১
ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় আইসিস ও জিহাদিদের দ্বারা
ফ্রান্স আক্রান্ত হচ্ছে বার বার, ফ্রান্সের সরকারি তথ্যানুসারে প্রায় ১০০০ জনের-ও
অধিক নাগরিক ও অভিবাসী ফ্রান্স থেকে আইসিস ও ইরাক এবং সিরিয়াতে বিভিন্ন জিহাদি
সংগঠনে যোগ দিয়েছে, প্যারিস বোমা হামলায় আক্রান্ত হল কয়েকবার, Charlie Hebdo সাময়িকীটির
সাথে জড়িতরা নিহত হলো, কিছুদিন আগে এক রিফুজি ট্রাক চালিয়ে হত্যা করলো ৮৪ জনকে এবং
আহত করলো শত জনের উপরে। আইসিস ও আইসিস-সমর্থক জিহাদি সংগঠনগুলো যার দায়স্বীকার
করেছে। যেনো ফ্রান্সই আইসিসের আক্রমণের শ্রেষ্ঠ স্থান, কিন্তু কেনো? কেনো বারবার
ফ্রান্স আক্রান্ত হচ্ছে? আইসিসের সাম্প্রতিককালে বাঙলাদেশে তৎপরতার সাথে এর কী বা
সম্পর্ক?
২
নৃবিজ্ঞানি জন বোয়েন (John R. Bowen) এর মতে মূলত
তিনটি প্রধান কারণে ফ্রান্স বারবার উগ্রপন্থিদের দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে। প্রথমত,
ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলোর তুলনায় ফ্রান্সের সাথে ইসলামিক দেশগুলোর সাপে-নেউলে
সম্পর্ক অনেক কাল আগ থেকেই। ইউরোপের অনেক দেশই (যেমন, ব্রিটেন, স্পেন, পর্তুগাল
ইত্যাদি) সাম্রাজ্যবাদী, তবে সেইসব দেশের তুলনায় ফ্রান্স বরাবরই ইসলামিক দেশগুলোকে
আক্রমণ করেছে এবং তাদের উপনিবেশে পরিণত করেছে। যেমন, ১৮৩০ সাল থেকে ফ্রান্স ক্রমে
দখল করে নিয়েছিলো আলজেরিয়া, আফ্রিকার ইসলামিক দেশগুলো, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে
সিরিয়া ও লেবাননকে হস্তগত করলো, এভাবে ক্রমে ফ্রান্স বিভিন্ন ইসলামিক দেশগুলোকে
দখল করে; ফলে এইসব দেশে ফরাসীরা যেমন ঘাঁটি বাঁধে (যেমন, ভারতীয় উপমহাদেশে ইংরেজরা
এসে থাকলো, ব্যবসা করলো, লুটপাত করলো, দেশীয় নারীদের সাথে মিলিত হলো) তেমনি তাদের
বংশবিস্তার করে, এবং একই সাথে বিভিন্ন উপনিবেশ থেকে গরিব অসহায় লোকরা মূল ফ্রান্স
ভূখণ্ডে আসে কাজের আশায় (ঠিক যেমন, বিলেতে ভারতীয় উপমহাদেশের লোকেরা যেতে শুরু করে
এবং সেখানে স্থায়ী হতে চেষ্টা করে)। অর্থাৎ, ফ্রান্সে ইসলামিক আদর্শে বিশ্বাসীদের
সংখ্যা বাড়তে থাকে, এছাড়া উপনিবেশের কারণে সেখানকার লোকজন ফরাসী ভাষা শিখতে শুরু
করে এবং ফ্রান্স-ও ভাষিক সুবিধার জন্য ফরাসী ভাষী লোকদের অগ্রাধিকার দেয়, ফলে অনেক
ইসলামিক দেশ থেকে অভিবাসীরা ফ্রান্সে ঢোকার সুযোগ পায়। যদিও ১৯৫৪ থেকে ১৯৬২
পর্যন্ত রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পরে ফ্রান্স আলজেরিয়া “ছাড়ে”, তারপর-ও
ফ্রান্স কখনোই পুরোপুরিভাবে তাদের উপনিবেশগুলো থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয় নি কখনো,
যেমন, ব্রিটেন ভারত ও পাকিস্তানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরে সেই দেশগুলো
স্বাধীন দেশ হিসেবে কাজ করে, কিন্তু ফ্রান্সের উপনিবেশগুলোতে এখনো ফ্রান্স সামরিক
ও অর্থনৈতিক হস্তক্ষেপ করে, যেমন, ফ্রান্স মালিতে আল-কায়েদা হামলা চালালে পাল্টা
সামরিক হামলা চালায়, পূর্ব আফ্রিকার ফ্রান্সের উপনেবিশগুলোতে নিজেদের স্বার্থের
(যেমন, খনিজ আহরণ) জন্য সামরিক পদক্ষেপ নেয় এখনো। ফলে এইসব দেশের লোকজনের মনে
ক্ষোভ ও রাগ রয়ে গেছে সেই অনেককাল আগ থেকে। সাথে ফ্রান্স ২০০৫ সালে পুরোপুরি মুখ
ঢেকে পরা হিজাব নিষিদ্ধ করে, ফলে সেখানে বসবাসরত ইসলামি বিশ্বাসীরা তাদের ধর্মের
প্রতি আঘাত হিসেবে দেখে, ফলে ঘরে ও বাইরে ইসলামি বিশ্বাসীদের কাছে ফ্রান্স ক্ষোভ ও
রাগের কেন্দ্র।
যদিও ফ্রান্স বর্তমানে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ, কিন্তু ক্যাথলিক
চার্চ দীর্ঘদিন ধরে ফ্রান্সের লোকদের (বিশেষ করে গরিব কৃষিজীবি ও নিম্ন আয়ের
লোকদের উপর) নানাভাবে শোষণ করে (বিভিন্ন ধর্মীয় কর দিয়ে, ধর্মের নামে হত্যা ও
ক্ষমতায়নের মাধ্যমে)। ফলে ফরাসীদের মাঝে ধর্ম নিয়ে আক্ষেপ ও বাজে অভিজ্ঞতা আছে,
তাই তারা রাষ্ট্রব্যবস্থা ও ধর্মব্যবস্থা পৃথক করার যখনই সুযোগ পেয়েছে তখনই করেছে,
এবং এটি তাদের উন্নতির জন্য সহায়ক-ও ছিলো, যেহেতু মুক্তমত ও সংস্কৃতি সুযোগ হয়েছে।
কিন্তু থেকে থেকে ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসীদের মাঝে ক্ষমতা ও প্রভাব
বিস্তারের প্রয়াস ছিলো সবসময়ই। ফলে আধুনিক ফ্রান্স মিডিয়ার অবাধ স্বাধীনতায়
বিশ্বাসী, এই কারণে চার্লি হেবদো শুধুমাত্র ইসলামিক নয় বরং খ্রিস্ট ধর্মীয়, এমনকি
মাইকেল জ্যাকসনকে নিয়ে-ও ব্যঙ্গাত্মক কার্টুন এঁকেছিলো, কিন্তু ইসলামিক মতবাদে
বিশ্বাসীদের জন্য তা ছিলো অনেক বেশি কিছু, তাই ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ফলে আইসিস ও
অন্যান্য জিহাদি লোকেরা এই ক্ষোভ ও রাগকে নিজেদের উদ্দেশ্য ব্যবহার করার জন্য যুবক
ও কিশোরদের উগ্রপন্থী বানাতে শুরু করে তখন অনুসারী ঠিকই পাওয়া যায়।
অন্যদিকে, বারবার হামলার কারণে ফ্রান্সে-ও ইসলামিক মতবাদে
বিশ্বাসীদের প্রতি জন্মাচ্ছে ঘৃণা ও বর্ণবাদের, যেহেতু ডানপন্থীরা মনে করছে
ফ্রান্সের আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ নীতির সাথে ইসলামিক মতবাদ, বিশেষ করে জিহাদি মতবাদের
একটু মিলে না, ফলে ডানপন্থীরা-ও এই সুযোগে ঘৃণা ও বর্ণবাদের বিস্তার ঘটাচ্ছে। ফলে
এক দল (ইসলামিক মতবাদে বিশ্বাসীরা) অন্য দলকে (মূল ধর্মনিরপেক্ষ ফরাসী জনগণ)
দোষারোপ করছে এবং পরষ্পরকে শক্রু হিসেবে চিহ্নিত করছে। আইসিস ও জিহাদি দলগুলো এই
বিভক্তিকে ব্যবহার করে তাদের মতবাদ ছড়িয়ে দিচ্ছে, উগ্রপন্থী বানাচ্ছে ক্ষোভ ও রাগী
তরুণদের। এবং ঘরের শক্রু বিভীষণের মতো ফ্রান্স আক্রান্ত হচ্ছে বারবার অভিবাসী ও নিজস্ব
বাসিন্দাদের দ্বারা, যারা আইসিস ও জিহাদি দলগুলো দ্বারা প্রভাবিত।
৩
কিন্তু আইসিস বাঙলাদেশে আগ্রহী কেনো সেই প্রশ্নের উত্তর
ফ্রান্সের অবস্থার উদাহরণে আছে। আইসিস ইরাক ও সিরিয়ার বিভিন্ন অংশ দখল করলে-ও
ইদানীং রাশিয়া (তারা চাচ্ছে আসাদকে ক্ষমতায় রাখতে বা সহযোগিতা করতে, যেহেতু আসাদ
রাশিয়ার ভালো বন্ধু ও অই অঞ্চলে রাশিয়ার স্বার্থ ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও প্রভাব
বিস্তারে অনুঘটক ও সাহায্যকারী হিসেবে ভবিষ্যতে কাজে দিবে) ও ফ্রান্সের (ফ্রান্স
নিজেদের বাঁচাতে আইসিসের সমাপ্তি চায়) আক্রমণে এবং সিরিয়া ও ইরাকের জনগণ (আইসিস
কখনোই বৃহত্তর জনমত পায় নি অই দুটি দেশে) ও বাহিনির কাছে ক্রমশ দখলকৃত জায়গাগুলো
হারাচ্ছে। অর্থাৎ, আইসিস ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। তাই আইসিস চায় দুটো জিনিস,
অন্যত্র ঘাঁটি স্থাপন কিংবা আশ্রয় পাওয়া, এবং সাপের শেষ মরণছোবলের মতো বিভিন্ন
স্থানে সন্ত্রাসবাদী হামলার মাধ্যমে আইসিস ত্রাসের সৃষ্টি করছে। যেমন, পাকিস্তানি
সেনাবাহিনি ও দোসর রাজাকাররা যেমন ১৯৭১ এ হেরে যাচ্ছে জেনে আমাদের বুদ্ধিজীবিদের
হত্যার মাধ্যমে ত্রাসের সৃষ্টি করতে ও আমাদের মেধাহীন করতে চেয়েছে তেমনি আইসিস
ত্রাসের সৃষ্টি করছে ইউরোপ জুড়ে (বেলজিয়াম ও ফ্রান্সে হামলা) ও অন্যত্র। যেহেতু
বাঙলাদেশে কিছু লোকের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন রয়েছে আইসিস ও জিহাদি সংগঠনগুলোর
প্রতি এবং বাঙলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে সরকারি ও বিরোধীদলের মাঝে
তাই মতবাদ বিস্তার ও রাজনৈতিক সুযোগের ব্যবহার করে বাঙলাদেশে অস্তিস্ত্ব জানান
দিচ্ছে আইসিস। অর্থাৎ, ফ্রান্সের মতো বাঙলাদেশে-ও স্থানীয় লোকদের মাধ্যমে আইসিস ও
জিহাদি লোকগুলো প্রভাব বিস্তার করছে। বাঙলাদেশ সরকার বারবার ভুল করছে আইসিস ও উগ্রপন্থীদের
অস্বীকার করে। সমস্যা সমাধানের প্রথম ধাপ সমস্যা চিহ্নিতকরণ, ও দ্রুত পদক্ষেপ
নেয়া, এবং বাঙলাদেশ সরকার এইকাজে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে আসছে বরাবরই।
৪
ফ্রান্স আইসিসের আক্রমণে তাদের দশকের পর দশকের
পররাষ্ট্রনীতি কিংবা অভ্যন্তরীণ ধর্মনিরপেক্ষতা পাল্টাবে না, তেমনি বন্ধ করবে না
ব্যঙ্গাত্মক মতপ্রকাশ। কিন্তু এই আক্রমণে ফ্রান্স হয়তো তাদের অভিবাসী নীতি
পাল্টাবে, দুর্বিষহ হতে পারে অভিবাসীদের জীবন, এর প্রভাব পড়বে সমগ্র ইউরোপে, এবং
ইসলামিক মতবাদে বিশ্বাসীদের প্রতি বর্ণবাদী বিদ্বেষ বাড়বে। তেমনি বাঙলাদেশে
জন্মলগ্ন থেকে চলে আসা রাজনৈতিক কাদা ছড়াছড়ি ও অস্থিতিশীলতার সমাধান হবে না
শীঘ্রই, কিন্তু কথা হচ্ছে এই সুযোগ ব্যবহার করে কিছু মানুষের সমর্থন নিয়ে আইসিস কি
বাঙলাদেশকে হামলার জন্য নতুন ফ্রান্স বানিয়ে তুলবে?
No comments:
Post a Comment