এসো খড়ে সুঁই খুঁজি

Custom Search

Sunday, April 25, 2010

১৯৭১: ঘাস থেকে ঘুড়ি, রূপকথাগুলো বাস্তবফুল

১৯৭১: ঘাস থেকে ঘুড়ি, রূপকথাগুলো বাস্তবফুল
=============================


এলোচুল মেলে ডাকলে বলে এসে গেলাম
খোঁপার বাঁধনে বাঁধলে বলে ডোরে পড়লাম
এসো তোমার খোঁপার বাঁধন আমার ছন্নগঠন
খুলে পরষ্পরের সুতো ধরি।


একদা এক দেশে একটি গ্রাম ছিল।

গ্রাম থাকলে মানুষ থাকে, আর থাকে পাহারাদার বৃক্ষসভ্যতা। রোদচশমায় মুখচোখ ঢেকে কড়ই গাছের শাখাপাতানিশান তলে একটি মাঝারী বয়েসের টিনের ঘর পাওয়া গেল। ঘরের মালিক মতিউরের পাকা দাঁড়ির সাথে পাল্লা দিয়ে ঢেউটিনগুলো ফুটোবহুল হয়েছে। ফলস্বরূপ অন্দরঘরে বর্ষার অনুপ্রবেশ রোধ করতে এখানে সেখানে পলিথিন খড়ের গেলাপ দিয়ে আচ্ছাদন দেয়া হয়েছে। দু'টি ছেলেমেয়ে নিয়ে মাতা-তেরেসা-বউটা সংসার সামাল দেয়, চাঁদ-সূর্য যেমন পোনা-তারাদের রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করে।


রূপকথার সেইসব কাহিনি আমরা জানি, ঠাকুরমা আরবদেশে গেলে সিন্দাবাদের আত্মীয় হয়ে যান, গ্রামে থাকলে লোককথা আর রসূলপুর উপশহরে এলে কাসেম মোল্লার মতো নয়া বাড়িঘর বানিয়ে তালপাতার সেপাইদের ওস্তাদ হয়ে যান! রূপকথা স্বপ্নে ভর করলে কবিরাজ জ্যোতিষী হওয়া যায়, বাস্তবে ছোবল মারলে সংসার বিকোয় বাজারে।


তাই মতিউর বিড়ি ফুঁকে। কাসেম বিড়ি।


সে সময়ে অসময়ে কামলা দেয়, আর বর্ষা মৌসুমে বন্ধ্যা উপশহরে কাজ না পেলে আল্লাহ-ভগবানের দোহাই দিয়ে কুম্ভকর্ণের মুরিদ বনে গিয়ে অলস মেহগনি গাছটির মতো পড়ে পড়ে ঘুমোয়। বউ, নয়নতারা, সোনার কাঠি রূপোর কাঠির সন্ধান জানে না, তাই স্বামীর ঘুমের ব্যাঘাত করে না। তদাপি ছেলেমেয়ে দু'টির মুখের মাপ জানে বলে এপাড়া-ওপাড়ার কচুশাক, ডুলমিশাক দিয়ে রান্না করে চুলার মর্যাদা রক্ষা করে।


না, জমছে না। রূপকথার গল্পে একটি দানব দরকার। নিদেনপক্ষে একটা জাঁদরেল মন্ত্রী কিংবা নটরাজ সৈনিক।



তবু-ও কেন কারো ঘ্রাত শরীরে অন্য ঘ্রাণের আস্বাদ!
জমানো জলে ভিজলে স্নান, উলটপালট নামলে বৃষ্টিভেজা।


হেলাল মিয়া কুয়া থেকে পানি তুলছিলেন। সন্ধ্যে হয়ে আসছে আসছে। শব্দটা শুনে তার মনে হলো বালতিটা কুয়োয় পড়ে গেছে, অনেকটা ছল্যাৎ করে শব্দ হয়েছে। কিন্তু শব্দের পুনরাবৃত্তি হওয়াতে তিনি আশপাশে তাকালেন।
না, এরকম গাঢ় শব্দ হওয়ার কোন উৎস ধারেকাছে নেই। বাচ্চারা অনেক আগেই খেলার মাঠকে ছুটি দিয়ে এসেছে।

কতক্ষণ অবিশ্রাম শব্দ হলো। হেলাল মিয়া ছুটে গেলেন বড় রাস্তার দিকে। শব্দটা সেখান থেকে আসছে। বড় ছেলের পোষা কুকুরটা রাস্তার মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে ছিল, লোকগুলো অন্ধকারের মতো নিঃশব্দে এল আর কুকুরটার পেট বরাবর একটি লাথি মেরে রাস্তা থেকে সরিয়ে দিল। কুঁইকুঁই করে কুকুরটা পাশের ধান খেতে হাঁটুজলে গিয়ে পড়ে, আর বেবাক ধানশীষের মাখখান থেকে নিরীহ গর্জন করতে থাকে।

হেলাল মিয়ার শীর্ণ শরীর আর টাকমাথার মতো তার রাগ-ও যেমনতেমন। কুকুরটা এমনিতেই পোলাপাইনের লাথি-দৌড়ানি খায়, তবু-ও এটা দেখে তার মাথায় রক্ত উঠে গেল।

মানুষ আর কুকুরের মাঝে পার্থক্যটা খুব বেশি নয় সেটা বুঝিয়ে দিতেই খানিকপরে হেলাল মিয়া অর্ধমৃত শরীরের ঠাঁই হলো চুপচাপ ঘুমানো মাটিতে।


সেদিন রাতে, কৃষ্ণপক্ষের চাঁদের আলোয় দেখা গেল ঘুমের ভিতরে স্বপ্ন হারিয়ে যাওয়ার মতো করে গ্রামে স্থানপত্তন করে কয়েকটি হেলিকপ্টার, সাঁজোয়া বহর লুটতরাজ সেনাদের টহল। সে রাতে, চাঁদ ও তারাদের পাশাপাশি অনেকে স্থানবদল করে আর নির্ঘুম সময় কাটিয়ে স্বপ্নচাষ স্থগিত রাখে।


দানবের আগমনে রূপকথার মোড় কোনদিকে যাবে?

আমরা জানি, আমরা অন্ধজ্ঞানী।


তাকে হারিয়ে ফেলি, নিজেকে হারানোর/পাওয়ার ছলে
সংসারে পাশাপাশি থাকে আদা ও উর্বশী


মতিউরকে প্রায় কাসেম মিয়ার বাড়ির আশপাশে ঘুরঘুর করতে দেখা যায়।
কাসেম মিয়া কোন এক অজ্ঞাত কারণে মতিউরকেই আস্টে-মায়য়ার কাজগুলো দেন। সে কারণেই কিনা সে আশপাশে থাকে। ভাব যেন এই বুঝি কাসেম মিয়া ডাক দিয়ে বলবে, 'মতি, ভিড়ার বাড়ির নারিকেল গাছগুলার তো দাঁড়ি-গোঁফ বাইর হইয়া গেল, সাফ-সতুর কইরা দিস।' গাছের দাঁড়ি-গোঁফ বিশেষ কিছু নয়, মরা-আধমরা পাতা-ডালপালা বৃক্ষের বৃদ্ধি-প্রতিবন্ধক; মতিউরের কাম হলো সেইসব পরিষ্কার করা। কাজ শেষে, আকাশের মতো কাসেম মিয়ার মন ভাল থাকলে, গতর খাটার টাকার পাশাপশি নারিকেল সুপারী-ও মিলে। সেটা দিয়ে বউটা নারিকেলের চিঁড়া, পানের খিলি পাকায়। মতিউর নিজের দাঁড়ি-গোঁফের বর্ধনের দিকে খেয়াল না রাখলে-ও কথায় অকথায় কাসেম মিয়াকে গাছগাছালির পরিচর্যার কথা মনে করায়ে দেয়।
অবশ্য আরেকটা অন্তর্নিহিত কারণ আছে। তবে সেই কারণটি রসূলপুর গেরামে মিলিটারী ক্যাম্প কিংবা জলের নিচের প্রাসাদে ফুলকন্যাকে বন্দী করে রাখার মতো নষ্ট বাস্তবিক। রইসুনা। কাসেম মিয়ার ঘরের কামের বেটি, সম্পর্কে কাসেম মিয়ার দূর সম্পর্কের লতানো আত্মীয়-ও বটে।
রইসুনার শরীরের রঙ ধুতিসাদা রসুনের মতো সাদা না হলে-ও বেশ উপভোগ্য বর্ণের। অনেকটা ভিড়ার বাড়ির পাকা নারিকেলের মালার মতো হলদে-ফর্শা। সে অবশ্য ভালো চা বানায়, দুপুরের দিকে- আকাশটা যখন সূর্য-বিড়ি ফুঁকে কিংবা মতিউরের কাজকারবার পাহারা দেয়ার মতো কেউ আশপাশে থাকে না- তখন রইসুনা হালকা আদা দিয়ে পারুলবিবির সিঁথির সিঁদুরের লাহান লাল-চা বানায়ে আনে। আর বিনিময়ে মতিউর হরেক কিছিমের গপসপ করে: বৃদ্ধ বটগাছটি ক্যান গভীর রাতে পাতা ঝরিয়ে কাঁদে কিংবা শশ্মান লাগোয়া খালের পানি ক্যান তিঁতা তিঁতা হয় সেইসব হাজারো রহস্য বলে বলে রইসুনার মনোযোগ মাকড়সার পোকা আটকানোর মতো ধরে রেখে নিজের শরীর ও মন উভয়ই কাজের ফাঁকে একটু জিরিয়ে নেয়!

'মতি ভাই, পরিবার কেমন আছে?' দুপুরবেলায় ঘন রোদের সময়ে ভূতের গল্প যেমন জমে না তেমনি রইসুনার হঠাৎ এই প্রশ্নে মতিউর সিগারেটের ধোঁয়ার গতিপথ পাল্টিয়ে বিষম খায়।

'হ, ভালাছে। হঠাৎ কিল্লাই?'
'না, এমনি। চায়ে চিনি হইছে তো?'
'তোমার চায়ে সব সময় চিনি হয়। তুমি হইলা পাক্কা চাওয়ালী।' নিজের রসে মতিউর নিজেই হাসে।
রইসুনা আরেকটু কাছে ঘেঁষে অনেকটা গোপন কথার বলার ভঙ্গিতে কহে উঠে, 'ভাবী কি আবার পোয়াতি?'
এবার মতিউরের আরো অস্বস্তি লাগে, সে তিঁতে বদনে খরো-তেঁতুল হয়ে যায়।
'না, তুঁই এমন আবজাব কথা জিগাইতেছ ক্যান?'
'হি হি, এমনি। আপনার চমকানি লাগে নি?'
মতিউরের চমকানি লাগে না যে এটা পুরোপুরি সঠিক নয়। চুলা প্রায় উপোস থাকে, রান্না হয় না, হলে-ও খাদ্য অখাদ্য খেয়ে বউটা যে শরীর অটুট রাখছে সেটা ভাবতে গিয়ে মতিউরের মাঝে মাঝে বিস্ময় জাগে।
'রইসু, তুঁই কি কিছু বলবা? বিশেষ কিছু?' মতিউর সিগারেটের ধোঁয়ার নেকাবে নিজের মুখটাকে আড়াল করে বলে।
'না, কী আর কমু। আমগো কথা কে শুনব।'
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হওয়ার ক্লান্তিতে রইসুনা বলে উঠে। সে বিপত্নীক। বিয়ের ছয় মাসের মাথায় শাস্ত্রধার্মিক স্বামী হজ্জে গিয়ে আল্লাহর মাল হয়ে উপারে গিয়েছে। সে থেকে সে ভ্রমর, আগে ছিল প্রজাপতি। বসন্ত এলে তার মতো নারীদের কলরব ও কদর উভয়ই বাড়ে। শীতের জমাটে তাদের কথা কেউ শুনে না।
'আমারে আপন ভাইবা কইতে পার।' মতিউর নদীজলচোখে তাকায়।
'নারে ভাই কিছু না। তোমার গপ ইস্টার্ট করো আবার। হুদাই সময় নষ্ট করাইলাম।'
মতিউর অনেকটা বিশ্রাম ছেড়ে কাজে ফেরার ইচ্ছে করে না, সে গপ-ও শুনতে চায় না। সে রইসুনার জীবন খুঁড়ে।
'মিলিটারী আইসে দেখছেন?' রইসুনা হঠাৎ জাগতিক হয়ে যায়।
'হুঁ। না জানি কী হয়।'
'কিছু হইব না। কাসেম বদ্দা দাঁড়ি রাখতেছে। সিন্নি-ও দিব কইছে। সে আমাগো দেখব। গেরাম তো তাগোই।'
'তোমারে কইছে?' মতিউর ঝিমায়।
'হুনছি। ভাবীর লগে কথা কইতেছিল, আমি কিনারে আছিলাম।'
মতিউর কাঁচিটা কাছে টেনে নেয়, 'এইবার মেলাটা হইল না।'
'কিসের মেলা?'
'আরে, দরকা'র মেলা। নন্দীয়া মেলা।'
'সময়ে এখন বিষ আর আপনি মেলার চিন্তা করেন!' রইসুনা উঠে দাঁড়ায়।
মতিউর কাজে ফেরার প্রস্তুতি নেয়। 'রইসু, মিলিটারী চইল্লা গেলে যদি মেলা হয় তুঁই কি আমার লগে যাইবা? তঁরে সারকাস দেখামু নি। একটু রাইত-বিরাইত অইব আরকি।'
রইসুনা কথা বলে না। রোদ থেকে বাঁচার জন্যই হয়ত সে মাথায় ঘোমটা তুলে নেয়। আর ধানক্ষেতের ভরা মাঠের মতো দাঁড়ি-গোঁফ সমৃদ্ধ মতিউরের মুখখানির দিকে অনেকক্ষণ আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থেকে কিছু না বলে কাপ-পিরিচ নিয়ে সে অন্দরবাড়ির দিকে রওয়ানা দেয়।


একদিন মহাপতনের আগে পৃথিবীর সমস্ত
সবুজ একেকটি মানচিত্রের গঠন নিয়ে ডায়েরীর পাতায় ঘুম হবে।


হাত ফাঁকি দিয়ে নাটাইয়ের সাথে আড়ি দিয়ে ষোলবর্গা ঘুড়িটি চিলের সাথী হতে পারে! যখন-তখন!
রূপকথার গল্পে মঞ্চাইলে অনেক কিছু হয়।
সে ঘুড়ি উড়ায়। অন্য একটি বালক সুতো কেটে দিল। খানিক উপরে উঠে একটু গোত্তা খেল সদ্য বিচ্ছেদ বরণ করা ঘুড়িটি। ছেলেটি জানে এই ঘুড়ি এখন কোথায় পড়বে তার ঠিক নেই। এরকম ঢাউস ঘুড়ি সে হারাতে চায় না, তাই ঘুড়িটাকে মায়ের মুখের মতন চোখে চোখে রেখে সে পিছনে দৌড় শুরু করল। তার কষ্ট লাগছে না, বরং মনটা কেমন হাওয়া হাওয়া!
সে দৌড়ায়। ঘুড়িটার উড্ডয়ন ফুরোয়। বেশি দূর না। একটি খাল। সে ঘুড়ি উড়াচ্ছিল খেতের 'পরে। খাল ফেরিয়ে ইস্কুল-মাঠের কিনারে লুটিয়েছে। ক্লান্তিকে ছুটি দিয়ে সে ঘুড়িটার টুটি চপে ধরে, এবার বাড়ি ফেরা যাক। মা নিশ্চয় তাকে ঝিঁনুক-মুক্তো-খোঁজা খুঁজছে!

'আব্বে......কই... .....।' অপরিচিত কণ্ঠে সে পিছনে তাকায়। গোঁফওয়ালা একটা লোক। গৌরাবর্ণের। এই অঞ্চলের নয় সেটা নিজের বিছানা চেনার মতো বোঝা যায়।

সে ভাষা বুঝে না। হাবভাব বুঝে।
'....... ........ .........'
লোকটা তার নিরুত্তরে একটু রগচটা হয়ে যায়। ঈশারা-ভঙ্গি দেখে বুঝতে পারে লোকটা তার আগমনে খুশি নয়! সে-ও হাত নাড়িয়ে আঙুল ছাড়িয়ে ঘুড়ি দেখায়।
'আঁর ঘুড়ি গা সজীব্বা কাডি দিছে। ঘুড়ির লাই আইছি। কিছু নিই ন'য়।'
'....... ........ .........'
লোকটা হঠাৎ তাকে পাকড়াও করে, সে ভয় পেয়ে ঘুড়িটা আঁকড়ে ধরে- অনেকটা মাঝরাতিতে মায়ের পিঠ আঁকড়ে ধরার লাহান।

আরে, অইটা কাসেম কাগু না! হ্যাঁ, তাই তো। দাঁড়ি রাখার কারণে চেনা যাচ্ছে না।

'কাক্কা........।' সে ডাক ছাড়ে।
লোকটা সেদিকেই যাচ্ছে। কাসেম মিয়া এদিকে তাকান। তার চোখ খানিক সুরু হয়ে উঠে, এই পোলারে পাইল কই।
বিদ্যালয়ের মাঠে আগে ঘাস ছিল প্রচুর, এখন আগাছা আছে। ক্যাম্প, তাঁবুঘর আর মানুষ-আগাছা। এটা তাদেরই ইস্কুল। এখন শিয়ালেরা বসত করছে বলে কেলাস হয় না। লোকজন মুরগী হয়ে ঘরবন্দী- খোঁপবন্দী।
'....... ........ .........' কাসেম মিয়া লোকটার সাথে কথা বলে। সে বুঝতে পারে না। কাসেম কাগু কি কলমী বুবু হয়ে গেল? কলমী বুবুকে গতবার বরইভূতে ধরেছিল, তখন এরকম আবোল-তাবোল বকতেন, কেউ বুঝত না।
'....... ........ .........' লোকটা হাসে চোখ বাঁচিয়ে। কেবল ঠোঁটে।
'....... ........ .........' যাহ্, দুইজনকেই ভূতে ধরেছে। একজন অন্যজনের কথা বুঝছে। ভূতেলা ভাই।
লোকটা তাকে কোলের উপর নিয়ে বসে। ওরা কথায় মশগুল হয়। আরেকটা ভূত এসে খাবার দিয়ে যায়, ওদের খাওয়া দেখে তার মুখে লালা আসে ঘ্রাণে।
অনেকক্ষণ পরে লোকটা তার গাল টিপে দেয়। সে মূর্ছা যায় হতবাক। লোকটার গোঁফ টেনে দেয় সে। না, এই লোকটা জ্বিন, আগুনের তৈয়ার, কেমন রেগে গেল নিমিষেই!
'....... ........ .........'
'....... ........ .........'
লোকটা তার হাফপ্যান্টের ভিতর হাত ঢুকিয়ে দেয়! সে তীব্র চিৎকার করে পাখিদের টহল ভেঙে দেয়।
কাসেম মিয়া অন্য দিকে মুখ ফেরান। সে এলোপাতাড়ি হাতপা ছুঁড়ে। তার হাতের পাতাগুলো ভাঙনের ঘুড়ি হয়ে বাতাসে হাবি খায়।


যদিও তোমার আমার অনেক গল্প ছিল,
আমরা তবুও একটি কবিতার অপেক্ষায় ছিলাম!


সেদিন ঘন অন্ধকারের রাত্রির পরে- মোরগ আর কাজলা কাকগুলো বিহানে ডাকাডাকি করে সূর্যকে ঘুম থেকে তোলার বদলে তাকে জাগিয়ে দিলে সে দেখে মা অনেক আগেই হংসী হয়েছে।
নিম-ডাল দিয়ে দাঁত মাজন করে সে জল খায়। আজকাল সে ঘরের আশপাশেই থাকে। ঘুড়ি উড়ানি ক্ষ্যামা দিয়েছে। মাঝেমাঝে সে হঠাৎ উঠোনে চলে আসা হাঁস-মুরগী তাড়ায়- হাঁস-মুরগীগুলো কিছু উড়ে নিরাপদ দূরত্বে চলে যায়।
খেতে গিয়ে টের পেল বাবা নেই। সাধারণত সক্কালবেলা তারা একসাথে খায়।
'বাপজান কই?'
মা কথা কহে না। হাঁড়ির নিচে জমা কালির মতো মুখটাকে কালো করে রাখেন।
'কথা কও না ক্যান?'
'খাইতেছিলি খা। সাতসকালে এত কথা কস ক্যান?'
'বাপজান কই কও। না হলে খামু না। পান্তাভাত খাই না।'
সে উঠে গিয়ে ঘরের কোণায় বসে পড়ে কেঁচোর সঙ্গী হয়। মা শিকা থেকে একটা পাতিল নামান।
'আয়, মিঠাই খা। তোর বাপে আনছে।;
সে কথা বলে না একটুও, তেতুঁল গাছের নিরবতা ধরে রাখে। মা এসে মাথার চুলে বিলি কেটে দেয়।
'তোর বাপ...তোর বাপ কাজে গেছে।'
'আঁরে ক'ন কিল্লাই? আর এত্তো সক্কালে কিয়ের কাজ। আইজকা তো বাপের কা ন থাকির কাম।' সে অবাধ্য হাতপা ছুঁড়ে।
সন্ধ্যার আগে আগে 'আয় টুকটুক' করে গৃহপালিত দুয়েকটা মুরগী ঘরে ফেরানোর ন্যায় মা বলে, 'তোর বাপ যুদ্ধে গেছে।'
'যুদ্ধ কি জিনিস? আমারে না বইলা গেল ক্যান?'
সে যুদ্ধ চিনে না। সে চিনে শাপলা, সে জানর ধানী জমিতে কাকতাড়ুয়া আর উড়ে পাখিদের বিরোধ।
'মুক্তিযুদ্ধ। আমগো সবার মুক্তি হইব। ইস্কুলের মাঠে আবার ঘুড়ি উড়াইতে পারবি। মন মতো চলতে পারবি।'
তার চোখে দুটি সোনা-হীরার খণ্ড চকচক করে।
'মুক্তিযুদ্ধ হইলে কি আমি রোজ মিঠাই খাইতে পারুম? আমার কচুর শাক খাইতে ভাল্লাগে না। আমি মিঠাই চাই।'
মা খানিক চুপ রয়। নিজের নাকফুল, হাতের চুড়িতে সংসারের বন্ধন; রান্নাঘরের তৈজসপত্রে পূর্বপুরুষের পাপ ইত্যাদি মনচক্ষে দেখে নিয়ে অস্থির কণ্ঠে বলে উঠেন, 'পাবি, সব পাবি। মুক্তিযুদ্ধ আমাগোরে সব বাঘ থেইকা মুক্তি দিব। এখন খাইয়া 'ল। তোরে বড় হইতে হইব না!'
ছেলেটি দেখে মায়ের চোখে নির্জন অশ্রু। সে মিঠাই খাওয়ার সাথে সাথে মায়ের কয়েকটি অশ্রু পান করে।


অ-শোক গাছের নিচে আছে ভবিষ্যত-ফুল
অন্ধকার মানে অন্ধকার, আমি মানে আমি
আর দেশ মানে অজস্র আমার মাঝে তুমি


জলের নিচের প্রাসাদে ঢের দৈত্য-রাজপুত্রের অসিবাজি হয়। রাজকন্যা ভয়ে, হীরা-জহরতের ভারে আরেকটু কুঁকড়ে, আরেকটু ক্লান্ত হয়ে যায়। সেইসব খবর মাছেরা গোয়েন্দা সেজে জেনে ফেলে, ঢেউের কাছে বলে রাখে; ঢেউরা তীরে তীরে রাষ্ট্র করে দেয়। খাদ্যচক্র কিংবা প্রকৃতিচক্রের অন্তরঙ্গতায় একদিন সবাই টের পায়- ঘাস-ফড়িঙ-ইঁদুর-সাপ-ঈগল: মাটি থেকে আসমান।
মা-ও জানেন, ছেলেটা চিঁড়ে-মুড়ির একটু আধটুকু।
মাঝে মাঝে অন্ধকারের বোরকা পরে কেউ কেউ আসে। তাদের খুঁজতে আসে শিয়ালগুলি। সর্বশেষ পরিস্থিতির খবর দেয় বেতার।
মা যত্ন করে মাটির মানুষদের খাওয়ান। খাটের নিচে, ভিড়ার মাটির নিচে তারা অস্ত্র গোলাগুলির সাথে পুঁতে রাখে ভবিষ্যৎ। অন্যদল আসে পরের সপ্তাহে।
কচুগাছগুলো রোদ-জলের আহলাদে বড় হয়ে উঠে। তাদের কেউ কাটতে আসে না। ঘাসফড়িঙেরা ঘুড়ি বানায়। কেউ সুতো কাটতে আসে না।


রূপকথা অনাদিকাল চলতে পারে না। ঘুমে চোখ লুটোপুটি খায়। মূলত আমাদের জীবনে আমরা রূপকথার গল্পের সমাপ্তি টেনে অপরবাস্তবের ঘুম নিয়ে শুয়ে পড়ি, উঠে বসি, কর্ম সঞ্চালনে আগ্রহ হয়ে পড়ি।
পূর্ণিমা মানে চাঁদের যৌবন, সে যৌবনের নাড়ি ছিঁড়ে কতকগুলো জোছনাশিশু জন্ম নেয়। তারা একটি দেশকে অমলিন করে তুলবে বলে।
রূপকথার গল্পের সুখ মন কেমন করা ভাবের মাঝে ভ্রান্তি থাকে; চাঁদের কলঙ্ক-ও চোখে পড়ে।
সেদিন পূর্ণিমা ছিল নদীর জলের মতো টলটলে।
ওরা মাথায় মুকুট নিয়ে আসছিল, কাঁধে একটা দাফন-খাট।
ওরা সাতজন ছিল।
উঠোনে অসংখ্য ছায়ার মাঝে খাটটি নামিয়ে রাখা হয়। ছেলেটি মায়ের পিছনে পিছনে এসে দাঁড়ায়। মা বুঝে। মা কাঁদে, মা চাঁদের সহোদরা।
বাবা, বাবা.....। সে দেখে এখনো বুকের কাছে কিছু রক্ত শুকনো ইতিহাস হয়ে আছে। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ছেলেটির চোখে অসংখ্য ঘাস ঘুড়ি হয়ে যায়, আর রূপকথাগুলো দেশবাস্তব হয়ে উঠে।



১৯৭১: ঘাস থেকে ঘুড়ি, রূপকথাগুলো বাস্তবফুল

No comments:

Post a Comment

কী নিয়ে মাতামাতি...

13 Reasons Why (1) ADHD (1) Alzheimer's disease (1) Antibiotic Resistance (1) Anxiety (1) Autism (1) Brexit (1) Brief Answers to the Big Questions (10) Britain (1) Bruce Peninsula (1) Cades Cove Scenic Drive (1) Canada (2) Clingsman Dome (1) District 9 (1) Dopamine (1) Dyer's Bay (1) Federico Garcia Lorca (1) Fierté Montréal (2) Gaspé & Percé Rock (1) Global Warming (2) Great Smoky Mountains (2) Heatwave (1) Hemianopia (1) infographics (1) Instagram (104) International Balloon Festival (1) Interstate 77 (1) Lift (1) Links (1) Maple syrup boiling down (1) Maple syrup harvesting (1) Marconi Union (1) Mike Krath (1) Montmorency Falls (2) Montreal International Jazz Festival (1) Montreal Pride Parade (2) Mother Teresa (1) Movies (1) Music (2) Netflix (1) Niagara Falls (3) Nickelback (1) Nirvana (1) North Carolina (1) nutella (1) Photography (2) Photos (104) Poets of the Fall (2) Psychology (1) Rain storm in Montreal (1) Rape (1) Reading List (1) Saint-Remi (1) Samuel de Champlain Bridge (1) Sandra Crook (1) Schizophrenia (1) Sci-Fi (1) Sci-Hub (1) Shortest Sci-Fi (1) Smoky Mountains (1) Stephen Hawking (15) Sunshine 2007 (1) Tennessee (1) The Beatles (1) The Danish Girl (1) The Grand Design (8) The Handsome Family (1) Tobermory (1) Toronto (2) Transexualism (1) True Detective (1) Tyrannosaurus rex (1) Wallingford Back Mine – Mulgrave et Derry (1) West Island (1) Womenchapter (1) অটিজম (3) অটোয়া (1) অণুগল্প (7) অনুবাদ (17) অভিগীতি (12) অভিলিপি (9) অর্থনীতি (2) অ্যালকোহল (1) আইন ও বিচারব্যবস্থা (1) আইসিস (2) আচরণগত স্নায়ুবিজ্ঞান (1) আত্মহত্যা (2) আলঝেইমারের রোগ (3) আলোকচিত্র (6) আলোকবাজি (9) ইচ্ছেকথা (3) ইন্সটাগ্রাম (104) উইমেন-চ্যাপ্টার (1) উদ্বেগ (1) উবার (1) একুশে বইমেলা (1) এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধ (1) এম-তত্ত্ব (5) কবিতা (95) কম্পিউটার বিজ্ঞান (1) করোনাভাইরাস (6) কলাম (5) কানাডা (4) কাব্যালোচনা (2) কাসেম বিন আবুবাকার (1) কিশোরতোষ (1) কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (1) কৃষ্ণগহ্বর (1) কোভিড-১৯ (8) ক্যান্সার (1) ক্রসফায়ার (1) ক্লোনিং (1) খাদ্যব্যবস্থা (1) গণতন্ত্র (1) গবেষণা (1) গবেষণাপত্র (1) গর্ভপাত (1) গল্প (8) গাঁজা (1) গান (17) গুজব (1) গ্যাব্রিয়েলা মিস্ট্রাল (1) চলচ্চিত্র (4) ছড়া (5) ছবি (104) ছোটগল্প (5) জঙ্গিবাদ (1) জনস্বাস্থ্য (2) জিকা ভাইরাস (1) জীববিজ্ঞান (1) জীবাণু (1) ট্রান্সসেক্সুয়াল (1) ট্রান্সসেক্সুয়ালিজম (1) ডাইনোসর (1) ডাউনলোড (1) ডোপামিন (1) তাপমাত্রা (1) তিল-গপ্পো (17) তুষার দত্ত (2) তেজস্ক্রিয়তা চিকিৎসা (1) দূরবীন (2) দৃষ্টিশক্তি (1) ধর্ম (3) ধর্ষণ (2) নায়াগ্রা ফলস জলপ্রপাত (1) নারী (3) নারী স্বাধীনতা (1) নুটেলা (1) নৈতিকতা (1) পরিবেশ (1) পাঁচমিশালী (1) পাঠসূচি (1) পাম তেল (1) পাহাড় (1) পুস্তক (1) পেডোফিলিয়া (1) প্রকৃতি (1) প্রবন্ধ (2) প্রবাস (2) প্রাইমেট (1) ফটোগ্রাফী (1) ফেসবুক (1) ফ্রান্স (1) বই (2) বড় প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত উত্তর (10) বয়ঃসন্ধি (1) বর্ণবাদ (1) বাঙলাদেশ (18) বাবা (1) বাংলাদেশ (1) বিজ্ঞপ্তি (1) বিজ্ঞান (13) বিটলস (1) বিষণ্নতা (3) বুরকিনি (1) বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি (7) বৈশ্বিক উষ্ণতা (1) ব্যক্তিত্ব (1) ব্যথা (1) ভাইটামিন ডি (1) ভাইরাস (1) ভালোবাসা (1) ভুয়া খবর (1) ভেন্টিলেটর (1) ভ্রমণ (3) মনস্তত্ত্ব (1) মনোবিজ্ঞান (19) মন্ট্রিয়াল (1) মন্ট্রিয়াল আন্তর্জাতিক জ্যাজ উৎসব (2) মস্তিষ্ক ক্যান্সার (1) মহিমান্বিত নকশা (3) মাদক (1) মাদকাসত্তি (2) মাদার তেরেসা (1) মানসিক স্বাস্থ্য (5) মুক্তগদ্য (3) মুক্তচিন্তা (3) মুক্তিযুদ্ধ (3) মৌলবাদ (1) যাপিত জীবন (2) যুগান্তর পত্রিকা (1) যৌনতা (1) রাজনীতি (1) রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প (3) রূপান্তরকাম (1) রৌদ্রস্নান (1) লিওনার্ড ম্লোডিনো (5) লিংক (2) লিঙ্গরূপান্তর (1) লিঙ্গরূপান্তরকারী (1) লিথিয়াম (1) লিফট (1) শিক্ষাব্যবস্থা (1) শিশুতোষ (3) সংগীত (3) সন্ত্রাসবাদ (1) সংবাদমাধ্যম (1) সময়ভ্রমণ (1) সমালোচনা (1) সর্দিগর্মি (1) সানশাইন (1) সামাজিক দূরত্ব (1) সাম্প্রতিক দেখা চলচ্চিত্র (1) সার্স-কোভ-২ ভাইরাস (4) সাহিত্য (4) স্কিৎসোফ্রেনিয়া (1) স্টিফেন হকিং (16) স্ট্রোক (1) স্নায়ুবিজ্ঞান (12) স্নায়ুবিষ (1) স্বাস্থ্যসেবা (1) হলুদ (1)
রোদের অসুখ © 2008 Por *Templates para Você*