১.
গুলশানের কূটনৈতিক এলাকায় হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্ট যে হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটলো, যাতে প্রাণ হারালো আইনপ্রয়োগকারী বাহিনির দুইজন সদস্যসহ ২০ জন দেশি-বিদেশি নাগরিক, আহত হলেন ১৩ জন, সেই ঘটনাটি বিস্ময়কর কিন্তু মূলত অকল্পনীয় কিছু নয়! তেমনি অবাক হওয়ার কিছু নেই ঈদের দিনে শোলাকিয়ায় পুলিশসহ চারজনের মৃত্যুতে।
কেননা সরকার বরাবরই জঙ্গিবাদ ও উগ্রপন্থিদের উত্থানকে অস্বীকার করে আসছে সব বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে, সরকারের মুখপাত্র ও আমলারা আমাদের জানান যে ব্লগার-নাস্তিকদের রয়েসয়ে লিখতে হবে, সংস্কৃতিকর্মীদের বুঝেশুনে সংস্কৃতি চর্চা করতে হবে- এইসব বলে এবং জঙ্গি ও উগ্রবাদের প্রতি যথার্থ ব্যবস্থা না নিয়ে সরকার মূলত জঙ্গি ও উগ্রবাদকে জিইয়ে রেখেছে এবং আশকারা দিয়েছে। বাকিসব ঘটনার ধারাবাহিকতাই গুলশানের নারকীয় অবস্থা। গুলশানের ঘটনার পরে এখনো পর্যন্ত সরকার কোনো রাঘববোয়ালকে ধরতে পারে নি, সরকার আইসিস জড়িত নয় (অথচ তাদের ওয়েবসাইটে তারা ঘটনার সময়ই ছবি দিয়েছিলো) বলে দাবি করছে। আর কতো আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলে সরকারের হুঁশ হবে।
সামনে আরো হতে পারে, হয়তো মতিঝিলের কোনো বাণিজ্যিক এলাকায় সামনে গাড়িবোমা হবে, হয়তো পল্টন অথবা মোহাম্মদপুরের কোনো জনবহুল স্থানে বা বাজারে আত্মঘাতী বোমা হামলায় মারা পড়বে কয়েকশ' মানুষ, এবং আমাদের সরকার তখনো “দেশে জঙ্গি নাই, সব ষড়যন্ত্র” বলে সেই পুরানো কথাই বলবেন সরাসরি সম্প্রচারিত বক্তব্যে, এবং আমরা এক দল আরেক দলকে দোষারোপ করে যাবো এবং দেশকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিতে থাকবো। অথচ মনে রাখা দরকার যে উগ্রপন্থি মতবাদ ছড়িয়ে পড়ে এক্সপোনেশিয়ালভাবে বা চক্রবৃদ্ধিহারে। অথচ আমাদের সাধারণ পুলিশবাহিনি ও আইনশৃংখলা রক্ষাবাহিনির (সেনাবাহিনি ও কমান্ডো নয়) এইসব সন্ত্রাসবাদের মোকাবেলা করার প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা আছে কি না সেটি সংশয়ের, গুলশানে দুইজন পুলিশ কর্মকর্তার এবং শোলাকিয়ায় অন্য আরেকজনের মৃত্যু সংশয়ী করে তোলে। এবং এই-ও মনে রাখা দরকার যে যেহেতু তারা গুলশানের মতো একটি কূটনৈতিক এলাকায় যথেষ্ট নিরাপত্তাবহুল এলাকায় হামলা করেছে তারা অনেক পরিকল্পিত ও ব্যাপক হামলার সামর্থ্য রাখে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন যে "তারা টুকটাক একটা-দুটো করে মানুষ হত্যা করে যাচ্ছিল", ঠিক কতোটা মানুষের মৃত্যু আপনার কাছে শুধুই টুকটাক? ঠিক কতোটা জীবন? ঠিক আরো কতো প্রাণহানির পরে আপনি সচেতনভাবে বলবেন যে দেশে আইসিসের অস্তিত্ব আছে, এবং ভারসাম্য হারানোর পথে? কতো অপচয়ের পরে আপনি যৌথবাহিনি নামাবেন?
২.
অথচ এই সমস্যা সমাধান সম্ভব এখনো। একটি সমস্যা সমাধানের প্রথম ধাপই হচ্ছে সমস্যাকে চিহ্নিত করা। জঙ্গিবাদ হচ্ছে একটি মোলের মতন, একে সঠিক সময়ে চিকিৎসা না করলে ক্যান্সারে পরিণত হবে। অথচ আওয়ামী লীগ সরকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য কিংবা রাষ্ট্র ও শাসনের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন তুলে রাখার জন্য জঙ্গিবাদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে আসছে। কিন্তু জনগণ চায় শান্তি, নিরাপত্তা ও মৌলিক চাহিদার যোগান। সরকার কি বুঝতে পারছে না যে এইসব উগ্রবাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে দেশ নিজেকে ঠেলে দিতে পারে গৃহবিপ্লব ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির ছোবলের দিকে?
এই জঙ্গিবাদকে নির্মূল জন্য দরকার দ্রুত যৌথবাহিনি দ্বারা সাঁড়াশি অভিযান। জঙ্গি প্রশিক্ষণকেন্দ্র খুঁজে বের করে ধ্বংস করতে হবে, জঙ্গিবাদ ও উগ্রবাদের রাঘববোয়ালদের আইনের আওতায় আনতে হবে। সময়ক্ষেপণ মানেই জঙ্গিদের সুযোগ করে দেয়া, তাদের নেটওয়ার্ককে গুঁছিয়ে নেয়ার সুযোগ করে দেয়া, আরো অনেক লোকবল যোগাড়ের সুবিধে করে দেয়া, এবং পরবর্তীতে আরো বড় বিপর্যয় বা ছোবল মারা জন্য সামর্থ্য করে দেয়া। সকলের মনে রাখা দরকার যে গত বিএনপি আমলে যখন বাঙলা ভাই ও জিএমবি জঙ্গিদের ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয়েছিলো তখনকার সরকার-ও প্রথমদিকে সব অস্বীকার করেছিলো, তবে শেষ পর্যন্ত ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়েছিলো। আওয়ামী লীগ সরকার সেই তুলনায় কিছুই করছে না, অথচ আগ্রাসন ও ক্ষয়ক্ষতি এবং মৃত্যুর হার বেশি।
এই উগ্রবাদের জন্ম ও বিস্তার কীভাবে সেই কথা ভাবলে নজরে আসে শিক্ষাব্যবস্থা। সরকার প্রাথমিক শিক্ষা মানেই বোঝে অক্ষরজ্ঞানের হারের বৃদ্ধি, কিন্তু দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে নৈতিকতার শিক্ষাদান নেই। আধুনিক মনোবৈজ্ঞানিক গবেষণা নির্দেশ করে যে মানুষ জন্মগতভাবে “নৈতিক” বা “সহর্মমী”, কিন্তু এই ব্যাপার সুপ্ত থাকে, একে শিক্ষা ও পরিবেশের মাধ্যমে জাগিয়ে তুলতে হয়। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা মানুষ হওয়া শেখায় না, জীবিকার জন্য গড়ে তুলে। দশকের পর দশক ধরে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা আধুনিকায়ন থেকে বিচ্ছিন্ন।
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় মাদ্রাসা শিক্ষা নিষিদ্ধ করতে হবে কিংবা এই শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকায়ন বা হালনাগাদ করা দরকার। আগের সন্ত্রাসবাদের ঘটনাগুলোর হামলাকারিরা ছিলো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মাদ্রাসা শিক্ষার সাথে জড়িত বা এই শিক্ষায় শিক্ষিত। ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করলে, অর্থাৎ ধর্মীয় স্পর্শকাতর ব্যাপারগুলো বাদ দিলে, মাদ্রাসা শিক্ষা দেশকে কিছু দেয় নাই, লাখ লাখ কিশোরযুবাদের মূল সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে শুধু, উগ্রবাদী মতবাদ বুনে দিয়েছে তাদের মস্তিষ্কে, এবং কয়েক লাখ/কোটির জনশক্তির অপচয় করেছে। মাদ্রাসা শিক্ষার্থী ও এর সাথে জড়িতদের দিকে থেকে চিন্তা করলে- যেহেতু তারা মূল সমাজ থেকে কারণেঅকারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তাদের নিজদের মানসিক ও আর্থিক বিপর্যয়ের জন্য তারা সমাজকেই দায়ী করে। জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ ধর্ম ও রাজনীতি ও ক্ষমতায়নের জন্য এদের এই অবস্থাকে ব্যবহার করে হিংস্রবিদ্বেষী করে তোলে। নানা ধরণের মাদ্রাসা (যেমন, কাদিয়ানি বনাম অন্যান্য) ও তাদের শিক্ষা-ও একে অন্যের সাথে সাংঘর্ষিক এবং বিদ্রেষমূলক-ও। অর্থনৈতিক সংগ্রামে থাকা অধিকাংশ মাদ্রাসা বা মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের প্রভাবিত করা যায় অর্থপ্রলোভনের মাধ্যমে-ও।
শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার প্রয়োজন এবং সামাজিক মূল্যবোধে মুক্তচিন্তার চর্চা দরকার। গুলশানের ঘটনার সাথে জড়িতদের প্রায় সবাই স্বচ্ছল পরিবারের সন্তান, কিন্তু তাদের পরিবার তাদের এইসব কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকার ব্যাপারে সজাগ ছিলো না। নিব্রাস ইসলামকে (নিহত জঙ্গীদের একজন) ও আরো কয়েকজন সঙ্গীকে জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ছিলেন লাপাত্তা, তাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অ্যাকাউন্টসমূহ নির্দেশ করে যে তারা গভীরভাবে কিছু করছিলেন। তাদের পরিবার জিডিও করেছিলো তাদের নিরুদ্দেশতা নিয়ে। অর্থাৎ, পুরো ব্যাপারটি নির্দেশ করে যে আমরা আমাদের সন্তানদের ভালো বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা ইস্কুলে পাঠায়েই দায়িত্ব শেষ করে ফেলেছি ভাবি, তাদের প্রতি নজর রাখি না, জানি না তারা কাদের সাথে মিশে কিংবা কী ধরণের চিন্তাধারণা ধারণ করছে প্রতিনিয়ত।
কিশোরযুবা বয়েসে মানুষের মস্তিষ্ক থাকে সংবেদনশীল, যেহেতু তখনো পর্যন্ত মস্তিষ্ক পরিণত হয় নি গঠন ও সংযোগের দিক থেকে, তাই এইসময় খুব সহজেই অপ্রাপ্তবয়ষ্কদের প্রভাবিত করা যায়, তাদের মগজধোলাই করা যায়। কিশোরযুবারা (কিংবা সদ্য যুবক) ঝুঁকি নিতে পরোয়া করে না, তাদের চিন্তায় গভীরতা নেই, তাই এদেরকে চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করা যায়। তাই আমাদের সংস্কারের জন্য মনোযোগ দিতে হবে পরিবার থেকে, প্রতিবেশ থেকেই। আপনি হয়তো একজন সাধারণ মানুষ, ব্যক্তিগত ধর্ম নিয়ে থাকতে চান, কিন্তু আপনার পাশের জন কিংবা অন্য আরেকজন আপনার মতো না-ও হতে পারে; যেহেতু ধর্ম খুবই স্পর্শকাতর বিষয় এবং এর বিভিন্ন বিষয়কে অপব্যাখ্যা করে র্যাডিক্যালিজ জন্ম দেয়া সহজ, ধর্মের ইতিহাস তাই বলে, তাই আমাদেরকে সংস্কার ব্যক্তি পর্যায় থেকে, পরিবার পাড়াপ্রতিবেশি থেকেই শুরু করতে হবে। আমাদের প্রার্থনা হয়তো ব্যক্তিগত সান্তনাদান বা প্রবোধের জন্য ছাড়া কোনো কাজেরই নয়। "এই মৃত্যুউপত্যকা আমার দেশ নয়" এইসব কাব্যকথায় কিছুই হবে না। আপনি আমি সংস্কার না করলে একদিন অসংস্কারই সংস্কারের রীতি হয়ে দেশ আফগানিস্তান ইরাক এইসব পরিণত হবে।
এখনো অনেকের গোপন সহানুভূতি সমর্থন রয়েছে জঙ্গীবাদের প্রতি, যেহেতু তারা "নাস্তিক"দের কতল করেছিলো, নাস্তিকদের মারছে, তাতে ধর্মান্ধ মুসলিম কিংবা মডারেট মুসলিমের কী আসে যায়। অথচ তারা নাস্তিকদের মেরে থেমে থাকে নি, বাদ যায় নি শিক্ষক-শিক্ষার্থী-প্রকাশক-ভিন্নধর্মী-লেখক-সংস্কৃতিকর্মী-মানবাধিকার কর্মী ইত্যাদি। আপনি-ও হতে পারেন পরবর্তী শিকার। এতো হত্যা একটি ব্যাপারই নির্দেশ করে- ধর্ম এদের কৌশলগত হাতিয়ার। আর ইতিহাস নির্দেশ করে যে ধর্ম যখনই হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে তখনই প্রাণহানি হয়েছে ব্যাপক। রাষ্ট্রধর্মপ্রতিষ্ঠার মাঝে গৌরব নেই, রাষ্ট্রে শান্তিপ্রতিষ্ঠায় আছে।
৩.
হয়তো এই জঙ্গিবাদ ও চরমপন্থীদের আবির্ভাব যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কারণে, হয়তো সরকারের ক্ষমতা আঁকড়ে পড়ে থাকার জন্য, কিন্তু সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চাপের বিরুদ্ধে-ও যেমন আপোষহীন মনোভাব দেখিয়েছিলো বা দেখাচ্ছে তেমন আপোষহীন কার্যক্রমের প্রয়োজন জঙ্গিবাদ দমনে।
আফগানিস্তানে যখন তালেবানরা ক্ষমতা দখলের জন্য চেয়েছিলো তারা-ও ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলো, যেহেতু এইসব বিপথগামী মানুষরা ক্ষমতালাভের পর তাদের মাথায় যখন যা চাপে তাই তারা ধর্মের নাম করে চাপিয়ে দিতে চায় তাই পরবর্তীতে তালেবানরা বন্ধ করে দেয়া শুরু করলো দেশের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ, নারীদের বেপর্দা হওয়া চলবে না, শরিয়ত মাফিক চলতে হবে, পুরুষদের এক মুঠো দাঁড়ি রাখতে হবে ইত্যাদি। এইসব পরে হয়েছে, তার আগে তারা ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে, অর্থাৎ ধর্মকে ব্যবহার করে সাধারণ জনগণকে প্রভাবিত করেছে, তাদেরকে চোখে ধুলো দিয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের দেশ-ও “খাঁটি ইসলামিক রাষ্ট্র” হবে এবং আফগানিস্তান ইরাক সিরিয়ার মতো হয়ে উঠবে। শান্তিকামী জনগণ ও সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা শান্তিই চায় না কি উগ্রবাদকে নীরব সমর্থন দিয়ে বা সহানুভূতি দেখিয়ে দেশকে ব্যর্থরাষ্ট্রের দিকে ঠেকে দিবে; এবং এই সিদ্ধান্ত খুব দ্রুতই নিতে হবে।
No comments:
Post a Comment