নিউ ইয়র্ক টাইমসে একটি দারুণ সচিত্র লেখা পড়লাম। জোনাথন কোরাম এবং কার্ল জিমারের লেখা। বিভিন্ন অঙ্কনের মাধ্যমে সহজবোধ্যভাবে বোঝানো হয়েছে কীভাবে করোনাভাইরাস আপনার শরীরকে আক্রান্ত করে। যেহেতু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার মতো সাধারণ জ্ঞান নিয়ে-ও অনেক গুজব ও উস্কানিমূলক অপতথ্য প্রকাশিত হচ্ছে তাই আমার ইচ্ছে হলো বাঙালি পাঠকদের জন্য এটি অনুবাদ করি।
চিত্র: সার্স-কোভ-২ ভাইরাস
কোভিড-১৯ এর কারণ হচ্ছে সার্স-কোভ-২ ভাইরাসটি, এটি একটি করোনাভাইরাস। কোভিড-১৯
হচ্ছে এই ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট রোগ। কমপক্ষে অন্য ছয় ধরণের করোনাভাইরাস মানুষকে সংক্রামিত
করে, কিছু কিছু ভাইরাস সাধারণ সর্দিকাশি সৃষ্টি করে এবং অন্য দুটো সার্স (SARS) এবং মার্স
(MERS) রোগের প্রকোপ ঘটায়।
চিত্র: মুকুট জাতীয় গজাল-সদৃশ (spike) প্রোটিন
করোনাভাইরাসকে এই নামকরণ করা হয়েছে এগুলোর পৃষ্ঠে মুকুট জাতীয় গজাল-সদৃশ
(spike) প্রোটিনের কারণে। ভাইরাসটি তৈলাক্ত লিপিড অণুসমূহের একটি আবরণে আচ্ছাদিত থাকে,
যা সাবানের সংস্পর্শে এলে ভেঙে পড়ে। তাই এই ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য বার বার
সাবান দিয়ে হাত ধোয়া অপরিহার্য।
চিত্র: ভাইরাসটি এসিই২ (ACE2) নামক প্রোটিন তৈরি করে এমন কোষসমূহের সাথে সংযুক্ত হয়
ভাইরাসটি নাক, মুখ অথবা চোখের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে, তারপরে শ্বাসনালীতে এসিই২
(ACE2) নামক প্রোটিন তৈরি করে এমন কোষসমূহের সাথে সংযুক্ত হয়। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন
যে ভাইরাসটি বাদুড় থেকে উদ্ভব হয়েছে, সেক্ষেত্রে-ও এটি একইরকম প্রোটিনের সাথে সংযুক্ত
হয়ে থাকতে পারে।
চিত্র: ভাইরাসটির কোষে প্রবেশের পরে এটির আরএনএ'কে মানবকোষে প্রকাশ করে
ভাইরাসটি মানবকোষকে সংক্রামিত করে মানবকোষের কোষঝিল্লির সাথে ভাইরাসটির তৈলাক্ত
ঝিল্লিকে একীভূত করে বা জোড়া লাগিয়ে। একবার ভেতরে প্রবেশের পরে, করোনাভাইরাস এটির আরএনএ
(RNA; যা প্রোটিন তৈরির কোড বহন করে) নামক জিনগত উপাদানকে মানবকোষে প্রকাশ করে।
চিত্র: আক্রান্ত কোষটি ভাইরাসটির আরএনএ পাঠ করে ভাইরাল প্রোটিন তৈরি করে
ভাইরাসটির জিনোম (সকল জিনগত তথ্যের সমষ্টি) ৩০ হাজার “অক্ষর” এর চেয়ে কম দীর্ঘ,
সেই তুলনায় আমাদের জিনোম ৩ বিলিয়নের-ও বেশি “অক্ষর” এর চেয়ে দীর্ঘ। ভাইরাসটি কোষে প্রবেশের
পরে আক্রান্ত কোষটি নিজস্ব অন্যান্য আরএনএ’র পাশাপাশি ভাইরাসটির প্রকাশিত আরএনএকে পাঠ
করে এবং শরীরের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাকে ফাঁকি দেওয়া প্রোটিন তৈরি করতে শুরু করে ও ভাইরাসটির নতুন নতুন প্রতিলিপি তৈরি করে। উল্লেখ্য যে, অ্যান্টিবায়োটিক ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলে এবং ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করে না, তাই
প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধগুলো সার্স-কোভ-২ কিংবা অন্যান্য ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ
করবে না। তবে বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখছেন প্রচলিত অ্যান্টিভাইরাল ওষুধগুলো এই ভাইরাসটির
প্রোটিনগুলোকে ব্যাহত করতে পারে কিনা এবং সংক্রমণ বন্ধ করতে পারে কিনা।
চিত্র: ভাইরাসটির নতুন নতুন প্রতিলিপি বানানো শুরু হয়
সংক্রমণের অগ্রগতির সাথে সাথে, কোষের
জৈবিক যন্ত্রপাতিগুলো ভাইরাসটির নতুন গজাল
প্রোটিন এবং অন্যান্য প্রোটিনগুলো গাদায় গাদায় বানানো শুরু করে
যা ভাইরাসটির আর-ও প্রতিলিপি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ, ভাইরাস মানবকোষের ব্যবস্থাকে 'হাইজ্যাক' করে নিজের প্রতিলিপি সৃষ্টি করে।
ভাইরাসটির নতুন প্রতিলিপিগুলো একত্রিত করা হয় এবং কোষের বাইরের প্রান্তগুলোতে বহন
করে আনা হয়।
চিত্র: প্রতিটি সংক্রামিত কোষ ভাইরাসটির কয়েক মিলিয়ন প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে
প্রতিটি সংক্রামিত কোষ ভাইরাসটির কয়েক মিলিয়ন প্রতিলিপি তৈরি করতে
পারে, অবশেষে কোষটি ভেঙে যাওয়ার এবং মরে যাওয়ার আগে। এই নতুন
প্রতিলিপিগুলো কাছের অন্যান্য ভালো কোষগুলোকে আক্তান্ত করতে শুরু করে অথবা ফোঁটায় ফোঁটায়
ফুসফুসে জমা হয় যেগুলো কাশি বা হাঁচির মাধ্যমে বাইরের পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে।
চিত্র: মারাত্মক ক্ষেত্রে, রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা বেশি প্রতিক্রিয়া দেখায় ও ফুসফুসের কোষগুলোকে আক্রমণ শুরু করতে পারে
শরীরের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থার ভাইরাসটিকে সাফ করার জন্য লড়াই করার
কারণে বেশিরভাগ কোভিড -১৯ সংক্রমণে জ্বর হয়। মারাত্মক ক্ষেত্রে, রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা বেশি প্রতিক্রিয়া দেখায় ও ফুসফুসের কোষগুলোকে আক্রমণ
শুরু করতে পারে। ফলে, ফুসফুসে তরল জমা হয় এবং মরে যাওয়া কোষগুলো বাধা সৃষ্টি করে, ফলে
শ্বাস নিতে সমস্যা হয়। সংক্রমণের
একটি শতাংশের ক্ষেত্রে তীব্র শ্বাসযন্ত্রের সংকট উপসর্গ (acute respiratory distress syndrome) দেখা দেয় এবং মৃত্যু হতে পারে।
চিত্র: কাশি এবং হাঁচির মাধ্যমে ভাইরাসটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে
কাশি এবং হাঁচির কারণে ভাইরাসে ভরপুর ফোঁটাগুলো কাছের মানুষকে আক্রান্ত করে
পারে, এবং কাছের পৃষ্ঠসমূহের উপরিভাগে গিয়ে পড়তে পারে, যেখানে ভাইরাসটি
কয়েক ঘন্টা থেকে কয়েক দিন ধরে টিকে থাকতে পারে। স্বাস্থ্যকর্মীদের মতে, সার্স-কোভ-২
ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের উচিত (কিন্তু সুস্থ ব্যক্তিদের নয়) ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া
কমানোর জন্য মুখোশ পরিধান করা। স্বাস্থ্যসেবা কর্মী এবং সংক্রামিত লোকদের যত্ন নেওয়া
অন্যদেরও মুখোশ পরা উচিত।
চিত্র: সম্ভাব্য টিকা আবিষ্কার কীভাবে সম্ভব হবে
ভবিষ্যতে একটি টিকা (ভ্যাকসিন) আবিষ্কার করা সম্ভব হলে এটি শরীরকে অ্যান্টিবডি তৈরি করতে সহায়তা করতে পারে যা সার্স-কোভ-২ ভাইরাসকে লক্ষ্য করে এবং এটি মানুষের কোষগুলোকে সংক্রামিত হওয়া থেকে রোধ করে। অন্যান্য ফ্লু টিকা বা ভ্যাকসিন একইভাবে কাজ করে তবে ফ্লু ভ্যাকসিন থেকে উৎপন্ন অ্যান্টিবডিগুলো করোনভাইরাস থেকে সংক্রমণ ঠেকাতে পারে না।
চিত্র: কীভাবে সাবানের অণুগুলো ভাইরাসটিকে ধ্বংস করে। তাই সাবান দিয়ে হাত নিয়মিত ধুবেন।
সাবানের অণুগুলো ভাইরাসটিকে সহজে ধ্বংস করে, যেহেতু সাবানের অণুগুলোর জল-এড়ানো
লেজগুলো ভাইরাসের লিপিডের ঝিল্লিতে আটকে ঝিল্লিকে ছিঁড়ে ফেলে। করোনাভাইরাস
আক্রান্ত হওয়া এড়ানোর সর্বোত্তম উপায় হলো সাবান দিয়ে আপনার
হাত ধোয়া, আপনার মুখ স্পর্শ করা এড়ানো, অসুস্থ লোকদের থেকে আপনার দূরত্ব বজায় রাখা এবং নিয়মিত ঘন ঘন ব্যবহৃত পৃষ্ঠগুলি
পরিষ্কার করা।
সূত্র: Dr. Matthew B. Frieman and Dr. Stuart Weston, Univ. of Maryland School of Medicine; Fields Virology; Fenner and White’s Medical Virology; Nature; Science; The Lancet; New England Journal of Medicine; Centers for Disease Control and Prevention
No comments:
Post a Comment