১
ঢাকা একটি অভিশপ্ত নগর। জনতা আমাকে কখনোই টানে নি। নাগরিকগণ টেনেছে। ঢাকার অধিকাংশ লোকই জনতার অংশ, নাগরিক নয়। এবং এটিই ঢাকার অভিশপ্ততার কারণ। এই নগরীর মানুষ চে'কে ফাঁকি দিয়ে বিপ্লব না করলে-ও এই নগরীর ব্যাঙাচির মতো যত্রতত্র গড়ে ওঠা দালানেরা একদিন ভীষণ বিপ্লব করে উঠবে, এবং রণে ভঙ্গ দিবে। আমি টের পাই। ধুলোজীবন কী জিনিস এই নগরে না আসলে টের পাওয়া যায় না।
ঢাকা একটি অভিশপ্ত নগর। জনতা আমাকে কখনোই টানে নি। নাগরিকগণ টেনেছে। ঢাকার অধিকাংশ লোকই জনতার অংশ, নাগরিক নয়। এবং এটিই ঢাকার অভিশপ্ততার কারণ। এই নগরীর মানুষ চে'কে ফাঁকি দিয়ে বিপ্লব না করলে-ও এই নগরীর ব্যাঙাচির মতো যত্রতত্র গড়ে ওঠা দালানেরা একদিন ভীষণ বিপ্লব করে উঠবে, এবং রণে ভঙ্গ দিবে। আমি টের পাই। ধুলোজীবন কী জিনিস এই নগরে না আসলে টের পাওয়া যায় না।
অথচ এই নগরী একসময় ছিলো অহংকারের রঙের মতন সবুজ। আমি ঢাকাকে অভিশাপ দিই নি, কেবল পুরানো ব্যর্থ প্রেমের মতো দূরে সরিয়ে দিয়েছিলাম। প্রকৃত অর্থে আমি হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। নিজের অভিযোজন ক্ষমতা নিয়ে আমার বরাবরই গর্ব ছিলো, এবং ঢাকায় প্রথম সপ্তাহ থেকে টের পেলাম আমার গৌরব ছিলো তেলাপোকার ডানার মতো মেকি।
আমার ঠাঁই হলো মোহাম্মদপুরে। রিয়াদ ভাইকে একটি বকুল। ঢাকার দুটি অংশের প্রতি আমার মুগ্ধতা থাকবে। মোহাম্মদপুর ও ধানমণ্ডি। যে আসাদ গেটের কথা আমি ঢের পড়েছিলাম তা এবারই প্রথম দেখি। আসাদ গেটটাকে আমার পাজলের মতন মনে হতো। যেনো দিনের একেক সময় এটি একেক চরিত্র ধারণ করে, এবং দুদিকের ট্র্যাফিক ধরে গেলে দু ধরণের অনুভূতি সৃষ্টি হয়, যেনো এই পথে শিউলি-শিশির মাড়ানো মেঠোগলির মতো অনেক হেঁটেছি, অথচ হাঁটি নি।
ঢাকাকে আমি শেষের দিকে করুণা করেছি। তবে আমি জানতাম এই শহরে আমাকে বুমেরাং হয়ে আসতে হবে। এই শহরে থাকে আমার প্রিয় কিছু মানুষ-মানুষী। যাদের ডানা নেই বলে আমি আসি। তারা হয়তো আমার মতো ছয়তলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে শৈশবস্মৃতি মন্থন করে না, হয়তো মেঘে খাওয়া আধ থোকা চাঁদ কিংবা স্বচ্ছ জোছনা দেখার চে' তারা সঙ্গমপ্রিয় ডলফিন হয়ে উঠতে পছন্দ করে, তবুও তারা ঢাকায় থাকে।
২
আমার প্রকৃত বন্ধুর সংখ্যা- মানে যাদেরকে আমি আমার তরফ থেকে বন্ধু বলে গণ্য করি- তাদের সংখ্যা আঙুলের করের মতো গণনাযোগ্য। তবে আমি অনেকের সাথে মিশতাম, এখনো, পাড়ার গুণ্ডা ঈভটিজার- যাদেরকে আমি ভালো হয়ে যাবার কথা বলতাম ও বিনিময়ে তারা আমার পিছে কুকুর লাগিয়ে দিতো, কিংবা নারায়ণ স্যারের মতো দেবতুল্য মানুষ- অনেকের সাথে মিশে মিশে আমি খারাপ হয় নি, খারাপটুকু চিনে নিয়েছিলাম পরিষ্কার। আমি কেবল চিনি নি একটি বটগাছ। আমাদের বাসা থানার পাশে। ফলে রক্ষিত। থানার সামনে খালের ধারে বিশাল বটগাছ। বটগাছ সাধারণত থাকে বিশাল মাঠের মাঝখানে, খোলা জায়গায়, ওই গাছটি কেনো খালের ধারে বড় হয়েছিলো! এই ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্যের জন্যই আমি সম্ভবত এটাকে ভালোবেসেছিলাম। এবং ছোটবেলায় আমি যখন পরিবারের চাপে ধার্মিক ছিলাম ও মক্তব থেকে মার খেয়ে আসতাম তখন আমি বিশ্বাস রাখতাম আগামী জন্মে, একটি পাখি হয়ে জন্মানোর। যে এসে বটের হাড়ে বাসা বাঁধবে, লাল লাল গোটলা ফল খেয়ে রুনা লায়লার গানে উল্লেখিত "পান খেয়ে ঠোঁট করবে লাল।"
সেই বটগাছটি আমার হ্যাফপ্যান্ট কালের বন্ধু তুহিনের মতো নেই হয়ে গেছে, আমি টের পেলাম এবং অদৃশ্য অশ্রু ঝরালাম। তুহিন বিয়ে করে ব্যবসায় নেমে গেছে, এই ছেলেটি এক সময় কবিতা লিখতো, গিটার বাজানোর স্বপ্ন দেখতো, বাঁশি বাজাতো, আমরা কতো পরিকল্পনা করেছি- কবিতা লিখে একদিন রাষ্ট্র করে দেবো নিজেদের; আমি আমার কথা রেখেছি, তুহিন রাখে নি, সুনীলের তেত্রিশ বছর আসলেই দীর্ঘ। তুহিন রাতে এখন আর হাঁটে না, রবীন্দ্রনাথের কবিতার মতন সময় ও যৌবনের কী নিদারুণ অপচয়- এককে শূন্য দিয়ে ভাগ করা কেনো অসংজ্ঞায়িত আমি ভাবতে ভাবতে ভাবি।
৩
আমি আমার শৈশবের চেয়ে কৈশোরকে বেশি ভালোবেসেছি। সেজন্যই আমি শৈশব নিয়ে কোনো কবিতা লিখি নি, টাইম মেশিনে চড়ে শৈশবে ফিরে যাওয়া ইচ্ছে আমার কখনোই হয় নি। আমার ইচ্ছে ছিলো কচুরিপানা হওয়ার, জলে জলে ভেসে যাবো এবং সারাদিন রোদের সৌন্দর্য চুষে নেবো, সারা শরীরে মেখে নেবো বৃষ্টির নির্যাস। জীবনে কেনা সব বইয়ে যেমন বুকশেলফে ধরে রাখা যায় নি, পোকায় খেয়ে গেছে, চুরি গেছে- তেমনি এই সমস্ত বিলাসী ইচ্ছেরা নাই নাই হয়ে গেছে। আমার ইচ্ছে হতো গ্রামের বাড়ি যাওয়ার। আম-কাঁঠালের সময়ে ইস্কুল ছুটি হতো, এই সময়ে আমি ফি বছরই গ্রামে যেতাম, অবশ্য ঈদের সময়-ও যাওয়া হতো। এক সময় আমরা প্রথম আলোর স্লোগানের মতো বদলে গেলাম, আমরা আমাদের বাসায় ঈদ করা শুরু করলাম, গ্রামের প্রতি টানটুকু না কমলে-ও কম্পাসের সামনে আরেকটি চুম্বক রাখায় দিক পরিবর্তন হলো।
আমাদের গ্রামের বাড়িটুকু আদর্শ বাড়ি। আমার প্রপিতামহ অনেক কামিয়েছেন, আমি ধারণা করি সেই সম্পদ বানানোয় তিনি পুরোপুরি সৎ ছিলেন না, সৎ থেকে অঢেল সম্পদের মালিক হওয়া যায় না। তবে তার ছোটো ছেলে অনেক সৎ ছিলো। সে মাদ্রাসা দিলো, দাতব্য চিকিৎসালয় বানালেন, পুকুর কেটে দিলেন, এতিমখানা গড়লেন, ইস্কুল স্থাপন করলেন। ফলে আমাদের গ্রামের বাড়ির সামনে এইসব প্রতিষ্ঠান, ঠিক পিছনে পারিবারিক একান্নবর্তী কবরস্থান ও বৃক্ষের প্যারেড, ঠিক পরেই আবার-ও পুকুর ও অনেকক্ষণ চুপচাপ জলের দিকে তাকিয়ে বসে থাকার পুকুরঘাট, এরপরে বাড়ি বাড়ি।
গ্রামে গেলে আমি প্রচুর আশ্চর্য হই- এই বাস্তুভিটায় আমার পিতা জন্মেছে, তারো পিতা, এবং তারো পিতা। যাদের বংশগতিচিহ্ন ও মিম আমি বহন করছি। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকের মতন শিশির ঝরে। আর কী সবুজ চারিদিক। ডগি- মানে বিস্তৃত মাঠ- বছরের নির্দিষ্ট সময়ে চাষাবাদ হয়, অন্য সময় ছেলেমেয়েরা খেলে। দাঁড়িয়াবান্ধা, বৌছি, হাডুডু, সাত-ঝিক- এখন সবাই ক্রিকেট খেলে ফুটবল লাথায়; তবুও আমি কোনো মনমরা কিশোর দেখি।
৪
সব কিছু কী দ্রুত পাল্টে যায়, পাঁচ বছরে অনেক তো পরিবর্তন হলো। আইফোন আইপ্যাড এসে মোবাইল ট্যাবলেট সংস্কৃতিকে পাল্টে দিলো, উইকিপিডিয়ায় জ্ঞানের পাতা জমা হচ্ছে অহরহ, ভারত টিপাইমুখ বাঁধ ফারাক্কা বাঁধকে কেন্দ্রকে জোতদারি করে গেলো- সেই তুলনায় আমাদের গ্রামের উঠোনের লাল পেয়ারা গাছটার নেই হয়ে যাওয়াটা বিস্ময়কর নয়। নেই টিনের চাল, যেখানে পাটিপাতা তৈরি শীতলপাটি, ঝাড়ু, ঝুড়ি ইত্যাদি রোদে দিতো কাজের লোকজন; যে টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ শুনে পৃথিবীকে "মায়াবী নদীর পারের দেশ" মনে হতো।
গিয়েছিলাম বন্ধুদের নিয়ে। উদ্দেশ্য ছিলো আমাদের ঘরটাতে (সবাই এখন শহরে থাকার কারণে সেটি আপাত খালি) মজা করবো।
অন্য যেকোনো স্মৃতিগ্রস্ত মানুষের মতন আমি-ও পাঁচ বছর আগেরকার সেইসব রোদমাখা স্মৃতির সাথে এইসব মেলাতে লাগলাম। গ্রামে ছবি তুলতে এক সমস্যা। সবাই ফাল ফাল করে চেয়ে থাকে, নিজের হাতে ঢাউস ক্যামেরা ওদের হাত খালি- এই ভাবনাটা-ও আমাকে মাঝে মাঝে কুঁকড়ে দিতো।
চুরি করে নারিকেল ডাব খেয়েছি, তাস পিটিয়েছি, সাঁতরে পুকুরের গাঁধ জল ঘোলা করেছি, আর নিজেদের মনের গল্পগুলো অকপটে বলে গেছি। যেনো আমাদের গল্প শোনার জন্য সবুজের টহল অস্থির অপেক্ষা করেছিলো।
৫
ছবি: প্রতিবন্ধী শৈশব
এই মেয়েটি অটিস্টিক। আমি যখন ছবি তুলছিলাম সে নীরবে পিছে এসে দাঁড়ালো, এবং অদ্ভুত সুন্দর এক জোড়া চোখে বিস্ময় মেখে চেয়ে থাকলো। পৃথিবী কবে সব শিশুর খেলাঘরের মতো আনন্দের হয়ে উঠবে?
ছবি: আনারসের কুঁড়ি
ক্ষেতের মালিক দূরে বসা ছিলো। না হলে এটাকে আমি সাবাড় করে দিতাম।
ছবি: মনখারাপের ফুল
অবহেলিত দরিদ্র শৈশব। অথচ দেবশিশু।
ছবি: পাটিপাতা গাছের ফুল
পাটিপাতা গাছে দারুণ সাদা ফুল হয়, হাসনাহেনা ফুলের মতো খাঁটি সাদা রঙ, তবে ঘ্রাণ নেই। হালকা মধু হয়। ফুলের নিচের বৃন্ত ফেলে দিয়ে চুষে টানতে হয়। আমরা ছোটবেলায় গ্রামে এলে বাজি ধরতাম এক মিনিটে কে কয়টা ফুলের মধু খেতে পারে!
ছবি: তুলোগাছের ফুল
তুলো ঝরা পথ দেখে মনে নিজের ত্বকের মতন। লোমশ।
ছবি: আমার নাম ফুল
বন্য ফুল। নাম জানি না। বোধহয় ফার্ন জাতীয় কিছু।
ছবি: অলস দুপুরের বিশ্রাম
গ্রামে এইরকম দৃশ্য সচরাচর চোখে পড়ে। কাজ করতে করতে হাঁফিয়ে গেলে বা প্রচুর গরম পড়লে এইরকম জিরিয়ে নেয়া।
ছবি: গহীন পথ
বাগানবাড়ির সদরপথ।
ছবি: নিবিড় সাঁকো
সাঁকো। আমার জীবনের প্রথম গান লিখেছিলাম এখানকার নিকটে, একটি খেঁজুর গাছের নিচে, দিব্যি মনে আছে।
ছবি: লাল জবা
জবা ফুলের অন্য নাম তার রাতুল ঠোঁট।
ছবি: পাঠশালা
"আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা, ফুল তুলিতে যাই..." জ্ঞানপুষ্প।
ছবি: জাতীয় ফল কাঁঠাল
২০০৬ এর পর কাঁঠাল খাই নি। কাঁঠালের কোষ মেখে দুধ দিয়ে খেতে দারুণ, মা কী একটা আমসির মতো তৈরি-ও করতো।
ছবি: ডাব
ছবি: দূরন্ত শৈশব
ছবি: লাকড়ি
ছবি: তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে
এই ছবিটা ছাগু ও আস্তিকদের জন্য, যারা মনে করে তালগাছ তাদেরই।
ছবি: কচুরিপানা
কচুরিপানার ফুলের ছবি তোলা হয় নি। আফসোস।
ছবি: জলে কার ছায়া পড়ে গো
ছবি: পদ্মপাতার পুকুর
এই পুকুরে কতো দাপাদাপি করেছি। এখন ভাবলেই মনে হয় গতজন্মের স্মৃতি!
আমার ঠাঁই হলো মোহাম্মদপুরে। রিয়াদ ভাইকে একটি বকুল। ঢাকার দুটি অংশের প্রতি আমার মুগ্ধতা থাকবে। মোহাম্মদপুর ও ধানমণ্ডি। যে আসাদ গেটের কথা আমি ঢের পড়েছিলাম তা এবারই প্রথম দেখি। আসাদ গেটটাকে আমার পাজলের মতন মনে হতো। যেনো দিনের একেক সময় এটি একেক চরিত্র ধারণ করে, এবং দুদিকের ট্র্যাফিক ধরে গেলে দু ধরণের অনুভূতি সৃষ্টি হয়, যেনো এই পথে শিউলি-শিশির মাড়ানো মেঠোগলির মতো অনেক হেঁটেছি, অথচ হাঁটি নি।
ঢাকাকে আমি শেষের দিকে করুণা করেছি। তবে আমি জানতাম এই শহরে আমাকে বুমেরাং হয়ে আসতে হবে। এই শহরে থাকে আমার প্রিয় কিছু মানুষ-মানুষী। যাদের ডানা নেই বলে আমি আসি। তারা হয়তো আমার মতো ছয়তলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে শৈশবস্মৃতি মন্থন করে না, হয়তো মেঘে খাওয়া আধ থোকা চাঁদ কিংবা স্বচ্ছ জোছনা দেখার চে' তারা সঙ্গমপ্রিয় ডলফিন হয়ে উঠতে পছন্দ করে, তবুও তারা ঢাকায় থাকে।
২
আমার প্রকৃত বন্ধুর সংখ্যা- মানে যাদেরকে আমি আমার তরফ থেকে বন্ধু বলে গণ্য করি- তাদের সংখ্যা আঙুলের করের মতো গণনাযোগ্য। তবে আমি অনেকের সাথে মিশতাম, এখনো, পাড়ার গুণ্ডা ঈভটিজার- যাদেরকে আমি ভালো হয়ে যাবার কথা বলতাম ও বিনিময়ে তারা আমার পিছে কুকুর লাগিয়ে দিতো, কিংবা নারায়ণ স্যারের মতো দেবতুল্য মানুষ- অনেকের সাথে মিশে মিশে আমি খারাপ হয় নি, খারাপটুকু চিনে নিয়েছিলাম পরিষ্কার। আমি কেবল চিনি নি একটি বটগাছ। আমাদের বাসা থানার পাশে। ফলে রক্ষিত। থানার সামনে খালের ধারে বিশাল বটগাছ। বটগাছ সাধারণত থাকে বিশাল মাঠের মাঝখানে, খোলা জায়গায়, ওই গাছটি কেনো খালের ধারে বড় হয়েছিলো! এই ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্যের জন্যই আমি সম্ভবত এটাকে ভালোবেসেছিলাম। এবং ছোটবেলায় আমি যখন পরিবারের চাপে ধার্মিক ছিলাম ও মক্তব থেকে মার খেয়ে আসতাম তখন আমি বিশ্বাস রাখতাম আগামী জন্মে, একটি পাখি হয়ে জন্মানোর। যে এসে বটের হাড়ে বাসা বাঁধবে, লাল লাল গোটলা ফল খেয়ে রুনা লায়লার গানে উল্লেখিত "পান খেয়ে ঠোঁট করবে লাল।"
সেই বটগাছটি আমার হ্যাফপ্যান্ট কালের বন্ধু তুহিনের মতো নেই হয়ে গেছে, আমি টের পেলাম এবং অদৃশ্য অশ্রু ঝরালাম। তুহিন বিয়ে করে ব্যবসায় নেমে গেছে, এই ছেলেটি এক সময় কবিতা লিখতো, গিটার বাজানোর স্বপ্ন দেখতো, বাঁশি বাজাতো, আমরা কতো পরিকল্পনা করেছি- কবিতা লিখে একদিন রাষ্ট্র করে দেবো নিজেদের; আমি আমার কথা রেখেছি, তুহিন রাখে নি, সুনীলের তেত্রিশ বছর আসলেই দীর্ঘ। তুহিন রাতে এখন আর হাঁটে না, রবীন্দ্রনাথের কবিতার মতন সময় ও যৌবনের কী নিদারুণ অপচয়- এককে শূন্য দিয়ে ভাগ করা কেনো অসংজ্ঞায়িত আমি ভাবতে ভাবতে ভাবি।
৩
আমি আমার শৈশবের চেয়ে কৈশোরকে বেশি ভালোবেসেছি। সেজন্যই আমি শৈশব নিয়ে কোনো কবিতা লিখি নি, টাইম মেশিনে চড়ে শৈশবে ফিরে যাওয়া ইচ্ছে আমার কখনোই হয় নি। আমার ইচ্ছে ছিলো কচুরিপানা হওয়ার, জলে জলে ভেসে যাবো এবং সারাদিন রোদের সৌন্দর্য চুষে নেবো, সারা শরীরে মেখে নেবো বৃষ্টির নির্যাস। জীবনে কেনা সব বইয়ে যেমন বুকশেলফে ধরে রাখা যায় নি, পোকায় খেয়ে গেছে, চুরি গেছে- তেমনি এই সমস্ত বিলাসী ইচ্ছেরা নাই নাই হয়ে গেছে। আমার ইচ্ছে হতো গ্রামের বাড়ি যাওয়ার। আম-কাঁঠালের সময়ে ইস্কুল ছুটি হতো, এই সময়ে আমি ফি বছরই গ্রামে যেতাম, অবশ্য ঈদের সময়-ও যাওয়া হতো। এক সময় আমরা প্রথম আলোর স্লোগানের মতো বদলে গেলাম, আমরা আমাদের বাসায় ঈদ করা শুরু করলাম, গ্রামের প্রতি টানটুকু না কমলে-ও কম্পাসের সামনে আরেকটি চুম্বক রাখায় দিক পরিবর্তন হলো।
আমাদের গ্রামের বাড়িটুকু আদর্শ বাড়ি। আমার প্রপিতামহ অনেক কামিয়েছেন, আমি ধারণা করি সেই সম্পদ বানানোয় তিনি পুরোপুরি সৎ ছিলেন না, সৎ থেকে অঢেল সম্পদের মালিক হওয়া যায় না। তবে তার ছোটো ছেলে অনেক সৎ ছিলো। সে মাদ্রাসা দিলো, দাতব্য চিকিৎসালয় বানালেন, পুকুর কেটে দিলেন, এতিমখানা গড়লেন, ইস্কুল স্থাপন করলেন। ফলে আমাদের গ্রামের বাড়ির সামনে এইসব প্রতিষ্ঠান, ঠিক পিছনে পারিবারিক একান্নবর্তী কবরস্থান ও বৃক্ষের প্যারেড, ঠিক পরেই আবার-ও পুকুর ও অনেকক্ষণ চুপচাপ জলের দিকে তাকিয়ে বসে থাকার পুকুরঘাট, এরপরে বাড়ি বাড়ি।
গ্রামে গেলে আমি প্রচুর আশ্চর্য হই- এই বাস্তুভিটায় আমার পিতা জন্মেছে, তারো পিতা, এবং তারো পিতা। যাদের বংশগতিচিহ্ন ও মিম আমি বহন করছি। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকের মতন শিশির ঝরে। আর কী সবুজ চারিদিক। ডগি- মানে বিস্তৃত মাঠ- বছরের নির্দিষ্ট সময়ে চাষাবাদ হয়, অন্য সময় ছেলেমেয়েরা খেলে। দাঁড়িয়াবান্ধা, বৌছি, হাডুডু, সাত-ঝিক- এখন সবাই ক্রিকেট খেলে ফুটবল লাথায়; তবুও আমি কোনো মনমরা কিশোর দেখি।
৪
সব কিছু কী দ্রুত পাল্টে যায়, পাঁচ বছরে অনেক তো পরিবর্তন হলো। আইফোন আইপ্যাড এসে মোবাইল ট্যাবলেট সংস্কৃতিকে পাল্টে দিলো, উইকিপিডিয়ায় জ্ঞানের পাতা জমা হচ্ছে অহরহ, ভারত টিপাইমুখ বাঁধ ফারাক্কা বাঁধকে কেন্দ্রকে জোতদারি করে গেলো- সেই তুলনায় আমাদের গ্রামের উঠোনের লাল পেয়ারা গাছটার নেই হয়ে যাওয়াটা বিস্ময়কর নয়। নেই টিনের চাল, যেখানে পাটিপাতা তৈরি শীতলপাটি, ঝাড়ু, ঝুড়ি ইত্যাদি রোদে দিতো কাজের লোকজন; যে টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ শুনে পৃথিবীকে "মায়াবী নদীর পারের দেশ" মনে হতো।
গিয়েছিলাম বন্ধুদের নিয়ে। উদ্দেশ্য ছিলো আমাদের ঘরটাতে (সবাই এখন শহরে থাকার কারণে সেটি আপাত খালি) মজা করবো।
অন্য যেকোনো স্মৃতিগ্রস্ত মানুষের মতন আমি-ও পাঁচ বছর আগেরকার সেইসব রোদমাখা স্মৃতির সাথে এইসব মেলাতে লাগলাম। গ্রামে ছবি তুলতে এক সমস্যা। সবাই ফাল ফাল করে চেয়ে থাকে, নিজের হাতে ঢাউস ক্যামেরা ওদের হাত খালি- এই ভাবনাটা-ও আমাকে মাঝে মাঝে কুঁকড়ে দিতো।
চুরি করে নারিকেল ডাব খেয়েছি, তাস পিটিয়েছি, সাঁতরে পুকুরের গাঁধ জল ঘোলা করেছি, আর নিজেদের মনের গল্পগুলো অকপটে বলে গেছি। যেনো আমাদের গল্প শোনার জন্য সবুজের টহল অস্থির অপেক্ষা করেছিলো।
৫
ছবি: প্রতিবন্ধী শৈশব
এই মেয়েটি অটিস্টিক। আমি যখন ছবি তুলছিলাম সে নীরবে পিছে এসে দাঁড়ালো, এবং অদ্ভুত সুন্দর এক জোড়া চোখে বিস্ময় মেখে চেয়ে থাকলো। পৃথিবী কবে সব শিশুর খেলাঘরের মতো আনন্দের হয়ে উঠবে?
ছবি: আনারসের কুঁড়ি
ক্ষেতের মালিক দূরে বসা ছিলো। না হলে এটাকে আমি সাবাড় করে দিতাম।
ছবি: মনখারাপের ফুল
অবহেলিত দরিদ্র শৈশব। অথচ দেবশিশু।
ছবি: পাটিপাতা গাছের ফুল
পাটিপাতা গাছে দারুণ সাদা ফুল হয়, হাসনাহেনা ফুলের মতো খাঁটি সাদা রঙ, তবে ঘ্রাণ নেই। হালকা মধু হয়। ফুলের নিচের বৃন্ত ফেলে দিয়ে চুষে টানতে হয়। আমরা ছোটবেলায় গ্রামে এলে বাজি ধরতাম এক মিনিটে কে কয়টা ফুলের মধু খেতে পারে!
ছবি: তুলোগাছের ফুল
তুলো ঝরা পথ দেখে মনে নিজের ত্বকের মতন। লোমশ।
ছবি: আমার নাম ফুল
বন্য ফুল। নাম জানি না। বোধহয় ফার্ন জাতীয় কিছু।
ছবি: অলস দুপুরের বিশ্রাম
গ্রামে এইরকম দৃশ্য সচরাচর চোখে পড়ে। কাজ করতে করতে হাঁফিয়ে গেলে বা প্রচুর গরম পড়লে এইরকম জিরিয়ে নেয়া।
ছবি: গহীন পথ
বাগানবাড়ির সদরপথ।
ছবি: নিবিড় সাঁকো
সাঁকো। আমার জীবনের প্রথম গান লিখেছিলাম এখানকার নিকটে, একটি খেঁজুর গাছের নিচে, দিব্যি মনে আছে।
ছবি: লাল জবা
জবা ফুলের অন্য নাম তার রাতুল ঠোঁট।
ছবি: পাঠশালা
"আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা, ফুল তুলিতে যাই..." জ্ঞানপুষ্প।
ছবি: জাতীয় ফল কাঁঠাল
২০০৬ এর পর কাঁঠাল খাই নি। কাঁঠালের কোষ মেখে দুধ দিয়ে খেতে দারুণ, মা কী একটা আমসির মতো তৈরি-ও করতো।
ছবি: ডাব
ছবি: দূরন্ত শৈশব
ছবি: লাকড়ি
ছবি: তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে
এই ছবিটা ছাগু ও আস্তিকদের জন্য, যারা মনে করে তালগাছ তাদেরই।
ছবি: কচুরিপানা
কচুরিপানার ফুলের ছবি তোলা হয় নি। আফসোস।
ছবি: জলে কার ছায়া পড়ে গো
ছবি: পদ্মপাতার পুকুর
এই পুকুরে কতো দাপাদাপি করেছি। এখন ভাবলেই মনে হয় গতজন্মের স্মৃতি!
No comments:
Post a Comment