১
সপ্তাহ খানেক আগে নিউরোসায়েন্সের একটি কনফারেন্সে লন্ডন (ইউকে) যাওয়া হলো। দেশে যাওয়া কিংবা আসার পথে লন্ডনে ট্রানজিট হলেও, কখনো বেড়ানো কিংবা অন্যান্য কাজে যাওয়া হয়নি।
যদিও কনফারেন্সটি ছিলো সেমিস্টারের মাঝখানে তাই বেশিদিন থাকা সম্ভব ছিলো না, কিন্তু গেলাম। গত শতাব্দীর চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে মনোবিজ্ঞানে বিহেইভিয়ারিজম দৃষ্টিভঙ্গি রাশিয়া ও পরে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে জনপ্রিয় হলেও যুক্তরাজ্যে ষাট থেকে আশির দশকে মনোবিজ্ঞানের, বিশেষ করে বিহেইভিয়ারিজমের প্রচুর আলোড়িত গবেষণা হয়।
সেগুলোর উপর এখন স্নায়ুবিজ্ঞানীরা গবেষণা করে জানতে চেষ্টা করেন- কীভাবে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীরা শেখে, কীভাবে শেখা সংক্রান্ত স্মৃতি গঠিত ও বিলুপ্ত হয় ইত্যাদি। তাই সেইসব গুরু বিজ্ঞানীদের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ পেয়ে আমিও প্রবল উচ্ছ্বাস নিয়ে লন্ডনে গেলাম কনফারেন্সের আমন্ত্রণ পেয়ে।
হিথ্রো বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে আমার বেশ নিশ্ছিদ্র মনে হলেও চা পাতার ছাঁকুনি দিয়ে বালি ছাঁকার মতো-ও মনে হলো, অনেক ক্ষেত্রে বাগাড়ম্বর ও অহেতুক নাজেহালের শিকার হন নানা দেশের লোকেরা, বিশেষ করে যাদের দেশের পাসপোর্টের জোর কম।
যেমন, আমার সামনের যাত্রী ছিলেন এক আফ্রিকান, তাকে নিরাপত্তাকর্মী একের পর এক প্রশ্ন করে বিব্রত ও বিরক্ত করেই গেলেন, অথচ তার সামনের জন ছিলো এক ফরাসি এবং সে অল্প কিছু প্রশ্নের পরেই চলে গেলো।
সেই ভারতীয় নিরাপত্তাকর্মী আমার কানাডিয়ান পাসপোর্ট দেখে তাই কিছুটা হতাশই হলো বলে মনে হলো। এইসব হেজেমনি শেষ করে যখন বিমানবন্দর থেকে বের হলাম ততক্ষণে ঘণ্টাখানেক হয়ে গেছে।
সারাদিনের জার্নির শেষ করে হোটেলে এসে ঘুমাবো ভাবলাম। কিন্তু ঘুম যে আসে না, যেনো সে ইউনিকর্ন!
২
নতুন কোথাও গেলে অনেকের প্রথম রাতে ঘুম আসে না। অবশ্য এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে। প্রথমত, আমাদের ঘুমের ব্যাপারটি 'সার্কেডিয়ান রিদম'সমূহ ('বডি ক্লক'ও বলে) নিয়ন্ত্রণ করে, নতুন জায়গার সময় সাথে আপনার বাসস্থানের সময়ে (সূর্যের আলো) উনিশ-বিশ হলে 'সার্কেডিয়ান রিদম'গুলোতে গোলযোগ দেখা দেয়, ফলে ঘুম ব্যাহত হয়।
ছবি: রয়টার্স ছবি: রয়টার্স দ্বিতীয় আরেকটি কারণ বিবর্তনীয়; ঘুমের সময় আমাদের মস্তিষ্কের অনেক অংশের অ্যাক্টিভিটি কমে আসে, কিন্তু নতুন জায়গায় গেলে ঘুমের সময়ে এই অ্যাক্টিভিটি কিন্তু তেমন কমে না, অনেক অংশ "আধ-জাগ্রত" থাকে, একটি আত্মরক্ষামূলক কৌশল, বিবর্তনের ইতিহাসে মস্তিষ্কে এই হয়েছে।
নতুন জায়গায় গেলেও আমার ঘুমের তেমন ব্যাঘাত ঘটে না। বিছানায় গেলে পাঁচ থেকে দশ মিনিটে আমি ঘুমিয়ে পড়ি। কিন্তু তখন লন্ডনের সেই ঘন গভীর রাত্তিরে নিজেকে ঘুমহীন কোনো নিশাচর লাগছিলো।
দশতলা হোটেলের জানালা দিয়ে নিচে বাইরে তাকালে মনে হয় লন্ডনের রাস্তাগুলো জীবনের কিছু গহীন ভুলের মতন জেগে থাকে।
পরেরদিন কনফারেন্সের দীর্ঘ একটি দিন, অনেক ব্যস্ততা, সে হিসেবেও ঘুমের দরকার। ইচ্ছে করছিলো বাইরে রাস্তায় গিয়ে হাঁটতে। একটি শহর চেনার প্রধান উপায় হচ্ছে হেঁটে হেঁটে শহর দেখা, মানুষ দেখা, প্রতিটি শহরের নিজস্ব কিছু ধাঁধাঁ থাকে, সেগুলো পর্যবেক্ষণ ও সমাধান করা। দিন হলে নিচে হাঁটতে যেতাম।
দূরে একটি পুলিশের গাড়ি; এক যুগল হাত ধরে রাস্তা পার হচ্ছে; একটি মোটরগাড়ি এসে থামে লাল সংকেতবাতিতে; পাব-রেস্তোরাঁ থেকে থেকে থেকে কিছু মানুষ বের হচ্ছে; তাদের হাসিতে ঝরে পড়ে লাস্য, সম্ভাবনা, বিকল্প উপায়ের বুনন; আমি এইসব দৃশ্য দেখি। আমার ঘুম আসতে আসতে ছুটে যায়; হঠাৎ পরিচিত কারো নাম মনে করতে গিয়ে মনে করতে না-পারার মতন।
নিচের লন্ডন শহরকে আমার 'কোমল গান্ধার' মনে হয়; সুর অথবা সংশয়ের ক্যারাভান ভেসে আসে। আমি ঘুমাতে যাই।
৩
লন্ডনের কিছু কিছু জিনিস দেখে আমি অভিভূত হলাম। ভীষণ ভালো লাগলো তাদের পাবলিক ট্রান্সপোর্টেশন ব্যবস্থা, ঘড়ির কাঁটা ধরে চলে আসে বাস, মেট্রো বা সাবওয়ে (লন্ডনের লোকজন বলে টিউব), মন্ট্রিয়লের মতন 'লাস্ট বেঞ্চে'র ছাত্রের মতো নয়। আর চারিদিকে উপমহাদেশের লোকজনের ছড়াছড়ি।
ছবি: রয়টার্স ছবি: রয়টার্স মন্ট্রিয়লে নাকি প্রায় পনের হাজার বাঙালি থাকে, এর মাঝে আমার সাথে হয়তো ঘনিষ্ঠ পরিচয় আছে বড় জোর পনের জনের।
তাই লন্ডনে এতো বাঙালি ও উপমহাদেশের লোকজন দেখে আমার কিঞ্চিত সন্দেহ হতে লাগলো লন্ডন কী উপমহাদেশের লোকজন দখল করে নিলো নাকি! যেমন ব্রিটিশরা উপমহাদেশে দখলদারিত্ব করেছিলো দুইশ বছরের অধিক। এক পরিসংখ্যানে দেখলাম লন্ডনে প্রায় ৩ লাখ ফরাসি বাস করে, মূলত লন্ডন হচ্ছে 'ষষ্ঠ বৃহত্তর ফরাসি শহর'।
সহজে বোঝা যায় লন্ডন আর ইংরেজদের হাতে নেই। আগামী বিশ্ব ক্রমেই হবে অভিবাসীদের বিশ্ব, আমি মুগ্ধতা নিয়ে তাই দেখি।
দ্বিতীয় আরেকটি 'কালচারাল শক' মনে হলো লন্ডনের ইংরেজি! কানাডার ইংরেজির বানানরীতিতে ইউকে ইংরেজিকে অনুসরণ করা হয়, তবে উচ্চারণভঙ্গি অনেকাংশে আমেরিকান ইংরেজি ঘেঁষা; এছাড়া আছে ফরাসি শব্দের ব্যবহার, বিশেষ করে ক্যুবেকে।
প্রতিটি ভাষায় নিজস্ব অভিব্যক্তি (এক্সপ্রেশন) থাকে অঞ্চল অনুসারে, এক্ষেত্রেও কানাডার ইংরেজিতে আমেরিকান সংস্কৃতি ও ইংরেজির প্রভাব আছে। তাই ব্রিটিশ ইংরেজির এক্সপ্রেশন আমাকে বিভ্রান্ত করে তুললো।
তারা লিফট ব্যবহার করে, এলিভেটর না; সাবওয়ে ব্যবহার করে না, টিউবে চড়ে; লাইনে দাঁড়ায় না, কিউ (কিউইং) করে; 'ভ্যাকুয়াম' দেয় না, 'হুভার' করে; 'ফ্যান্সি' মানে যে চাওয়া বোঝায় সেটিও আরেক ব্যাপার; এইরকম নানা ব্যতিক্রম।
এছাড়া আছে তাদের উচ্চারণভঙ্গির ভিন্নতা। বিশেষ করে স্কটিশ ও আয়ারল্যান্ডের উচ্চারণভঙ্গিতে (আমাদের কনফারেন্স গাইড ছিলো এক স্কটিশ স্নায়ুবিজ্ঞানী) অভ্যস্ত হতে গিয়ে আমার লন্ডনের ৮-১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসেও চিকন ঘাম বের হওয়ার উপক্রম হল।
বুঝতে পারলাম আমেরিকান টিভি সিরিজ কিংবা মুভির পাশাপাশি আরও বেশি করে ব্রিটিশ টিভি সিরিজ দেখতে হবে! ভাগ্য ভালো আমার সাথে আমার সুপারভাইজার ছিলেন, তিনি তার পিএইচডির এক সেমিস্টার ও পোস্ট-ডক করেছিলেন কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ে, তাই ইউকের হালচাল ও অভিব্যক্তির সাথে বেজায় পরিচিত।
আমার সুপারভাইজার আমার ভ্রমণনির্দেশক হিসেবে সহায়তা করলো।
৪
কোথাও বেড়াতে গেলে সেই জায়গায় সম্পর্কে গুগল সার্চ করে কিছুটা ধারণা নিয়ে নেই। রিয়েল এস্টেটে আগ্রহ থাকায় আমি জেনে নিলাম যে লন্ডনে বাড়ির ভাড়া অনেক, বাড়ি কেনা অনেকের সাধ্যের বাইরে, ছোটখাট বাড়ি যেগুলোর দাম মন্ট্রিয়লে বড়জোর কয়েক লাখ ডলার হবে সেগুলো মিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায় লন্ডনে।
ছবি: রয়টার্স ছবি: রয়টার্স ব্রেক্সিটের পরে লন্ডনের অর্থনীতি যতোটা ভয়াবহ হবে বলে ধারণা করা হয়েছিলো ততোটা হয়নি, বরং কিছুটা উর্ধ্বমুখী, তারপরেও পরিসংখ্যান বলছে, যে লন্ডনের এক তৃতীয়াংশ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে অথবা কাছাকাছি বাস করে (ইউরোপের মানের তুলনায়)।
লন্ডনের বাতাস প্রচুর দূষিত, মন্ট্রিয়লের মতো নির্মল নয়। এজন্য দেখলাম সিটি অনেক কাজ করছে, লোকজনকে দূষণ কমানোর জন্য বেশি পাবলিক ট্রান্সপোর্টেশন ব্যবহার করতে বলছে, সচেতন হতে বলছে, নিজেদের আচরণ পরিবর্তনের জন্য বলছে।
বায়ু দূষণ শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অনেক খারাপ, যেমন অ্যাজমা কিংবা সাইনাসের অসুখ-বিসুখ লেগে থাকা, কিংবা শ্বাসকষ্টজনিত রোগ ছাড়াও বায়ু দূষণের সাথে অনেক নিউরোডিজেনারিটিভ রোগের (যেমন, আলঝেইমারের রোগ) সম্পর্ক পাওয়া গেছে।
লন্ডনের আরেকটি ব্যাপার বেশ ভালো লাগলো, স্থাপত্যশিল্প, পুরাতন দালান ও তাদের গঠন ও কারুকাজ। ইউরোপের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী শহর নিজের গরীমা নিয়ে সিংহাসনবিহীন রাণীর মতন বসে আছে বলে মনে হলো। নিউ ইয়র্কে গেলে যেমন একেকটি দালান কতো তলার সেটি গুণতে যেমন উপর পানে তাকাতে হয় তেমনি লন্ডনের দালান ও স্থাপত্যশিল্পের মুগ্ধ সৌন্দর্য দেখতে আমি উপরে তাকিয়ে তাকিয়ে হাঁটি আর কারো কারো সাথে ধাক্কা খেয়ে যাই রাস্তায়।
৫
আমি ছিলাম মাত্র দুই দিন তিন রাত, ছবি তোলা হয়নি, কনফারেন্সের ব্যস্ততায় শহর দেখার সুযোগ হয়নি তেমন; এছাড়া ভুলে ক্যামেরা রেখে গিয়েছিলাম মন্ট্রিয়ল বিমানবন্দরে গাড়ির ভেতরে।
আমার লন্ডন দেখা ভীষণ রকমের 'অসম্পূর্ণ' এবং 'বায়াসড'; তারপরও জেনে গেলাম যে এই শহরে আবার আসতে হবে, হেঁটে হেঁটে শহর দেখা দেখতে হবে, মানুষ দেখতে হবে, শহরের নিজস্ব ধাঁধাগুলো পর্যবেক্ষণ ও সমাধান করতে আমি আবার আসবো।
৬
লেখাটি শেষ করবো একটি ভালো খবর দিয়ে।
মন্ট্রিয়ালকে অনথিভুক্ত অভিবাসী উদ্বাস্তুর জন্য 'আশ্রয়স্থল শহর' বা 'স্যাংচুয়ারি সিটি' হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, অর্থাৎ অনথিভুক্ত উদ্বাস্তুরা সিটির সেবাসমূহ নিতে পারবেন অন্যান্য নথিভুক্ত নাগরিকদের মতই।
তাদেরকে সেবা নেওয়ার সময়ে বা পরে পুলিশ বা অভিবাসী সংস্থার কাছে রিপোর্ট করা কিংবা "ধরিয়ে দেয়া" হবে না। আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী-সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞার পরে (ট্রাম্প সরকারের কিছু মুসলিম দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ব্যাপারে) অনেক অভিবাসী ও উদ্বাস্তু সেখান থেকে ক্যুবেকের সীমানা পার হয়ে কানাডায় প্রবেশ করছে। এই ঘোষণা সেইসব অনথিভুক্ত অভিবাসী রিফুজিদের জন্য কিছুটা স্বস্তি নিশ্চিত করবে।
আমি জানি মন্ট্রিয়লই আমার শহর, 'এই শহর জানে আমার অনেক প্রথম কিছু'।
সপ্তাহ খানেক আগে নিউরোসায়েন্সের একটি কনফারেন্সে লন্ডন (ইউকে) যাওয়া হলো। দেশে যাওয়া কিংবা আসার পথে লন্ডনে ট্রানজিট হলেও, কখনো বেড়ানো কিংবা অন্যান্য কাজে যাওয়া হয়নি।
যদিও কনফারেন্সটি ছিলো সেমিস্টারের মাঝখানে তাই বেশিদিন থাকা সম্ভব ছিলো না, কিন্তু গেলাম। গত শতাব্দীর চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে মনোবিজ্ঞানে বিহেইভিয়ারিজম দৃষ্টিভঙ্গি রাশিয়া ও পরে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে জনপ্রিয় হলেও যুক্তরাজ্যে ষাট থেকে আশির দশকে মনোবিজ্ঞানের, বিশেষ করে বিহেইভিয়ারিজমের প্রচুর আলোড়িত গবেষণা হয়।
সেগুলোর উপর এখন স্নায়ুবিজ্ঞানীরা গবেষণা করে জানতে চেষ্টা করেন- কীভাবে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীরা শেখে, কীভাবে শেখা সংক্রান্ত স্মৃতি গঠিত ও বিলুপ্ত হয় ইত্যাদি। তাই সেইসব গুরু বিজ্ঞানীদের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ পেয়ে আমিও প্রবল উচ্ছ্বাস নিয়ে লন্ডনে গেলাম কনফারেন্সের আমন্ত্রণ পেয়ে।
হিথ্রো বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে আমার বেশ নিশ্ছিদ্র মনে হলেও চা পাতার ছাঁকুনি দিয়ে বালি ছাঁকার মতো-ও মনে হলো, অনেক ক্ষেত্রে বাগাড়ম্বর ও অহেতুক নাজেহালের শিকার হন নানা দেশের লোকেরা, বিশেষ করে যাদের দেশের পাসপোর্টের জোর কম।
যেমন, আমার সামনের যাত্রী ছিলেন এক আফ্রিকান, তাকে নিরাপত্তাকর্মী একের পর এক প্রশ্ন করে বিব্রত ও বিরক্ত করেই গেলেন, অথচ তার সামনের জন ছিলো এক ফরাসি এবং সে অল্প কিছু প্রশ্নের পরেই চলে গেলো।
সেই ভারতীয় নিরাপত্তাকর্মী আমার কানাডিয়ান পাসপোর্ট দেখে তাই কিছুটা হতাশই হলো বলে মনে হলো। এইসব হেজেমনি শেষ করে যখন বিমানবন্দর থেকে বের হলাম ততক্ষণে ঘণ্টাখানেক হয়ে গেছে।
সারাদিনের জার্নির শেষ করে হোটেলে এসে ঘুমাবো ভাবলাম। কিন্তু ঘুম যে আসে না, যেনো সে ইউনিকর্ন!
২
নতুন কোথাও গেলে অনেকের প্রথম রাতে ঘুম আসে না। অবশ্য এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে। প্রথমত, আমাদের ঘুমের ব্যাপারটি 'সার্কেডিয়ান রিদম'সমূহ ('বডি ক্লক'ও বলে) নিয়ন্ত্রণ করে, নতুন জায়গার সময় সাথে আপনার বাসস্থানের সময়ে (সূর্যের আলো) উনিশ-বিশ হলে 'সার্কেডিয়ান রিদম'গুলোতে গোলযোগ দেখা দেয়, ফলে ঘুম ব্যাহত হয়।
ছবি: রয়টার্স ছবি: রয়টার্স দ্বিতীয় আরেকটি কারণ বিবর্তনীয়; ঘুমের সময় আমাদের মস্তিষ্কের অনেক অংশের অ্যাক্টিভিটি কমে আসে, কিন্তু নতুন জায়গায় গেলে ঘুমের সময়ে এই অ্যাক্টিভিটি কিন্তু তেমন কমে না, অনেক অংশ "আধ-জাগ্রত" থাকে, একটি আত্মরক্ষামূলক কৌশল, বিবর্তনের ইতিহাসে মস্তিষ্কে এই হয়েছে।
নতুন জায়গায় গেলেও আমার ঘুমের তেমন ব্যাঘাত ঘটে না। বিছানায় গেলে পাঁচ থেকে দশ মিনিটে আমি ঘুমিয়ে পড়ি। কিন্তু তখন লন্ডনের সেই ঘন গভীর রাত্তিরে নিজেকে ঘুমহীন কোনো নিশাচর লাগছিলো।
দশতলা হোটেলের জানালা দিয়ে নিচে বাইরে তাকালে মনে হয় লন্ডনের রাস্তাগুলো জীবনের কিছু গহীন ভুলের মতন জেগে থাকে।
পরেরদিন কনফারেন্সের দীর্ঘ একটি দিন, অনেক ব্যস্ততা, সে হিসেবেও ঘুমের দরকার। ইচ্ছে করছিলো বাইরে রাস্তায় গিয়ে হাঁটতে। একটি শহর চেনার প্রধান উপায় হচ্ছে হেঁটে হেঁটে শহর দেখা, মানুষ দেখা, প্রতিটি শহরের নিজস্ব কিছু ধাঁধাঁ থাকে, সেগুলো পর্যবেক্ষণ ও সমাধান করা। দিন হলে নিচে হাঁটতে যেতাম।
দূরে একটি পুলিশের গাড়ি; এক যুগল হাত ধরে রাস্তা পার হচ্ছে; একটি মোটরগাড়ি এসে থামে লাল সংকেতবাতিতে; পাব-রেস্তোরাঁ থেকে থেকে থেকে কিছু মানুষ বের হচ্ছে; তাদের হাসিতে ঝরে পড়ে লাস্য, সম্ভাবনা, বিকল্প উপায়ের বুনন; আমি এইসব দৃশ্য দেখি। আমার ঘুম আসতে আসতে ছুটে যায়; হঠাৎ পরিচিত কারো নাম মনে করতে গিয়ে মনে করতে না-পারার মতন।
নিচের লন্ডন শহরকে আমার 'কোমল গান্ধার' মনে হয়; সুর অথবা সংশয়ের ক্যারাভান ভেসে আসে। আমি ঘুমাতে যাই।
৩
লন্ডনের কিছু কিছু জিনিস দেখে আমি অভিভূত হলাম। ভীষণ ভালো লাগলো তাদের পাবলিক ট্রান্সপোর্টেশন ব্যবস্থা, ঘড়ির কাঁটা ধরে চলে আসে বাস, মেট্রো বা সাবওয়ে (লন্ডনের লোকজন বলে টিউব), মন্ট্রিয়লের মতন 'লাস্ট বেঞ্চে'র ছাত্রের মতো নয়। আর চারিদিকে উপমহাদেশের লোকজনের ছড়াছড়ি।
ছবি: রয়টার্স ছবি: রয়টার্স মন্ট্রিয়লে নাকি প্রায় পনের হাজার বাঙালি থাকে, এর মাঝে আমার সাথে হয়তো ঘনিষ্ঠ পরিচয় আছে বড় জোর পনের জনের।
তাই লন্ডনে এতো বাঙালি ও উপমহাদেশের লোকজন দেখে আমার কিঞ্চিত সন্দেহ হতে লাগলো লন্ডন কী উপমহাদেশের লোকজন দখল করে নিলো নাকি! যেমন ব্রিটিশরা উপমহাদেশে দখলদারিত্ব করেছিলো দুইশ বছরের অধিক। এক পরিসংখ্যানে দেখলাম লন্ডনে প্রায় ৩ লাখ ফরাসি বাস করে, মূলত লন্ডন হচ্ছে 'ষষ্ঠ বৃহত্তর ফরাসি শহর'।
সহজে বোঝা যায় লন্ডন আর ইংরেজদের হাতে নেই। আগামী বিশ্ব ক্রমেই হবে অভিবাসীদের বিশ্ব, আমি মুগ্ধতা নিয়ে তাই দেখি।
দ্বিতীয় আরেকটি 'কালচারাল শক' মনে হলো লন্ডনের ইংরেজি! কানাডার ইংরেজির বানানরীতিতে ইউকে ইংরেজিকে অনুসরণ করা হয়, তবে উচ্চারণভঙ্গি অনেকাংশে আমেরিকান ইংরেজি ঘেঁষা; এছাড়া আছে ফরাসি শব্দের ব্যবহার, বিশেষ করে ক্যুবেকে।
প্রতিটি ভাষায় নিজস্ব অভিব্যক্তি (এক্সপ্রেশন) থাকে অঞ্চল অনুসারে, এক্ষেত্রেও কানাডার ইংরেজিতে আমেরিকান সংস্কৃতি ও ইংরেজির প্রভাব আছে। তাই ব্রিটিশ ইংরেজির এক্সপ্রেশন আমাকে বিভ্রান্ত করে তুললো।
তারা লিফট ব্যবহার করে, এলিভেটর না; সাবওয়ে ব্যবহার করে না, টিউবে চড়ে; লাইনে দাঁড়ায় না, কিউ (কিউইং) করে; 'ভ্যাকুয়াম' দেয় না, 'হুভার' করে; 'ফ্যান্সি' মানে যে চাওয়া বোঝায় সেটিও আরেক ব্যাপার; এইরকম নানা ব্যতিক্রম।
এছাড়া আছে তাদের উচ্চারণভঙ্গির ভিন্নতা। বিশেষ করে স্কটিশ ও আয়ারল্যান্ডের উচ্চারণভঙ্গিতে (আমাদের কনফারেন্স গাইড ছিলো এক স্কটিশ স্নায়ুবিজ্ঞানী) অভ্যস্ত হতে গিয়ে আমার লন্ডনের ৮-১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসেও চিকন ঘাম বের হওয়ার উপক্রম হল।
বুঝতে পারলাম আমেরিকান টিভি সিরিজ কিংবা মুভির পাশাপাশি আরও বেশি করে ব্রিটিশ টিভি সিরিজ দেখতে হবে! ভাগ্য ভালো আমার সাথে আমার সুপারভাইজার ছিলেন, তিনি তার পিএইচডির এক সেমিস্টার ও পোস্ট-ডক করেছিলেন কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ে, তাই ইউকের হালচাল ও অভিব্যক্তির সাথে বেজায় পরিচিত।
আমার সুপারভাইজার আমার ভ্রমণনির্দেশক হিসেবে সহায়তা করলো।
৪
কোথাও বেড়াতে গেলে সেই জায়গায় সম্পর্কে গুগল সার্চ করে কিছুটা ধারণা নিয়ে নেই। রিয়েল এস্টেটে আগ্রহ থাকায় আমি জেনে নিলাম যে লন্ডনে বাড়ির ভাড়া অনেক, বাড়ি কেনা অনেকের সাধ্যের বাইরে, ছোটখাট বাড়ি যেগুলোর দাম মন্ট্রিয়লে বড়জোর কয়েক লাখ ডলার হবে সেগুলো মিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায় লন্ডনে।
ছবি: রয়টার্স ছবি: রয়টার্স ব্রেক্সিটের পরে লন্ডনের অর্থনীতি যতোটা ভয়াবহ হবে বলে ধারণা করা হয়েছিলো ততোটা হয়নি, বরং কিছুটা উর্ধ্বমুখী, তারপরেও পরিসংখ্যান বলছে, যে লন্ডনের এক তৃতীয়াংশ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে অথবা কাছাকাছি বাস করে (ইউরোপের মানের তুলনায়)।
লন্ডনের বাতাস প্রচুর দূষিত, মন্ট্রিয়লের মতো নির্মল নয়। এজন্য দেখলাম সিটি অনেক কাজ করছে, লোকজনকে দূষণ কমানোর জন্য বেশি পাবলিক ট্রান্সপোর্টেশন ব্যবহার করতে বলছে, সচেতন হতে বলছে, নিজেদের আচরণ পরিবর্তনের জন্য বলছে।
বায়ু দূষণ শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অনেক খারাপ, যেমন অ্যাজমা কিংবা সাইনাসের অসুখ-বিসুখ লেগে থাকা, কিংবা শ্বাসকষ্টজনিত রোগ ছাড়াও বায়ু দূষণের সাথে অনেক নিউরোডিজেনারিটিভ রোগের (যেমন, আলঝেইমারের রোগ) সম্পর্ক পাওয়া গেছে।
লন্ডনের আরেকটি ব্যাপার বেশ ভালো লাগলো, স্থাপত্যশিল্প, পুরাতন দালান ও তাদের গঠন ও কারুকাজ। ইউরোপের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী শহর নিজের গরীমা নিয়ে সিংহাসনবিহীন রাণীর মতন বসে আছে বলে মনে হলো। নিউ ইয়র্কে গেলে যেমন একেকটি দালান কতো তলার সেটি গুণতে যেমন উপর পানে তাকাতে হয় তেমনি লন্ডনের দালান ও স্থাপত্যশিল্পের মুগ্ধ সৌন্দর্য দেখতে আমি উপরে তাকিয়ে তাকিয়ে হাঁটি আর কারো কারো সাথে ধাক্কা খেয়ে যাই রাস্তায়।
৫
আমি ছিলাম মাত্র দুই দিন তিন রাত, ছবি তোলা হয়নি, কনফারেন্সের ব্যস্ততায় শহর দেখার সুযোগ হয়নি তেমন; এছাড়া ভুলে ক্যামেরা রেখে গিয়েছিলাম মন্ট্রিয়ল বিমানবন্দরে গাড়ির ভেতরে।
আমার লন্ডন দেখা ভীষণ রকমের 'অসম্পূর্ণ' এবং 'বায়াসড'; তারপরও জেনে গেলাম যে এই শহরে আবার আসতে হবে, হেঁটে হেঁটে শহর দেখা দেখতে হবে, মানুষ দেখতে হবে, শহরের নিজস্ব ধাঁধাগুলো পর্যবেক্ষণ ও সমাধান করতে আমি আবার আসবো।
৬
লেখাটি শেষ করবো একটি ভালো খবর দিয়ে।
মন্ট্রিয়ালকে অনথিভুক্ত অভিবাসী উদ্বাস্তুর জন্য 'আশ্রয়স্থল শহর' বা 'স্যাংচুয়ারি সিটি' হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, অর্থাৎ অনথিভুক্ত উদ্বাস্তুরা সিটির সেবাসমূহ নিতে পারবেন অন্যান্য নথিভুক্ত নাগরিকদের মতই।
তাদেরকে সেবা নেওয়ার সময়ে বা পরে পুলিশ বা অভিবাসী সংস্থার কাছে রিপোর্ট করা কিংবা "ধরিয়ে দেয়া" হবে না। আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী-সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞার পরে (ট্রাম্প সরকারের কিছু মুসলিম দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ব্যাপারে) অনেক অভিবাসী ও উদ্বাস্তু সেখান থেকে ক্যুবেকের সীমানা পার হয়ে কানাডায় প্রবেশ করছে। এই ঘোষণা সেইসব অনথিভুক্ত অভিবাসী রিফুজিদের জন্য কিছুটা স্বস্তি নিশ্চিত করবে।
আমি জানি মন্ট্রিয়লই আমার শহর, 'এই শহর জানে আমার অনেক প্রথম কিছু'।
No comments:
Post a Comment