এসো খড়ে সুঁই খুঁজি

Custom Search

Friday, April 3, 2009

ঘাসপাড়ের পুরুষদের কথা

কপালে নয়ন তুলে আকাশ পানে তাকালেই বৃষ্টি থেমে যাবে না। জ্বি। আজ আমাদের পুষ্করণী মনে বৃষ্টি-মাদলে তবলার সুর তোলার দিন, মিছে চোখ রাঙাচ্ছেন কেন? আপনার জন্য ভিন্ন কিছু হতে পারে বৈকি; মাঘ মাস সবার শরীরে এক প্রকারে ধরা দেয় না। মাঘ মাসের চিলেকোঠা শীতে কেউ শীতস্তম্ভের কম্বল গায়ে শুয়ে থাকে, কেউ ফি রবিবারে হাঁসের মাংশ ভোজনের উৎসব করে। আপনার জন্য আজ সব-কিছু-চুলোয়-যাক দিন হতে পারে, আমাদের বিবিধ আনন্দের দিন। ঘাসপাড়ের পুরুষ কিংবা মানুষদের সাথে আপনাদের স্বয়ংক্রিয় নাগরিক জীবনের ব্যস্ত পার্থক্য থাকা অপ্রিয় কিছু নয়।

আপনি নাকের লোম ছিঁড়ে অফিসের টেবিল কুরুক্ষেত্র করে ফেলেন নির্বিষ দুপুরে ভাতঘুম না দেয়ার কষ্ট ভুলতে। সেটুকু ব্যর্থ আস্ফালন আপনাকে উৎসুক করে রাখে তা মুখ দিয়ে খিস্তি আকারে বের হয় বিকালের বাস ধরার সময়, আমি জানি। আপনি বিরক্ত মনে হয়ত বানরের সাথে মানুষের বিবর্তন-যোগসূত্র অনুসন্ধান করেন; কিংবা নিয়মবহির্ভূতভাবে সিগারেট ধরিয়ে জাতির হাত-পা লুলা করে দেন। আমরা যারা ঘাসপাড়ের লোকজন তারা নিরসবদনে উন্নাসিকতার কোরাস গাই, আমাদের প্রথাগত জীবনের জন্য ঈশ্বরের শ্রাদ্ধ করি!


চোখ লাল করেছেন কেন? কথা কানে না দেয়া তো আপনাদের কাছে ভোজনপর্ব শেষে ন্যাপকিনের শরীর বিষাক্তকরণের মতন ব্যাপার। আমাদের কথায় মনকষ্ট পাবেন না। ঘাসপাড়ের লোকদের চামড়া ভারী হয়। অন্যের দুঃখ, কষ্ট তাদের কাছে তুচ্ছমুল্য।

------------------------------------------------
ঘাসপাড়ের চরে নতুন যাত্রীবাহী লঞ্চ এসেছে। পালা করে নামছেন অভিজাত শ্রেণীর রঙ প্রতিফলন করা সাদা লোকেরা। বাতাসে, পাড়ার চায়ের দোকানে শোনা যাচ্ছে বনভোজনের কাজটি সাহেবরা এবার ঘাসপাড়েই করবেন।
কিন্তু নির্বিচারি বৃষ্টি তাদের আয়োজনে জল ঢেলে দিয়েছে। জলের প্রবাহ সবার সহ্য হয় না, জলে কেবল নবীন মীনদের উল্লাস মানায়! স্থলের বাঘদের সাথে জলপ্রবাহের মৌন আড়ি অটুট আছে।
------------------------------------------------
কায়েস সাহেব রোদ-চশমার মধ্য দিয়ে তাকালেন। এবং তার চোখে ঘোর লেগে গেল। হাসির মতো ঘোর-ও সংক্রামক জিনিস, তবে ঘোর ভঙ্গ হয় হঠাৎ। ঘোর ভাঙানোর জন্যই কিনা তিনি রোদ-চশমা খুললেন, আশপাশে ব্যস্তদৃষ্টিতে তাকালেন। কিশোর বয়সে ঘন ঘন প্রেমে পড়ার মতন তিনি বিহ্বল চোখে সবকিছুর দিকে তাকাচ্ছেন। এই চরে একটা জায়গা কিনে ফেললে কেমন হয়? বছরে একবার এলেও সুদাসল অর্জিত হয়ে যাবে। না, কায়েস সাহেব ব্যবসাসংক্রান্ত ভাবনাকে তালাক দিয়েই ছুটিতে এসেছেন; চিন্তার ডালপালা দ্রুত বেড়ে ওঠে- তিনি মূলুচ্ছেদ করে দিলেন।
কে যেন ছুটে আসছে। কায়েস সাহেব শব্দের উৎপত্তি-স্থলের পানে চাইলেন; লুঙ্গি কোমরে বাঁধা একটা লোক! না, একজন না, আর-ও অনেকে।
"আপনেরা কারা?" হাতে বাঁশের লাঠি ধরা লোকটা বলল। মনে হচ্ছে সেই সর্দার।
"আমরা ছুটিতে এসেছি।"
"কয়জন?"
"পঁচিশ জনের মতো হবে। আমার বন্ধুরা, তাদের পরিবার।" তখনই কায়েস সাহেব ভুলটা বুঝতে পারলেন। তিনি লোকটাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন, তার প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন অবলীলায়। "আপনারা কারা?" কায়েস সাহেব সুরু চোখে তাকালেন।
"এটা আমাগো চর। এখানে আমরাই থাকি। আপনেরা কয়দিন থাকতে চাইলে থাকেন, মাগার ফাল দিয়েন না।" কথাটা বলেই যেভাবে এসেছিল ঠিক সেভাবেই চলে গেল লোকগুলো।
------------------------------------------------
ঘাসপাড়ের মানুষদের অর্থ্যাৎ নারী, পুরুষদের মাঝে নতুন হুজুগের সঞ্চারণ হয়েছে। পুরুষরা বেলে মাথায় শৈত্যরোদ উপভোগ করার আয়োজন করছেন, সবাই ন্যাড়া হওয়ার জন্য ঐক্যহন্টন করে সমাবেত হচ্ছেন পাড়ার নাপিত দোকানে। সেখানে নানাবিধ মহাপন্যাস কিংবা মহাকাব্য প্রসবিত এক দিনরাতে। পুরুষদের শীত-নিবারণ-জিনিস নারীরা এবারের শীতে আরো তাপ ধরে রাখার প্রতীচ্ছা রাখছেন। নারীগণ কাঁথায় জীবনসংগীতের সুর তুলছেন প্রথাগত উৎকর্ষতায়!

ঘাসপাড়ের সবখানে প্রাণের জাগরণ এই শীতে! বসন্তবিলাসী মানুষদের একহাত দেখিয়ে দেয়া বীরত্বের প্রদর্শনী বৈকি।

-----------------------------------------------
রাতে কায়েস সাহেব তার সিদ্ধান্তের কথা জানালেন। তিনি এই চরে বিলাসঘর নির্মাণ করবেন। নিগূঢ় কারণ কেউ না জানলেও সবাই প্রতিবাদ জানাল, প্রত্যেক বছর এখানে পদচিহ্ন রাখতে আসা অসম্ভব। রাগমোচন বারবার হওয়া সন্দেহজনক।
প্রতিটি জিনিসের অবতারণার সাথে সাথে দু'টি পক্ষ সৃষ্টি হয়ে যায় অবলীলাক্রমে। কায়েস সাহেবের পক্ষে ক্ষীণ সমর্থন জানাল তার কন্যা বৃষ্টি। পিতারা একচোখা হন- কায়েস সাহেব মেয়ের এই সমর্থনে বলশালী হলেন এবং অটুট থাকলেন সিদ্ধান্ত ব্যস্তবায়নে।
কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানলেন এখানকার জায়গা, জমি সমবায়ের মাধ্যমে বণ্টন করা। কিনতে হলে পুরো চর কিনতে হবে, নতুবা কিছুই নয়। আর সেটা সম্ভব হবে না, যারপরনাই সন্দেহ প্রকাশ করলেন কায়েস সাহেব; কারণ, উচ্ছেদের সূক্ষ্ম একটা সীমা আছে।
তিনি সেই সর্দার লোকটিকে বললেন তাকে এক টুকরো জমি ছেড়ে দিতে, টাকাপয়সা কোন ব্যাপার না। তাছাড়া, তিনি এখানে অনেক কর্মসংস্থান করবেন, দুবেলা পেটপুরে খাবে মানুষগুলো; নবান্ন-উৎসবে শুধু ভাত খেলে চলে না।
মানুষের একটা বিচিত্র অভ্যাস হল সহজাত শ্রেণীবিন্যাস করা। ফলস্বরূপ, সেই সর্দার লোকটির কাছে কায়েস সাহেব কৃষ্ণগহ্বর হিসেবে ধরা পড়েছেন। তিনি জমি পাবেন না।
-----------------------------------------------
হয়ত শুক্রবারে শ্বশুরবাড়ি-দর্শন করার মতো অফিসফেরত আপনার মনে উদয় হয় সপ্তাহান্ত উদযাপনের বিবিধ চিন্তা, আপনি উর্ধ্বতন কর্মকর্তার আগ্রহ টানতে আয়োজন করেন ভোজন-উৎসবের; যেখানে উদীয়মান কথাশিল্পী হয়ে উঠেন স্বয়ং কর্মকর্তা, আপনি হয়ে উঠেন গোসলখানার নিরাপদ কবি, কিংবা কর্ম-কর্তার স্ত্রী হয়ে যান রাগ-বেরাগের এক টুকরো শিল্পী। আপনি উল্লাসে-কামে-আনন্দে বিমোহিত হয়ে যান এবং আপনার চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসে এক-একটি ধর্ষণিক বাংলাদেশ।
----------------------------------------------
কায়েস সাহেব পরদিন সমবায় সর্দার রণবীরকে ডেকে পাঠালেন। তিনি কতিপয় বাসন্তী উপকৌঢনসম টাকা ও শহুরে আবাস-স্থানের বড়শী ফেললেন, আশ্চর্যজনক ব্যাপার হল রণবীর ধরা দিল না; অপারগ হয়ে কায়েস সাহেব দ্বিগুণ লোভ হাঁকালেন, এবার-ও খেয়েদেয়ে মাছ পালাল। কায়েস সাহেব এইবেলার জন্য ক্ষান্ত দিলেন।
বৈকালিক উজ্জ্বল আকাশের নিচে তিনি দ্বিতীয় নাক্ষত্রিক মেয়ে বৃষ্টিকে নিয়ে দ্বীপাঞ্চল দেখতে বের হলেন; সারি সারি কাশবন দেখে আনন্দে আত্মহারা হল বৃষ্টি। তার মায়ের একটা হলদে পাড় দেয়া সুবজাভ সাদা শাড়ি ছিল, তবে সেই শাড়ি দিলখোলা উড়তে পারতো না বেখেয়ালি বাতাসে; কাশবন দোল খায়, বৃষ্টি দোল খায় মনমন্দিরে। দক্ষিণ দিকে সারিবন্ধ ঘর, অনেকটা বর্গাকারভাবে; মাঝখানে মানানসই উঠান। বৃষ্টি দেখল অনেকেই খেলছে- চোখ বাঁধা একজনের, অন্যরা তাকে ছুঁ'য়ে ছুঁ'য়ে যাচ্ছে। বৃষ্টি বাবার আদুরে ধমক উপেক্ষা করে ওদের সাথে খেলতে গেল। অথচ পোনামাছের মতো জলে আলোড়ন শুনে ভীষণ আত্মমগ্ন বালকবালিকারা খেলা বন্ধ করে দিল। বৃষ্টি ভগ্ন হৃদে সরে আসে। মাটির দাওয়াই বসে কতিপয় নারীরা চুল বাঁধছে পরষ্পরের, কেউবা স্বামীর মাথা থেকে পক্ক-অর্ধপক্ক চুল তোলার মতন ডাল-শস্য থেকে ময়লা বেছে ফেলে দিচ্ছেন। বৃষ্টি সাময়িক অতিথির দোহাই দিয়ে মেজবানদের কাছ থেকে নিজের সংসারিক চুল বেঁধে নিল, বলা চলে সে শিখে নিল।
কায়েস সাহেব বাঁশগাছ-লম্বা-দূরত্বে দাঁড়িয়ে সবকিছু অবলোকন করলেন, তার ঠোঁটের কোণে সহজাত ব্যবসায়িক হাসি ফুটে উঠল!
-------------------------------------------------
আপনার বগলে মানুষ্যত্বের বাল জমে, অপবিত্র জিনিস বেশি দিন শরীরভিটায় রাখতে নেই; আপনি চেতনার উৎপত্তিস্থল ঠিক রেখে মানুষ্যত্বের সব ধুলো ঝেঁড়ে ফেলেন। ঘাসপাড়ার মানুষ উল্টোটা করে; বৃষ্টির জলে ভিজে তারা শরীরের ময়লা ধুয়ে ফেলে, মানুষ্যত্বের উৎপত্তি স্থল বগল নয়- নীতিধারক মস্তিষ্ক। আপনার উচ্চমধ্যবিত্ত মেজাজের সূচনাস্থল ইংরেজ সাহেবের গোমস্তা আপনার দাদামশাই চৌধুরী সাহেবের কাছ থেকে; আপনি জানেন না যে বিবর্তন কোনকিছু ধ্বংস করে ফেলে না এক পলকেই, ক্রমশ পরিবর্তন ঘটিয়ে চলে।
আপনি নিজের গায়ে হাত বোলাতে ভালবাসেন না, আমরা জানি; নতুবা বাক্সবন্ধী স্বপ্ন নিয়ে পথে নামা মীনাক্ষীর গায়ে আপনার অবাধ্য হাত উঠতো না; আপনি দেবতার শরীরে আঙুল বুলাতে আগ্রহী এবং দেবতাদের উন্নাসিক বলেই জানি আমরা।
---------------------------------------------------
পরদিন সকালে ঘাসপাড়ার লোকদের ঘুম ভাঙল ভীষণ কলরবে। বাতাসে গুজবের হাত-পা-ডানা। কালরাত্রে রণবীরকে কয়েকজন আক্রমণ করেছিল বাঁশঝাড়ের কাছটায়। বাঁশঝাড় জায়গাটা নিরীহ হলে-ও এখানে এসে মানুষজন দুর্ধর্ষ হয়ে উঠে, এটা প্রচলিত সত্য। রণবীর মধ্যাকাশে কালপুরুষ থাকা সময়ে মিরাজের দোকান থেকে সিগারেট কিনে বাড়ি ফিরছিল, অতর্কিত হামলা করে জনা তিনেক লোক, তাদের মুখমণ্ডল মুখোশে ঢাকা ছিল। উত্তম-মাধ্যম মার খেয়ে মাটিতে ঢলে পড়ার আগে রণবীর শুনেছিল একটি বাক্য- 'শালা, আপোষ মানতে শিখ।'
বস্তুত, রণবীর এখন জীবনাত্মার সাথে আপোষের চেষ্টায় আছে, থেকে থেকে হাঁপিয়ে উঠছে তার বেলেমাটিঙসাদৃশ্য শরীর। ডাক্তার নেই এই দ্বীপে- মাইল পঞ্চাশেক দূরে বাওতালি গাঁয়ে মতলব ডাক্তারের চিকিৎসালয়; নওজোয়ান মাঝিরা অবিশ্রান্ত দাঁড় টানলে-ও সাঁঝের আগে ডাক্তারের টিকিটি মিলবে না। এখন জলচিকিৎসা ও ভেষজচিকিৎসা চলছে।
দুপুরের দিকে টের পাওয়া গেল রণবীর এবার হয়ত পটল তুলবে। কায়েস সাহেব এলেন বৃষ্টিকে নিয়ে। বৃষ্টিকে দিয়ে তিনি প্রস্তাব দিলেন যে তার লঞ্চ ব্যবহার করে দ্রুত সদরে যাওয়া যাবে, তিনি সোহাদ্যের খাতিরে এইটুকু করতে দ্বিধাবোধ করবেন না; মানুষকে তিনি কাছে রাখতে চান।
সবাইকে বিস্মিত করে দিয়ে রণবীর সাহায্য নাকচ করে দিল। সে দাওয়াই'তে শীতলপাটি পেতে শুয়ে থাকল। উঠোন লাগোয়া অশ্বথ গাছে পাখিদের আনাগোনা, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠ থেকে পাখিসকল পোকা ধরে ধরে খাচ্ছে; রণবীরের চোখে নেমে আসে রাজাপ্রজাঘুম।
--------------------------------------------------
'বাজান, ভাত খ্যাইয়া যা।' রাতের শরীর ছিঁড়ে আপনি বাড়ি ফিরছেন রূপবতী রিকশায় করে আপনার গ্রামীণ মায়ের কন্ঠস্বর কল্পনা করে, আপনার গাড়ির কাঁচ ভেঙে গেছে বছরের প্রথম শিলাবৃষ্টিতে! অন্ধকার ডাস্টবিনগলি পার হওয়ার সময় আপনি ডুঁকরে কেঁদে উঠলেন; অন্ধকারের চোখ ফাঁকি দিয়ে আপনার জীবনে এল প্রথম শুভ্রবৃষ্টি।
-------------------------------------------------
রণবীরের স্ত্রী পাঁচ মাসের পোয়াতী, কাজেকর্মে ভীষণ রকম জড়তা এসে গেছে। রণবীর মাঝরাতে শায়লার পেটে হাত বোলায়, মৃদু চাপ দেয়; তার হর্ষ লাগে। একটা ছেলে তার দরকার। পাড়ার অনেকেই তাকে সর্দার হিসেবে মাছ-শস্য ইত্যাদি থেকে কিছুটা ভাগ দেয়, কিন্তু শরীর নরোম হয়ে এলে কে পুষবে তাকে। মেয়েটা এমন সরল হয়েছে কথা বলতে গেলে মরমে মরে আসে।
রণবীর আনমনা জেগে থাকে। মাঝে মাঝে কলতলায় গিয়ে মাটির পিঁড়িতে বসে থাকে, আকাশ দেখে, তারাফুল দেখে। শায়লা আধ-ঘুমন্ত বিছানায় হালকা নড়াচড়া করে, ক্যাঁচ-ম্যাঁচ শব্দ হয় বেতের খাটে।
রণবীর বসতে আসে কলতলায়, আজ আকাশ শূন্য। চারধারে গহীন অন্ধকার। কলতলায় কে যেন বসে আছে, পানির শব্দ হচ্ছে। রণবীর সর্তক পায়ে কাছে যায়। শিউলি, লোকমানের বউ।
"শিউলি, কী কর রাতবিরাতে।" রণবীর বলল।
"সিনান করি।" খিলখিল শব্দে হাসে শিউলি, রণবীর গভীর চমকে উঠে।
"লোকমান কই?"
"তিনি ঘুমাছেন।" শিউলি ঠোঁট কাটে দাঁতে।
রণবীর শায়লার কথা ভাবে। শায়লা দিনেদুপুরে স্নান করতে আসে না, রণবীরের চোখে ঘুম আসে না।
রণবীর শায়লার অটুট শরীরে চোখ রাগে, তার ম্যায়াও বিড়ালটা ঠিকরে আসে। তার নিশপিশ করতে থাকা শরীর পোষ মানে না, সে শিউলির হাত ধরে।

সকালে রণবীরের যখন ঘুম ভাঙল তখন আলো আসে নাই পৃথিবীতে। রণবীর কলতলায় দাঁত মাজতে এসে লোকমানের ঘরে শোরগোল শুনে। রণবীর এগিয়ে যায়। আধ-খোলা দরজার ফাঁক দিয়ে দেখে লোকমান শিউলিকে মারছে। রণবীরের মায়া লাগে, সে গলা-খাঁকারি দেয়।

লোকমান রণবীরের দিকে তাকাল। লোকমানের চোখ লালচে।
"লকু, বউ মারো ক্যান?" রণবীর নিম বাকল দিয়ে দাঁত মাজন করতে করতে অস্পষ্ট গলায় বলে।
"ছিনালি করে বেটি।"
রণবীর কিছু বলে না। ছিনালি করা বউদের মারা জায়েজ আছে, মসজিদের হুজুর গেল সপ্তাহে বলেছিলেন। রণবীর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে।
"লকু, এবেলা ক্ষান্ত দে', নামাজ পড়তে যা; বেলা তো শেষ হয়ে যাবে।"
লোকমান ক্ষান্ত দেয়, গামছা নিয়ে গরগর করতে করতে বের হয়ে যায় রণবীরের সামনে দিয়ে। রণবীর শিউলির দিকে তাকায়; এককোণে উবু বসে আছে শিউলি। শিশিরের আঘাতে ঝরে আসে শিউলিরা।

অতিথিমশাইদের প্রস্থানের কোন ইঙ্গিত না পেয়ে রণবীর সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে কায়েস সাহেবের সাথে দেখা করতে গেলেন। লঞ্চের ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে গেছে, সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের কোন সুযোগ না থাকলে-ও রণবীর তাদের দু'দিন সময় দিল দ্বীপ ছেড়ে চলে যাওয়ার। কায়েস সাহেব কিছু বললেন না, তবে তার মতিগতিতে বোঝা যায় তিনি দু'দিনে দ্বীপ ছাড়বেন না, রণবীর অন্য ব্যবস্থা নেয়ার পরিকল্পনা নেয়।

রণবীর জামসেদকে নিয়ে বাঁশঝাড়ের কাছটায় অনেক গুল্মলতা, ঝোপঝাড় কেটে একটা সুন্দর শ্রী দিল জায়গাটার।তারা গোখরা সাপের আস্তানা আবিষ্কার করে, ইয়া বড় বড় ডিম আর কয়েকটা মাসুম পিচ্চিসাপ; রণবীর আগুন জ্বালায় বৃত্তাকারে, তারপর বৃত্তের মাঝখান থেকে খুচিয়ে মারে একটা বাচ্চা সাপকে; মা সাপটা ছোবল মারে, কাছে আসতে চায়, আগুনের জন্য পারে না। জামসেদ একটা ডিম ভেঙে দেয়, ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসে জমাট জীবন। মা সাপটা কিছুক্ষণ ছোবল-টোবল মেরে বাকি বাচ্চাগুলোকে নিয়ে পালায়। রণবীর তাকিয়ে থাকে। কায়েস সাহেব ও সাঙ্গপাঙ্গদের তাড়ানোর বুদ্ধি সে পেয়ে যায়।
রণবীর জামসেদের সাহায্য নিয়ে কাটা ঝোপঝাড়, কঞ্চি সংগ্রহ করে, উদ্দিষ্ট ঝোপঝাড় জ্বালানির প্রয়োজন মেটাবে, বাঁশ-কঞ্চিতে ভাত রান্না হয় তাড়াতাড়ি। বিকালের দিকে রণবীর ছোট মেয়েকে নিয়ে বড়শি ফেলতে গেল।
কৃত্রিম খোরাকের আশায় আসা মাছের আলোড়ন দেখে মেয়ে কুয়াশার মুখ যখন চন্দ্রবদন হয়ে যাচ্ছে তখনই শোরগোল শুনে মাথা তুলে তাকাল রণবীর। লোকমান আর কাসেম মিয়া ছুটে আসছে।
'ভাইজান, ভাবীজান আপনারে ডাকে।' লোকমান উত্তেজিত স্বরে বলে।
'ক্যান?'
'সেই লোকটা আইছে, সাথে মেয়েটা। মেয়েটার যায় যায় অবস্থা। সবাই পাড়ার উঠানে জমাট দিছে।'
রণবীর ব্যস্ত হাতে বড়শি ঘুটিয়ে পা চালাল বাড়ির দিকে।
উঠোন ভর্তি মানুষ, গোল করে দাঁড়িয়ে আছে; রণবীর ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেল। কায়েস সাহেব মাটিতে কন্যার মাথা কোলে নিয়ে বসে আছেন, দ্বিধাযুক্ত মুখমন্ডল; বৃষ্টি আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে- মৃদু বাতাসে উড়ছে তার মেঘরাজিকুন্তল।
'কি হইছে?' রণবীর হাঁটু গেঁড়ে বসল।
'বিকালে হাঁটতে গিয়ে ...কথা বলছে না, আপনাদের একজন লোক পথের ধারে পেল।'
'কোনায়?'
'বাঁশঝাড়ের কাছে।'
'কই, আমি তো আজ সারাদিন ওখানটায় ছিলুম।'
'জানি না। আপনি কিছু করতে পারবেন? কোন রকমের প্রাথমিক চিকিৎসা? আমার লঞ্চের অবস্থা তো জানেনই; আমি অবশ্য নৌকায় করে লোক পাঠিয়েছি ডাক্তার নিয়ে আসার জন্য।' আধ-ভাঙা কণ্ঠে বললেন কায়েস সাহেব।
'আমরা ভেষজ চিকিৎসা করি। আপনার মেয়ের সইবে তো? গিলতে পারলেই হল।' রণবীর লোকমানকে বন্দোবস্ত করতে বলে।
আস্তে আস্তে ভিড় কমে আসে, বোঝাই যাচ্ছে বৃষ্টির কই মাছের প্রাণ; এই যাত্রায় হয়তো পারাপার হবে না- মৃত্যুর মাঝে বিদ্যমান সূক্ষ্মানন্দ দেখার জন্য সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে মন চাইছে না মোরগ-স্বভাবি মানুষদের; তারা দ্রুত ঘুমিয়ে পড়েন।
হঠাৎ নড়েচড়ে উঠে বৃষ্টি। উৎকন্ঠিত লোকদের মাথা আর-ও নিচু হয়ে আসে; ছায়া পড়ে বিবিধ।
'বাবা, আমি যদি মায়ের মতো চলে যাই, তুমি ভাল হয়ে যেও।' বৃষ্টি কাতুরে। 'আপনি তো এখানকার সর্দার, তাই না?' রণবীরকে শুধাল।
'আমি ওদের বন্ধু।'
'আমি চলে গেলে আমাকে এক টুকরো জমি দিবেন? আমাকে এখানে থাকতে দিয়েন। শহরে মানুষ নাই, সবুজ নাই। দিবেন?' বৃষ্টি রণবীরের হাত ধরতে হাত বাড়ায়।

বিকেল মরে আসছে। ঘাসপাড়ের সবুজরা এবেলা ঘুমুতে যাবে, আজকের সূর্যাভিসার শেষ হয়েছে অনেক আগেই। কায়েস সাহেব আকাশের দিকে তাকালেন, মাটিকে তার অচেনা মনে হল- এক-টুকরো জমি। রণবীর হৃদশূন্য মানুষের মতো উঠে দাঁড়াল, শীতের শেষের এই বিকেল-সন্ধ্যা ক্ষণে সে জল হওয়ার স্বপ্ন দেখে; উজানে ভেসে কতো সহজে শহরে চলে যেতে পারতো!

ঘাসপাড়ে সন্ধ্যা নামে, জলঘোরসন্ধিআঁধার। ঘাসপাড়ের পুরুষদের শরীরে জন্ম নেয় কতিপয় জোনাক, নারীদের চোখে বিষুবীয় সূর্যকথার রাত।
----------------------------------
এই বারের গ্রীষ্মে ঘাসপাড়ের পুরুষদের মাঝে নব উদ্যোগের ডাক পড়েছে- মাথাভর্তি লম্বা লম্বা চুল রাখা শুরু করেছে সবাই- বৃষ্টির কবরে এখনো ঘাস জন্মে নি।


........

রচনাকাল: অক্টোবর, ২০০৮।


গল্পটির শেষাংশ পরিবর্তিত হয়ে একটি লিটল-ম্যাগে প্রকাশিত হয়েছে।


No comments:

Post a Comment

কী নিয়ে মাতামাতি...

13 Reasons Why (1) ADHD (1) Alzheimer's disease (1) Antibiotic Resistance (1) Anxiety (1) Autism (1) Brexit (1) Brief Answers to the Big Questions (10) Britain (1) Bruce Peninsula (1) Cades Cove Scenic Drive (1) Canada (2) Clingsman Dome (1) District 9 (1) Dopamine (1) Dyer's Bay (1) Federico Garcia Lorca (1) Fierté Montréal (2) Gaspé & Percé Rock (1) Global Warming (2) Great Smoky Mountains (2) Heatwave (1) Hemianopia (1) infographics (1) Instagram (104) International Balloon Festival (1) Interstate 77 (1) Lift (1) Links (1) Maple syrup boiling down (1) Maple syrup harvesting (1) Marconi Union (1) Mike Krath (1) Montmorency Falls (2) Montreal International Jazz Festival (1) Montreal Pride Parade (2) Mother Teresa (1) Movies (1) Music (2) Netflix (1) Niagara Falls (3) Nickelback (1) Nirvana (1) North Carolina (1) nutella (1) Photography (2) Photos (104) Poets of the Fall (2) Psychology (1) Rain storm in Montreal (1) Rape (1) Reading List (1) Saint-Remi (1) Samuel de Champlain Bridge (1) Sandra Crook (1) Schizophrenia (1) Sci-Fi (1) Sci-Hub (1) Shortest Sci-Fi (1) Smoky Mountains (1) Stephen Hawking (15) Sunshine 2007 (1) Tennessee (1) The Beatles (1) The Danish Girl (1) The Grand Design (8) The Handsome Family (1) Tobermory (1) Toronto (2) Transexualism (1) True Detective (1) Tyrannosaurus rex (1) Wallingford Back Mine – Mulgrave et Derry (1) West Island (1) Womenchapter (1) অটিজম (3) অটোয়া (1) অণুগল্প (7) অনুবাদ (17) অভিগীতি (12) অভিলিপি (9) অর্থনীতি (2) অ্যালকোহল (1) আইন ও বিচারব্যবস্থা (1) আইসিস (2) আচরণগত স্নায়ুবিজ্ঞান (1) আত্মহত্যা (2) আলঝেইমারের রোগ (3) আলোকচিত্র (6) আলোকবাজি (9) ইচ্ছেকথা (3) ইন্সটাগ্রাম (104) উইমেন-চ্যাপ্টার (1) উদ্বেগ (1) উবার (1) একুশে বইমেলা (1) এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধ (1) এম-তত্ত্ব (5) কবিতা (95) কম্পিউটার বিজ্ঞান (1) করোনাভাইরাস (6) কলাম (5) কানাডা (4) কাব্যালোচনা (2) কাসেম বিন আবুবাকার (1) কিশোরতোষ (1) কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (1) কৃষ্ণগহ্বর (1) কোভিড-১৯ (8) ক্যান্সার (1) ক্রসফায়ার (1) ক্লোনিং (1) খাদ্যব্যবস্থা (1) গণতন্ত্র (1) গবেষণা (1) গবেষণাপত্র (1) গর্ভপাত (1) গল্প (8) গাঁজা (1) গান (17) গুজব (1) গ্যাব্রিয়েলা মিস্ট্রাল (1) চলচ্চিত্র (4) ছড়া (5) ছবি (104) ছোটগল্প (5) জঙ্গিবাদ (1) জনস্বাস্থ্য (2) জিকা ভাইরাস (1) জীববিজ্ঞান (1) জীবাণু (1) ট্রান্সসেক্সুয়াল (1) ট্রান্সসেক্সুয়ালিজম (1) ডাইনোসর (1) ডাউনলোড (1) ডোপামিন (1) তাপমাত্রা (1) তিল-গপ্পো (17) তুষার দত্ত (2) তেজস্ক্রিয়তা চিকিৎসা (1) দূরবীন (2) দৃষ্টিশক্তি (1) ধর্ম (3) ধর্ষণ (2) নায়াগ্রা ফলস জলপ্রপাত (1) নারী (3) নারী স্বাধীনতা (1) নুটেলা (1) নৈতিকতা (1) পরিবেশ (1) পাঁচমিশালী (1) পাঠসূচি (1) পাম তেল (1) পাহাড় (1) পুস্তক (1) পেডোফিলিয়া (1) প্রকৃতি (1) প্রবন্ধ (2) প্রবাস (2) প্রাইমেট (1) ফটোগ্রাফী (1) ফেসবুক (1) ফ্রান্স (1) বই (2) বড় প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত উত্তর (10) বয়ঃসন্ধি (1) বর্ণবাদ (1) বাঙলাদেশ (18) বাবা (1) বাংলাদেশ (1) বিজ্ঞপ্তি (1) বিজ্ঞান (13) বিটলস (1) বিষণ্নতা (3) বুরকিনি (1) বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি (7) বৈশ্বিক উষ্ণতা (1) ব্যক্তিত্ব (1) ব্যথা (1) ভাইটামিন ডি (1) ভাইরাস (1) ভালোবাসা (1) ভুয়া খবর (1) ভেন্টিলেটর (1) ভ্রমণ (3) মনস্তত্ত্ব (1) মনোবিজ্ঞান (19) মন্ট্রিয়াল (1) মন্ট্রিয়াল আন্তর্জাতিক জ্যাজ উৎসব (2) মস্তিষ্ক ক্যান্সার (1) মহিমান্বিত নকশা (3) মাদক (1) মাদকাসত্তি (2) মাদার তেরেসা (1) মানসিক স্বাস্থ্য (5) মুক্তগদ্য (3) মুক্তচিন্তা (3) মুক্তিযুদ্ধ (3) মৌলবাদ (1) যাপিত জীবন (2) যুগান্তর পত্রিকা (1) যৌনতা (1) রাজনীতি (1) রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প (3) রূপান্তরকাম (1) রৌদ্রস্নান (1) লিওনার্ড ম্লোডিনো (5) লিংক (2) লিঙ্গরূপান্তর (1) লিঙ্গরূপান্তরকারী (1) লিথিয়াম (1) লিফট (1) শিক্ষাব্যবস্থা (1) শিশুতোষ (3) সংগীত (3) সন্ত্রাসবাদ (1) সংবাদমাধ্যম (1) সময়ভ্রমণ (1) সমালোচনা (1) সর্দিগর্মি (1) সানশাইন (1) সামাজিক দূরত্ব (1) সাম্প্রতিক দেখা চলচ্চিত্র (1) সার্স-কোভ-২ ভাইরাস (4) সাহিত্য (4) স্কিৎসোফ্রেনিয়া (1) স্টিফেন হকিং (16) স্ট্রোক (1) স্নায়ুবিজ্ঞান (12) স্নায়ুবিষ (1) স্বাস্থ্যসেবা (1) হলুদ (1)
রোদের অসুখ © 2008 Por *Templates para Você*