আমার মৃত্যুটা কীভাবে হবে আপনাকে বলি।
পুকুর বা দিঘীর জলে। ভেলায়। মাদকতাময় জোছনা অথবা বোবা রোদ্দুরে। আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসতে চাইবে, অথচ আমি জোর করে জেগে থাকবো। মস্তিষ্কের ভেতরে সমস্ত স্মৃতি রঙের ট্রেন হয়ে তীব্র বেগে ছুটতে থাকবে। এবং সে থাকবে। অথবা মা, যদি মা আবার আসে। আমি ঘন নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে পৃথিবীকে অবজ্ঞা করে চলে যাবো।
সোমবার সকালে উঠে বাস ধরতে দাঁড়ি কামাতে হবে না দ্রুততার সাথে, গালের বাঁ পাশে দাগ পড়বে না। বাচ্চার দেখাশোনা, ইস্কুলের খবর নেয়া, জীবন কেমন যাচ্ছে সেটি ইনিয়েবিনিয়ে জানতে গিয়ে মূলত তার বন্ধুদের ব্যাপারে তথ্য নেয়া। তেমনি করে তাকে-ও জেরা না করা। তার অফিসের কোনো কলিগকে সন্দেহ না করা, ওই লোকটার সাথে বেশি কথা বললো কি না সেটি নিয়ে চিন্তিত না হওয়া। সপ্তাহের বাজার করতে গিয়ে খিস্তি করা। আর বছরে এক বা দুয়েক ফার্মের মুরগীর বাজারে গিয়ে বিক্রি হয়ে যাওয়ার মতো করে বেড়ানো যাওয়া। এইসব। সারমেয় জীবন। আমাকে আর বইতে হবে না। জীবন আমাকে অবজ্ঞা করেছে। আমি জীবনকে উপহাস করে যাবো। পাতায় বসে থাকা পোকাটি, যে জিরাফের গ্রীবা বেয়ে নেমে যাওয়ার আগে একটু কামড়ে দিতে চায়।
আমার ছোটবেলা সরল ছিলো না। সত্য জেনে ওরা ইস্কুল থেকে বের করে দিয়েছিলো। কেউ বন্ধুত্ব পাতায় নি। পরে আমাকে বাধ্য হয়ে পড়তে হয় প্রতিবন্ধীদের ইস্কুলে। সীমাবদ্ধতা না থাকলে-ও আমার। কলেজে কিছুটা স্বাধীনতা পেলাম। সিগারেট ধরেছিলাম বলে কিছু মাছি-বন্ধু-ও পেলাম। আর পেলাম নীল আকাশ। যার মেঘে মেঘে আমার দুঃখ বিছিয়ে দিয়ে কালো করে ফেলতাম, এবং বর্ষা নামিয়ে আনতাম। ইউনিতে ঢুকে পড়ে আমি পাল্টে গেলাম। পাল্টালাম। বুঝে গেলাম অধিকার কেড়ে নিতে হয়, সংগ্রাম করে অধিকার পাওয়া যায় না, অধিকার কেড়ে নিতে হয়!
আমার জন্মটা কীভাবে হলো আপনাকে বলি।
এইসব পরে শুনেছি। একটি প্রায়-অন্ধকার ঘরে। এবং রেন্ডির তেলে অথবা হারিকেনে কেরোসিন জ্বলে গর্ভযন্ত্রণায় আমার মায়ের গোঙ্গানির সাথে পাল্লা দিয়ে এক আধটু আলো, রাত ছিলো বলে আলোহীনতা বেশি অসহ্য লাগে নি। বাইরে কালবৈশাখীর যুবতীর ওড়না উড়িয়ে নেওয়া মাতাল হাওয়া। রহিমা খালা ধাত্রীর কাজ করেছিলো। মায়ের প্রতি এটুকু মমতা কেনো জানি তিনি দেখিয়েছিলেন। আমি রহিমা খালাকে বৃদ্ধাশ্রমে ঠাঁই নিতে দিই নি। মা আঁতুরঘরেই থেকে গিয়েছিলো বলে আমি আরো অসহায় হলাম।
আমার নাম রাফি রাখলো। মানুষ আদর করে ইদানীং কুকুরের নাম-ও যিশু রাখে। তবে আমি আরো একটি নাম নিয়ে বড় হলাম। নামটা শুনে আমার এতো কষ্ট হতো যে আমার আত্মহত্যা করতে মন চাইতো, মায়ের জন্য। সবাই এতো বেশি ডাকতো যে ওটাকেই আমার নাম মনে হতো। নটির পোলা।
No comments:
Post a Comment