অপর্ণার সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল মিহি কুয়াশার শীতার্ত ভোরে- ক্ষণজন্মা শিশিরদল তখন প্রাকৃতিক ভৃঙ্গার পূর্ণ করার কাজে ব্রত ছিল। তার বাবার বদলির চাকুরী- উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা। অগাস্টের এক রৌদ্রাক্রান্ত অথচ শীতকম্বল পরিহিত ভোরে আমাদের ইস্কুলে এসে ভর্তি হয় অপর্ণা। বছরের মাঝ-সময় থেকে আর শিক্ষার্থী ভর্তি করানোর রেওয়াজ না থাকলে-ও সে আমাদের সহপাঠিনী হয়ে গেল, বলা চলে তার অসাধারণ মেধার কারণে! বেলোয়ারি জানালায় রোদ জমে একাকার হয়ে যাওয়া দিনগুলো হামাগুঁড়ি দিত আমাদের ইস্কুলের বারান্দায়।
শ্রেণীকক্ষের প্রচলিত নিয়ম হলো একজন ভাল শিক্ষার্থীর পাশে একজন মাঝারি বা খারাপ মানের শিক্ষার্থী বসবে; সপ্তাহ শেষে অপর্ণার পাশে স্থান হল আমার। আমি যদি-ও ছাত্রী হিসেবে খারাপ নই; সেরা এক থেকে দশের কৌঠায় আমার নাম থাকে, তদাপি নতুন ছাত্রী অপর্ণাকে বিদ্যালয় বা শ্রেণীকক্ষের প্রথাসমূহ সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দেয়ার জন্য আমাকেই বেছে নিয়েছে শিক্ষকমশাই।
আমি তার নারী হওয়ার গল্প শুনতাম, সে নারী হয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই- ঋতুস্রাব হওয়া নারী নয়; রমণী নয়- ভিন্নাঙকের এক নারী যার স্বপ্ন থাকে যেমনিচ্ছে, ছায়া থাকে আধালো-আধান্ধকার, আর একজন নাগর থাকে। আমি তার কবিতা শুনতাম। অপর্ণা কবিতা লিখতো, আমাকে বলেছিল যখন আমাদের মাঝে সৌহার্দ্য হয়ে গিয়েছিল। সেই কবিতাগুলো আমাদের বইভর্তি কাব্যাবলীর মতন ছিল না; না থাকতো ছন্দ, না থাকতো প্রচলিত বিন্যাস। আমি তদাপি মাথা নাড়তাম, আমার শুনতে ভাল্লাগতো; অপর্ণা যখন মিহি সুরে আবৃত্তি করতো আমার হাতের কতিপয় লোম দাঁড়িয়ে যেতো। বিনিময়ে আমি তাকে শোনাতাম আমার জানালায় বসা দাঁড়কাক আর কার্নিসে বাসা বাঁধা পায়রার গল্প, বারান্দার অর্কিডের দেহসৌষ্ঠব বৃদ্ধির কথাসমূহ এবং পত্রিকা পাতা থেকে নেয়া বিনোদনদায়ক কাহিনী।
অপর্ণারা থাকা শুরু করেছিল কলোনীর সরকারী বাসায়। বিশাল আয়তনের ছাদে বৈকালিন মেঘের নিচে আড্ডা হতো ডালভাজা, চানাচুর, নিদেনপক্ষে ভাঙা বাদামে; মাঝে মাঝে এসে জুটতো সৈকত ভাই- অপর্ণার খালাতো ভাই; আমি কিছুদিন পরেই টের পেয়ে গেলাম সৈকত-অপর্ণার ব্যাপারটা। সৈকত ভাই-ও কবিতা লিখতো, তবে অপর্ণার মতো বিঁদঘুটে নয়; ছান্দিক। তাদের নদী-নক্ষত্র-নির্জন সময়ে আমি নিজে কুঁকড়ে যেতাম- আমি নারী হতে চাইতাম।
অপর্ণাকে দেখে আমি আশ্চর্য হতাম। মেধাবিনী মেয়ে, অথচ যাবতীয় কাজ-অকাজে সে উপস্থিত থাকে; ফি শুক্রবারে শেষ ঘণ্টার ক্লাস ফাঁকি দিয়ে সিনেমা দেখে, পাড়ার রকে আড্ডা মারা ছেলেদের সাথে ঝগড়া করে। আমি কয়েক সপ্তাহ তার সাথে লুকিয়ে গিয়ে সিনেমা দেখে এলাম। একবার বাংলার শিক্ষকের চোখে পড়লাম; অপর্ণা প্রত্যুপন্নমতি স্বভাবে খালার বাসায় যাচ্ছে বলে সামাল দিল, আমি একলা থাকলে লজ্জাতেই মরে যেতাম।
দাঁড়কাকের কথা অপর্ণা কোনদিন বিশ্বাস করতে চাইতো না, একদিন বাসায় নিয়ে এসে দেখালাম। আমার কামরার জানালার কার্নিসে একটা দাঁড়কাক প্রায়শ এসে বসে থাকতো; কোন প্রকারের শোরগোল করতো না, শুধু আলতো বসে থাকা। আমার মজাই লাগতো। কোন কোন দুপুরে আমার ইস্কুল তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গেলে আমি বাসায় এসে একা একা সাজতাম, চুল বাঁধতাম; শাড়ি-জামা ঘন ঘন পাল্টিয়ে পড়তুম। দাঁড়কাকটা দেখতো, তবে সে আমার নাগর ছিল না; হয়ত, দৃশ্যক-নাগর ছিল।
"আমি হলে একদিনেই এটাকে পাড়া ছাড়া করতাম।" অপর্ণা নাক সিঁটকায়, আমি আহত হই।
"কিভাবে?" আমি বই গুছাতে থাকি, সারা টেবিল এলোমেলো বই-খাতা-কলম ইত্যাদি।
"একদিন গরম পানি ঢেলে দিতাম কিংবা ছ্যাঁক দিতাম।" অপর্ণা আমার জামাকাপড় দেখে আর কথা বলে, আমি বিছানার কোণায় বসে থাকি; ঘরে বিবিধ নৈঃশব্দ্য।
সৈকত ভাইরা আমাদের এলাকায় থাকতো, অথচ কোনদিন দেখি নাই আগে; অপর্ণার সাথে পরিচয় না হলে এই ভারী কাঁচের চশমা পরিহিত ছেলেটার সাথে কখনো কাটান হতো না আশ্বিনা বিকাল- সূর্যের ক্রমশ রঙ হারানো হলুদাভ-কমলা আলোকশাড়িতে যখন সবকিছু অলৌকিক মনে হয়; একেকটা দীর্ঘশ্বাস চলে যায় শ্বাস-প্রশ্বাসের দ্বিসাইকেল পথ ধরে। সৈকত কথা বলে কম, তাকিয়ে থাকে বেশি; আমি চিরকালই মাটির বন্ধু, মাটিতে বিভিন্ন উৎসাহজনক উপাদান খুঁজি হেঁট মাথায়।
অপর্ণার কাছেই শুনলাম সৈকত ভাই'র কিছু সীমাবদ্ধতার কথা। চোখ অন্ধ হওয়ার পথে, শব্দ-উচ্চারণে বিবিধ গোলযোগ; তবু-ও ছেলেটা কবিতা লেখে, নৈঃশব্দিক বসে থাকে, যেন নাই নাই করে-ও সর্বদা বিরাজমান। অপর্ণা এইসব জেনে-ও সখাসখি করে, মেয়েটাকে আমার দারুণ ঈর্ষা হয়।
অপর্ণা একদিন চুরি করে গলায়-মালা-পরানোর স্বপ্ন দেখে, আমার আশ্চর্য এক নারীর কথা মনে আসে।
আমার ছোট ভাই অনিককে ন্যাড়া করা হল আজ, ক্রিকেট ব্যাট এর প্রলোভন দেখিয়ে। লম্বা লম্বা চুলে ঘুরে বেড়ায়- দেখতেই কেমন লাগে! কিন্তু, ন্যাড়া হওয়ার পরে দেখা গেল বাবা ক্রিকেট ব্যাট কিনে দিতে আগ্রহী নয়; আমাদের বাসাটা কলোনীর পাশেই, আর আশপাশে খেলার মাঠ বলতে কলোনীর বাসাগুলোর মাঝখানের ক্রমশ হ্রাসময় 'উঠোন।' ফি বছর কতিপয় বাড়ির কাঁচের জানালা ভাঙার অভিযোগ আছে, বাবা সেই ফুলিঙ্গ উঁসকে দিয়ে আগুন ধরাতে চান না।
ফলশ্রুতিতে বিকেল যৌবনবতী না হতেই অভিমান করে অনিক বাসা থেকে বের হয়ে গেল, আমি তখন সিঁড়িঘরে অপর্ণার জন্য অপেক্ষা করছি; আজ আমরা কবি দেখতে যাব। আমরা বলতে অপর্ণা এবং আমার শরীর; শহরতলী থেকে কোন এক অদ্ভুত লোক এসেছে যিনি শব্দ বিক্রি করেন। অপর্ণার স্বাদ জেগেছে কবি দেখবে; যদি-ও কবি দেখার নিয়ম হলো কবির নিজের একটা কবিতার বই সাথে নিজে যাওয়া এবং মিহি সুরে বলতে পারা যে- "আপনার কবিতা মনোরম।" সমস্যা হলো অপর্ণার কাছে কোন বই নেই, সে ছাড়াছাড়াভাবে কিছু কবিতা পাঠ করেছে, সেই ভরসাতে যাচ্ছে।
মাঝরাস্তায় এসে অম্বর-নদে মেঘের জাহাজ দেখে অপর্ণার মত পরিবর্তন হলো, সে বাহানা ধরল যে সারা বিকেল ঘুরে বেড়াবে; কবি দেখার চেয়ে ফুঁচকা খাওয়া অনেক আরামদায়ক।
আমার পায়ের জোর কম, ইদানীং বুকের দম কমে আসছে বাড়ন্ত শরীরের সাথে বিপরীতভাবে-সমানুপাতিকতা বজায় রেখে। আমি বালাইঘাটের দোহাই দিলুম। অপর্ণা মানল না, সে সৈকত ভাইকে মুঠোফোনে ডাকল। সৈকত ভাই অপারগতা জানাল, আমি হলাম ইচ্ছে-পূজার বলি।
"তোকে একটা গোপন কথা বলি।"
"কী।" আমি উড়ন্ত বিহগদলের সাথে পাল্লা দিয়ে হাই তুললাম; মাঝরাস্তায় হাই তোলা বিশেষ দৃষ্টিসুন্দর কাজ নয়, তবু-ও আমি করলাম। আমার ভাল্লাগে।
"আমার বাবার একটা গোপন রমণী আছে।"
আমি হাঁটা বন্ধ করলাম নাকি পাদপাত হঠাৎ পায়ের সাথে সন্ধিবদ্ধ হলো তা নির্ণয়ার্থে চিন্তা করা যেতে পারে। আমি সেই চিন্তা বাদ দিয়ে অপর্ণার মুখের দিকে তাকালাম। নির্লীপ্ত, এবং সাবলীল।
"মাথা গেছে।"
"আরে শুন না, আমি কীভাবে আবিষ্কার করলুম ঘটনাটা; বাবা মাঝে মাঝে অফিসের ফাইল-পত্তুর নিয়ে আসে বাসায়- সেদিন বাসায় ভুলে ফেলে গিয়েছিল একটা দরকারী কাগজ; আমাকে ফোন করে বলল পিয়নকে দিয়ে পাটিয়ে দিতে। কী মনে হলো জানি না, আমি নিজেই নিয়ে গেলাম- আমি নিজের চোখে দেখেছি-"
বাতাসের ঘনত্ব বাড়ছে- আমার মনে হলো। বাতাসে এখন বিবিধ সংকর রেণু। আমি দূরত্ব মাপি। চোখের কড়াই'তে দৃশ্যের সংস্কার করি- ভাজাভাজি করি।
"বাবার জন্য আমার মায়া হয়। নিয়মিত আমার খোঁজ নেয়, আদর করে অথচ তিনি জানেন না আমি তাঁর সম্পর্কে কতো বিরাট সত্যটা জানি। বাবার দিকে যখন তাকাই- একটা বোকা মানুষের মুখ দেখি; আমার বোকা মানুষদের ভাল্লাগে না।"
"অপু, আমরা অন্য বিষয়ে কথা বলি?" আমি বাতাসের বোরকা পরি।
"তুই লজ্জা পাচ্ছিস নাকি? তুই আসলেই একটা মেয়ে থেকে গেলি, নারী হলি না।"
আমি কিছু বললাম না, কেবল চোখ দু'টি তুলে অপর্ণার দিকে তাকালাম অনিমেষ।
সেদিন শাড়িগন্ধভোরে আমি বিছানায় আধশোয়া শুয়ে দাঁড়কাকটাকে পর্যবেক্ষণ করছিলাম। মৌলিক কষ্ণরঙা।
দৌড়ঝাঁপ দিয়ে বাসা এলেন সৈকত ভাই। খবর ভয়াবহ। সৈকত ভাই'র নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যস্ততার সাথে মিলিয়ে যা বুঝলাম তার সারমর্ম হলো অপর্ণা বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছে। চিরকালীন প্রথার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে টেবিলে বার্তা রেখে গেছে। সৈকত ভাই'র কুত্তা-পাগল অবস্থা।
আমি আশ্চর্য হই নাই, নিরাশ হয়েছি! আমি ভেবেছিলাম সৈকত ভাই মালাটা পরবে, অথচ তিনি মাথানিচু করে বিছানার ধারে বসে আছেন।
"আপনাদের মাঝে ভুল বুঝাবুঝি হয়েছিল?" আমি হালকা সুরে বললাম।
"তুমি কী বলছ আমি বুঝতে পারছি না।"
"আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি সরাসরি- আপনার কী প্রেম করতেন?"
"আমি অপর্ণাকে পছন্দ করতাম, কিন্তু- ভাবি নি; কেন?"
"না, এমনি।"
আমি চেয়ারে গিয়ে বসলাম। বাইরে রোদের তীব্রতা বাড়ছে। রোদ পোশাক খুলে নগ্ন হয়ে যাচ্ছে; এখন সমস্তই আগুন। প্রাকৃতিক।
আমি মূল্যায়ন-পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছি। বাবাকে বলতেই শুধু একটা কথা বললেন, "তোমার কাছ থেকে এটা আশা করি নি।"
বিকালের দিকে একজন স্যারের কাছে পড়ছি; পদার্থবিজ্ঞান। অপর্ণা ফিরে আসে নাই, ওর বাবা বদলি হয়ে গেছেন লক্ষ্মীপুর। আমি ভেবেছিলাম অপর্ণা অন্তত আমাকে চিঠি-মিঠি দিবে; বিধিবাম- কোন হদিস পাই নি।
বিকেলের দিকে পড়া শেষে বাসা ফিরছি। আজকের আকাশটা ফোলা-ফোলা মেঘে ভর্তি। ছাপ ছাপ গন্ধ নিয়ে বিকালের সনাতনী রোদের নৌকাসমূহ পশ্চিমযাত্রায় নিমগ্ন হচ্ছে।
আচ্ছা, আজ কবি দেখতে গেলে কেমন হয়! আমার সাদা খাতার পৃষ্ঠাবলীতে লেখা অদৃশ্য সমস্ত কবিতাদল নিয়ে তাঁর সামনে দাঁড়াব আর মিহি সুরে বলব- 'পাঠ করুন; লিখে দিন আত্মশব্দ।' না, বাপু, সন্ধ্যে হয়ে আসছে। বাবা নিশ্চয় অফিস থেকে ফিরে এসেছেন। এতক্ষণে বোধহয় খোঁজাখুঁজি শুরু হয়ে গেছে, আজ বড্ড শ্লথগতিতে হন্টন হচ্ছে আমার।
সৈকত ভাইকে খবর দিব? সৈকত ভাইটা ঝর্ণা আপার সাথে অভিসার করছে ইদানীং, আমি প্রায়শ এখানে-সেখানে দেখি। আমার নিজেরই লজ্জা হয়। সৈকত ভাই কী কবি দেখতে যাবে? কবিরা কি কবিকে দেখে? না, কবিরা কবি-অন্ধ; তাঁদের কেবল কবিতা দেখার চোখ আছে- কবি দেখার নয়। অপর্ণাকে আমি অনেক দেখেছি, অপর্ণার পালানো আমাকে অনেক পড়িয়েছে।
রাস্তার বৈদ্যুতিক খুঁটি-বাতিগুলো জ্বলতে শুরু করেছে। তাদের মুখে বিকালের কোরাস, সূর্যের ক্রমহ্রাসমান আলোর আদর। এসব আধালো-আধান্ধকার পরিবেশে অপ্রাকৃতিক লাগে আশপাশের বস্তু, মানুষ। যেখানে পৌঁছেছি সেখানে রাত- এই মন্ত্রে বিশ্বাসী আধুনিক ভবঘুরেরা রাত যাপনের তরিকা আয়োজনে মগ্ন; তাদের সারারাত পাহারা দিবে বৈদ্যুতিক খুঁটি-বাতি; গালে, উলঙ্গ গ্রীবায় থোঁকায় থোঁকায় উড়ে এসে আহত হবে আলোকবর্ণ বা তরঙ্গরশ্মিসমূহ।
আমি নিজে নিজে টিকেট কেটে বাসে উঠে গেলাম; শহরের অন্য প্রান্তে নিরালায় থাকে লোকটা। বাস থেকে নেমে মিনিট পনের হাঁটতে হবে; পারব তো? কাল তো পত্রিকায় দেখেছিলিম যে একজন কিশোরীকে কয়েকটি নগরদস্যু আক্রমণ করে...।
বাসের হাতলে আমার হাত রেখে আমি টের পেলাম আমি অনেক আগেই নারী হয়ে গেছি, কেবল বৃষ্টির অপেক্ষায় জলগান গাই নি।
-------------
৪/২০০৯
শ্রেণীকক্ষের প্রচলিত নিয়ম হলো একজন ভাল শিক্ষার্থীর পাশে একজন মাঝারি বা খারাপ মানের শিক্ষার্থী বসবে; সপ্তাহ শেষে অপর্ণার পাশে স্থান হল আমার। আমি যদি-ও ছাত্রী হিসেবে খারাপ নই; সেরা এক থেকে দশের কৌঠায় আমার নাম থাকে, তদাপি নতুন ছাত্রী অপর্ণাকে বিদ্যালয় বা শ্রেণীকক্ষের প্রথাসমূহ সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দেয়ার জন্য আমাকেই বেছে নিয়েছে শিক্ষকমশাই।
আমি তার নারী হওয়ার গল্প শুনতাম, সে নারী হয়ে গিয়েছিল অনেক আগেই- ঋতুস্রাব হওয়া নারী নয়; রমণী নয়- ভিন্নাঙকের এক নারী যার স্বপ্ন থাকে যেমনিচ্ছে, ছায়া থাকে আধালো-আধান্ধকার, আর একজন নাগর থাকে। আমি তার কবিতা শুনতাম। অপর্ণা কবিতা লিখতো, আমাকে বলেছিল যখন আমাদের মাঝে সৌহার্দ্য হয়ে গিয়েছিল। সেই কবিতাগুলো আমাদের বইভর্তি কাব্যাবলীর মতন ছিল না; না থাকতো ছন্দ, না থাকতো প্রচলিত বিন্যাস। আমি তদাপি মাথা নাড়তাম, আমার শুনতে ভাল্লাগতো; অপর্ণা যখন মিহি সুরে আবৃত্তি করতো আমার হাতের কতিপয় লোম দাঁড়িয়ে যেতো। বিনিময়ে আমি তাকে শোনাতাম আমার জানালায় বসা দাঁড়কাক আর কার্নিসে বাসা বাঁধা পায়রার গল্প, বারান্দার অর্কিডের দেহসৌষ্ঠব বৃদ্ধির কথাসমূহ এবং পত্রিকা পাতা থেকে নেয়া বিনোদনদায়ক কাহিনী।
অপর্ণারা থাকা শুরু করেছিল কলোনীর সরকারী বাসায়। বিশাল আয়তনের ছাদে বৈকালিন মেঘের নিচে আড্ডা হতো ডালভাজা, চানাচুর, নিদেনপক্ষে ভাঙা বাদামে; মাঝে মাঝে এসে জুটতো সৈকত ভাই- অপর্ণার খালাতো ভাই; আমি কিছুদিন পরেই টের পেয়ে গেলাম সৈকত-অপর্ণার ব্যাপারটা। সৈকত ভাই-ও কবিতা লিখতো, তবে অপর্ণার মতো বিঁদঘুটে নয়; ছান্দিক। তাদের নদী-নক্ষত্র-নির্জন সময়ে আমি নিজে কুঁকড়ে যেতাম- আমি নারী হতে চাইতাম।
অপর্ণাকে দেখে আমি আশ্চর্য হতাম। মেধাবিনী মেয়ে, অথচ যাবতীয় কাজ-অকাজে সে উপস্থিত থাকে; ফি শুক্রবারে শেষ ঘণ্টার ক্লাস ফাঁকি দিয়ে সিনেমা দেখে, পাড়ার রকে আড্ডা মারা ছেলেদের সাথে ঝগড়া করে। আমি কয়েক সপ্তাহ তার সাথে লুকিয়ে গিয়ে সিনেমা দেখে এলাম। একবার বাংলার শিক্ষকের চোখে পড়লাম; অপর্ণা প্রত্যুপন্নমতি স্বভাবে খালার বাসায় যাচ্ছে বলে সামাল দিল, আমি একলা থাকলে লজ্জাতেই মরে যেতাম।
দাঁড়কাকের কথা অপর্ণা কোনদিন বিশ্বাস করতে চাইতো না, একদিন বাসায় নিয়ে এসে দেখালাম। আমার কামরার জানালার কার্নিসে একটা দাঁড়কাক প্রায়শ এসে বসে থাকতো; কোন প্রকারের শোরগোল করতো না, শুধু আলতো বসে থাকা। আমার মজাই লাগতো। কোন কোন দুপুরে আমার ইস্কুল তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গেলে আমি বাসায় এসে একা একা সাজতাম, চুল বাঁধতাম; শাড়ি-জামা ঘন ঘন পাল্টিয়ে পড়তুম। দাঁড়কাকটা দেখতো, তবে সে আমার নাগর ছিল না; হয়ত, দৃশ্যক-নাগর ছিল।
"আমি হলে একদিনেই এটাকে পাড়া ছাড়া করতাম।" অপর্ণা নাক সিঁটকায়, আমি আহত হই।
"কিভাবে?" আমি বই গুছাতে থাকি, সারা টেবিল এলোমেলো বই-খাতা-কলম ইত্যাদি।
"একদিন গরম পানি ঢেলে দিতাম কিংবা ছ্যাঁক দিতাম।" অপর্ণা আমার জামাকাপড় দেখে আর কথা বলে, আমি বিছানার কোণায় বসে থাকি; ঘরে বিবিধ নৈঃশব্দ্য।
সৈকত ভাইরা আমাদের এলাকায় থাকতো, অথচ কোনদিন দেখি নাই আগে; অপর্ণার সাথে পরিচয় না হলে এই ভারী কাঁচের চশমা পরিহিত ছেলেটার সাথে কখনো কাটান হতো না আশ্বিনা বিকাল- সূর্যের ক্রমশ রঙ হারানো হলুদাভ-কমলা আলোকশাড়িতে যখন সবকিছু অলৌকিক মনে হয়; একেকটা দীর্ঘশ্বাস চলে যায় শ্বাস-প্রশ্বাসের দ্বিসাইকেল পথ ধরে। সৈকত কথা বলে কম, তাকিয়ে থাকে বেশি; আমি চিরকালই মাটির বন্ধু, মাটিতে বিভিন্ন উৎসাহজনক উপাদান খুঁজি হেঁট মাথায়।
অপর্ণার কাছেই শুনলাম সৈকত ভাই'র কিছু সীমাবদ্ধতার কথা। চোখ অন্ধ হওয়ার পথে, শব্দ-উচ্চারণে বিবিধ গোলযোগ; তবু-ও ছেলেটা কবিতা লেখে, নৈঃশব্দিক বসে থাকে, যেন নাই নাই করে-ও সর্বদা বিরাজমান। অপর্ণা এইসব জেনে-ও সখাসখি করে, মেয়েটাকে আমার দারুণ ঈর্ষা হয়।
অপর্ণা একদিন চুরি করে গলায়-মালা-পরানোর স্বপ্ন দেখে, আমার আশ্চর্য এক নারীর কথা মনে আসে।
আমার ছোট ভাই অনিককে ন্যাড়া করা হল আজ, ক্রিকেট ব্যাট এর প্রলোভন দেখিয়ে। লম্বা লম্বা চুলে ঘুরে বেড়ায়- দেখতেই কেমন লাগে! কিন্তু, ন্যাড়া হওয়ার পরে দেখা গেল বাবা ক্রিকেট ব্যাট কিনে দিতে আগ্রহী নয়; আমাদের বাসাটা কলোনীর পাশেই, আর আশপাশে খেলার মাঠ বলতে কলোনীর বাসাগুলোর মাঝখানের ক্রমশ হ্রাসময় 'উঠোন।' ফি বছর কতিপয় বাড়ির কাঁচের জানালা ভাঙার অভিযোগ আছে, বাবা সেই ফুলিঙ্গ উঁসকে দিয়ে আগুন ধরাতে চান না।
ফলশ্রুতিতে বিকেল যৌবনবতী না হতেই অভিমান করে অনিক বাসা থেকে বের হয়ে গেল, আমি তখন সিঁড়িঘরে অপর্ণার জন্য অপেক্ষা করছি; আজ আমরা কবি দেখতে যাব। আমরা বলতে অপর্ণা এবং আমার শরীর; শহরতলী থেকে কোন এক অদ্ভুত লোক এসেছে যিনি শব্দ বিক্রি করেন। অপর্ণার স্বাদ জেগেছে কবি দেখবে; যদি-ও কবি দেখার নিয়ম হলো কবির নিজের একটা কবিতার বই সাথে নিজে যাওয়া এবং মিহি সুরে বলতে পারা যে- "আপনার কবিতা মনোরম।" সমস্যা হলো অপর্ণার কাছে কোন বই নেই, সে ছাড়াছাড়াভাবে কিছু কবিতা পাঠ করেছে, সেই ভরসাতে যাচ্ছে।
মাঝরাস্তায় এসে অম্বর-নদে মেঘের জাহাজ দেখে অপর্ণার মত পরিবর্তন হলো, সে বাহানা ধরল যে সারা বিকেল ঘুরে বেড়াবে; কবি দেখার চেয়ে ফুঁচকা খাওয়া অনেক আরামদায়ক।
আমার পায়ের জোর কম, ইদানীং বুকের দম কমে আসছে বাড়ন্ত শরীরের সাথে বিপরীতভাবে-সমানুপাতিকতা বজায় রেখে। আমি বালাইঘাটের দোহাই দিলুম। অপর্ণা মানল না, সে সৈকত ভাইকে মুঠোফোনে ডাকল। সৈকত ভাই অপারগতা জানাল, আমি হলাম ইচ্ছে-পূজার বলি।
"তোকে একটা গোপন কথা বলি।"
"কী।" আমি উড়ন্ত বিহগদলের সাথে পাল্লা দিয়ে হাই তুললাম; মাঝরাস্তায় হাই তোলা বিশেষ দৃষ্টিসুন্দর কাজ নয়, তবু-ও আমি করলাম। আমার ভাল্লাগে।
"আমার বাবার একটা গোপন রমণী আছে।"
আমি হাঁটা বন্ধ করলাম নাকি পাদপাত হঠাৎ পায়ের সাথে সন্ধিবদ্ধ হলো তা নির্ণয়ার্থে চিন্তা করা যেতে পারে। আমি সেই চিন্তা বাদ দিয়ে অপর্ণার মুখের দিকে তাকালাম। নির্লীপ্ত, এবং সাবলীল।
"মাথা গেছে।"
"আরে শুন না, আমি কীভাবে আবিষ্কার করলুম ঘটনাটা; বাবা মাঝে মাঝে অফিসের ফাইল-পত্তুর নিয়ে আসে বাসায়- সেদিন বাসায় ভুলে ফেলে গিয়েছিল একটা দরকারী কাগজ; আমাকে ফোন করে বলল পিয়নকে দিয়ে পাটিয়ে দিতে। কী মনে হলো জানি না, আমি নিজেই নিয়ে গেলাম- আমি নিজের চোখে দেখেছি-"
বাতাসের ঘনত্ব বাড়ছে- আমার মনে হলো। বাতাসে এখন বিবিধ সংকর রেণু। আমি দূরত্ব মাপি। চোখের কড়াই'তে দৃশ্যের সংস্কার করি- ভাজাভাজি করি।
"বাবার জন্য আমার মায়া হয়। নিয়মিত আমার খোঁজ নেয়, আদর করে অথচ তিনি জানেন না আমি তাঁর সম্পর্কে কতো বিরাট সত্যটা জানি। বাবার দিকে যখন তাকাই- একটা বোকা মানুষের মুখ দেখি; আমার বোকা মানুষদের ভাল্লাগে না।"
"অপু, আমরা অন্য বিষয়ে কথা বলি?" আমি বাতাসের বোরকা পরি।
"তুই লজ্জা পাচ্ছিস নাকি? তুই আসলেই একটা মেয়ে থেকে গেলি, নারী হলি না।"
আমি কিছু বললাম না, কেবল চোখ দু'টি তুলে অপর্ণার দিকে তাকালাম অনিমেষ।
সেদিন শাড়িগন্ধভোরে আমি বিছানায় আধশোয়া শুয়ে দাঁড়কাকটাকে পর্যবেক্ষণ করছিলাম। মৌলিক কষ্ণরঙা।
দৌড়ঝাঁপ দিয়ে বাসা এলেন সৈকত ভাই। খবর ভয়াবহ। সৈকত ভাই'র নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যস্ততার সাথে মিলিয়ে যা বুঝলাম তার সারমর্ম হলো অপর্ণা বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছে। চিরকালীন প্রথার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে টেবিলে বার্তা রেখে গেছে। সৈকত ভাই'র কুত্তা-পাগল অবস্থা।
আমি আশ্চর্য হই নাই, নিরাশ হয়েছি! আমি ভেবেছিলাম সৈকত ভাই মালাটা পরবে, অথচ তিনি মাথানিচু করে বিছানার ধারে বসে আছেন।
"আপনাদের মাঝে ভুল বুঝাবুঝি হয়েছিল?" আমি হালকা সুরে বললাম।
"তুমি কী বলছ আমি বুঝতে পারছি না।"
"আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি সরাসরি- আপনার কী প্রেম করতেন?"
"আমি অপর্ণাকে পছন্দ করতাম, কিন্তু- ভাবি নি; কেন?"
"না, এমনি।"
আমি চেয়ারে গিয়ে বসলাম। বাইরে রোদের তীব্রতা বাড়ছে। রোদ পোশাক খুলে নগ্ন হয়ে যাচ্ছে; এখন সমস্তই আগুন। প্রাকৃতিক।
আমি মূল্যায়ন-পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছি। বাবাকে বলতেই শুধু একটা কথা বললেন, "তোমার কাছ থেকে এটা আশা করি নি।"
বিকালের দিকে একজন স্যারের কাছে পড়ছি; পদার্থবিজ্ঞান। অপর্ণা ফিরে আসে নাই, ওর বাবা বদলি হয়ে গেছেন লক্ষ্মীপুর। আমি ভেবেছিলাম অপর্ণা অন্তত আমাকে চিঠি-মিঠি দিবে; বিধিবাম- কোন হদিস পাই নি।
বিকেলের দিকে পড়া শেষে বাসা ফিরছি। আজকের আকাশটা ফোলা-ফোলা মেঘে ভর্তি। ছাপ ছাপ গন্ধ নিয়ে বিকালের সনাতনী রোদের নৌকাসমূহ পশ্চিমযাত্রায় নিমগ্ন হচ্ছে।
আচ্ছা, আজ কবি দেখতে গেলে কেমন হয়! আমার সাদা খাতার পৃষ্ঠাবলীতে লেখা অদৃশ্য সমস্ত কবিতাদল নিয়ে তাঁর সামনে দাঁড়াব আর মিহি সুরে বলব- 'পাঠ করুন; লিখে দিন আত্মশব্দ।' না, বাপু, সন্ধ্যে হয়ে আসছে। বাবা নিশ্চয় অফিস থেকে ফিরে এসেছেন। এতক্ষণে বোধহয় খোঁজাখুঁজি শুরু হয়ে গেছে, আজ বড্ড শ্লথগতিতে হন্টন হচ্ছে আমার।
সৈকত ভাইকে খবর দিব? সৈকত ভাইটা ঝর্ণা আপার সাথে অভিসার করছে ইদানীং, আমি প্রায়শ এখানে-সেখানে দেখি। আমার নিজেরই লজ্জা হয়। সৈকত ভাই কী কবি দেখতে যাবে? কবিরা কি কবিকে দেখে? না, কবিরা কবি-অন্ধ; তাঁদের কেবল কবিতা দেখার চোখ আছে- কবি দেখার নয়। অপর্ণাকে আমি অনেক দেখেছি, অপর্ণার পালানো আমাকে অনেক পড়িয়েছে।
রাস্তার বৈদ্যুতিক খুঁটি-বাতিগুলো জ্বলতে শুরু করেছে। তাদের মুখে বিকালের কোরাস, সূর্যের ক্রমহ্রাসমান আলোর আদর। এসব আধালো-আধান্ধকার পরিবেশে অপ্রাকৃতিক লাগে আশপাশের বস্তু, মানুষ। যেখানে পৌঁছেছি সেখানে রাত- এই মন্ত্রে বিশ্বাসী আধুনিক ভবঘুরেরা রাত যাপনের তরিকা আয়োজনে মগ্ন; তাদের সারারাত পাহারা দিবে বৈদ্যুতিক খুঁটি-বাতি; গালে, উলঙ্গ গ্রীবায় থোঁকায় থোঁকায় উড়ে এসে আহত হবে আলোকবর্ণ বা তরঙ্গরশ্মিসমূহ।
আমি নিজে নিজে টিকেট কেটে বাসে উঠে গেলাম; শহরের অন্য প্রান্তে নিরালায় থাকে লোকটা। বাস থেকে নেমে মিনিট পনের হাঁটতে হবে; পারব তো? কাল তো পত্রিকায় দেখেছিলিম যে একজন কিশোরীকে কয়েকটি নগরদস্যু আক্রমণ করে...।
বাসের হাতলে আমার হাত রেখে আমি টের পেলাম আমি অনেক আগেই নারী হয়ে গেছি, কেবল বৃষ্টির অপেক্ষায় জলগান গাই নি।
-------------
৪/২০০৯
No comments:
Post a Comment