এই ছবিটা ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লু এর, ২০০৭ সালে Proceedings of
the National Academy of Sciences নামক বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্র (https://www.pnas.org/content/104/18/7582)
থেকে নেয়া। সেইসময়ে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের দুটো শহরের চিত্র তুলনা করা হয়েছে এই গ্রাফে, শহর দুটোর কর্তৃপক্ষ ও শহরবাসী ফ্লু’কে কীভাবে মোকাবিলা করেছিলো এবং সেই প্রস্তুতি ও কার্যকলাপের কারণে কতোজন মারা গিয়েছিলো তার একটি তুলনাচিত্র।
১৯১৮ সালে ফিলাডেলফিয়া শহর একটি
প্যারেড
আয়োজন
করেছিলো, ফ্লু যখন ছড়াচ্ছিলো তখনই, মূলত প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেয়া যোদ্ধাদের প্যারেড, কিন্তু স্বাস্থ্যকর্মীদের সতর্কবাণী ও নির্দেশনা উপেক্ষা করে (যেনো জনসমাগম না করে) সবমিলিয়ে প্রায় ২০০,০০০ জন লোক সেই প্যারেড দেখতে গিয়েছিলো। ফলে, সূচকবৃদ্ধি (Exponential growth) হারে তিনদিনের মধ্যেই হাজার হাজার লোক আক্রান্ত
হয়ে পড়েছিলো, পুরো ফিলাডেলফিয়ার ৩১ হাসপাতালে-ও সংকুলান হচ্ছিলো না রোগীদের। যার ফলে, সপ্তাহান্তের মধ্যেই ৪৫০০ জন রোগী মারা গিয়েছিলো। পরে শহর কর্তৃপক্ষ জরুরি অবস্থা ও শহরবন্ধী অবস্থা (lock down/closed down) ঘোষণা করে, কিন্তু ততোক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। অবশেষে,
স্পানিশ ফ্লুতে সারা পৃথিবী জুড়ে ৫০ মিলিয়ন থেকে ১০০ মিলিয়ন মানুষ মারা গিয়েছিলো।
অর্থাৎ, বিজ্ঞানী ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সতর্কবাণী ও নির্দেশনা উপেক্ষা করে জনসমাগমের কারণে ভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিলো।
অন্যদিকে ফিলাডেলফিয়ার ১৪০০ কিলিমিটার দূরের আরেকটি শহর সেন্ট লুইসের প্রস্তুতি ছিলো ভিন্ন। স্বাস্থ্যকর্মীদের সতর্কবাণী ও নির্দেশনা মেনে শহর কর্তৃপক্ষ ইস্কুল কলেজ, উদ্যান, পাঠাগার, কোর্টকাছারি, এবং এমনকি গির্জা ও প্রার্থনার অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলো। জনগণকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো যে ২০ জনের বেশি লোক একসাথে জড়ো হতে পারবে না, এইরকম সম্ভাবনা আছে এইরকম অনুষ্ঠান করা যাবে না। জনগণ-ও নির্দেশ মেনে সামাজিক দূরত্ব (social distancing) বজায় রেখেছিলো। ফলে, উপরের গ্রাফে দেখতে পাচ্ছেন যে, যেখানে ফিলাডেলফিয়ার মৃত্যুর হার ছিলো ২৫০ জন/১০০০০০, অন্যদিকে সেন্ট লুইসের মৃত্যুর হার ছিলো ২০ জন/১০০০০০। যখন, একটি জনসংখ্যাকে সার্বিকভাবে চিন্তা করবেন তখন ২৫০ জন/১০০০০০ বনাম ২০ জন/১০০০০০ মৃত্যুর হার আসলে হাজার হাজার মৃত্যুর ব্যবধান।
অর্থাৎ, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ফলে অনেক মানুষের প্রাণ বাঁচানো গিয়েছিলো। এতে শহর কর্তৃপক্ষের দূরদর্শীতা যেমন ছিলো তেমনি জনগণের সহায়তা-ও ছিলো। সবকিছু সরকারের উপর চাপিয়ে না দিয়ে নিজের কর্তব্য পালন করুন, নিজের পরিবারকে বাঁচান, আপনজনকে বাঁচান।
সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ফলে রোগ ছড়ানো সূচকবৃদ্ধি হারে না হয়ে ধীরে হয় (flattening
the curve)। কোভিড-১৯ করোনাভাইরাসের সংক্রামণ ঠেকানোর জন্য আমাদেরকে সেন্ট লুইসের জনগণের মতো আচরণ করতে হবে, সেইরকম
মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। যখন একটি ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া সীমিত রাখা যায় না (যেমন, কোভিড-১৯ করোনাভাইরাস
ইতিমধ্যে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে), তখন উচিত এর সংক্রামণের হার সীমিত করার চেষ্টা করা, যেনো একই সময়ে একসাথে অনেকে আক্রান্ত না হয়। চীন এই ব্যাপারটি করেছিলো তাদের আক্রান্ত শহর ও প্রদেশগুলোকে নজরবন্ধী ও শহরবন্ধী
করে, ফলে যারা আক্রান্ত
হয়েছিলো আগে তারা সুস্থ হচ্ছেন ও নতুন সংক্রামণের হার কমে আসছে। একই সাথে অনেক মানুষ আক্রান্ত হলে যতোই উন্নত স্বাস্থ্যব্যবস্থা থাকুক না কেনো একটি ব্যবস্থার কার্যসীমার কারণে সব মানুষ এক সাথে চিকিৎসা
সেবা পাবেন না, ফলে অনেক রোগী মারা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু যদি ভাইরাস সংক্রামণের হার সীমিত থাকে তবে ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীরা সূচারুভাবে তাদের কাজ করতে পারেন, অনেক মানুষের
জীবন বাঁচাতে পারেন এবং সেবাব্যবস্থার উপর অতিরিক্ত
চাপ পড়ে না। এছাড়া গবেষকদের হাতে পর্যাপ্ত
সময় থাকে টিকা কিংবা প্রতি-ভাইরাস থেরাপি আবিষ্কারের জন্য। মনে রাখুন যে, একটি টিকা আবিষ্কারের জন্য এবং তা সুষ্ঠভাবে প্রটোকল মেনে ক্লিনিক্যাল
ট্রায়ালের মাধ্যমে পরীক্ষা করে প্রান্তিক
জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে সময় লাগে, কমপক্ষে ১-২ বছর (আশাবাদী
সংখ্যা)। যদিও কোভিড-১৯ করোনাভাইরাসের টিকা আবিষ্কার হয়েছে (অনেক গবেষণাসংস্থা ও গবেষক দল দাবি করছেন), তারপর-ও এখনো অনেক ধাপ বাকি এটিকে বাজারজাতকরণের জন্য।
তাই, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা জুরুরি। এবং এই ক্ষেত্রে
সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে সময়। একটি জনসংখ্যার (শহর, রাষ্ট্র ইত্যাদির) ১% আক্রান্ত
হওয়ার আগেই যদি ভাইরাস সংক্রামণের হার সীমিত রাখা যায় তবে মৃত্যুর হার কমিয়ে রাখা যায়;
স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে প্রস্তুতি নেয়ার সময় দেয়া যায়। গবেষকদল ও টিকাপ্রস্তুতকারী সংস্থাগুলোকে
সময় দেয়া যায়।
কিন্তু সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা যাবে যখন সবাই করে।
আপনি আপনার করণীয়টুকু করছেন তো?
No comments:
Post a Comment