১
আপনি হয়তো খবরে পড়ে থাকতে পারেন যে অথবা বাস্তবে দেখে থাকতে পারেন যে একজন “সাধু” আগুনের উপরে বসে ধ্যান করছেন, অথচ তার ব্যথা লাগছে না, কিংবা একজন পথশিল্পী কয়লার উপর দিয়ে দিব্যি হেঁটে যাচ্ছেন, অথচ ব্যথায় কাতরে উঠছেন না। আপনার অবুঝ মন হয়তো ভাবলো যে এইসব হয়তো সাধুর সাধনার ফসল কিংবা পথশিল্পী্র জাদুর খেলা ইত্যাদি। কিন্তু এইসব আসলে জিনের (gene) কারসাজি! Antonio Regalado এর একটি লেখা পড়লাম। তিনি লিখেছেন যে এই লোকদের ব্যথা-সংক্রান্ত স্নায়ুবর্তনী অথবা ব্যথা নিয়ন্ত্রণ করে এমন জিনে মিউটেশন বা পরিবর্তন হয়েছে, ফলে তারা খুব কম ব্যথা অনুভব করেন অথবা একদমই করেন না!
২
২০০৬ সালের দিকে পাকিস্তানে এক পথশিল্পীকে পাওয়া গেলো যে আগুনের উপর হেঁটে যাওয়া, মার খাওয়া, কিংবা শীতে ঠাণ্ডা পানিতে হাত ঢুবিয়ে রাখা, ইত্যাদি যায় করে না কেনো সে কোনো ব্যথা অনুভব করে না! লোকজন-ও তাজ্জব! কী জাদু, কী সহনশীলতা ইত্যাদি! পরে একজন বললো যে আরে এইসব তো অনেকে পারে, দেখাও তো ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে! বাজি ধরে ছাদ থেকে লাফিয়ে নামতে গিয়ে এই পথশিল্পী মারা গিয়েছিলো; যদিও সে ব্যথা অনুভব করতো না কিন্তু শরীরের হাড় ভাঙা কিংবা মাথা ফেটে যাওয়া ইত্যাদি তো রোধ করা যায় না। কী এমন ছিলো যে এই পথশিল্পী কোনো ব্যথা অনুভব করতো না? পরে গবেষকরা দেখেন যে সে আসলে একটি অতিবিরল জেনেটিক ব্যাধিতে আক্রান্ত ছিলো, যার ফলে সে কোনো ব্যথা অনুভব করতো না। তার জিনে একটি মিউটেশনের কারণে SCN9A জিনটি অক্ষম ছিলো, এই জিন মস্তিষ্কে ব্যথার সংকেত বহন করতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে, যেহেতু তার জিনটি অকেজো ছিলো তার মস্তিস্কে ব্যথা-সংক্রান্ত সংকেত পৌঁছাতো না, ফলে সে ব্যথা অনুভব করতো না!
মস্তিস্ক নিয়ে আরেকটি মজার কথা বলি, মস্তিস্কের ভেতরের অংশ মানে মগজ কিন্তু ব্যথা অনুভব করে না! কারণ, কোনো ব্যথার রিসেপ্টর নেই মস্তিস্কের ভেতরে, সব ব্যথার রিসেপ্টর শরীরের অন্যত্র। এইজন্য যাদের মস্তিস্কে অপারেশন হয় কিংবা কোনো অংশ কেটে ফেলা হয় (যেমন, টিউমার কেটে ফেলার সময়) তারা ব্যথা অনুভব করেন না, যে ব্যথা অনুভূত হয় তা মস্তিস্কের করোটিতে বা হাড়ে।
মস্তিস্কের ব্যথা সংক্রান্ত সংকেত বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে আরেকটি মজার ব্যাপার বলি। শারীরিক ও মানসিক ব্যথা একইভাবে বিশ্লেষিত হয়। অর্থাৎ, আপনি শারীরিক কারণে যেমন ব্যথা অনুভব করেন এবং যেভাবে করেন, তেমন মানসিক ব্যাপারের ক্ষেত্রে-ও। আগুনে হাত পোড়া কিংবা প্রণয়ের আগুনে ছ্যাঁকা খাওয়া ক্ষেত্রবিশেষে একই। আহারে!
৩
শুধু এই পথশিল্পী নয়, এইরকম যারা ব্যথা অনুভব করেন না তাদের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে মস্তিস্কে ব্যথার সংকেত পৌঁছানোর বর্তনীতে কোনো না কোনো গোলযোগ থাকে, হয় স্নায়ুবর্তনী ঠিক মতো কাজ করছে না অথবা জিনে সমস্যা আছে। এই ব্যাপারটির সুবিধা নিয়ে Navega Therapeutics নামক একটি নতুন উদ্যোগ CRISPR ব্যবহার করে ব্যথা নির্মূলের একটি নতুন পদ্ধতি নিয়ে কাজ করছে। CRISPR দিয়ে জিনের একটি নির্দিষ্ট অংশ কেটে ফেলা যায়, জোড়া লাগানো যায় কিংবা মিউটেশন সৃষ্টি করা যায় জিনের বেইজ পরিবর্তন করে, ফলে জিনের প্রকাশ বৃদ্ধি বা কমানো কিংবা জিনের প্রকাশ বন্ধ করে দেয়া যায়। উদ্যোগটির লক্ষ্য হচ্ছে যে CRISPR ব্যবহার করে ব্যথা-নিয়ন্ত্রণ করে এমন জিনকে পরিবর্তন করা, ফলে ব্যথা-উপশমকারী ওষুধের সাহায্য ছাড়াই ব্যথা কমানো যাবে কিংবা সহনশীল পর্যায়ে আনা যাবে। এই ব্যাপারটি জরুরি, কারণ ক্যান্সা্, ডায়াবেটিস, কিংবা দুর্ঘটনার ফলে অনেকে প্রচুর শারীরিক ব্যথা অনুভব করেন এবং ব্যথার ওষুধ সেবন করেন, কিন্তু এইসব ওষুধে আসক্তির সম্ভাবনা থাকে, কারণ এগুলো ওপিওয়ড (opioids; যেমন হেরোইন, মরফিন ইত্যাদি ব্যথার ওষুধ মস্তিস্কের ওপিওয়ড স্নায়ুব্যবস্থার উপরে কাজ করে ব্যথা উপশম করে) ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে, যেটির অতিরিক্ত উত্তেজনা আসক্তিকর হতে পারে। যাইহোক, ইতিমধ্যে উদ্যোগটি ইঁদুর-জাতীয় প্রাণীর উপর গবেষণা করে ইতিবাচক ফল পেয়েছে, যেমন CRISPR ব্যবহার করে ইঁদুরদের ব্যথা-সংক্রান্ত জিনে দাবিয়ে রেখে তারা দেখলো যে গরম চাকতির উপর ইঁদুর দিব্যি চলাফেরা করছে, ব্যথায় ভুগছে না! ইতিমধ্যে মানুষের উপর জিন থেরাপির প্রচেষ্টা শুরু হয়ে গেছে এই পদ্ধতি ব্যবহার করে। আশা করা যায় ৫-১০ বছরের মধ্যে এই পদ্ধতি কার্যকরী ফলাফল প্রকাশ করতে পারবে।
৪
পুরো বিষয়ে কিন্তু রাজনৈতিক, নৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যাপার জড়িত আছে। মানুষ ব্যথা অনুভব করে কারণ ব্যথা মানুষকে তার আচরণ সংশোধন ও পরিবর্তনে অনুপ্রেরণা দেয়। যে পাড়ায় গিয়ে মার খেয়ে ব্যথা পেয়েছেন সেখানে আপনি আবার যাবার আগে দশবার ভাববেন কিংবা চুলায় ছ্যাঁকা খেয়ে পরের বার সাবধানে থাকবেন। কিন্তু ব্যথা উপশমের এইসব প্রযুক্তি ও চিকিৎসা যদি সহজলভ্য হয়ে যায় তার অপব্যবহারের বিপুল সম্ভাবনা আছে। আছে অতিমানব সৈনিক তৈরির সম্ভাবনা, যারা ব্যথা অনুভব না করাতে যেকোনো মিশনে অকুতোভয় লড়বে। এমনকি এই ব্যাপারে ২০১৭ সালে রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন যে জিনগত প্রকৌশল ব্যবহার এমন সৈনিক তৈরি করা যাবে যারা কোনো ব্যথা বা ভয় না পেয়ে লড়াই করবে, যা কিনা “পারমাণবিক বোমার চেয়ে-ও ভয়ঙ্কর” হবে।
No comments:
Post a Comment