নেইমপ্লেটের উপর বড় বড় হরফে লেখা:
ড. ভূতরাজ আঁহমেদাশশ্মান
স্থান: কবর বা শশ্মানের উত্তর কোণ।
এখানে পিচ্চি ভূত, ধামড়া ভূত- সব ভূতরোগের চিকিৎসা করা হয়।
এই নেইমপ্লেইট দেখে কার না আগ্রহ জন্মে! বলেন। আমি-ও দাদীজানের কাছ থেকে দাদার সাদা জোব্বাটা যোগাড় করে একটা ছদ্মবেশ নিয়ে পেললাম। চিকিৎসক ভূতলোক অনেক ভদ্র। নাকের উপর সর্ষফুলের চশমা আঁটা। বাঁ হাত দিয়ে টেবিলে অনবরত তবলা বাজানোর মতো শব্দ করে চলছেন।
যদি-ও আমার ভূতামি কোন রোগবালাই নেই, তবু-ও ভূতবিদ্যার প্রতি আগ্রহ থাকার কারণে তার আলয়ে যাওয়া। উদ্দেশ্য তার সাথে ভূতরাজ্য ও ভূতের নিয়ে একটু বুদ্ধিজীবিক বাতচিত করব!
বিসমিল্লাহ্ বলে শুরু করা যাক।
০
খামখেয়ালি বিদ্যুৎ চলে গেলে গল্পের আসর জমে; গ্রামে থাকলে উঠোনের দাওয়ায় কিংবা শহরে আমাদের বাসার খাবারঘরে। আমরা টগরা ছেলেমেয়েরা গোল টেবিলের আশপাশে উপনিবেশ অটুট করে বসতাম। রূপকথা বা গল্প বলার এই জীবনচর্চা আমার বরাবরই ভালো লাগে। জ্বি, জীবনচর্চা শব্দটা সজ্ঞানে ব্যবহার করা। মানুষ কথাঝুরি ও স্মৃতির জাবরকাটার মাধ্যমের বড় পরিসরে জীবনচর্চা করে।
তার কথাগুলো সাংসারিক বিষয়াশয় দিয়ে শুরু হয়, ক্রমেই অন্ধকার ঘনীভূত হওয়ার মতো সেসব প্রবাহিত হয় ভূতের গল্পের দিকে! ভূতের গল্প কিন্তু জীবন থেকে নেয়া।
একটু মুখবন্ধ লেখা যাক। গ্রামের বাড়িতে যাওয়া হতো প্রায় ছুটিতে। একান্নবর্তী বা বলে একশবর্তী-ও বলা চলে। আমার প্রপিতামহ থেকে শুরু করে সবার বাস্তুভিটে। বিশ্বায়ন ও নগরায়নের এই সময়ে অনেকে শহুরেফুল; তদাপি অনেকে তো এখনো ধানের গন্ধ ভালবাসে। বাড়ির সামনে ছোট দাদার গড়া দাতব্য চিকিৎসালয়, খামার বাড়ি, ইস্কুল, মক্তব, মাদ্রাসা ইত্যাদি। সেইসব স্থাপনার পিছনে সবুজ পাহারাদার- মানে গাছগাছালির সামন্তরাজ্য। সেই বনের মাঝে পারিবারিক কবরস্থান। ফলশ্রুতিতে, আকাশে চাঁদ না থাকলে, বিদ্যুৎমশাই বিয়াইবাড়িতে গেলে কিংবা জোনাকগুলো দেশান্তরী হলে পুরো এলাকাটা অদ্ভুত দেখায়। আমি নিজে-ও জায়গাটা দৌড়ে পার হই।
এতো গেলো গঠনের বর্ণনা। দাদার নাকি দু'টো বিড়াল ছিল যুবা বয়েসে; সে দু'টো নাকি ছ্দ্মবেশী জ্বীন! কিংবা আরেকটা গল্প বেশ সহজলভ্য- রাতে ইলিশমাছ ধুঁতে গেলে জলভূত মাছের ভিতরে ঢুকে যায়; ফলে ধৌতকারীর তীব্র জ্বর, অসুখ হয় ইত্যাদি।
এসব রূপকথার বা ভূতের গল্পে সৌন্দর্য থাকে, নিজস্ব আবেদন থাকে; নিজের যুক্তিটা সতেজ করে নেয়া যায় ভুল দেখিয়ে দিয়ে। একটা বিষয় চোখে পড়ে- ভূতবিদ্যার এসব গল্পে কিন্তু বাস্তববাদি উপদেশ থাকে। যেমন- বিড়াল, কুকুর ইত্যাদি উপকারী পশু, রাতে বাইরে থাকা উচিত না ইত্যাদি।
মানুষের এই গল্প বলা, অন্যভাবে বললে নিজের উপলব্দিকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দেয়া থেকেই সকল শিল্পের জন্ম; আমার মনে হয়। এই প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দেয়ার প্রক্রিয়া অন্য প্রাণীদের মাঝে-ও থাকে; মানবজাতির ক্ষেত্রে এটা ব্যাপক। এটা সম্ভবত প্রাকৃতিক, অর্থ্যাৎ সহজাত! মানুষের ডিএনএ'তে এসব ব্যাপার হয়ত রোপণ করা থাকে বংশানুক্রমে বিবর্তনে; মনে হয়।
১
এযুগে বিজ্ঞানভিত্তিক ভূতবাজি চলে; বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী, পরাবাস্তব কবিতা বা গল্পে যেসব দৃশ্য, বস্তু বা নিদেনপক্ষে প্রাণীর অবয়ব সৃষ্টি করা হয় তার সাথে প্রাগৈতিহাসিক ভূতবাজির মিল আছে। কিন্তু যুগের চাহিদা, সময়ের উপহারের কারণে গঠন ও দৃশ্যে এসবের-ও বিবর্তন হয়েছে। এসব ভাবনার যৌক্তিক কারণ দেয়া না গেলে-ও কারণ খোঁজা যেতে পারে। জ্ঞান বিকাশের প্রচলিত ধারাতো এমনই!
২
ভূত বা অশরীরী এগুলোর সাথে মানুষের অন্তর্নিহিত মানসিক অবস্থা, পরিবেশ ইত্যাদির সম্পর্কের কথাতো আমরা জানিই। ইদানীং একটা চিন্তা খেলছে মাথায়- এসব অতিপ্রাকৃতিক (ভ্রান্ত) বিষয়ের সাথে স্বপ্নের কি কোন যোগাযোগ আছে? ভূতের গল্প লেখা হয় নি। লেখা হলে বুঝতে পারতাম কেমন করে চিন্তাটা আসে। তবে ধারণা করছি- মানুষ যেমন স্মৃতিসমূহ সাজায়, চিন্তা করে তেমনি ভৌতিক জিনিসের অবতারণা করতে ভালবাসে। এটা হতে পারে লোকদৃষ্টি পাওয়ার আশায়, হতে পারে মানসিক দুর্বলতা ইত্যাদির কারণে। কেন যেন মনে হচ্ছে ভাষার অপভ্রংশের মতো চিন্তার অপভ্রংশই এসব রহস্য সাহিত্য বা ভৌতিক উপাদানের জনক।
৩
আমরা পরাবাস্তব সাজাই বাস্তবের বৈশিষ্ট্য, উপাদান, ধারণাকে এলেমেলোভাবে সাজিয়ে। যেমন ধরুন: আমি কবিতায় ব্যবহার করেছি 'মানানসই বিড়ালের ডানা।' বিড়াল কিংবা ডানা না দেখা হলে আমার লাইনটা লেখা হতো না! তবে মানুষ যেহেতু প্রাকৃতিকভাবে শৃঙ্খল বা সাজানো-গোছানো থাকতে চায়- পরাবাস্তব বর্ণনার ক্ষেত্রে-ও সে প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। পরাবাস্তব জগতের (ধরে নিচ্ছি এটি বিদ্যমান) সূত্রগুলো কি বাস্তব (পৃথিবীর জগতটাকেই বাস্তব জগত ধরে নেয়া যেতে পারে) জগতের মতো হবে? নাকি ঠিক উল্টো? কণা-প্রতিকণার মতো বাস্তব ও পরাবাস্তবের সাথে কোন সতীনপনা কিংবা ভাব থাকবে?
৪
রহস্য সাহিত্যে কুযুক্তি বা হেত্বাভাস বেশি হয়ে থাকে; অন্তত সাহিত্যের অন্য ধারাগুলোর থেকে। ত্রৈধবিন্দুতে যেমন জলের তিন অবস্থার দেখা যাওয়া যায় তেমনি মানুষের মনে কি এমন কোন ত্রৈধবিন্দু বিরাজমান যেটা যুক্তি, কুযুক্তি ও নিরপেক্ষ একটা ভাবের মতো? আমি সত্য বলি না, আমি মিথ্যা বলি না, আমি নিরপেক্ষ বলি না- এরকম তিনটি অবস্থা থাকতে পারে।
ভূত বলে পৃথিবীতে কিছু না থাকলে-ও এর রহস্য অনেক কিছুর দিকে ঠেলে দেয়। অনেক কিছু অস্তিত্ব খোঁজার দিকে।
৫
কই থেকে কই চলে গেলাম! ভূত দেখি এই লেখাতে ভর করল!
৬
ভূতের সাথে অদৃশ্য হওয়ার ব্যাপার জড়িত বৈকি। অদৃশ্য হতে পারার এই আদিম ইচ্ছেটা কি লেখক কৌশলে ভূতের গল্পে প্রকাশ করেন? মানুষের প্রাগহৈতিহাসিক ভয় হলো প্রকৃতি! হ্যাঁ, প্রকৃতির সকলধরনের ভয়কে জয় করে আয়ত্তে আনাই যেন আমাদের জ্ঞানের মূল উদ্দেশ্য। সে মোতাবেক বলা যেতে পারে, প্রকৃতির অজানা অংশকেই মানুষ হয়ত গল্পের ছলে তুলে ধরে। এবং ক্ষেত্রবিশেষে এই অজানাটুকু জানা হয়ে যায়! বিশ্বাস করলেন না? চলেন গ্রামের বাড়ির পুকুরে ডুব দিয়ে আসি, রাতের বেলা। আলেয়া দেখা যায়। পুকুরে আগুন জ্বলার মতো করে কী যেন জ্বলতে থাকে। এই জন্য গ্রামীণ প্রথা হলো গভীর রাতে মাছ ধোয়া উচিত না বা একা একা পুকুরপাড়ে বসা উচিত না। ওই আলেয়াটুকু মূলত কাঁদায় আটকানো মিথেন গ্যাস, গলিত-পচা গাছপালার অংশ, মাছের আঁশ ইত্যাদিতে বিদ্যমান ফসফরাসের কারণে সৃষ্ট। আমি নিজে একটা গল্প জানি। এই আলেয়াকে বলা হয় জলপরীর ধোঁয়া। মানে, জলপরী যখন গভীর দিঘীতে অদৃশ্য হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয় তখন মানুষের চোখে ধোঁকা দেয়ার জন্য এই আলেয়ার সৃষ্টি করে!
৭
ভূতনগরে অনেকে ন্যাংটো থাকে! সবাই ইচ্ছে মতো ভূতবাজি করে। সবচেয়ে মজার ভূতবাজি হলো মানুষকে নাজেহাল করা। যেসব পুরুষের চুল বড় বড় তাদের চুলে মেয়ে উঁকুনভূত বাসা বাঁধে। আর সারাদিন চুলকানোর অবস্থা সৃষ্টি করে। ফলে অস্বস্তি এড়াতে বোকা পুরুষগুলো চুল কেটে ফেলে! হা হা, হি হি। মেয়ে ভূতগুলো ভীষণ হিংসুটে, না হয় একটু খোলামেলা চুল রাখতে চাওয়া!
৮
লিঙ্গভেদে ভূতদের হাসির পার্থক্য আছে! পুরুষ ভূতবৃন্দ হোঁ হোঁ হোঁ করে হাসে, আর নারী ভূতরা হৈঁ হৈঁ হিঁহ হিঁহ করে!
জ্বি, এতদিন ভূল জানতেন। সেকি ঘাড় ফিরাবেন না; মামতো ভূত ঘাড় মড়কে দিবে কিন্তুক!
৯
মামতো ভূতের দুষ্টু ঝোলায় এখনো
ন্যাংটো ভূতের জামাকাপড় লুকানো
দুই ভূতে মিলে মনেচ্ছায় যেমনখুশি সাজি
সারাদিন পাড়ায়-বেপাড়ায় করে ভূতবাজি
পথ ভুলিয়ে কবরখানায় নিয়ে হালুমহলুম ভয় দেখানো
হোক তাদের নামে ভূতরাজের কাছে নালিশ জানানো
ভূতরাজের আবার উদাস মুখে কষ্ট মাখানো
মানুষ লেগেছে ভূতের পিছে চোখ ধাঁধানো
তার চেয়ে চলো আমরা যারা টুশকি-শিশুদল
ভূতের সাথে খেলাধুলায় শান্তি খুঁজি কেবল!
১০
তত্ত্বের আগে তত্ত্বের প্রয়োগ হয়, বা ঘটনার ব্যখ্যা দেয়ার জন্যই তত্ত্ব সৃষ্টি করা হয়। সাধারণত। অধিকাংশ বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব এভাবেই আবিষ্কৃত। যেমন ধরুন- আপেলের আকাশে উড়াল না দিয়ে মাটিতে পড়াকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নিউটন মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব আনলেন কিংবা নিউটনীয় বলবিদ্যা ও ম্যাক্সওয়েলের বিদ্যুৎচুম্বকীয় তত্ত্বের মাঝে সম্বন্বয় করতে গিয়েই আইনস্টাইন ফাঁদলেন যে আলোর গতি সর্বদাই সমান- যা আগে কেউ ভাবেন নি। ভূতবিদ্যা বা ভূতের গল্পে-ও একই রকম প্রয়োগ। পরাবাস্তব, কিংবা জাদুবাস্তব যাই বলুন না কেন সব পূর্বে উপস্থিত ছিল। অধিকাংশ সংস্কৃতি বা পরিমণ্ডলে বা পরিবেশে। সোনার কাঠি রূপার কাঠি মিলিয়ে রাজকন্যার ঘুম ভাঙানোকে মেলানো যায় জীবন ও মৃত্যুর মাঝে সূক্ষ্ম ব্যবধানটুকু বোঝার কল্পনার সাথে! মানে হলো, জীবন ও মৃত্যু বিষয়ক মানুষের এই ভাবনা প্রাগৈতিহাসিক। এটাকে কল্পনা ও সাহিত্যের সাথে মিলিয়ে পূর্বপুরুষরা এই রূপ দিয়েছেন। মনে হয়।
এই প্রবাহমান বিষয়গুলোর যৌক্তিক ব্যাখ্যার দেয়ার জন্য বা বিশদাকারে বোঝার জন্য পরাবাস্তব ও জাদুবাস্তব শব্দের ও তত্ত্বের প্রয়োগ হচ্ছে। ভূতের গল্পে বিষয়টা আরো প্রকট। মনোবিজ্ঞানের-ও সাহায্য চাওয়া যেতে পারে। জাদুটানা বা বাণটেনে (গ্রামাঞ্চলে তাবিজ করে মানুষ বধ করার ধারা এখনো প্রচলিত) বিষয়গুলো কিন্তু দু'টো দিকই উম্মোচন করে। শক্রুর শেষ রাখতে নেই বা শক্রুকে ঘায়েল করা উচিত; একই সাথে নিজের সহগোষ্ঠী বা সহভাবকদের মঙ্গলে রাখার চেষ্টা। মূলত, সেই প্রাচীন সময় থেকে মানুষ দ্বিব্যক্তিত্বের অধিকারী।
১১
ফরিদপুরের কাল্লোস মিয়া একদিন সাংঘাতিক সমস্যায় পড়লেন। তার বাসায় ভূতবাহিনী হানা দিল। রাতে তারা বারান্দার গ্রীল ধরে নাচানাচি করে- গান গায়; ঘুমন্ত লোকজনের পায়ের পাতায় সুড়সুড়ি দেয়! একটা বাচ্চা ভূত আছে; সবাই ডাকে দুধেলভূত। সে চুকচুক করে বিড়ালের লাহান দুধ খায় মিটসিফ খুলে; যদি-ও তার বিড়ালের মতো গোঁফ বা লেজ কোনটাই নেই।
কাল্লোস মিয়া মসজিদে ছুটলেন রবিবারের ছুটিতে। জোব্বা হজুরের কাছ থেকে পানি পড়া এনে ছড়িয়ে দিলেন বাড়ির চার সীমানায়।
না, কাজ হলো না। বরং, সাময়িক ক্যার্ফু জারীতে ভূতবাহিনী আরো অস্থির হয়ে উঠল। তারা কাপড় কাটতে লাগল। বাসিন্দাদের চুল ছিঁড়তে লাগল ঘুমের মাঝে। নিশু, কাল্লোস মিয়ার ছোট মেয়ে, একটা ছোট পুতুল পেয়েছিল গত ঈদে। নাগাভূত তার বাচ্চার জন্য সেটা চুরি করে নিয়ে গেল!
নিশু কাঁদছে তো কাঁদছেই।
কাল্লোল মিয়ার কিঞ্চিৎ সন্দেহ হলো যে জোব্বা হজুর পানিপড়া দেয়ার আগে অজু করেছিল কিনা! কাজ তো করে না!
পরেরদিন বিকালে অফিস থেকে এসে কড়া একটা ঘুম দিলেন। সন্ধ্যের দিকে পুরাতন বইপত্তুর ঘেটে ভূত তাড়ানোর কৌশল শিখে ফেললেন। কাঠকয়লা আর তুষ দিয়ে ধুপ বানিয়ে রাখতে হবে।
কিন্তু ভগবানবাম! দূষিত বাতাসে সবাই কমবেশি অসুস্থ হয়ে পড়ল।
সেদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে নিজে পরখ করলেন। যে গলিপথ দিয়ে আগে অফিসে যেতেন সেটা দিয়ে আর যান না; অফিস শেষে ঠিক ঠিক বাড়ি ফিরেন, বাসে হট্টগোল করেন না! মোড়ের কাছে পাড়াতো ছেলেমেয়েদের বকা দেন না।
দেখা গেলো, অতি আশ্চর্য; বাসায় ভূতের উপদ্রব শূন্যপ্রায়।
১২
রহস্যগল্প ভূতের গল্পের বর্ধিত, পরিশীলিত রূপ বলা চলে। ভূতের গল্পকে নিম্নবিত্ত গল্প ধরা হলে রহস্যগল্পকে মধ্যবিত্ত গল্প বলা চলে। মানুষ রহস্য ভালবাসে না, প্রকৃতি ভালবাসে।
মূলত প্রকৃতির গঠনই মানুষের কাছে রহস্য। তেমনি ভূতের গল্পের অসংযমতায় এর আকর্ষণ।
আবেগ নৈতিকতা বা যুক্তির ভিত্তি না হলে-ও, ভূতের গল্পে আবেগের খেলা অধিনায়কের মতোই বড়ো। শিল্প হলো মানুষের আবেগ বা অনুভূতি নিয়ে খেলা করা। কেউ সুশৃঙ্খলভাবে করেন, কেউ ইচ্ছেমতন।
১৩
পূর্বে বাঙালির সাহিত্যপ্রেম ছিল ভাতের সাথে সম্পর্কযুক্ত! এখনো। বাঙালি ভাতঘুমের আগে বই পড়ত- বই মানে গল্পের বই। ভূতরা যখন হানা দিল গল্পে তখন বাঙালি সবজায়গায় ভূত দেখতে শুরু করল। ইস্কুলে, পাঠশালায়, অফিসে, বাসের কোণায়, পুকুরধারে, রাস্তার পাশে- সর্বত্র। বাঙালির এই ভূতপ্রীতির কারণে যৌক্তিক মানুষ হতে সময় লাগে বেশি। কিন্তু আশা কথা হলো ভূতের গল্পের বদৌলতে বাঙালি বেশ কল্পনাপ্রবণ। এক চামচ বেশি বুঝে!
১৪
সবচেয়ে বড় ভূত হলো ঈশ্বর! কিংবা জটিল রূপকথা। আর ভূতের গল্প যেমন লোকমুখে ডালপালা গজায় তেমনি ঈশ্বরের সম্বন্ধীয় চিন্তাগুলো সময়ের সাথে সাথে সাম্রাজ্যবিস্তার করে। মাঝে মাঝে ঠেঁক না দিলে বিপদের আশংকা থাকে।
১৫
ইলাস্টিক টানলে বড় হয়, তারপর ঘচাং করে ছিঁড়ে যায়। ভূতের গল্প টানলে মেদবহুল হয়, তারপর আস্তাকুঁড়ের মালে পরিণত হয়।
সে বিচারে ভূতবাজি এখানে সমাপ্ত করা হলো!
৬/১/২০১০
ড. ভূতরাজ আঁহমেদাশশ্মান
স্থান: কবর বা শশ্মানের উত্তর কোণ।
এখানে পিচ্চি ভূত, ধামড়া ভূত- সব ভূতরোগের চিকিৎসা করা হয়।
এই নেইমপ্লেইট দেখে কার না আগ্রহ জন্মে! বলেন। আমি-ও দাদীজানের কাছ থেকে দাদার সাদা জোব্বাটা যোগাড় করে একটা ছদ্মবেশ নিয়ে পেললাম। চিকিৎসক ভূতলোক অনেক ভদ্র। নাকের উপর সর্ষফুলের চশমা আঁটা। বাঁ হাত দিয়ে টেবিলে অনবরত তবলা বাজানোর মতো শব্দ করে চলছেন।
যদি-ও আমার ভূতামি কোন রোগবালাই নেই, তবু-ও ভূতবিদ্যার প্রতি আগ্রহ থাকার কারণে তার আলয়ে যাওয়া। উদ্দেশ্য তার সাথে ভূতরাজ্য ও ভূতের নিয়ে একটু বুদ্ধিজীবিক বাতচিত করব!
বিসমিল্লাহ্ বলে শুরু করা যাক।
০
খামখেয়ালি বিদ্যুৎ চলে গেলে গল্পের আসর জমে; গ্রামে থাকলে উঠোনের দাওয়ায় কিংবা শহরে আমাদের বাসার খাবারঘরে। আমরা টগরা ছেলেমেয়েরা গোল টেবিলের আশপাশে উপনিবেশ অটুট করে বসতাম। রূপকথা বা গল্প বলার এই জীবনচর্চা আমার বরাবরই ভালো লাগে। জ্বি, জীবনচর্চা শব্দটা সজ্ঞানে ব্যবহার করা। মানুষ কথাঝুরি ও স্মৃতির জাবরকাটার মাধ্যমের বড় পরিসরে জীবনচর্চা করে।
তার কথাগুলো সাংসারিক বিষয়াশয় দিয়ে শুরু হয়, ক্রমেই অন্ধকার ঘনীভূত হওয়ার মতো সেসব প্রবাহিত হয় ভূতের গল্পের দিকে! ভূতের গল্প কিন্তু জীবন থেকে নেয়া।
একটু মুখবন্ধ লেখা যাক। গ্রামের বাড়িতে যাওয়া হতো প্রায় ছুটিতে। একান্নবর্তী বা বলে একশবর্তী-ও বলা চলে। আমার প্রপিতামহ থেকে শুরু করে সবার বাস্তুভিটে। বিশ্বায়ন ও নগরায়নের এই সময়ে অনেকে শহুরেফুল; তদাপি অনেকে তো এখনো ধানের গন্ধ ভালবাসে। বাড়ির সামনে ছোট দাদার গড়া দাতব্য চিকিৎসালয়, খামার বাড়ি, ইস্কুল, মক্তব, মাদ্রাসা ইত্যাদি। সেইসব স্থাপনার পিছনে সবুজ পাহারাদার- মানে গাছগাছালির সামন্তরাজ্য। সেই বনের মাঝে পারিবারিক কবরস্থান। ফলশ্রুতিতে, আকাশে চাঁদ না থাকলে, বিদ্যুৎমশাই বিয়াইবাড়িতে গেলে কিংবা জোনাকগুলো দেশান্তরী হলে পুরো এলাকাটা অদ্ভুত দেখায়। আমি নিজে-ও জায়গাটা দৌড়ে পার হই।
এতো গেলো গঠনের বর্ণনা। দাদার নাকি দু'টো বিড়াল ছিল যুবা বয়েসে; সে দু'টো নাকি ছ্দ্মবেশী জ্বীন! কিংবা আরেকটা গল্প বেশ সহজলভ্য- রাতে ইলিশমাছ ধুঁতে গেলে জলভূত মাছের ভিতরে ঢুকে যায়; ফলে ধৌতকারীর তীব্র জ্বর, অসুখ হয় ইত্যাদি।
এসব রূপকথার বা ভূতের গল্পে সৌন্দর্য থাকে, নিজস্ব আবেদন থাকে; নিজের যুক্তিটা সতেজ করে নেয়া যায় ভুল দেখিয়ে দিয়ে। একটা বিষয় চোখে পড়ে- ভূতবিদ্যার এসব গল্পে কিন্তু বাস্তববাদি উপদেশ থাকে। যেমন- বিড়াল, কুকুর ইত্যাদি উপকারী পশু, রাতে বাইরে থাকা উচিত না ইত্যাদি।
মানুষের এই গল্প বলা, অন্যভাবে বললে নিজের উপলব্দিকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দেয়া থেকেই সকল শিল্পের জন্ম; আমার মনে হয়। এই প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দেয়ার প্রক্রিয়া অন্য প্রাণীদের মাঝে-ও থাকে; মানবজাতির ক্ষেত্রে এটা ব্যাপক। এটা সম্ভবত প্রাকৃতিক, অর্থ্যাৎ সহজাত! মানুষের ডিএনএ'তে এসব ব্যাপার হয়ত রোপণ করা থাকে বংশানুক্রমে বিবর্তনে; মনে হয়।
১
এযুগে বিজ্ঞানভিত্তিক ভূতবাজি চলে; বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী, পরাবাস্তব কবিতা বা গল্পে যেসব দৃশ্য, বস্তু বা নিদেনপক্ষে প্রাণীর অবয়ব সৃষ্টি করা হয় তার সাথে প্রাগৈতিহাসিক ভূতবাজির মিল আছে। কিন্তু যুগের চাহিদা, সময়ের উপহারের কারণে গঠন ও দৃশ্যে এসবের-ও বিবর্তন হয়েছে। এসব ভাবনার যৌক্তিক কারণ দেয়া না গেলে-ও কারণ খোঁজা যেতে পারে। জ্ঞান বিকাশের প্রচলিত ধারাতো এমনই!
২
ভূত বা অশরীরী এগুলোর সাথে মানুষের অন্তর্নিহিত মানসিক অবস্থা, পরিবেশ ইত্যাদির সম্পর্কের কথাতো আমরা জানিই। ইদানীং একটা চিন্তা খেলছে মাথায়- এসব অতিপ্রাকৃতিক (ভ্রান্ত) বিষয়ের সাথে স্বপ্নের কি কোন যোগাযোগ আছে? ভূতের গল্প লেখা হয় নি। লেখা হলে বুঝতে পারতাম কেমন করে চিন্তাটা আসে। তবে ধারণা করছি- মানুষ যেমন স্মৃতিসমূহ সাজায়, চিন্তা করে তেমনি ভৌতিক জিনিসের অবতারণা করতে ভালবাসে। এটা হতে পারে লোকদৃষ্টি পাওয়ার আশায়, হতে পারে মানসিক দুর্বলতা ইত্যাদির কারণে। কেন যেন মনে হচ্ছে ভাষার অপভ্রংশের মতো চিন্তার অপভ্রংশই এসব রহস্য সাহিত্য বা ভৌতিক উপাদানের জনক।
৩
আমরা পরাবাস্তব সাজাই বাস্তবের বৈশিষ্ট্য, উপাদান, ধারণাকে এলেমেলোভাবে সাজিয়ে। যেমন ধরুন: আমি কবিতায় ব্যবহার করেছি 'মানানসই বিড়ালের ডানা।' বিড়াল কিংবা ডানা না দেখা হলে আমার লাইনটা লেখা হতো না! তবে মানুষ যেহেতু প্রাকৃতিকভাবে শৃঙ্খল বা সাজানো-গোছানো থাকতে চায়- পরাবাস্তব বর্ণনার ক্ষেত্রে-ও সে প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। পরাবাস্তব জগতের (ধরে নিচ্ছি এটি বিদ্যমান) সূত্রগুলো কি বাস্তব (পৃথিবীর জগতটাকেই বাস্তব জগত ধরে নেয়া যেতে পারে) জগতের মতো হবে? নাকি ঠিক উল্টো? কণা-প্রতিকণার মতো বাস্তব ও পরাবাস্তবের সাথে কোন সতীনপনা কিংবা ভাব থাকবে?
৪
রহস্য সাহিত্যে কুযুক্তি বা হেত্বাভাস বেশি হয়ে থাকে; অন্তত সাহিত্যের অন্য ধারাগুলোর থেকে। ত্রৈধবিন্দুতে যেমন জলের তিন অবস্থার দেখা যাওয়া যায় তেমনি মানুষের মনে কি এমন কোন ত্রৈধবিন্দু বিরাজমান যেটা যুক্তি, কুযুক্তি ও নিরপেক্ষ একটা ভাবের মতো? আমি সত্য বলি না, আমি মিথ্যা বলি না, আমি নিরপেক্ষ বলি না- এরকম তিনটি অবস্থা থাকতে পারে।
ভূত বলে পৃথিবীতে কিছু না থাকলে-ও এর রহস্য অনেক কিছুর দিকে ঠেলে দেয়। অনেক কিছু অস্তিত্ব খোঁজার দিকে।
৫
কই থেকে কই চলে গেলাম! ভূত দেখি এই লেখাতে ভর করল!
৬
ভূতের সাথে অদৃশ্য হওয়ার ব্যাপার জড়িত বৈকি। অদৃশ্য হতে পারার এই আদিম ইচ্ছেটা কি লেখক কৌশলে ভূতের গল্পে প্রকাশ করেন? মানুষের প্রাগহৈতিহাসিক ভয় হলো প্রকৃতি! হ্যাঁ, প্রকৃতির সকলধরনের ভয়কে জয় করে আয়ত্তে আনাই যেন আমাদের জ্ঞানের মূল উদ্দেশ্য। সে মোতাবেক বলা যেতে পারে, প্রকৃতির অজানা অংশকেই মানুষ হয়ত গল্পের ছলে তুলে ধরে। এবং ক্ষেত্রবিশেষে এই অজানাটুকু জানা হয়ে যায়! বিশ্বাস করলেন না? চলেন গ্রামের বাড়ির পুকুরে ডুব দিয়ে আসি, রাতের বেলা। আলেয়া দেখা যায়। পুকুরে আগুন জ্বলার মতো করে কী যেন জ্বলতে থাকে। এই জন্য গ্রামীণ প্রথা হলো গভীর রাতে মাছ ধোয়া উচিত না বা একা একা পুকুরপাড়ে বসা উচিত না। ওই আলেয়াটুকু মূলত কাঁদায় আটকানো মিথেন গ্যাস, গলিত-পচা গাছপালার অংশ, মাছের আঁশ ইত্যাদিতে বিদ্যমান ফসফরাসের কারণে সৃষ্ট। আমি নিজে একটা গল্প জানি। এই আলেয়াকে বলা হয় জলপরীর ধোঁয়া। মানে, জলপরী যখন গভীর দিঘীতে অদৃশ্য হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয় তখন মানুষের চোখে ধোঁকা দেয়ার জন্য এই আলেয়ার সৃষ্টি করে!
৭
ভূতনগরে অনেকে ন্যাংটো থাকে! সবাই ইচ্ছে মতো ভূতবাজি করে। সবচেয়ে মজার ভূতবাজি হলো মানুষকে নাজেহাল করা। যেসব পুরুষের চুল বড় বড় তাদের চুলে মেয়ে উঁকুনভূত বাসা বাঁধে। আর সারাদিন চুলকানোর অবস্থা সৃষ্টি করে। ফলে অস্বস্তি এড়াতে বোকা পুরুষগুলো চুল কেটে ফেলে! হা হা, হি হি। মেয়ে ভূতগুলো ভীষণ হিংসুটে, না হয় একটু খোলামেলা চুল রাখতে চাওয়া!
৮
লিঙ্গভেদে ভূতদের হাসির পার্থক্য আছে! পুরুষ ভূতবৃন্দ হোঁ হোঁ হোঁ করে হাসে, আর নারী ভূতরা হৈঁ হৈঁ হিঁহ হিঁহ করে!
জ্বি, এতদিন ভূল জানতেন। সেকি ঘাড় ফিরাবেন না; মামতো ভূত ঘাড় মড়কে দিবে কিন্তুক!
৯
মামতো ভূতের দুষ্টু ঝোলায় এখনো
ন্যাংটো ভূতের জামাকাপড় লুকানো
দুই ভূতে মিলে মনেচ্ছায় যেমনখুশি সাজি
সারাদিন পাড়ায়-বেপাড়ায় করে ভূতবাজি
পথ ভুলিয়ে কবরখানায় নিয়ে হালুমহলুম ভয় দেখানো
হোক তাদের নামে ভূতরাজের কাছে নালিশ জানানো
ভূতরাজের আবার উদাস মুখে কষ্ট মাখানো
মানুষ লেগেছে ভূতের পিছে চোখ ধাঁধানো
তার চেয়ে চলো আমরা যারা টুশকি-শিশুদল
ভূতের সাথে খেলাধুলায় শান্তি খুঁজি কেবল!
১০
তত্ত্বের আগে তত্ত্বের প্রয়োগ হয়, বা ঘটনার ব্যখ্যা দেয়ার জন্যই তত্ত্ব সৃষ্টি করা হয়। সাধারণত। অধিকাংশ বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব এভাবেই আবিষ্কৃত। যেমন ধরুন- আপেলের আকাশে উড়াল না দিয়ে মাটিতে পড়াকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নিউটন মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব আনলেন কিংবা নিউটনীয় বলবিদ্যা ও ম্যাক্সওয়েলের বিদ্যুৎচুম্বকীয় তত্ত্বের মাঝে সম্বন্বয় করতে গিয়েই আইনস্টাইন ফাঁদলেন যে আলোর গতি সর্বদাই সমান- যা আগে কেউ ভাবেন নি। ভূতবিদ্যা বা ভূতের গল্পে-ও একই রকম প্রয়োগ। পরাবাস্তব, কিংবা জাদুবাস্তব যাই বলুন না কেন সব পূর্বে উপস্থিত ছিল। অধিকাংশ সংস্কৃতি বা পরিমণ্ডলে বা পরিবেশে। সোনার কাঠি রূপার কাঠি মিলিয়ে রাজকন্যার ঘুম ভাঙানোকে মেলানো যায় জীবন ও মৃত্যুর মাঝে সূক্ষ্ম ব্যবধানটুকু বোঝার কল্পনার সাথে! মানে হলো, জীবন ও মৃত্যু বিষয়ক মানুষের এই ভাবনা প্রাগৈতিহাসিক। এটাকে কল্পনা ও সাহিত্যের সাথে মিলিয়ে পূর্বপুরুষরা এই রূপ দিয়েছেন। মনে হয়।
এই প্রবাহমান বিষয়গুলোর যৌক্তিক ব্যাখ্যার দেয়ার জন্য বা বিশদাকারে বোঝার জন্য পরাবাস্তব ও জাদুবাস্তব শব্দের ও তত্ত্বের প্রয়োগ হচ্ছে। ভূতের গল্পে বিষয়টা আরো প্রকট। মনোবিজ্ঞানের-ও সাহায্য চাওয়া যেতে পারে। জাদুটানা বা বাণটেনে (গ্রামাঞ্চলে তাবিজ করে মানুষ বধ করার ধারা এখনো প্রচলিত) বিষয়গুলো কিন্তু দু'টো দিকই উম্মোচন করে। শক্রুর শেষ রাখতে নেই বা শক্রুকে ঘায়েল করা উচিত; একই সাথে নিজের সহগোষ্ঠী বা সহভাবকদের মঙ্গলে রাখার চেষ্টা। মূলত, সেই প্রাচীন সময় থেকে মানুষ দ্বিব্যক্তিত্বের অধিকারী।
১১
ফরিদপুরের কাল্লোস মিয়া একদিন সাংঘাতিক সমস্যায় পড়লেন। তার বাসায় ভূতবাহিনী হানা দিল। রাতে তারা বারান্দার গ্রীল ধরে নাচানাচি করে- গান গায়; ঘুমন্ত লোকজনের পায়ের পাতায় সুড়সুড়ি দেয়! একটা বাচ্চা ভূত আছে; সবাই ডাকে দুধেলভূত। সে চুকচুক করে বিড়ালের লাহান দুধ খায় মিটসিফ খুলে; যদি-ও তার বিড়ালের মতো গোঁফ বা লেজ কোনটাই নেই।
কাল্লোস মিয়া মসজিদে ছুটলেন রবিবারের ছুটিতে। জোব্বা হজুরের কাছ থেকে পানি পড়া এনে ছড়িয়ে দিলেন বাড়ির চার সীমানায়।
না, কাজ হলো না। বরং, সাময়িক ক্যার্ফু জারীতে ভূতবাহিনী আরো অস্থির হয়ে উঠল। তারা কাপড় কাটতে লাগল। বাসিন্দাদের চুল ছিঁড়তে লাগল ঘুমের মাঝে। নিশু, কাল্লোস মিয়ার ছোট মেয়ে, একটা ছোট পুতুল পেয়েছিল গত ঈদে। নাগাভূত তার বাচ্চার জন্য সেটা চুরি করে নিয়ে গেল!
নিশু কাঁদছে তো কাঁদছেই।
কাল্লোল মিয়ার কিঞ্চিৎ সন্দেহ হলো যে জোব্বা হজুর পানিপড়া দেয়ার আগে অজু করেছিল কিনা! কাজ তো করে না!
পরেরদিন বিকালে অফিস থেকে এসে কড়া একটা ঘুম দিলেন। সন্ধ্যের দিকে পুরাতন বইপত্তুর ঘেটে ভূত তাড়ানোর কৌশল শিখে ফেললেন। কাঠকয়লা আর তুষ দিয়ে ধুপ বানিয়ে রাখতে হবে।
কিন্তু ভগবানবাম! দূষিত বাতাসে সবাই কমবেশি অসুস্থ হয়ে পড়ল।
সেদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে নিজে পরখ করলেন। যে গলিপথ দিয়ে আগে অফিসে যেতেন সেটা দিয়ে আর যান না; অফিস শেষে ঠিক ঠিক বাড়ি ফিরেন, বাসে হট্টগোল করেন না! মোড়ের কাছে পাড়াতো ছেলেমেয়েদের বকা দেন না।
দেখা গেলো, অতি আশ্চর্য; বাসায় ভূতের উপদ্রব শূন্যপ্রায়।
১২
রহস্যগল্প ভূতের গল্পের বর্ধিত, পরিশীলিত রূপ বলা চলে। ভূতের গল্পকে নিম্নবিত্ত গল্প ধরা হলে রহস্যগল্পকে মধ্যবিত্ত গল্প বলা চলে। মানুষ রহস্য ভালবাসে না, প্রকৃতি ভালবাসে।
মূলত প্রকৃতির গঠনই মানুষের কাছে রহস্য। তেমনি ভূতের গল্পের অসংযমতায় এর আকর্ষণ।
আবেগ নৈতিকতা বা যুক্তির ভিত্তি না হলে-ও, ভূতের গল্পে আবেগের খেলা অধিনায়কের মতোই বড়ো। শিল্প হলো মানুষের আবেগ বা অনুভূতি নিয়ে খেলা করা। কেউ সুশৃঙ্খলভাবে করেন, কেউ ইচ্ছেমতন।
১৩
পূর্বে বাঙালির সাহিত্যপ্রেম ছিল ভাতের সাথে সম্পর্কযুক্ত! এখনো। বাঙালি ভাতঘুমের আগে বই পড়ত- বই মানে গল্পের বই। ভূতরা যখন হানা দিল গল্পে তখন বাঙালি সবজায়গায় ভূত দেখতে শুরু করল। ইস্কুলে, পাঠশালায়, অফিসে, বাসের কোণায়, পুকুরধারে, রাস্তার পাশে- সর্বত্র। বাঙালির এই ভূতপ্রীতির কারণে যৌক্তিক মানুষ হতে সময় লাগে বেশি। কিন্তু আশা কথা হলো ভূতের গল্পের বদৌলতে বাঙালি বেশ কল্পনাপ্রবণ। এক চামচ বেশি বুঝে!
১৪
সবচেয়ে বড় ভূত হলো ঈশ্বর! কিংবা জটিল রূপকথা। আর ভূতের গল্প যেমন লোকমুখে ডালপালা গজায় তেমনি ঈশ্বরের সম্বন্ধীয় চিন্তাগুলো সময়ের সাথে সাথে সাম্রাজ্যবিস্তার করে। মাঝে মাঝে ঠেঁক না দিলে বিপদের আশংকা থাকে।
১৫
ইলাস্টিক টানলে বড় হয়, তারপর ঘচাং করে ছিঁড়ে যায়। ভূতের গল্প টানলে মেদবহুল হয়, তারপর আস্তাকুঁড়ের মালে পরিণত হয়।
সে বিচারে ভূতবাজি এখানে সমাপ্ত করা হলো!
৬/১/২০১০
No comments:
Post a Comment