অ
লোকটি দাঁড়ির ফাঁকে রোদের লুকোচুরি নিয়ে সূর্যে এসে দাঁড়ায়। রোদে শরীর রাখে।
খালি গা থেকে উড়ে যায় কতকগুলো ঘামের চিল। একবার মেঘের শ্রীটা দেখে নিয়ে পা বাড়ায় সে- যেতে হবে ঝুপড়ি দোকানে; বেলা হয়ে আসছে- বারটার পরে কলিমমিস্ত্রি আর চা করে না। কলিমমিস্ত্রি চায়ের কারিগর, কাঠের না। অথচ তার দোকানের মন্দার কাঠের বেঞ্চিতে বসলে আরাম লাগে- গরমকালে স্রোতেলা জলে স্নান দিলে যেমন লাগে সেরকম। বসে বসে লোকটা মাটির কথা ভাবে।
লোকটি বুড়োদা। সকলে তাই ডাকে।
তার জাত পরিচয় ঠাহর নেই কারো। সবাই জন্ম থেকে এই দাঁড়ির বন আর টাকমাথা দেখে আসছে- গ্রীষ্মে কী শীতে।
'কলিম, কইদিন লাগব?'
'কইতাম হারি না। পোলাটা ভাইঙা পড়তাছে।'
'বিকালে কী আহে না এইখানে?'
'এখন মাঝে মাঝে। ব্যথা উঠে প্রায়।'
ওরা চুপ হয়ে যায়। বাতাসের অণুপোনাগুলো বিশ্রাম পায়।
আ
তিনটি পাড়া নিয়ে গ্রামটি, হাজার তিনেক মানুষের ছায়া; একটি দিঘী। লোকটি দিঘীপাড়ে এসে দাঁড়ায় বিনম্র। সে রতনকে খুঁজছে, কলিমমিস্ত্রী বলল যে রতনকে ইদানীং দিঘীপাড়ে আনাগোনা করতে দেখা যায়।
'কী করো গো বাজান?'
'ডাল খুঁজি।'
'কিসের ডাল?'
'গাছের ডাল। শক্ত কিছিমের, ফাঁস দিমু।'
'ক্যান?'
'ক্যান মানে! তিন তিনটা বান্ধাইছে, একটা-ও জুইতের না। একবার-ও অকাল অইব মনে হয়। আমার দরকার ত্যাদড় পোলা, সারাজীবন তো গতর খাটতে পারুম না।'
লোকটি নির্লিপ্ত চোখে তাকায়,'এবার-ও অকাল অইব মনে হইল ক্যামনে?'
'পেট উচা না। পোলা অইবার অইলে পেটে বান ডাকতো।'
লোকটির চোখ পিটপিট করে, সূর্য মেঘে মেঘে লুকোচুরি।
'তুই তাইলে ফাঁসই দে।'
ই
কুসুম তখন কল থেকে জল নিয়ে ফিরছিল। এসে দেখে মাটির দাওয়ায় পিঁড়ি পেতে বসে আছে বুড়োদা।
কুসুমের শাড়িতে জলের ঝুলন, টুপটাপ ঝরে পড়ে ধুলোর পিপাসা মেটায়। তার বদনে দুপুরের নির্জন সুডৌল খেলা করে, বাতাসের চুম্বন ঝাপটায় উড়ে যায় কাঙালি চুল।
'এই অসময়ে যে?'
বুড়োটা চুপ করে থাকে। উদল উঠোনে কয়েকটি রোদ-ছায়ার আঁকিবুকি।
'তুই কই গেছিলি?'
'পুষ্কুরিণীতে।'
'এতক্ষণ লাগল!'
'কি করমু কও চাচা। তালুকদারের পুকুরের জল টলটলা, ভাত রানলে ফেন ফালানো লাগে না, খাওন যায়। তবে যা ভিড়। তালুকদারের চামচাটা কই যে আসছে মৌসুমে সে জল বিক্রি দিব। তাইলে নাকি ভিড় কমবে।'
'তালুকদাররে সেইকালে দৌড়ানি দিছিলাম। শালা রাজাকার।'
'কইলা যে ক্যান এই অসময়ে?'
'ফেন আছে? সক্কালের?'
কুসুম অটুটদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
'আপনে অভুগ আছেন আগে কইবেন না! আর আমি কি বেদমা ম্যাইয়া আপনার মুখ দেইখ্যা বুঝার উচিত ছিল। দাঁড়ান, ঘরে কিছু আছে কিনা দেখি।'
কুসুম আঁচল টেনে ঘরে যায়। এখানে মাটি শুষ্ক।
সে ফিরে আসে কিছুটা চিঁড়ে নিয়ে আর একটা উড়িকলার অর্ধেক।
'এই আছে। ওনি অর্ধেক খাইয়া বের হইছেন। আপনে খেয়ে নেন।'
'আকবর আইসা আবার না খাইয়া থাকব না?'
'আরে না। আমি ভাত পাকামু নে। জল আনলাম না।'
বুড়োটা শীর্ণ আঙুলে হাত বাড়ায়। আঙুলের সাথে মাটি লেগে আছে। সে মাটিসহ চিঁড়ে আর আর্ধেকটা কলা খেতে থাকে।
'ওরে মা, তুই কিছু খাইছস?' বুড়োটা মাথায় ধার দেয়।
পাকঘরটা দাওয়াই থেকে হাত পাঁচেক দূরে। কুসুম ছেলী (গোবর মাখানো গাছের ডাল) আর শুকনো পাতা দিয়ে আগুন জ্বালায়। সূর্য ঈর্ষা করে প্রখর হয়, এখন মাঝদুপুর।
ধোঁয়ার বৃত্ত থেকে উঁকি দিয়ে কুসুম বলে উঠে- 'আমি খামু নে। আপনে খান। না খাইয়া তো শ্যাষ।'
কথা সত্য। গতকাল সকাল থেকে তিনি অভুক্ত। অবশ্য তার অভ্যেস আছে।
'মারে। এখন তো তোর বেশি বেশি খাওয়ার কথা। বাচ্চাটারে মজবুত হওয়া লাগবো। অইটারে আমি সূর্যসন্তান বানামু।'
' হা হা। চাচায় যে কি কও।' কুসুম লজ্জা পেয়ে ডালিমফললাল। একবার নিজের পেটে হাত রাখে।
বুড়োটা এলোমেলো পায়ে উঠে এসে পাকঘরে পিঁড়িতে বসে। কাছাকাছি। চুপিচুপি আলতো স্বরে বলে উঠে,'মারে, একটা বায়না চামু। দিবি।'
কুসুমের হৃদয় ছ্যাঁত করে উঠে। না জানি কী!
'কও।'
'মারে, তোর ছাওলের আতুর ঘরে যাইতে দিবি। সবাই ছোঁয়ার আগে...'
কুসুম চোখ তুলে তাকায়। শশ্মান দূরে আছে, অথচ গাঢ় নৈঃশব্দের উড়ে আসে।
'অইখানে তো পরপুরুষ গো যাওন নিষেধ। আপনে কি করবেন?'
'বাচ্চাটারে একটু মাটি মাখায় দিমু। দিঘীর মাঝখানের মাটি। আমি ডুবসাঁতার দিয়ে তুইল্লা আনুম।'
'মাডি? মাডি মাখায় কি করবেন। তেল দিতে হয় জন্মাইলে। মাসকুটি খালা সেকথাই তো কইল সেদিন।'
'জানি রে। ওইটা ভুল। ঐ দিঘীর মাটি সুষম। বাচ্চা খাঁটি হইবো।'
' কী সব বকতাছ।' কুসুম ফুটন্ত পানিতে চাল ঢেলে দেয়। কচুশাক কাটতে বসে।
'বেবাকরে মাইরা চাপা দিয়া দিছে। আমার সামনে। আমার...আমার...আমারে একটা বাঁশগাছের সাথে ব্যাইন্ধা পিটাইছে। কব্জিতে আর বল নাই, কেহ কাজ-ও দেয় না এখন।' বুড়োটা শ্বাস নেয়, পুরাতন কোন কুয়া থেকে মানুষ উঠে আসলে যেমন হাঁপি খায় তেমনি। 'আমি গেছিলাম গঞ্জে, লাইলির বিবাহের বাজার করতে। আইসা দেখি..'
'লাইলি কেডা?' কুসুম অন্যদিকে তাকিয়ে কথা বলছে। মন্থর।
'আমার গুটলা বোনটা। মাজানরে, বাবাজানরে, সবাইরে, বেবাকরে। লাইলি জবাফুল ভালোবাসতো, সে তখন জবা হয়ে গিয়েছিল- তাকে জবা বানিয়ে দিয়েছে। তুই ক তো- অই দিঘীর মাটি ওদের রক্তে, সজীবতায় এখন উর্বর না?'
'হ গো চাচা।'
'তোর গুটলাটারে আমারে ধার দিবি। আমি দিঘীর পাড়ে জবার বিস্তার বুনে দিমু।'
নিষ্পাপ জলে ফুটে আছে দুই ফালি শালুক। সাঁতার কেটে তাদের পাশে গিয়ে থামে বুড়োটা। গামছা আর লুঙ্গি পরে নেমেছিল, মাঝজলে এসে লুঙ্গিটা খসে গেছে। হয়ত ভেসে উঠবে। তখন নেয়া যাবে।
হৃদপিণ্ডটা হাতিয়া'র উত্তাল। এখন নেই। এখন গড়ের মাঠ, দূরে তাকালে আপনিতেই চোখ বুঝে আসে।
ঝুপ করে গহীনে নেমে যায়। কয়েকটা মাছ সাহাবী হয়। কুশল জানতে চায় ফুলকি মেলে, জলের আলোড়নে সংকেত দিয়ে। হায়, মানুষ কবে মাছের মর্মকথা বুঝবে!
অজস্র মাছ।
নেমে যায়, নেমে যায়। বুড়োটা। শালুকের লতানো ধরে। না, শ্বাস নেই একটু-ও আর। মাথার ভিতরটা একদম খালি লাগছে। কখনো কী বেঁচে ছিল? না, হয়তো এইসব মাছেরা যেমন জলে শরীর মেলে আছে তেমনি নিজে-ও কারো ভিতরে বিথার হয়ে আছে! না, বাতাস আছে; চিন্তা করতে বাতাস লাগে। ওই তো মাটি দেখা যায়। ওখানে হয়ত মিশে আছে, প্রিয় আঙুলগুলোর দাগ। ওগো জল দাস করে নাও, মাছ করে নাও। এখানে জলের ক্ষেতে দোয়েল হয়ে থাকি, মৃত দোয়েলের ঠোঁট ভীষণ ছটা।
আলো নিভে আসছে, অন্ধকার তুমি সহোদর; আলো তুমি সতভাই। দৃষ্টি হারানোর আগে হাতে মাটির কোমল জেনে নেয় বুড়োটা।
ছেলেগুলো ডাঙগুলি খেলছিল কিংবা ডাঙগুলি ওদের ভিতর খেলছিল। ছেলেরা মাঠ ছেড়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ালে পথরোধ হয়ে যায়, তাকেই মাঠে নামতে হবে।
'চাচাজান শরীর ভালা নি?'
'হুম। তোমরা কি কিছু কইবা?'
'না চাচাজান। আপনার কুশল জানতে মঞ্চাইল।'
'আমার একটু তাড়া আছে। পথ ছাইড়া দাও।'
'কই যান? মাডি খুঁজতে? খেক খেক।'
'হ, আশপাশের অঞ্চলে-ও খুঁজন লাগবো। অনেক মাটি দরকার, অনেক মাটি।'
'হা হা। মাটি মাখলে দেশপ্রেমিক হইবো না চাচাজান। এর চেয়ে ভালো সুরমা লাগাইয়া আল্লার দরবারে ক্ষ্যেমা চান। সব তাঁর ইচ্ছা।'
'বাজান গো, আপনাগো লগে তর্কের সময় নাই। আলো থাকতে থাকতে কলসিপাড়ায় পৌঁছতে হবে।'
'আঁ। কত ওস্তাদ লোক, সময় টনকওয়ালা আইছে। লুঙ্গি খুঁইলা রাইখ্যা দিমু কইলাম। খেক খেক।'
পাখিরা আজ ঘরে বসে আছে। পাখিদের আজ গান নেই। বাজপাখি কখনো পাখি নয়, আকাশদস্যু।
ওরা মাটিতে ফেলে রাখে অজ্ঞান শরীরটা।
ঈ
আজ মঙ্গলবার। এখানে জড়ো হয়েছে অনেকে, রতনের বাড়ির দাওয়ায়। উঠোনের মাঝ বরাবর আঁতুরঘর করা হয়েছে। অস্থায়ী বাঁশের কাঠামো। মহিলারা দ্রুত লয়ে আসছে যাচ্ছে, কেউ জল হাতে, কেউ দরকারী কাপড় হাতে। রতন বিমর্ষ বসে আছে। সে নিশ্চিত এবার-ও মেয়ে হবে।
বেঞ্চিতে বসে আছে লোকগুলো। আজ কাজ নেই, কাজ ছুটি আজ। এখানে।
বুড়োটা পিঁড়িতে বসা। কোলের উপর গামছা রাখা, বাঁধা- ভিতরের...।
রতন উঠে গিয়ে দাইমা কাঁকন খালার সাথে কথা বলে। সময় হয়ে আসছে। কাজ চলছে, একটা ধাক্কা হলেই হবে।
মিনিট পনের পরে কান্নার আওয়াজ শোনা যায়। প্রথম ক্ষীণ সুরে, একটু নিরবতা, আবার কান্না, আবার নিরবতা। এরপর একটানা কিছুক্ষণ।
কাঁকন খালা পর্দা সরিয়ে বের হয়ে আসেন। তার মুখ সব বলে দেয়, তবু-ও দূরের ধানক্ষেতের দোয়েলটাকে শুনাতে তিনি জোরে বলে উঠেন, ' পোলা অইছে। পোলারে, রতনা..।'
রতন ডুঁকরে কেঁদে উঠে। নবজাতকের কান্নার স্বরে তার কান্না চাপা পড়ে আসে। কিংবা কেউ হয়তো রতনের কান্নাতে আগ্রহী নয়।
বুড়োটা উঠে দাঁড়ায় গামছা হতে। তার সময় হয়েছে।
বাম পাটা হাত ধরে আটকে রেখেছে কেউ। নজর দিয়ে দেখল রতনই ধরে। রতন যেতে দিবে না- সে শুনেছে নবজাতককে কিছু মাখাতে নেই- রোগে ধরে। জলিল মাস্টার বলেছে তাকে।
বুড়োটা ঝাঁকড়া মেরে হাত সরিয়ে নেয়। সে কুসুমকে কথা দিয়েছে। সে জবা ফুলকে কথা দিয়েছে। সে লাইলিকে কথা দিয়েছে। সে পা বাড়ায়।
এলোমেলো পা বাড়াতে গিয়ে বুড়োটা টের পায় না তার হাতের ভিতরে কতকগুলো মাটিফুল ফুটে আছে- মৌমৌ বকুলঘ্রাণে সরব আশপাশ।
লোকটি দাঁড়ির ফাঁকে রোদের লুকোচুরি নিয়ে সূর্যে এসে দাঁড়ায়। রোদে শরীর রাখে।
খালি গা থেকে উড়ে যায় কতকগুলো ঘামের চিল। একবার মেঘের শ্রীটা দেখে নিয়ে পা বাড়ায় সে- যেতে হবে ঝুপড়ি দোকানে; বেলা হয়ে আসছে- বারটার পরে কলিমমিস্ত্রি আর চা করে না। কলিমমিস্ত্রি চায়ের কারিগর, কাঠের না। অথচ তার দোকানের মন্দার কাঠের বেঞ্চিতে বসলে আরাম লাগে- গরমকালে স্রোতেলা জলে স্নান দিলে যেমন লাগে সেরকম। বসে বসে লোকটা মাটির কথা ভাবে।
লোকটি বুড়োদা। সকলে তাই ডাকে।
তার জাত পরিচয় ঠাহর নেই কারো। সবাই জন্ম থেকে এই দাঁড়ির বন আর টাকমাথা দেখে আসছে- গ্রীষ্মে কী শীতে।
'কলিম, কইদিন লাগব?'
'কইতাম হারি না। পোলাটা ভাইঙা পড়তাছে।'
'বিকালে কী আহে না এইখানে?'
'এখন মাঝে মাঝে। ব্যথা উঠে প্রায়।'
ওরা চুপ হয়ে যায়। বাতাসের অণুপোনাগুলো বিশ্রাম পায়।
আ
তিনটি পাড়া নিয়ে গ্রামটি, হাজার তিনেক মানুষের ছায়া; একটি দিঘী। লোকটি দিঘীপাড়ে এসে দাঁড়ায় বিনম্র। সে রতনকে খুঁজছে, কলিমমিস্ত্রী বলল যে রতনকে ইদানীং দিঘীপাড়ে আনাগোনা করতে দেখা যায়।
'কী করো গো বাজান?'
'ডাল খুঁজি।'
'কিসের ডাল?'
'গাছের ডাল। শক্ত কিছিমের, ফাঁস দিমু।'
'ক্যান?'
'ক্যান মানে! তিন তিনটা বান্ধাইছে, একটা-ও জুইতের না। একবার-ও অকাল অইব মনে হয়। আমার দরকার ত্যাদড় পোলা, সারাজীবন তো গতর খাটতে পারুম না।'
লোকটি নির্লিপ্ত চোখে তাকায়,'এবার-ও অকাল অইব মনে হইল ক্যামনে?'
'পেট উচা না। পোলা অইবার অইলে পেটে বান ডাকতো।'
লোকটির চোখ পিটপিট করে, সূর্য মেঘে মেঘে লুকোচুরি।
'তুই তাইলে ফাঁসই দে।'
ই
কুসুম তখন কল থেকে জল নিয়ে ফিরছিল। এসে দেখে মাটির দাওয়ায় পিঁড়ি পেতে বসে আছে বুড়োদা।
কুসুমের শাড়িতে জলের ঝুলন, টুপটাপ ঝরে পড়ে ধুলোর পিপাসা মেটায়। তার বদনে দুপুরের নির্জন সুডৌল খেলা করে, বাতাসের চুম্বন ঝাপটায় উড়ে যায় কাঙালি চুল।
'এই অসময়ে যে?'
বুড়োটা চুপ করে থাকে। উদল উঠোনে কয়েকটি রোদ-ছায়ার আঁকিবুকি।
'তুই কই গেছিলি?'
'পুষ্কুরিণীতে।'
'এতক্ষণ লাগল!'
'কি করমু কও চাচা। তালুকদারের পুকুরের জল টলটলা, ভাত রানলে ফেন ফালানো লাগে না, খাওন যায়। তবে যা ভিড়। তালুকদারের চামচাটা কই যে আসছে মৌসুমে সে জল বিক্রি দিব। তাইলে নাকি ভিড় কমবে।'
'তালুকদাররে সেইকালে দৌড়ানি দিছিলাম। শালা রাজাকার।'
'কইলা যে ক্যান এই অসময়ে?'
'ফেন আছে? সক্কালের?'
কুসুম অটুটদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
'আপনে অভুগ আছেন আগে কইবেন না! আর আমি কি বেদমা ম্যাইয়া আপনার মুখ দেইখ্যা বুঝার উচিত ছিল। দাঁড়ান, ঘরে কিছু আছে কিনা দেখি।'
কুসুম আঁচল টেনে ঘরে যায়। এখানে মাটি শুষ্ক।
সে ফিরে আসে কিছুটা চিঁড়ে নিয়ে আর একটা উড়িকলার অর্ধেক।
'এই আছে। ওনি অর্ধেক খাইয়া বের হইছেন। আপনে খেয়ে নেন।'
'আকবর আইসা আবার না খাইয়া থাকব না?'
'আরে না। আমি ভাত পাকামু নে। জল আনলাম না।'
বুড়োটা শীর্ণ আঙুলে হাত বাড়ায়। আঙুলের সাথে মাটি লেগে আছে। সে মাটিসহ চিঁড়ে আর আর্ধেকটা কলা খেতে থাকে।
'ওরে মা, তুই কিছু খাইছস?' বুড়োটা মাথায় ধার দেয়।
পাকঘরটা দাওয়াই থেকে হাত পাঁচেক দূরে। কুসুম ছেলী (গোবর মাখানো গাছের ডাল) আর শুকনো পাতা দিয়ে আগুন জ্বালায়। সূর্য ঈর্ষা করে প্রখর হয়, এখন মাঝদুপুর।
ধোঁয়ার বৃত্ত থেকে উঁকি দিয়ে কুসুম বলে উঠে- 'আমি খামু নে। আপনে খান। না খাইয়া তো শ্যাষ।'
কথা সত্য। গতকাল সকাল থেকে তিনি অভুক্ত। অবশ্য তার অভ্যেস আছে।
'মারে। এখন তো তোর বেশি বেশি খাওয়ার কথা। বাচ্চাটারে মজবুত হওয়া লাগবো। অইটারে আমি সূর্যসন্তান বানামু।'
' হা হা। চাচায় যে কি কও।' কুসুম লজ্জা পেয়ে ডালিমফললাল। একবার নিজের পেটে হাত রাখে।
বুড়োটা এলোমেলো পায়ে উঠে এসে পাকঘরে পিঁড়িতে বসে। কাছাকাছি। চুপিচুপি আলতো স্বরে বলে উঠে,'মারে, একটা বায়না চামু। দিবি।'
কুসুমের হৃদয় ছ্যাঁত করে উঠে। না জানি কী!
'কও।'
'মারে, তোর ছাওলের আতুর ঘরে যাইতে দিবি। সবাই ছোঁয়ার আগে...'
কুসুম চোখ তুলে তাকায়। শশ্মান দূরে আছে, অথচ গাঢ় নৈঃশব্দের উড়ে আসে।
'অইখানে তো পরপুরুষ গো যাওন নিষেধ। আপনে কি করবেন?'
'বাচ্চাটারে একটু মাটি মাখায় দিমু। দিঘীর মাঝখানের মাটি। আমি ডুবসাঁতার দিয়ে তুইল্লা আনুম।'
'মাডি? মাডি মাখায় কি করবেন। তেল দিতে হয় জন্মাইলে। মাসকুটি খালা সেকথাই তো কইল সেদিন।'
'জানি রে। ওইটা ভুল। ঐ দিঘীর মাটি সুষম। বাচ্চা খাঁটি হইবো।'
' কী সব বকতাছ।' কুসুম ফুটন্ত পানিতে চাল ঢেলে দেয়। কচুশাক কাটতে বসে।
'বেবাকরে মাইরা চাপা দিয়া দিছে। আমার সামনে। আমার...আমার...আমারে একটা বাঁশগাছের সাথে ব্যাইন্ধা পিটাইছে। কব্জিতে আর বল নাই, কেহ কাজ-ও দেয় না এখন।' বুড়োটা শ্বাস নেয়, পুরাতন কোন কুয়া থেকে মানুষ উঠে আসলে যেমন হাঁপি খায় তেমনি। 'আমি গেছিলাম গঞ্জে, লাইলির বিবাহের বাজার করতে। আইসা দেখি..'
'লাইলি কেডা?' কুসুম অন্যদিকে তাকিয়ে কথা বলছে। মন্থর।
'আমার গুটলা বোনটা। মাজানরে, বাবাজানরে, সবাইরে, বেবাকরে। লাইলি জবাফুল ভালোবাসতো, সে তখন জবা হয়ে গিয়েছিল- তাকে জবা বানিয়ে দিয়েছে। তুই ক তো- অই দিঘীর মাটি ওদের রক্তে, সজীবতায় এখন উর্বর না?'
'হ গো চাচা।'
'তোর গুটলাটারে আমারে ধার দিবি। আমি দিঘীর পাড়ে জবার বিস্তার বুনে দিমু।'
নিষ্পাপ জলে ফুটে আছে দুই ফালি শালুক। সাঁতার কেটে তাদের পাশে গিয়ে থামে বুড়োটা। গামছা আর লুঙ্গি পরে নেমেছিল, মাঝজলে এসে লুঙ্গিটা খসে গেছে। হয়ত ভেসে উঠবে। তখন নেয়া যাবে।
হৃদপিণ্ডটা হাতিয়া'র উত্তাল। এখন নেই। এখন গড়ের মাঠ, দূরে তাকালে আপনিতেই চোখ বুঝে আসে।
ঝুপ করে গহীনে নেমে যায়। কয়েকটা মাছ সাহাবী হয়। কুশল জানতে চায় ফুলকি মেলে, জলের আলোড়নে সংকেত দিয়ে। হায়, মানুষ কবে মাছের মর্মকথা বুঝবে!
অজস্র মাছ।
নেমে যায়, নেমে যায়। বুড়োটা। শালুকের লতানো ধরে। না, শ্বাস নেই একটু-ও আর। মাথার ভিতরটা একদম খালি লাগছে। কখনো কী বেঁচে ছিল? না, হয়তো এইসব মাছেরা যেমন জলে শরীর মেলে আছে তেমনি নিজে-ও কারো ভিতরে বিথার হয়ে আছে! না, বাতাস আছে; চিন্তা করতে বাতাস লাগে। ওই তো মাটি দেখা যায়। ওখানে হয়ত মিশে আছে, প্রিয় আঙুলগুলোর দাগ। ওগো জল দাস করে নাও, মাছ করে নাও। এখানে জলের ক্ষেতে দোয়েল হয়ে থাকি, মৃত দোয়েলের ঠোঁট ভীষণ ছটা।
আলো নিভে আসছে, অন্ধকার তুমি সহোদর; আলো তুমি সতভাই। দৃষ্টি হারানোর আগে হাতে মাটির কোমল জেনে নেয় বুড়োটা।
ছেলেগুলো ডাঙগুলি খেলছিল কিংবা ডাঙগুলি ওদের ভিতর খেলছিল। ছেলেরা মাঠ ছেড়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ালে পথরোধ হয়ে যায়, তাকেই মাঠে নামতে হবে।
'চাচাজান শরীর ভালা নি?'
'হুম। তোমরা কি কিছু কইবা?'
'না চাচাজান। আপনার কুশল জানতে মঞ্চাইল।'
'আমার একটু তাড়া আছে। পথ ছাইড়া দাও।'
'কই যান? মাডি খুঁজতে? খেক খেক।'
'হ, আশপাশের অঞ্চলে-ও খুঁজন লাগবো। অনেক মাটি দরকার, অনেক মাটি।'
'হা হা। মাটি মাখলে দেশপ্রেমিক হইবো না চাচাজান। এর চেয়ে ভালো সুরমা লাগাইয়া আল্লার দরবারে ক্ষ্যেমা চান। সব তাঁর ইচ্ছা।'
'বাজান গো, আপনাগো লগে তর্কের সময় নাই। আলো থাকতে থাকতে কলসিপাড়ায় পৌঁছতে হবে।'
'আঁ। কত ওস্তাদ লোক, সময় টনকওয়ালা আইছে। লুঙ্গি খুঁইলা রাইখ্যা দিমু কইলাম। খেক খেক।'
পাখিরা আজ ঘরে বসে আছে। পাখিদের আজ গান নেই। বাজপাখি কখনো পাখি নয়, আকাশদস্যু।
ওরা মাটিতে ফেলে রাখে অজ্ঞান শরীরটা।
ঈ
আজ মঙ্গলবার। এখানে জড়ো হয়েছে অনেকে, রতনের বাড়ির দাওয়ায়। উঠোনের মাঝ বরাবর আঁতুরঘর করা হয়েছে। অস্থায়ী বাঁশের কাঠামো। মহিলারা দ্রুত লয়ে আসছে যাচ্ছে, কেউ জল হাতে, কেউ দরকারী কাপড় হাতে। রতন বিমর্ষ বসে আছে। সে নিশ্চিত এবার-ও মেয়ে হবে।
বেঞ্চিতে বসে আছে লোকগুলো। আজ কাজ নেই, কাজ ছুটি আজ। এখানে।
বুড়োটা পিঁড়িতে বসা। কোলের উপর গামছা রাখা, বাঁধা- ভিতরের...।
রতন উঠে গিয়ে দাইমা কাঁকন খালার সাথে কথা বলে। সময় হয়ে আসছে। কাজ চলছে, একটা ধাক্কা হলেই হবে।
মিনিট পনের পরে কান্নার আওয়াজ শোনা যায়। প্রথম ক্ষীণ সুরে, একটু নিরবতা, আবার কান্না, আবার নিরবতা। এরপর একটানা কিছুক্ষণ।
কাঁকন খালা পর্দা সরিয়ে বের হয়ে আসেন। তার মুখ সব বলে দেয়, তবু-ও দূরের ধানক্ষেতের দোয়েলটাকে শুনাতে তিনি জোরে বলে উঠেন, ' পোলা অইছে। পোলারে, রতনা..।'
রতন ডুঁকরে কেঁদে উঠে। নবজাতকের কান্নার স্বরে তার কান্না চাপা পড়ে আসে। কিংবা কেউ হয়তো রতনের কান্নাতে আগ্রহী নয়।
বুড়োটা উঠে দাঁড়ায় গামছা হতে। তার সময় হয়েছে।
বাম পাটা হাত ধরে আটকে রেখেছে কেউ। নজর দিয়ে দেখল রতনই ধরে। রতন যেতে দিবে না- সে শুনেছে নবজাতককে কিছু মাখাতে নেই- রোগে ধরে। জলিল মাস্টার বলেছে তাকে।
বুড়োটা ঝাঁকড়া মেরে হাত সরিয়ে নেয়। সে কুসুমকে কথা দিয়েছে। সে জবা ফুলকে কথা দিয়েছে। সে লাইলিকে কথা দিয়েছে। সে পা বাড়ায়।
এলোমেলো পা বাড়াতে গিয়ে বুড়োটা টের পায় না তার হাতের ভিতরে কতকগুলো মাটিফুল ফুটে আছে- মৌমৌ বকুলঘ্রাণে সরব আশপাশ।
No comments:
Post a Comment