১
প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় না আসা খবরের একটি হচ্ছে ফরিদার
(ছদ্মনাম) মৃত্যু। চাচাতো ভাই দ্বারা ধর্ষিত হওয়া ফরিদা অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে গর্ভধারণ
করে ফেলে। পরে তার পরিবার সামাজিক লজ্জার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য গোপনে
গর্ভপাতের জন্য তাকে নিয়ে যায় ফেনী শহরের একটি তথাকথিত ক্লিনিকে। গর্ভপাতের
সময়কার অতিরিক্ত রক্তপাত-সংক্রান্ত জটিলতায় মৃত্যুবরণ করে ফরিদা। পরে জানা গেলো
যে, ক্লিনিকে যে “নার্স” তার গর্ভপাতের দায়িত্বে ছিলো সে মূলত
একজন “আয়া”। যেহেতু বাংলাদেশে গর্ভপাত নিষিদ্ধ তাই এতো
গোপনীয়তা, তাছাড়া রয়েছে গর্ভপাত বিষয়ে আমাদের স্বচ্ছ জ্ঞান সচেতনা না থাকাতে সৃষ্ট
সামাজিক অগ্রহণযোগ্যতার ব্যাপার। এভাবে কয়েক শতাব্দি পুরানো গর্ভপাত-সংক্রান্ত আইনের
নিষেধাজ্ঞার কারণে প্রতিবছর মৃত্যুবরণ করে অসংখ্য ফরিদা।
বস্তুত, গবেষণা সংস্থা
গাটমেচারের তথ্য মতে, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৬ লাখ ৪৬ হাজারের অধিক গর্ভপাত
হয়, এবং অধিকাংশই হচ্ছে অনিরাপদ পদ্ধতিতে। সারাদেশে প্রতি ১০০০ জন নারীর (বয়েসসীমা
১৫-৪৪) ১৮.২ জন নারী গর্ভপাত করেন নানা কারণে এবং গর্ভপাত-সংক্রান্ত মৃত্যুর হার মোট
গর্ভপাতের ১% বা প্রায় ৭ হাজার, যাদের অধিকাংশই ঘটে গর্ভপাত নিষিদ্ধ হওয়ার কারণে
বিভিন্ন জটিলতার কারণে।
বাংলাদেশের গর্ভপাত-সংক্রান্ত
অধিকাংশ আইন মূলত ব্রিটিশ আমলের ১৮৬০ সালের পেনাল কোড থেকে আসা, যা
অনুসারে গর্ভপাত নিষিদ্ধ, যদি না নারীর জীবন বাঁচাতে গর্ভপাতের প্রয়োজন হয়। তবে
মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী কালীন সময়ে গর্ভপাতের আইনের ক্ষেত্রে কিছুটা শিথিলতা আনা হয়।
যেমন, ১৯৭২ সালের আইন অনুসারে যেসব নারী মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্ষণের শিকার হয়েছেন
তাদের জন্য গর্ভপাত বৈধ করা হয়েছিলো। এছাড়া, ১৯৭৯ সালে মাসিক নিয়মিতকরণ বা
মেনস্ট্রুয়াল রেগুলেশনের (Menstrual Regulation, এমআর) অধীনে, অর্থাৎ,
নারীদের ঋতুস্রাব নিয়মিত করার জন্য গর্ভপাত বৈধ করা হয়। মূলত,
বাংলাদেশে এই পদ্ধতির আশ্রয় নিয়ে বৈধভাবে (আইনগতভাবে) গর্ভপাত করানোর চেষ্টা করা
হয়। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কিছু ব্যতিক্রমবাদে পেনাল কোডের মূল আইন অনুসারে
বাংলাদেশে গর্ভপাত নিষিদ্ধ। এমনকি ধর্ষণের ফলে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ, শারীরিক ও
মানসিক দুরাবস্থার কারণে গর্ভধারণ চালিয়ে যেতে না পারা, অর্থনৈতিক অথবা সামাজিক
কারণ, কিংবা গর্ভের ভ্রুণের জৈব অথবা শারীরিক ক্রটি ইত্যাদি ক্ষেত্রে-ও গর্ভপাত
নিষিদ্ধ। এমনকি যেসব ক্ষেত্রে গর্ভপাত আইনগতভাবে বৈধ সেইসব ক্ষেত্রে স্বামী অথবা
অভিভাবকের সম্মতির প্রয়োজন পড়ে, অর্থাৎ, নারীর একার সিদ্ধান্তে গর্ভপাত করা যাচ্ছে
না। ফলে স্বামী বা অভিভাবকবিহীন নারীদের অথবা যেসব ক্ষেত্রে তাদের অনুমতি পাওয়া
যায় না পারিবারিক অথবা সামাজিক অনৈক্যের কারণে সেসব ক্ষেত্রে নারীরা হয়রানির শিকার
হন।
২
যেহেতু গর্ভপাত মোটের উপর নিষিদ্ধ, তাই অনেকক্ষেত্রে
ডাক্তাররা গর্ভপাত করাতে চান না। এছাড়া, গর্ভধারিণীর জীবন রক্ষায় গর্ভপাত বৈধ বলা হলে-ও
নানা জটিলতার সম্মুখীন হন একজন নারী। যেমন, গর্ভধারিণী জীবনশংকটাপন্ন কোনো রোগে
আক্রান্ত কিনা তা পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত করেই তবে বৈধভাবে গর্ভপাত ঘটানোর
চেষ্টা করতে হয়। এছাড়া, রয়েছে গর্ভপাতকে কেন্দ্র করে মানুষের অসচেতনা-জনিত
সামাজিক ট্যাবু বা অগ্রহণযোগ্যতা ইত্যাদি। ফলে গর্ভপাত-সংক্রান্ত ব্যাপারে অনেক
গোপনীয়তার আশ্রয় নিতে বাধ্য হন নারীরা এবং ফলত নানা জটিলতার মুখোমুখি হন। বিভিন্ন
ক্লিনিকে অথবা মাতৃসদনে অবৈধভাবে (ক্ষেত্রবিশেষে বৈধ গর্ভপাতের ক্ষেত্রে-ও) যেসব
গর্ভপাত ঘটানো হয় সেগুলো হয়ে থাকে দাই বা আয়া অথবা হাতুড়ে ডাক্তারদের দ্বারা। ফলে পেশাদারিত্বের
অভাবে গর্ভপাত-সংক্রান্ত জটিলতা দেখা দেয়। যেমন, জরায়ুতে ইনফেকশন অথবা ক্ষতের
সৃষ্টি হওয়া, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হওয়া, এবং এমনকি মৃত্যুবরণ করা। ফলে নিরাপদ
গর্ভপাতের প্রয়োজনেই গর্ভপাত-সংক্রান্ত আইনের পরিবর্তন দরকার। যখন গর্ভপাত বৈধ হবে
তখন অভিজ্ঞ ডাক্তারের কাছে অথবা পেশাদার ক্লিনিকে এই সেবা নিরাপদেই পেতে পারবেন
নারীরা, ফলে গোপনীয়তা ও দণ্ডের ভয়ে অনাবশ্যক ঝুঁকি নিতে হবে না। এছাড়া, নারীর গর্ভপাত একজন নারীর জন্মগত
অধিকার হওয়া উচিত, নারীর শরীর
নারীরই। প্রজনন দুটো
মানুষের ফসল, কিন্তু নারীই গর্ভে এই ভ্রুণকে ধারণ করেন নানা কষ্ট প্রতিকূলতার মধ্য
দিয়ে, তাই গর্ভপাত কিংবা গর্ভ-সংক্রান্ত প্রথম সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত নারীরই। কোনো
কারণে গর্ভধারণ হয়ে গেলেই তাকে মেনে নিতে হবে এমন হওয়া উচিত নয়, অনেক সময় অনিচ্ছা
কিংবা দুর্ঘটনায় যে গর্ভধারণ হয় কিংবা যেসব ক্ষেত্রে পারিবারিক ও সামাজিক জটিলতার
সৃষ্টি হতে পারে সেইসব ক্ষেত্রে ভবিষয়্যতের কথা চিন্তা করে গর্ভপাত-সংক্রান্ত
ব্যাপারে নারীকে সিদ্ধান্ত নেয়ার স্বাধীনতা দেয়া উচিত, এবং এইক্ষেত্রে প্রথম ধাপ
হচ্ছে গর্ভপাতকে আইন ও সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য চোখে দেখা। আমাদের দেশে নারীরা
অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রের মতো মাতৃত্ব-সংক্রান্ত বিষয়ে ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে
বৈষম্যের শিকার (যেমন, জোর করে বাচ্চা নিতে বাধ্য করা, গর্ভকালীন উপযুক্ত সেবা ও
চিকিৎসা না পাওয়া ইত্যাদি); তাই নারীদের মাতৃত্ব-সংক্রান্ত কল্যাণ, বিকাশ ও
স্বাস্থ্যের অংশ হিসেবে গর্ভপাতের বৈধতার প্রয়োজন। এছাড়া, পৃথিবীতে এমন কোনো নজির
নেই যে গর্ভপাত বৈধ করার ফলে অপরাধ কিংবা সামাজিক অবক্ষয় ইত্যাদি বেড়ে গেছে (যেমন,
অনেকে দাবি করেন যে গর্ভপাত বৈধ হলে প্রাক-বিবাহকালীন গর্ভপাতের হার বেড়ে যাবে),
বরং গবেষণায়
দেখা যায় যে গর্ভপাত নিষিদ্ধ হোক কিংবা আইনগতভাবে বৈধ হোক না কেনো গর্ভপাতের
হার একই ধরণের থাকে, কিন্তু
গর্ভপাত আইনগতভাবে নিষিদ্ধ থাকলে গোপন গর্ভপাতের জটিলতায় নারী বা মায়েদের মৃত্যুর
হার ৩৪ গুণ বেশি হয়ে থাকে, তাই নারীর
মাতৃত্ব-সংক্রান্ত স্বাধীনতা নিশ্চিত করা ও গর্ভধারণ-সংক্রান্ত মৃত্যুর হার কমানোর
জন্য গর্ভপাতের বৈধতার প্রয়োজন।
৩
অনেক নারীর ক্ষেত্রে (বিশেষত গ্রামীণ অঞ্চলে নিম্ন আয়ের
মানুষের) স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করা সম্ভব হয় না অবকাঠামোগত অনুন্নততা ও আর্থিক অসচ্ছলতার
কারণে, ফলে তারা স্বাস্থ্যসম্মত ক্লিনিকের দারস্থ হতে পারেন না। কিন্তু গর্ভপাত
বৈধতা দানের মাধ্যমে একে যদি মৌলিক স্বাস্থ্যসেবার অন্তর্ভুক্ত করা যায় তবে এইসব
জটিলতা দূর হতে পারে সহজেই।
বাংলাদেশ সরকার ও বিভিন্ন স্বাস্থ্য সংস্থা নিরাপদ মাতৃত্ব
নিশ্চিত করার জন্য অনেক পরিশ্রম ও অর্থ ব্যয় করছে। অথচ গর্ভকালীন শিশু ও মৃত্যুর
হার অনেক কমলে-ও এখনো অনিরাপদ গর্ভপাতের ফলে মাতৃত্ব-জড়িত মৃত্যুসংখ্যা কমছে না।
যেহেতু সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য এবং আইনগতভাবে অবৈধ হওয়ার কারণে অনেক নারীই অদক্ষ
হাতে অস্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে গর্ভপাত করতে গিয়ে জটিলতার শিকার ও মৃত্যুবরণ করছেন।
তাই নিরাপদ মাতৃত্বের অংশ হিসেবে গর্ভপাত-সংক্রান্ত আইনের সংশোধন প্রয়োজন, ফলে
নারীরা নির্ভয়ে বৈধভাবে গর্ভপাত করাতে পারবেন স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে যোগ্য
চিকিৎসকের কাছে।
আমাদের দেশে অনেকে ধর্মীয় গোঁড়ামি অথবা অনুশাসনের জন্য
গর্ভপাতকে মেনে নেন না। অথচ এই
আর্টিকেল মতে, দেশের প্রধান ধর্ম ইসলাম কিন্তু গর্ভধারণের ১৬ সপ্তাহ
পর্যন্ত গর্ভপাতকে অনুমোদন করে। অর্থাৎ, ব্যাপারটি ধর্মীয় চাপ নয়, বরং অজ্ঞতা ও
কুসংস্কারের কারণে অধিকাংশ লোকের কাছে গর্ভপাত সম্পর্কিত ঋণাত্মক মনোভাব রয়েছে। তাছাড়া
পৃথিবীর কিছু মুসলিমপ্রধান দেশে (যেমন, তিউনেশিয়া) গর্ভপাত বৈধ। এছাড়া আমাদের দেশে
প্রজনন-সংক্রান্ত বিভিন্ন পদ্ধতি (যেমন, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি) কিন্তু বৈধ এবং
সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য। গর্ভপাত-সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে এবং জনগণকে এই
ব্যাপার সচেতন করলে এইসব বাধা ও কুসংস্কার দূর করা যাবে, এবং রক্ষা পাবে ফরিদার
মতো অসংখ্য নারীর জীবন।
অনেকে ধারণা করেন যে গর্ভপাতের সময় যে ভ্রুণকে সরিয়ে ফেলা
হয় তা “হত্যার” সমান, এই ভ্রুণের মানুষের সমান অধিকার
আছে ইত্যাদি। কিন্তু আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান ও স্নায়ুবিজ্ঞান মতে ব্যাপারটি
অন্যরকম। গর্ভপাত
সাধারণত যখন করা হয় (গর্ভধারণ বা নিষেকের ২-৩ মাসের মাঝে) তখন গর্ভস্থ কোষগুলো একজন “মানুষ” নয়, বরং নারীর শরীরের অন্যান্য অংশের
কিছু কোষগুচ্ছের মতো। এই সময়ে ভ্রুণের মস্তিষ্কবিকাশ পুরোপুরি শুরু হয় নি, এবং
তার ব্যথা বেদনাবোধের সামর্থ্য নেই। তাছাড়া, প্রাকৃতিকভাবে-ও কিন্তু গর্ভপাত ঘটে,
গবেষণায় দেখা যায় যে অধিকাংশ নিষেকের প্রায় ৬২% ভ্রুণের ক্ষেত্রে গর্ভকালীন নানা
কারণে প্রাকৃতিকভাবে গর্ভপাত ঘটে (মূলত এভাবে প্রাকৃতিকভাবেই সুস্থসবল ভ্রুণই
পৃথিবীর আলো দেখে) এবং অনেক নারী টেরই পান না ব্যাপারটি। কৃত্রিমভাবে তাই প্রথম
২-৩ মাসের আগে গর্ভপাতে কোনো হত্যা হয় না, তাই নৈতিকতার দোহাই দিয়ে গর্ভপাতের
বিপক্ষের যুক্তি টিকে না।
৪
সর্বোপরি তাই বলা চলে যে গর্ভপাত আইনগতভাবে বৈধতা পাওয়া যুগ
ও নারীর স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য জরুরি। বাংলাদেশ এখনো অনেকক্ষেত্রে সেই ব্রিটিশ
আমলের উপনিবেশের আইনের বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছে। সময় হয়েছে যুগ ও তথ্যের উপর ভিত্তি করে
এইসব আইনের সংশোধন অথবা নতুন নীতিমালা প্রণয়ন। বাংলাদেশের গর্ভপাত-সংক্রান্ত আইন
মূলত বৈষম্যমূলক এবং আন্তর্জাতিক সর্বজনীন মানব অধিকারের বিপক্ষে যেহেতু এইসব আইন
নিশ্চিত করে না যে চিকিৎসা ও জীবন সংক্রান্ত মৌলিক ব্যাপারগুলোতে নারী নিজে
সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আশা করি গর্ভপাত বিষয়ে যেসব কুসংস্কার ও অবমাননাকর সামাজিক
ট্যাবু জড়িয়ে সেইসব দূর হবে। যেহেতু অবৈধ গর্ভপাতের কারণে প্রতিবছর প্রাণ হারাচ্ছে
ফরিদার মতো অসংখ্য নারী তাই মানবিকভাবেই এই সংক্রান্ত আইনের সংশোধন প্রয়োজন
শীঘ্রই।
No comments:
Post a Comment