১
গত ২৪ আগস্ট ওবায়দুল খান নামে এক ঘাতক উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের সামনের ফুটওভার ব্রিজে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী রিশাকে ছুরিকাঘাত করে। এরপর ২৮ আগস্ট ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রিশা মারা যায়। এই ঘটনার সপ্তাহখানেক আগেই আফসানা নামের আরও একজন নারী হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। তার স্বজনদের দাবি, ছাত্রলীগকর্মী রবিন এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী (ছাত্রলীগ থেকে বলা হচ্ছে রবিনের সঙ্গে তাদের কোনও সম্পর্ক নেই)। আফসানার মৃত্যুকে চালানো হচ্ছে ‘আত্মহত্যা’ হিসেবে, একটি মানুষ আত্মহত্যা করলে কেন তার লাশ হাসপাতালে রেখে পালিয়ে যায় দু’জন যুবক?
যাইহোক, মনে আছে তনুকে? যে তনু ধর্ষিত হলো বাড়ি ফেরার পথে, যার ধর্ষণ-সংক্রান্ত ময়নাতদন্ত নিয়ে প্রহসন করলো সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক দল ও প্রশাসন ছিল নিশ্চুপ। ব্যাটারি শেষ হয়ে নিস্তব্ধ হওয়া ঘড়ির মতো এইরকম অসংখ্য ঘটনা ও মামলার বিচার হয় না; বরং আরও অনেক আফসানা, রিশা, মিতু কিংবা অন্য কোনও নারী নির্যাতনের শিকার হন, ধর্ষণের শিকার হন, মেরে ফেলা হয় তাদের। আমাদের দেশেই, যে দেশে প্রধান দুটি দলের প্রধান নারী, সেই দেশে নিশ্চয়তা দিয়ে বলা যায় না—আজ যে মেয়েটি স্কুলে গেল বা বাইরে বেড়াতে গেল, সে নিরাপদে বাড়ি ফিরবে।
রিশা, আফসানা, মিতু অথবা তনু—তাদের প্রতি নির্যাতন অথবা তাদের মৃত্যু আপাত ‘বিচ্ছিন্ন’ ঘটনা মনে হলেও এ সব ঘটনা মূলত তুলে ধরে আমাদের দেশে নারীদের প্রতি মনোভাব ও আচরণ। এ সব ঘটনা তুলে ধরে আমাদের সমাজের অবক্ষয়, নারীদের কর্ম ও চিন্তার স্বাধীনতা না থাকা, তাদের দমিয়ে রাখার চেষ্টা, তাদের একজন মানুষ হিসেবে যাপনের সুযোগ সুবিধে না দেওয়া। এ সব ঘটনা তুলে ধরে আমাদের প্রশাসনের দুর্বলতা, ক্ষমতা ও দলীয় প্রভাবের কৌশলে অপরাধ থেকে পার পেয়ে যাওয়ার দৃষ্টান্ত।
২.
রিশার অভিভাবক ও স্কুলটির অন্য অভিভাবকরা অভিযোগ করেছেন, যখন ছুরিকাঘাতে আহত হয়ে ছটপট করছিল রিশা তখন স্কুলবাসসহ অসংখ্য গাড়ি আশপাশে থাকলে-ও কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসেননি। রিশার বাবা-মা দাবি করেছেন, যখন রিশা গুরুতর আহত হয়ে ছটফট করছিল, তখন স্কুল কর্তৃপক্ষ তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। এটাও তো নৈতিকতার চরম অবক্ষয়। স্কুল প্রাঙ্গণে অসংখ্য গাড়ি অথচ নিজের স্কুলের শিক্ষার্থীর সাহায্যেও তারা এগিয়ে আসতে চাননি। কী ভয়াবহ! এমনটা কেন হলো? রিশা কেবল একজন কিশোরী বলে? নাকি সে গুরুত্বপূর্ণ কোনও ব্যক্তির কন্যা নয় বলে? নাকি সে কেবল একজন কন্যাসন্তান বলে পায়নি সাহায্য?
আফসানা ও তনু হত্যা মনে করিয়ে দেয় ক্ষমতা ও দলীয় প্রভাবের দুর্দান্ত অপব্যবহার, যেন আপনার সঙ্গে কোনও ক্ষমতাসীন দলের কারও সঙ্গে জানাশোনা থাকলে অথবা তাদের সঙ্গে সংযোগ থাকলে, তাদের একজন হলে আপনার অপরাধ মাফ। প্রায় দেখা যায়, কোনও একটি ঘটনা ঘটার পর যখন পরিবেশ পরিস্থিতি খানিক স্তিমিত হয়ে আসে, তখন পর্যন্ত অপেক্ষা করে অপরাধীরা, তারপর আবার ফিরে আসে, শিকার হয় অন্যকোনও কিশোরী বা নারী। পুলিশ অথবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যথেষ্ট জনসম্পদ ও কৌশল আছে এ সব অপরাধীকে ধরার, শুধু সদিচ্ছা নেই, শুধু তাদের ওপর রয়েছে ওপর মহলের চাপ। রিশার ঘাতক ওবায়েদুলকে পুলিশ গ্রেফতার করেনি, গ্রামবাসী তাকে ধরে পুলিশের হাতে সোপর্দ করেছে। প্রতিটি রাষ্ট্রেই কিছু অপরাধী পার পেয়ে যায়। অপরাধের মাত্রা বা হার কমিয়ে বা নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়, কিন্তু বাংলাদেশে যেভাবে অপরাধের হার বাড়ছে, বিশেষ করে নারীদের প্রতি, তাতে সন্দেহ হয় কোনও নৈরাজ্যের দেশে আছি আমরা।
এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় নারীদের প্রতি অপরাধের হার আমাদের দেশে অনেক বেশি। যেমন, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান সংস্থার তথ্যমতে, ২০১১ সালে প্রতি দশজন নারীর ৯ জন (৮৭%) তাদের স্বামী বা সঙ্গী দ্বারা কোনও না কোনওভাবে নির্যাতিত হয়েছেন। শুধু তাই নয়, এক-তৃতীয়াংশ নারী স্বামী বা সঙ্গীর আরও ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হবেন এই ভয়ে পুলিশকে রিপোর্ট করেননি কিংবা ডাক্তারের কাছে যাননি চিকিৎসার জন্য, নীরবে সহে গেছেন। বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর পরিসংখ্যান অনুসারে নারী ও শিশুদের প্রতি রিপোর্ট করা নির্যাতন ও নানাবিধ অবমাননার সংখ্যা ২০০২-২০১৫ সাল নাগাদ প্রায় ২ লাখ ৪৩ হাজার ৩৭৩।
এইতো গেলো নির্যাতনের পরিসংখ্যান, ধর্ষণের হারও তুলনামূলকভাবে আমাদের দেশে অনেক বেশি। যেমন: জানুয়ারি ২০১১ থেকে ডিসেম্বর ২০১২ সাল নাগাদ চলমান এক তথ্যজরিপে দেখা গেছে যে, বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে (সঙ্গী নয়, এমন লোক দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছেন প্রতি ১০০ জনে ৫.৪ জন নারী। এছাড়া বাংলাদেশের ধর্ষণের শিকার প্রতি চার জনের মধ্যে একজন গণধর্ষণের শিকার হন (একাধিক পুরুষ দ্বারা)। নারী ও কিশোরীদের প্রতি এ সব নির্যাতন, ধর্ষণ ও অপরাধ করে থাকে পুরুষরাই। এতো বেশি অপরাধের হারের কারণ সঠিক বিচার না হওয়া, ফলে
ইতিবাচক স্পর্ধার (positive reinforcement) মতো ঘটে, এবং অপরাধ বাড়তেই থাকে।
৩.
ধর্ষণ প্রমাণের জন্য বাংলাদেশ এখনও ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’- এর মাধ্যমে তদন্ত হয়। শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে ভয়াবহ একটি ঘটনার পরে ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’ ও পুলিশের জেরা (যেখানে আক্রান্ত নারীর দোষ খুঁজতে ব্যস্ত) যে মানসিকভাবে কতটা ট্রমা তা ধারণা নেই অনেকের। অথচ ধর্ষণ হয়েছে কিনা, তা নির্ণয়ের জন্য বীর্য, রক্ত, যোনি নিঃসরণ, লালা, যোনির অ্যাপিথেলিয়াল কোষ সংগ্রহ করে ধর্ষককে শনাক্ত করা যায় সহজেই। ডিএনএ প্রোফাইলিং করা যায় অনেক কম খরচে। এসব ব্যবস্থা বরং অন্যগুলোর চেয়ে অনেক নির্ভরযোগ্য।
বাঙলাদেশে নেই নারীদের সমান বেতন-ভাতার স্কেল। একজন নারী ও
একজন পুরুষ একই চাকুরির জন্য (যেমন, শিক্ষকতা) একই পরিমাণ কাজ করলে-ও নারীদের বেতন
পুরুষদের তুলনায় কম; যদিও এই সমস্যা পৃথিবীর অনেক দেশ, উন্নত দেশ আমেরিকার
যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশে আছে, তারপর-ও বাঙলাদেশে এটি ভয়াবহ। চাকুরির জন্য
প্রাধান্য দেয়া হয় পুরুষ প্রার্থীদের, অথচ বর্তমানে নারীদের শিক্ষার হার ও
যোগ্যতার হার পুরুষদের চেয়ে বেশি। নারীদেরকে পদোন্নয়নের ক্ষেত্রে-ও বৈষম্যতার
শিকার হতে হয়।
বাংলাদেশে নেই গর্ভপাতের মতো ব্যক্তিগত বিষয়ে নারীর স্বাধীনতা, আইন করে রাখা হয়েছে, পুরুষ ও অভিভাবকের অনুমতি লাগবে। যেন নারী শরীরের ওপর অন্যের অধিকার! অথচ ধর্ষণের শিকার হয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের পরে একজন নারী কী করবে? এ রকম অনেক ক্ষেত্রে নারীদের প্রতি সমান মর্যাদা নিশ্চিত করে এমন আইন নেই।
এত গেলো রাষ্ট্রব্যবস্থার কথা, পারিবারিক ও সামাজিকভাবেও নারীদের দমিয়ে রাখা হয়। সংসার সামাল দেওয়া, সন্তান লালন-পালনের অধিকাংশ কাজ করেন এ দেশে নারীরাই। অথচ বিশ্বায়নের এই যুগে জীবনযাত্রা মান ও ব্যয়ের কথা চিন্তা করে এবং আধুনিক সংসার ব্যবস্থায় উচিত পুরুষ ও নারীর সমান (সাধ্যমতো কম-বেশি) কন্ট্রিবিউট করা। আমাদের দেশে পুরুষরা ‘স্বামী’ (যার আভিধানিক অর্থ প্রভু, অনেক পুরুষ মূলত এই অর্থেই আচরণ করেন), ‘বিয়ে করেন’ বা নারীদের ‘বিয়ে দেওয়া’ হয়। অথচ দু’জনই বিয়ে নামক সামাজিক ও আইনগত বন্ধনে যোগ দেন।
প্রেমে সাড়া না দিলে হত্যা, এসিড নিক্ষেপের শিকার হন একজন নারী, অথচ যেকোনও মানুষের রয়েছে ব্যক্তিগত নির্বাচনের স্বাধীনতা। আমাদের দেশে মেয়েদের বিয়ে পারিবারিকভাবে চাপিয়ে দেওয়া হয় অনেক কিছু, এমনকি সঙ্গী নির্বাচনও হয় মেয়েটির অভিমত উপেক্ষা করে।
সমাজের সর্বস্তরে এভাবে শত শতভাবে দমিয়ে রাখা নারীদের প্রতি
যে অবিচার ও অন্যায় করা হয় তার বিপরীতে তাদের হত্যা নির্যাতনের বিচার না হওয়া অবাক
করে না। কারণ এভাবে দেখে-ও না দেখার ভান করে আমরা মেনে নিই, এবং এভাবে অপরাধ ও
অন্যায়ের অশুভ চক্র চলতে থাকে।
৪.
অধিকাংশ পুরুষ জানেই না যে, নারীদের সমান মর্যাদা ও স্বাধীনতায় মূলত পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের লাভ। যেমন: যেসব পরিবারে কাজকর্ম ও অর্থনৈতিক ভার নারী-পুরুষ দুজন সঙ্গীই বহন করে নেন, সে সব যুগল অন্যান্য যুগলের তুলনায় বেশি সুখী হন। তারা গড়ে দীর্ঘদিন বাঁচেন এবং মানসিকভাবে বিভিন্ন ব্যধিতে কম শিকার হন। এমনকি তাদের ছেলেমেয়েদের মানসিক ও বুদ্ধিমত্তার বিকাশ অন্যান্য ছেলেমেয়ের তুলনায় বেশি হয়। পরবর্তী জীবনে সে সব ছেলেমেয়েও উন্নতি লাভ করে বেশ (ধারণা করা হয় বাবা-মাকে অনুকরণ করে তারা ভালো ব্যাপারগুলো শেখে এবং পরে কাজে লাগায়)। যেসব রাষ্ট্রে নারীদের বেতন স্কেলে বৈষম্য নেই এবং
কর্মক্ষেত্র ও অর্থনৈতিক ব্যাপারগুলোতে নারীদের সমানাধিকার দেয়া হয় সেইসব
রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও জিডিপি অন্যান্য রাষ্ট্রের তুলনায় গড়ে বেশি।
নারীদের প্রাপ্য স্বাধীনতা দানে পুরুষদের লাভ চেয়ে ক্ষতি নেই, বরং একজন পুরুষ পাবেন নির্ভরযোগ্য একজন সঙ্গী, যে আপনার পাশাপাশি হাল ধরতে পারবে, আপনাকে উৎসাহ দিয়ে ও দৃষ্টান্ত হয়ে উন্নতির লক্ষ্যে পৌঁছে দেবে।
৫.
অনেক বছর ধরে চলে আসা নারীদের প্রতি এ সব বৈষম্যমূলক প্রথা আচরণ ইত্যাদি একদিনে পাল্টানোর নয়, তবে যত তাড়াতাড়ি আমাদের মানসিকতার পরিবর্তনের সূচনা ঘটে তত ভালো। আমরা স্বপ্ন দেখতে পারি আমাদের আইনরক্ষাকারী বাহিনীরা রিশা, আফসানা, তনু এইরকম অনেক নাম-না-জানা নারীদের প্রতি, নজরে না আসা আলোচিত না হওয়া অপরাধের বিচার করে দৃষ্টান্ত রাখবেন, যেন পরবর্তী অপরাধে কেউ উৎসাহিত না হয়। আমরা চাইতে দেখতে পারি বিশ্বায়নের এই যুগে যখন অনেক তথ্যই হাতের নাগালে পাওয়া যায়, তখন অভিভাবকেরা তাদের সন্তানদের লালনপালন করবেন লিঙ্গ-ভিত্তিক কোনও বৈষম্য ছাড়াই। এভাবে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিবর্তনের সূচনা ঘটলে এই সমাজ অনেক নিরাপদ হবে, নারীদের জন্য। পক্ষান্তরে পুরুষ ও পুরো সমাজের জন্য।
No comments:
Post a Comment