী “দ্বিতীয় মস্তিষ্ক” বলেন।
অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়াসমূহ আমাদের শুধু খাদ্য বিপাকে সাহায্য করে এমন না, এগুলো মস্তিষ্কে সংকেত পাঠিয়ে আমাদের মানসিকতা, মেজাজ-ও নিয়ন্ত্রণ করে। পূর্ববর্তী গবেষণা, বিশেষ করে ইঁদুর-জাতীয় প্রাণীর উপর পরিচালিত গবেষণা বিষণ্নতার
রোগের সাথে অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়ার ব্যবস্থায় পরিবর্তনের আলামত পেয়েছিলো। যেমন, যেসব ইঁদুরদের ব্যাকটেরিয়ানিরোধক দেওয়ার পরে তাদের অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়ার বৈচিত্র্যে পরিবর্তন ঘটে সেগুলো স্মৃতি-সংক্রান্ত
বিভিন্ন পরীক্ষায় বাজে ফলাফল করে। শুধু তাই না, ব্যাকটেরিয়ানিরোধকের ফলে অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়ার বৈচিত্র্যে পরিবর্তনের সাথে অটিজম, বিভিন্ন স্নায়ু-বিলোপ রোগ যেমন আলঝেইমারের
রোগের সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন বিভিন্ন গবেষকেরা।
অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে যে, আয়ারল্যান্ডের এক গবেষকদল বিষণ্নতার রোগে আক্রান্ত রোগীদের অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া ইঁদুরে স্থানান্তরিত করেন এবং তারা লক্ষ্য করেন যে পরে সেইসব ইঁদুরগুলো বিভিন্ন বিষণ্নতা-ন্যায় আচরণ প্রদর্শন করে, এবং তাদের নিউরোট্রান্সমিটারের বিপাকে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়; অর্থাৎ, বিষণ্নতার রোগের সাথে অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়াদের বৈচিত্র্যের সম্পর্ক সুস্পষ্ট।
৩
কিন্তু কথা হচ্ছে যে ব্যাকটেরিয়ার বৈচিত্র্যের পরিবর্তনের ফলে ঠিক কীভাবে মস্তিষ্কে পরিবর্তন ঘটে কিংবা কীভাবে স্নায়ুবিক কার্যাবলি অথবা জৈবিক কার্যাবলিতে পরিবর্তন হয়?
এই ব্যাপারে দারুণ এক গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করেন সম্প্রতি Nature Microbiology তে প্রকাশিত এক গবেষণায় Philip Strandwitz এর নেতৃত্বে এক গবেষকদল। তারা KLE1738 নামের এক দুর্লভ আন্ত্রিক ব্যাকটেরিয়া নিয়ে গবেষণা করেন। এই ব্যাকটেরিয়া গাবা (gamma-aminobutyric
acid বা GABA) নাম রাসায়নিক অণু খেয়ে বেঁচে থাকে, গাবা হচ্ছে মস্তিষ্কে ব্যবহৃত প্রধান প্রশমন-জনক (inhibitory) নিউরোট্রান্সমিটার, যা মস্তিষ্কের বিভিন্ন কার্যাবলিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার সংকেত বহন করে সুষ্ঠতা বজায় রাখে। অন্যাদিকে আরেক ধরণের ব্যাকটেরিয়া আছে যেগুলো গাবা উৎপাদন করে, অর্থাৎ, গাবা উৎপাদনের পরে KLE1738 ব্যাকটেরিয়া সেটি খেয়ে বেঁচে থাকে। যখন ব্যাকটেরিয়ার বৈচিত্র্যে তারতম্য ঘটে (যেমন- এক ধরণের ব্যাকটেরিয়া সংখ্যা বৃদ্ধি অথবা হ্রাস পায়) তখন ব্যবস্থায় গোলযোগ সৃষ্টি হয়, ফলে গাবা-সংক্রান্ত স্নায়ুবিক ব্যবস্থা অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। গাবার পরিমাণ কমে যাওয়ার সাথে বিষণ্নতার রোগের সম্পর্ক রয়েছে, যা পূর্ববর্তী গবেষণা নির্ণয় করেছিলো। অর্থাৎ, নির্দিষ্ট ধরণের ব্যাকটেরিয়ার বিনাশে অথবা বৃদ্ধিতে গাবার উৎপাদনে পরিবর্তন ঘটে, যা আচরণগত পরিবর্তনের দিকে ঠেলে দেয়, যেমন কাজেকর্মে উৎসাহ না পাওয়া, যা কিনা বিষণ্নতার রোগের অন্যতম লক্ষণ।
Philip Strandwitz এবং তার গবেষণাদলের মতে যদি বিষণ্নতার রোগে আক্রান্ত রোগীদের অন্ত্রে গাবা-উৎপাদনকারী ব্যাকটেরিয়া সংখ্যা বৃদ্ধি করা যায় তবে বিষণ্নতার রোগের উন্নতি হতে পারে। বস্তুত, ২৩ জন রোগীর উপর পরিচালিত একটি ছোট গবেষণায় দেখা যায় যে আসলেই যেসব রোগীর মলে গাবা-উৎপাদনকারী ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ বেশি ছিলো তাদের বিষণ্নতার উপসর্গ কম ছিলো।
তবে একথা মনে রাখা দরকার যে এইসব গবেষণা ছোট আকারের, তাই অনেক অংশগ্রহণকারী নিয়ে বড় গবেষণার প্রয়োজন নিশ্চিত করে কিছু বলার জন্য; এছাড়া অনেক গবেষণায় বিভিন্ন ফ্যাক্টর যেমন, অংশগ্রহণকারীদের ওষুধসেবন, খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করা হয় নি, যা ফলাফলকে প্রভাবিত করে থাকতে পারে। তবে এই কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আন্ত্রিক ব্যাকটেরিয়ার বৈচিত্র্য মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয়, এবং যেসব আচরণ ও কার্যকলাপ (যেমন- অপ্রয়োজনীয় ব্যাকটেরিয়ানিরোধক) এই বৈচিত্র্যকে পরিবর্তন করে সেগুলো থেকে বিরত থাকা দরকার।
No comments:
Post a Comment