হাঁটাহাঁটির ব্যাপারে আমি জন্মগত প্রতিভা বলা চলে। পাশের বাড়ির নজরুল সাহেবের মত হাতের থাবা মেরে কুমড়া ক্রয় কিংবা গন্ধ শুঁকে পাবদা মাছ কেনার মতন তুখোড় না হলেও বাজারের কার্যটুকু সমাধা করতে আমার নাতিদীর্ঘ সময় লাগে। নজরুল সাহেব আহলাদি কদম পেলে বাজারে যাবেন, পথে নানাবিধ কুশল বিনিময় করে নিজ এবং অন্য অনেকের দিন ধন্য করে দেন তিনি। পরিচিতির সুক্ষ্ম অথচ ফলদায়ক পন্থা হল কুশল বিনিময়; নজরুল সাহেব দাপ্তরিক কার্যপ্রণালীতে প্রতিভার ছাপ না রাখতে পারলেও সংসারিক কাজে অতিশয় ধূর্ত এবং তুখোড়। তিনি সরব, ভারী পা পেলে বেলা গড়িয়ে ভাল জিনিসটি নিয়ে আসেন; আমি নিরব, নিমগ্ন পা পেলে ভালতর জিনিসটি নিয়ে আসি।
প্রতিবেশীর প্রয়োজন আমি নিয়মিত অনুভব করি। বিপদে-আপদে সাহায্য ছাড়াও আমাদের স্বয়ংক্রিয় নাগরিক জীবনে প্রতিবেশী নজরুল সাহেব অনেক ভূমিকা পালন করছেন। এই সপ্তাহে তিনি সোফা-সেট পাল্টালেন তো পরের সপ্তাহে আমরা-ও খাট-পালঙ্ক পাল্টাতে কসুর করি না। তিনি আমাদের মনে ভাল-হিংসা সৃষ্টি করে চলেছেন।
নজরুল সাহেব অবধারিতভাবে ফি বিকালে নৈরাশ্যের ফাঁকে নিয়ম করে আমাদের সরোবরী বারান্দায় আমার সাথে দাবা খেলার নিমিত্তে হাজির হবেন এবং অতি সূক্ষ্মতার সহিত আমার পকেট থেকে জল-খাবারের টাকাগুলো খসিয়ে নেন। অবশ্য এর বদলা স্বরূপ প্রতি সপ্তাহান্তে তার একান্নবর্তী পরিবারে আমাদের দু'টি সংসারিক জীবের নিমন্ত্রণ পড়ে। সে নিমন্ত্রণে খানাপিনার চেয়ে তাদের নব্য আমদানীকৃত আসবাবপত্র কিংবা বিপণনী সামগ্রীর কারুকার্য, জৌশ দেখে আমাদের প্রথাগত চোখের ব্যায়াম হয়।
আমাদের ভাললাগা, মন্দলাগা, লোভ-ঘৃণা ইত্যাদি রিপু তাড়িত বোধ বিস্কুট-দৌড় খেলার মতন সুতোয় বাধা; যখন যার ডাক পড়ে সে এসে সঙ্গী হয়।
সেই নজরুল সাহেব একদিন হারিয়ে গেলেন। নিয়ম করে সুবোধ বালকের মত বাড়ি ফেরা যার নিত্যকর্ম ছিল সে মানুষটা একদিন বাড়ি ফিরলেন না। জানা-আধজানা সকল সম্ভাব স্থানে তার-বেতার যোগাযোগ হল, তিনি লাপাত্তা। ডুমুরের ফুল আমাদের প্রতিবেশীর বারান্দায় ফুটে থাকল। যাবতীয় সকল জাগতিক দুঃখগাঁথা, প্রলাপ, গল্প আছড়ে পড়ল সবার মুখে, চায়ের কাপে। নজরুল সাহেবের এই নিরুদ্দেশ যাত্রায় সবচেয়ে মনকষ্ট পেলেন আমার স্ত্রী। পরকীয়ার লেশবিন্দু নয়; আমাদের ভাল-ঘৃণার সময় হয়েছে উদ্বায়ী পদার্থে রূপ নেয়ার- উবে যাবে আমাদের পালা করে দৌলত প্রদর্শনীর আয়োজন।
পরিশিষ্ট: আমাদের নতুন প্রতিবেশী এসেছে। নবীন পরিবারে সারাদিন প্রেম মাখামাখি। আমরা যারা দেবতা হয়ে আছি তাদের সাময়িক অর্ঘ্যাভাব দেখা দিলেও সমস্যার বলিরেখা পড়েছে না আমাদের কপালে। কারণ, আমরা জানি পৃথিবীতে ফুলের অভাব নেই।
===================================
মূল পোস্ট: সামহয়্যার-ইন-ব্লগ
রচনাকাল: ২০ শে জানুয়ারি, ২০০৯
No comments:
Post a Comment