২০১৫ এর ডিসেম্বরে অটোয়া গিয়েছিলাম। অটোয়ায় কবি মেসবা আলম অর্ঘ্য থাকে, তার বাসায় গিয়ে উঠলাম, সে একা থাকে, আমি মিলে দুইদিনের জন্য দোকা। যেকোনো জায়গায় বেড়াতে গেলে আমি সাধারণত চেষ্টা করি কোনো পরিচিত লোক কিংবা আত্মীয়ের বাসায় উঠতে, তাহলে কথা বলার মানুষ পাওয়া যায়, নতুন শহর সম্পর্কে শহরেই বসবাসকারী লোকদের কাছ থেকে তথ্য জানা যায়; সেইরকম কোনো কেউ না থাকলে এয়ারবিনবি (AirBnb) কিংবা কোনো হোটেলে ওঠা হয়। অটোয়ায় এর আগে গিয়েছিলাম ২০০৮ এ, তখন চাচাতো বোন ও তার পরিবার সেখানে থাকতো। তখন কানাডার সংসদভবন ও আশপাশের এলাকা এইসব ঘুরেছিলাম, যদিও সেইসব স্মৃতি এখন ঝাপসা।
অটোয়াকে কেনো যেনো আমার এক বিধবা নারীর মতন মনে হয়, তার ভেতরে রহস্য আছে, সৌন্দর্য আছে, বিষণ্নতায় ভরপুর, অথচ চারিদিকে শীতের কুয়াশার ভেতরে রাখা শীতল হাতের মতন নিস্তবতা আর অভিযোগহীনতায় ঘেরা। মন্ট্রিয়ালের হই-হুল্লোড় আর ফেস্টিভ্যালের তুলনায় অটোয়া যেনো সদ্য বয়েসসন্ধিতে আসা কোনো কিশোর কিশোরীর মতন ব্রীড়ায় অন্তর্মুখী। একটি দেশের রাজধানী শহর বলতে যে অগণন মানুষের সমাবেশ, পিঁপড়ে আর উইঢিবির মতন যত্রতত্র গড়ে ওঠা অট্টালিকার সমারোহ আর যানজটের আশংকা থাকে অটোয়ায় সেইসব নেই; আছে রবিবারের বিকেলে হঠাৎ কী মনে করে আকাশের দিকে তাকিয়ে অনেকক্ষণ দৃষ্টি না ফেরানোর আনন্দ, আছে মায়ের হাতের রান্নার নিপুণতার মতন সুপরিকল্পিত নগরায়নের ছোঁয়া, আর গোপন প্রেমিকার মতন পাব, রেস্তোরা, মদের দোকানে দুপুরের বন্দরের কাজ একটু কমে যাওয়ার মতন ঢিলেঢালা ভাব।
মন্ট্রিয়াল থেকে অটোয়া ঘণ্টা আড়াইয়ের পথ, গাড়ি জোরে চালালে হয়তো দুই ঘন্টার; তবে অন্টারিও প্রদেশে ১২০ কিমি/ঘন্টার উপরে গেলে হাইওয়ে পুলিশ জরিমানা করে ৯৫ ডলার, ১৪০ কিমি/ঘন্টা চালালে ২৯৫ ডলার। আমি সাধারণ স্পিড লিমিটের ১০-১৫ কিমি/ঘন্টা বেশি জোরে চালাই। তাছাড়া তখন ডিসেম্বরের তুষারপাত পুরোদমে শুরু না হলে-ও রাস্তা হালকা পিচ্ছিল, রাতভর টুকটাক যেটুকু মিহি তুষার পড়ে কিংবা কুয়াশা পড়ে তার কারণে, তাছাড়া বিকেল সাড়ে চারটা দিকে পথে নামলাম, চারিদিকে সড়কবাতির আলো আর দূরের জনপদের বিচ্চুরিত ছাড়া অন্ধকার; তাই চালানো ১০৫-১১০ কিমি/ঘন্টায়। সাধারণত কোথাও বেড়াতে গেলে আমি অন্তত পথ হারাই একবার, এবার-ও ব্যতিক্রম হলো না। তবে হাইওয়ে ৪০ থেকে ট্র্যান্স কানাডিয়ান হাইওয়ে এবং এরপর হাইওয়ে ৪১৩ ধরে যেতে হয়, সরল রাস্তা বলে বেশি ঘুরতে হলো না।
সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ পৌঁছে গেলাম অর্ঘ্যের বাসায়। অনেকদিন পর দেখা, সেই ২০১৪ এর গ্রীষ্মে শেষবার দেখা হয়েছিলো উঠোন চিত্রশালার বনভোজনে। রাতে দেখা হলো সাজি আপার (সুলতানা শিরীন সাজি) সাথে একটি অনুষ্ঠানে, সাজি আপা ব্লগার ও কবি লেখেন। অটোয়ার অন্যান্য সংস্কৃতিমনা বাঙালিদের অনুষ্ঠান, আড্ডা, গলাবাজি, গানে রাত এগারটা বাজে আমরা যখন ফিরে এলাম তখনো সেই অনুষ্ঠান চলছিলো।
অর্ঘ্যের নতুন বই বের হবে ২০১৬ এর বইমেলায়, দেশে যাবে সেই উপলক্ষে। তার বই থেকে কবিতা পড়ে শোনালো। কথায় অকথায় আর গান শুনে মধ্যরাত পর্যন্ত চললো আমাদের প্রথমদিনের আড্ডা। ঠিক হলো কাল শহর দেখতে যাবো।
পরের দিন দেখা করলাম লুবনার সাথে, কবি নাজনীন খলিলের মেয়ে, সে অটোয়াতে পড়ছে, সে-ও দেশে যাবে। সবার দেশে যাওয়ার কথা শুনে আমার-ও দেশমায়া জেগে উঠলো। তিনজনে মিলে ঘুরলাম গাড়িতে পায়ে হেঁটে এখানে সেখানে, দুপুরের খাওয়া হলো একটি ভিয়েতনামিজ রেস্তোরায়, ভিয়েতনামিজদের খাবার অনেকটা চাইনিজদের মতো, লুডলস তফু বিভিন্ন ধরণের পাতা সবজি ইত্যাদি বেশি থাকে, তবে ঝাল কম থাকে।
সন্ধ্যার দিকে এসে অর্ঘ্য আবার গান আর কবিতা নিয়ে বসলো। এবার বিনয়ের কবিতা। বিনয় মজুমদার।
"সুস্থ মৃত্তিকার চেয়ে সমুদ্রেরা কত বেশি বিপদসংকুল
অর্ঘ্য এলএসডি কিংবা স্পিডে ঘোর পাওয়া মানুষের মতো একেক করে বিনয়ের কবিতা পড়তে থাকে। আমি শুনি, কবিতা আবৃতি করার মেধা ও কৌশল আমার নেই। কবিতার আবৃতি অনেক সময় কবিতার উপলব্ধিকে পাল্টে দেয়, অনেক সময় গোত্তা খাওয়া ঘুড়ির মতন কবিতাকে অপমান-ও করে দেয়, তাই কবিতার আবৃতি বিপদজনক। তবে অর্ঘ্যের পাঠ শুনে মনে হয় সে এইসব কবিতা অসংখ্যবার পাঠে করেছে, হয়তো নিজের জন্যই, নিজের জন্য কবিতা পাঠই শ্রেষ্ঠ পাঠ, অর্ঘ্যের মকশো করা আছে।
"আমার আশ্চর্য ফুল, যেন চকোলেট, নিমিষেই
বিনয় পাঠ শেষে অর্ঘ্যের আট তলার বারান্দায় বসে আমরা রাতের আকাশ পাঠ করি, তারা নেই, মেঘে ঢাকা, চারিদিকে ক্রিসমাসের জনশূন্যতা। আমরা পান করি। গান শুনি। কথা আগাই। নিজেদের কেনো জানি পাললিক যুগের দুইজন যুবকের মতো মনে হয়; তখন হয়তো তাদের চিন্তায় ছিলো শিকার, দল সম্প্রদায়ের ভাবনা, এবং নারী। আমরা টের পাই উপস্থিতি, পরিস্থিতি ও সময় পাল্টালে-ও আমাদের চিন্তা মূলত এইসব ঘেষে; মানুষের মস্তিষ্ক বিবর্তনে গড়া, এতো সহজে পাল্টায় কী করে।
রাতে আমরা বের হলাম অর্ঘ্যের এক পুরানো বন্ধুর সাথে দেখা করতে, সেখানে গিয়ে আবার আড্ডা, তারপর রাত্রি দুইটায় তুষারপাতের মধ্য দিয়ে বাড়ি ফেরা, অর্ঘ্য তখন পানের প্রভাবে সমানে বকে যাচ্ছে। আমি কিঞ্চিৎ চিন্তিত। বাড়ি ফিরলাম নিরাপদেই।
গভীর রাতে ও পরের দিন সকালে জম্পেশ তুষারপাত হলো, এই তুষারপাত পায়ে নিয়ে শহর দেখা যায় না, তারপর-ও আমরা বের হলাম বিকেলের দিকে; কানাডার পার্লামেন্ট ও সংলগ্ন এলাকা দেখার জন্য।
কানাডার পার্লামেন্ট ভবন
"যে জলে আগুন জ্বলে" (হেলাল হাফিজ)
সংসদভবনের পেছনের অংশ
অটোয়া নদী
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত কানাডিয়ান সৈনিকদের সমাধি ও স্মৃতিস্তম্ভ
বীর কানাডিয়ান সৈনিকদের স্মৃতিস্তম্ভ
নির্জন রাস্তা, পার্লামেন্টের পাশেই
অটোয়াকে কেনো যেনো আমার এক বিধবা নারীর মতন মনে হয়, তার ভেতরে রহস্য আছে, সৌন্দর্য আছে, বিষণ্নতায় ভরপুর, অথচ চারিদিকে শীতের কুয়াশার ভেতরে রাখা শীতল হাতের মতন নিস্তবতা আর অভিযোগহীনতায় ঘেরা। মন্ট্রিয়ালের হই-হুল্লোড় আর ফেস্টিভ্যালের তুলনায় অটোয়া যেনো সদ্য বয়েসসন্ধিতে আসা কোনো কিশোর কিশোরীর মতন ব্রীড়ায় অন্তর্মুখী। একটি দেশের রাজধানী শহর বলতে যে অগণন মানুষের সমাবেশ, পিঁপড়ে আর উইঢিবির মতন যত্রতত্র গড়ে ওঠা অট্টালিকার সমারোহ আর যানজটের আশংকা থাকে অটোয়ায় সেইসব নেই; আছে রবিবারের বিকেলে হঠাৎ কী মনে করে আকাশের দিকে তাকিয়ে অনেকক্ষণ দৃষ্টি না ফেরানোর আনন্দ, আছে মায়ের হাতের রান্নার নিপুণতার মতন সুপরিকল্পিত নগরায়নের ছোঁয়া, আর গোপন প্রেমিকার মতন পাব, রেস্তোরা, মদের দোকানে দুপুরের বন্দরের কাজ একটু কমে যাওয়ার মতন ঢিলেঢালা ভাব।
মন্ট্রিয়াল থেকে অটোয়া ঘণ্টা আড়াইয়ের পথ, গাড়ি জোরে চালালে হয়তো দুই ঘন্টার; তবে অন্টারিও প্রদেশে ১২০ কিমি/ঘন্টার উপরে গেলে হাইওয়ে পুলিশ জরিমানা করে ৯৫ ডলার, ১৪০ কিমি/ঘন্টা চালালে ২৯৫ ডলার। আমি সাধারণ স্পিড লিমিটের ১০-১৫ কিমি/ঘন্টা বেশি জোরে চালাই। তাছাড়া তখন ডিসেম্বরের তুষারপাত পুরোদমে শুরু না হলে-ও রাস্তা হালকা পিচ্ছিল, রাতভর টুকটাক যেটুকু মিহি তুষার পড়ে কিংবা কুয়াশা পড়ে তার কারণে, তাছাড়া বিকেল সাড়ে চারটা দিকে পথে নামলাম, চারিদিকে সড়কবাতির আলো আর দূরের জনপদের বিচ্চুরিত ছাড়া অন্ধকার; তাই চালানো ১০৫-১১০ কিমি/ঘন্টায়। সাধারণত কোথাও বেড়াতে গেলে আমি অন্তত পথ হারাই একবার, এবার-ও ব্যতিক্রম হলো না। তবে হাইওয়ে ৪০ থেকে ট্র্যান্স কানাডিয়ান হাইওয়ে এবং এরপর হাইওয়ে ৪১৩ ধরে যেতে হয়, সরল রাস্তা বলে বেশি ঘুরতে হলো না।
সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ পৌঁছে গেলাম অর্ঘ্যের বাসায়। অনেকদিন পর দেখা, সেই ২০১৪ এর গ্রীষ্মে শেষবার দেখা হয়েছিলো উঠোন চিত্রশালার বনভোজনে। রাতে দেখা হলো সাজি আপার (সুলতানা শিরীন সাজি) সাথে একটি অনুষ্ঠানে, সাজি আপা ব্লগার ও কবি লেখেন। অটোয়ার অন্যান্য সংস্কৃতিমনা বাঙালিদের অনুষ্ঠান, আড্ডা, গলাবাজি, গানে রাত এগারটা বাজে আমরা যখন ফিরে এলাম তখনো সেই অনুষ্ঠান চলছিলো।
অর্ঘ্যের নতুন বই বের হবে ২০১৬ এর বইমেলায়, দেশে যাবে সেই উপলক্ষে। তার বই থেকে কবিতা পড়ে শোনালো। কথায় অকথায় আর গান শুনে মধ্যরাত পর্যন্ত চললো আমাদের প্রথমদিনের আড্ডা। ঠিক হলো কাল শহর দেখতে যাবো।
পরের দিন দেখা করলাম লুবনার সাথে, কবি নাজনীন খলিলের মেয়ে, সে অটোয়াতে পড়ছে, সে-ও দেশে যাবে। সবার দেশে যাওয়ার কথা শুনে আমার-ও দেশমায়া জেগে উঠলো। তিনজনে মিলে ঘুরলাম গাড়িতে পায়ে হেঁটে এখানে সেখানে, দুপুরের খাওয়া হলো একটি ভিয়েতনামিজ রেস্তোরায়, ভিয়েতনামিজদের খাবার অনেকটা চাইনিজদের মতো, লুডলস তফু বিভিন্ন ধরণের পাতা সবজি ইত্যাদি বেশি থাকে, তবে ঝাল কম থাকে।
সন্ধ্যার দিকে এসে অর্ঘ্য আবার গান আর কবিতা নিয়ে বসলো। এবার বিনয়ের কবিতা। বিনয় মজুমদার।
"সুস্থ মৃত্তিকার চেয়ে সমুদ্রেরা কত বেশি বিপদসংকুল
তারো বেশি বিপদের নীলিমায় প্রক্ষালিত বিভিন্ন আকাশ,
এ-সত্য জেনেও তবু আমরা তো সাগরে আকাশে
সঞ্চারিত হ’তে চাই, চিরকাল হ’তে অভিলাষী,
সকল প্রকার জ্বরে মাথা ধোয়া আমাদের ভালো লাগে ব’লে |
তবুও কেন যে আজো, হায় হাসি, হায় দেবদারু,
মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে যায়!"
(মুকুরে প্রতিফলিত/ বিনয় মজুমদার)
বিনয়ের কবিতায় তথ্যকে (fact) উপস্থাপনের বিষয়টা অভিনব, বাঙলা কবিতায় এটি অন্যতম সংযোজন। অনেকে কবিতা বলতে বুঝে ফুল-ফল-লতা-পাতা-নদী-প্রকৃতি এইসব, বড়জোর উপমা; কিন্তু উপমা ও উপমিত এই দুয়ে তথ্যের যে বিপর্যয় ঘটে সাধারণত, বিনয়ের কবিতায় এটি কম। যেমন, একজন কবি একদিন পড়ে শোনালো "ব্যথার পিরামিড গলে পড়ে", পিরামিড ভেঙে পড়ে এটি ভালো শোনায়, উপমার রেশ ধরে বাস্তবতা ও বিজ্ঞান বিষয়ক তথ্যের বিপর্যয় ঘটে না। বিনয় (খুব সম্ভবত তার প্রকৌশলে পড়াশোনা ও বিজ্ঞানমনষ্কতার জন্য) এই ব্যাপারটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন কবিতায়।
অর্ঘ্য আরো বিনয় পাঠ করতে থাকে। অর্ঘ্যের আবৃতি ভঙ্গি ও গলা ভালো।
"এতই সহজ, তবু বেদনায় নিজ হাতে রাখি
মৃত্যুর প্রস্তর, যাতে কাউকে না ভালোবেসে ফেলে ফেলি।
গ্রহণে সক্ষম নও। পারাবত, বৃক্ষচুড়া থেকে
পতন হলেও তুমি আঘাত পাও না, উড়ে যাবে।
প্রাচীন চিত্রের মতো চিরস্থায়ী হাসি নিয়ে তুমি
চ’লে যাবে; ক্ষত নিয়ে যন্ত্রণায় স্তব্ধ হব আমি।"
(ভালোবাসা দিতে পারি/ বিনয় মজুমদার)
"প্রাচীন চিত্রের মতো চিরস্থায়ী হাসি", কী দারুণ একটি উপমা। ঠিক কতো কাল স্থায়ী?
"একটি উজ্জ্বল মাছ একবার উড়ে
"প্রাচীন চিত্রের মতো চিরস্থায়ী হাসি", কী দারুণ একটি উপমা। ঠিক কতো কাল স্থায়ী?
"একটি উজ্জ্বল মাছ একবার উড়ে
দৃশ্যত সুনীল কিন্তু প্রকৃত পস্তাবে স্বচ্ছ জলে
পুনরায় ডুবে গেলো — এই স্মিত দৃশ্য দেখে নিয়ে
বেগনার গাঢ় রসে আপক্ক রক্তিম হ’লো ফল |"
(একটি উজ্জ্বল মাছ/ বিনয় মজুমদার)
"আমার আশ্চর্য ফুল, যেন চকোলেট, নিমিষেই
গলাধঃকরণ তাকে না ক’রে ক্রমশ রস নিয়ে
তৃপ্ত হই, দীর্ঘ তৃষ্ণা ভুলে থাকি আবিষ্কারে, প্রেমে।
অনেক ভেবেছি আমি, অনেক ছোবল নিয়ে প্রাণে
জেনেছি বিদীর্ণ হওয়া কাকে বলে, কাকে বলে নীল-
আকাশের হৃদয়ের; কাকে বলে নির্বিকার পাখি।
অথবা ফড়িঙ তার স্বচ্ছ ডানা মেলে উড়ে যায়।
উড়ে যায় শ্বাস ফেলে যুবকের প্রানের উপরে।
আমি রোগে মুগ্ধ হয়ে দৃশ্য দেখি, দেখি জানালায়
আকাশের লালা ঝরে বাতাসের আশ্রয়ে আশ্রয়ে।
আমি মুগ্ধ; উড়ে গেছ; ফিরে এসো, ফিরে এসো , চাকা,
রথ হয়ে, জয় হয়ে, চিরন্তন কাব্য হয়ে এসো।
আমরা বিশুদ্ধ দেশে গান হবো, প্রেম হবো, অবয়বহীন
সুর হয়ে লিপ্ত হবো পৃথীবীর সব আকাশে।"
(আমার আশ্চর্য ফুল/বিনয় মজুমদার)
বিনয় পাঠ শেষে অর্ঘ্যের আট তলার বারান্দায় বসে আমরা রাতের আকাশ পাঠ করি, তারা নেই, মেঘে ঢাকা, চারিদিকে ক্রিসমাসের জনশূন্যতা। আমরা পান করি। গান শুনি। কথা আগাই। নিজেদের কেনো জানি পাললিক যুগের দুইজন যুবকের মতো মনে হয়; তখন হয়তো তাদের চিন্তায় ছিলো শিকার, দল সম্প্রদায়ের ভাবনা, এবং নারী। আমরা টের পাই উপস্থিতি, পরিস্থিতি ও সময় পাল্টালে-ও আমাদের চিন্তা মূলত এইসব ঘেষে; মানুষের মস্তিষ্ক বিবর্তনে গড়া, এতো সহজে পাল্টায় কী করে।
রাতে আমরা বের হলাম অর্ঘ্যের এক পুরানো বন্ধুর সাথে দেখা করতে, সেখানে গিয়ে আবার আড্ডা, তারপর রাত্রি দুইটায় তুষারপাতের মধ্য দিয়ে বাড়ি ফেরা, অর্ঘ্য তখন পানের প্রভাবে সমানে বকে যাচ্ছে। আমি কিঞ্চিৎ চিন্তিত। বাড়ি ফিরলাম নিরাপদেই।
গভীর রাতে ও পরের দিন সকালে জম্পেশ তুষারপাত হলো, এই তুষারপাত পায়ে নিয়ে শহর দেখা যায় না, তারপর-ও আমরা বের হলাম বিকেলের দিকে; কানাডার পার্লামেন্ট ও সংলগ্ন এলাকা দেখার জন্য।
ছবি: সংসদভবনে যাওয়ার পথ
অটোয়া বড় শহর নয়। মাত্র ২৭৭৮ বর্গ কিলোমিটার, জনসংখ্যা মাত্র ৩৩৯ জন/বর্গকিমি। মন্ট্রিয়ালের তুলনায় অটোয়া সরকারিভাবেই দ্বিভাষী, ইংরেজি ও ফরাসি। মন্ট্রিয়াল ক্যুবেক প্রদেশে, যেখানে সরকারি ভাষা শুধু ফরাসি, এই নিয়ে কানাডার ফেডারেল সরকারের সাথে ক্যুবেক প্রদেশে সাপে-নেউলে সম্পর্ক। অটোয়া অবস্থিত অটোয়া নদীর পাশে, নদীর এপাশে ক্যুবেক প্রদেশ, ওপাশে অন্টারিও প্রদেশ (অটোয়া)। অটোয়ায় প্রধানত সেবা (কানাডা সরকারের বিভিন্ন সেবা) কেন্দ্রিক ও হাই-টেক ব্যবসা বাণিজ্যের শহর; শিল্পবাণিজ্য কম।
আর্কিটেকচারের ক্ষেত্রে অটোয়ার দালানগুলো মূলত রোমান্টিক এবং Picturesque স্টাইলের। আমি মূলত ডাউনটাউনের কাছেই ছিলাম বলে আবাসিক এলাকা কেমন সেটা টের পাই নি, ধারণা করছি মন্ট্রিয়ালের মতো হবে; ইউরোপীয় শিল্পের প্রভাব নিয়ে উত্তর আমেরিকার বাড়ি ঘরের মতনই।
অটোয়াতে মেট্রো বা পাতালরেল নাই। বাসের সূচি-ও তেমন সুবিধার মনে হলো না, যদিও আমরা ঘুরেছি মূলত নিজের গাড়িতে করে।
কানাডার পার্লামেন্ট ভবন
সংসদভবনের সামনেই রয়েছে ছোট কৃত্রিম ঝর্ণা, মাঝখানে আগুন জ্বলে।
"যে জলে আগুন জ্বলে" (হেলাল হাফিজ)
সমগ্র সংসদভবন
সংসদভবনের পেছনের অংশ
অটোয়া নদী
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত কানাডিয়ান সৈনিকদের সমাধি ও স্মৃতিস্তম্ভ
বীর কানাডিয়ান সৈনিকদের স্মৃতিস্তম্ভ
নির্জন রাস্তা, পার্লামেন্টের পাশেই
No comments:
Post a Comment