প্রবাস জীবনে প্রথম কয়েক বছরের সংগ্রাম হচ্ছে একটি অচেনা দেশে কিংবা সংস্কৃতিতে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া। নিজেকে নিজে আবিষ্কারের সংগ্রাম ও পেরে ওঠার গল্প। সবাই যে পেরে ওঠে,তা নয়। তাই ২৬ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেও কোনো বৃদ্ধ চলে যান পার্কে কিংবা মন খুলে কথা বলতে চলে যান বাঙালি এলাকায়। হয়তো ঘুরে-ফিরে মানুষ নিজের অস্তিত্বকে খোঁজেন। মাটি, দেশ, সংস্কৃতি বা মূল্যবোধ ইত্যাদি ভারি শব্দগুলোর পাল্লায় নিজেকে মেপে দেখতে চান। সবার জন্য যে এই মানিয়ে নেওয়া সহজ তা নয়। যে দেশে বা সংস্কৃতিতে এসে পা দিলেন- অভিবাসীদের প্রতি তাদের মনোভাব ও আচরণ কেমন, তা অনেকভাবে প্রভাবিত করে। যেমন- আপনি হয়তো চাকরি খুঁজছেন এবং কোনও কোম্পানির প্রার্থীনির্বাচক হয়তো একজন বর্ণবাদী লোক। তাহলে আপনার চাকরি পাওয়া কঠিন হবে, খাপ খাইয়ে নিতে সমস্যা হবে।
বর্ণবাদ জটিল বিষয়। শুধু অন্য দেশের বা সংস্কৃতির লোকদের প্রতি নয়, অনেক দেশে নিজ দেশের অন্য লোকদের প্রতিও বর্ণবাদ চোখে পড়ে। যেমন যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদের শিকার হন আফ্রিকান-আমেরিকানরা। ক্ষেত্রবিশেষে এই বর্ণবাদ প্রাতিষ্ঠানিক (ইন্সটিটিউশনালাইজড রেইসিজম)। যুক্তরাষ্ট্রের কারাগারগুলোতে বিভিন্ন জনসংখ্যার (যেমন- ককেশান, মেক্সিকান ইত্যাদি) অনুপাতে আফ্রিকান-আমেরিকানদের সংখ্যা অনেক বেশি। এর অন্যতম কারণ বর্ণবাদের শিকার হওয়া ও নানাভাবে অবহেলিত আফ্রিকান-আমেরিকানরা সহজেউঠে দাঁড়াতে পারেন না। নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে দারিদ্র ও অবহেলার কুচক্রে পড়েন। বাংলাদেশেও পাহাড়ে বসবাসকারীদের প্রতি এবং সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের প্রতি অনেকের বর্ণবাদী মনোভাব রয়েছে।
প্রবাসে দীর্ঘদিন থেকেছেন কিন্তু বর্ণবাদের শিকার হননি- এমন লোক পাওয়া কঠিন।কানাডায় এগারো বছরের প্রবাস জীবনে আমি একবার বর্ণবাদের শিকার হয়েছিলাম। অন্যান্য দেশের তুলনায় কানাডায় বর্ণবাদ কম, তবেদুর্লভ নয়।
ফরাসি-কানাডিয়ান ও ইংরেজ-কানাডিয়ানদের মাঝে সূক্ষ্ম প্রতিযোগিতা ও বর্ণবাদ রয়েছে। বিশেষ করে কানাডার ফরাসি ভাষাভাষী অধ্যুষিতক্যুবেক প্রদেশে।কানাডায় প্রথমে ফরাসি উপনিবেশরা এসে ঘাঁটি ফেললেও পরে ইংরেজরা এসে দখলদারিত্ব করে। পৃথিবীর নানা দেশেঅনেক অঞ্চল তারা দখল করে নিয়েছে। এছাড়া ফরাসিরা ইউরোপে ইংরেজদের কাছে হেরে যাওয়ার ফলে চুক্তির বিনিময় হিসেবে কানাডার অনেক অঞ্চল ইংরেজদের হাতে ছেড়ে দেয়। কিন্তু স্থানীয় ফরাসিরা রাজায়-রাজায় যুদ্ধের এই ফলাফল মেনে নিতে পারেননি। ফলে এক ধরনের বিভক্তি থেকে গিয়েছে।
এছাড়া ফরাসিরাও নানা সময়ে ইংরেজদের বর্ণবাদের শিকার হয়েছিলেন কানাডায় তাদের নানা শাসনামলে। আধুনিককালেফরাসিরা মূলত ক্যুবেক প্রদেশে বসবাস করেন, আমি এখানেই থাকি। ক্যুবেকের ফরাসি-কানাডিয়ানরা মনে করেন, তারা কানাডিয়ানদের চেয়ে ভিন্ন জাতি, তাদের মাতৃভাষা ভিন্ন।
যদিও কানাডার আইন অনুসারে ফরাসি ও ইংরেজি-দুটোই সরকারি ভাষা। সংস্কৃতি ভিন্ন হলেও তারা চায় ক্যুবেক প্রদেশকানাডা থেকে বিভক্ত হয়ে নতুন রাষ্ট্র হোক। তবে এইভাবনার সাথে সবাই একমত নন। যেহেতু কানাডা (এবং ক্যুবেকও) একটি বহুজাতিক বহুসংস্কৃতির দেশ।
সম্প্রতি নানা অভিবাসের কলরবে ক্যুবেক প্রদেশের নানা শহরও আর ফরাসিপ্রধান নয়। যেমন, মন্ট্রিয়াল। তারপরও কানাডা থেকে বিভক্ত হওয়ার জন্যক্যুবেকে দুইবার রেফেরান্ডাম হয়েছে। ফরাসি কানাডিয়ানরা চায় ফরাসি হবে ক্যুবেকের একমাত্র সার্বজনীন ভাষা। যদিও ক্যুবেকআইনে ফরাসি একমাত্র সরকারি ভাষা। আমার বর্ণবাদের শিকার হওয়া এই ভাষাকেন্দ্রিক, আজ থেকে বছর তিনেক আগের কাহিনি।
রেভিনিউ ক্যুবেকে যেতে হয়েছিলো আয়করসংক্রান্ত একটি ব্যাপারে। আমি কাজ চালিয়ে নেওয়ার মতো ফরাসি ভাষা জানি। বলতে পারি, লিখতে পারি ভালো, বুঝতে পারি আরেকটু বেশি। তবে ইংরেজিই ব্যবহার করি বেশি এবং স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। যখন আমি ইংরেজি বলা শুরু করলাম, সেবাদপ্তরের মহিলা আমাকে বিরক্ত গলায় বললেন, ক্যুবেকের সরকারি ভাষা ফরাসি এবং ফরাসি না বললে তিনি আমার সঙ্গে কথা বলবেন না। পুরো সংলাপে তিনি ফরাসিতে কথা বলছেনআর আমি ইংরেজিতে উত্তর দিচ্ছি। অর্থাৎ আমরা পরস্পরের ভাষা বুঝতে পারছি কিন্তু ব্যবহার করতে চাচ্ছি না। সাধারণত কেউ আমাকে যদি বলেনতিনি ইংরেজি জানেন না এবং অনুরোধ করেন তবে আমি ফরাসিই বলি। কিন্তু সেই মহিলার কর্কশ আচরণে আমার জেদ চেপে গেল এবং বললাম যে কানাডার আইন অনুসারে আমি ইংরেজিতে সেবা পাওয়ার অধিকার রাখি। তিনি তখন যুক্তিতে না পেরে বললেন, তিনি নিরাপত্তাকর্মীদের ফোন করবেন আমি ফরাসি না বললে। পুরো হাস্যকর ব্যাপার। আমার বাবা সঙ্গে ছিলেন। তিনি বললেন, ঝামেলা করার দরকার কী! তুই তো ফরাসি পারিসই, আমাদের কাজ শেষ করে চলে গেলেই তো হয়। আমি তখন বললাম, তাই বলে অন্যায় মেনে নেব না। এটি চরম বর্ণবাদ। পরে আমাদের শোরগোল শুনে মহিলার উর্ধ্বতন কর্মকর্তা এসে ক্ষমা চাইলেন এবং আমাদের অন্য আরেকজনের মাধ্যমে ইংরেজিতেই সেবা প্রদান করলেন। এই বর্ণবাদের ঘটনায় আমার জীবন পাল্টে যায়নি, তিক্তভাব জন্মেছিল। কিন্তু সবাই আমার মতো অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন না। অনেকে মেডিকেল সংক্রান্ত ব্যাপারের মতো জীবন-মরণ প্রশ্নেবর্ণবাদের শিকার হন। বর্ণবাদের ধারণা তখনই জন্মে যখন আমরা এই ভুল ধারণা শিখি যে আমাদের সংস্কৃতি, ধারণা, মনোভাব, মূল্যবোধ অন্য সবার চেয়ে সেরা বা ভালোএবং ভাবি অন্যরা আমাদের দেশে কিংবা কার্যসীমানায় ‘উড়ে এসে জুড়ে বসছে’।
মানুষ বর্ণবাদ শেখে। আমি অনেক বাঙালি অভিভাবককে দেখেছি নিজের সন্তানদের সামনেচাইনিজ কিংবা কৃষ্ণাঙ্গ ইত্যাদি সংস্কৃতির লোকদের প্রতি স্টেরিওটাইপ কিংবা বর্ণবাদী উক্তি অথবা আচরণ করতে। এইসব আচরণ ও উক্তি সন্তানদের মনে প্রভাব সৃষ্টি করে। তারা বড়দের অনুকরণে সামাজিক-পারিবারিক পরিবেশ থেকে সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ শেখে। তাই বর্ণবাদ দূর করতে প্রয়োজন সচেতনতা ও সুশিক্ষা।
সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন প্রতিবাদ। হয়তো আপনি নিজে বর্ণবাদের শিকার হননি, কিন্তু একজনকে হতে দেখেছেন তবে প্রতিবাদ করুন। যখন অন্যায়ের প্রতিবাদ করা হয় না, তখন অপরাধীরা প্রশ্রয় পায়। হয়তো বর্ণবাদের প্রতিবাদ করতে গিয়ে আপনাকে আপনার স্বস্তির জায়গা থেকে একটু সরে আসতে হবে কিংবা সময় ব্যয় করতে হবে। কিন্তু বর্ণবাদ দূর করতে গেলে প্রয়োজন এর সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনা, প্রতিবাদ ও কর্মোদ্দ্যোগ।
প্রবাসে আরেক ধরনের বর্ণবাদ আমার চোখে পড়ে। তা মূলত বাঙালিদের আঞ্চলিক হেজেমনি। যেমনসিলেটের লোক অন্যান্য অঞ্চলের লোকদের সঙ্গেদূরত্ব রেখে চলেন। বরিশাল ও নোয়াখালীর লোকদের নিয়ে স্টেরিওটাইপ কথা চালু আছে, ঢাকার লোকদের উন্নাসিক মনোভাব ইত্যাদি।
অনেকে একে অঞ্চলপ্রীতি কিংবা স্বাভাবিক মেনে নিলেও গভীরভাবে বিশ্লেষণে এইসব আচরণ বর্ণবাদের আরেক রূপ। 'ইনগ্রুপসঅ্যান্ড আউটগ্রুপস' মনোভাব থেকেই বর্ণবাদসংক্রান্ত মানসিকতার জন্ম নেয়। বাঙালিদের এইরকম আঞ্চলিকতার সঙ্গে আমি পরিচিত ছিলাম না। আমরা যখন কানাডা আসি তখন আমার কৈশোর। বাবার কেন যেন মনে হলো ছেলেমেয়ে খারাপ প্রভাব ও পরিবেশে পড়ে নষ্ট হয়ে যাবে, এই ভেবে তিনি আমাদের বাড়ি কিনেছিলেন মন্ট্রিয়ালের বাঙালি অধ্যুষিত এলাকা (যেমন- প্লাম্নদন, পার্ক এরিয়া, ভার্দন ইত্যাদি) থেকে অনেক দূরের একটি শহরে। তাই প্রবাসের প্রথম পাঁচ-ছয় বছর আমাদের বাংলাদেশিদের সঙ্গে মেশার সুযোগ হয়নি। এক পর্যায়ে আমি বাংলাই ভুলে যেতে বসছিলাম। লেখালেখির কারণে অনলাইনে অনেকের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। ইদানিং কয়েকজন বাঙালি পরিবারের সঙ্গে ভালো জানাশোনা আছে। ফলে কিছু কিছু বাঙালি অনুষ্ঠানে যাওয়া হয়। তবে প্রগতিশীলদের অনুষ্ঠান ছাড়াএগুলো অনেক ক্ষেত্রে অঞ্চলভিত্তিক। যেমন- সিলেটের লোকজন নিজেদের মধ্যে বনভোজনের আয়োজন করেন। নোয়াখালী, বরিশালের লোকজন নিজেরা নিজেদের মধ্যে করেন।সমিতি, সভা, বনভোজন, অনুষ্ঠান নিয়ে নানাভাবে বিভক্ত প্রবাসের বাঙালি সম্প্রদায়।অন্যান্য দেশের মানুষের তুলনায়বাংলাদেশি বাঙালিদের মাঝে এই আঞ্চলিকতা বেশি।
প্রবাসে নতুন কোনো বাঙালির সঙ্গে পরিচয় হলে,বিশেষ করে যারা প্রগতিশীল নন কিংবা নতুন প্রজন্মের নন, অবধারিতভাবে যে প্রশ্নটি প্রায় শুনি বা শুনতাম তা হচ্ছে আমি কোন এলাকার লোক। যেনো এই প্রবাসে দেশ ছেড়ে এতো দূরে একজন দেশি একই ভাষাভাষী মানুষের সঙ্গেপরিচয় ও সংযোগের চেয়ে বড় দেশে কোন এলাকায় বাড়ি!
আমরা যারা ছোটবেলায় বা কম বয়েসে প্রবাসে এসেছি তাদের জন্য এইসব আঞ্চলিকতার প্রশ্ন পুরোপুরি অপমানজনক। হ্যাঁ, আমাদের উচ্চারণ ভালো নয়। আমাদের বাংলা লিখতে বলতে ভুল হয়। তবুও আমাদের বড় পরিচয় ও বড় দিক হচ্ছে, আমরা এতো দীর্ঘকাল এখানে থেকে এখনো বাংলাকে ধারণ করি, দেশকে ধারণ করি।
শুদ্ধভাবে ভাবলে আমরা কেবল এক প্রজাতি, মানুষ। পরিস্থিতি ও পরিবেশের কারণে আমরা এই-সেই, অমুক-তমুক, বাঙালি-অবাঙালি, হিন্দু-মুসলিম, ধনী-গরিব, নারী-পুরুষ। বর্ণবাদমুক্ত বিশ্ব কবে সম্ভব হবে কিংবা অদৌ সম্ভব হবে কিনা- এইসব না ভেবে নিজের অবস্থান থেকে নিজেদের বর্ণবাদবিরোধী মনোভাবকে চাঙ্গা করে তুলতে পারলেই সমাজ ও সংস্কৃতি এবং মানুষেরই জয়।মনে রাখা দরকার, আমাদের আত্মীয়তা, সদলের প্রতি সম্প্রীতি এইসব যেনো অন্যের বিপত্তি হয়ে না দাঁড়ায়। তাহলে আমাদের মূল পরিচয় ও মনুষ্যত্বই প্রশ্নের মুখে পড়ে যায়।
No comments:
Post a Comment